ধারাবাহিক উপন্যাস সুবর্ণরেখার তীরে <br /> প্রথম পর্ব <br />ছন্দা বিশ্বাস

ধারাবাহিক উপন্যাস সুবর্ণরেখার তীরে
প্রথম পর্ব
ছন্দা বিশ্বাস

সে বহুকাল আগের কথা। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে সেই সময়ে সিংভূমে (বর্তমানে যার নাম ঝাড়খন্ড)রাজত্ব করতেন মল্লরাজ জগৎদেব সিং। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন মধ্য ভারতে মান্ডুর মল্ল রাজ্যের শাসক। মান্ডু বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত। মল্ল হল ধার জেলার একটি নগরী। বহুকাল ধরে সেখানে রাজ্য শাসন করে আসছেন রাজপুত বংশীয় রাজন্যবর্গ। স্ত্রী কন্যা এবং প্রজাবর্গসহ বেশ সুখেই দিনাতিপাত করছিলেন মল্লরাজ। কিন্তু নিরন্তর সুখ লাভ বুঝি স্বয়ং ঈশ্বরেরও সহ্য হয় না। একদিন চর মারফৎ তিনি জানতে পারেন দিল্লীর সুলতানের নজর পড়েছে মান্ডুর উপরে। দিল্লীতে তখন রাজত্ব করছেন সুলতান আলাউদ্দিন খলজী। আসমুদ্র হিমাচলের সকলেই তার কথা শুনেছে। যে কনো মুহূর্তে আলাউদ্দিন মান্ডু আক্রমণ করতে পারে। তাই তিনি গোপনে রাজধানী সরিয়ে নিলে আসেন পাহাড় ঘেরা এই সিংভূমে। সুবর্ণরেখার তীরে গড়ে তুললেন নয়া রাজধানী। এরপরে কেটে গেছে বহু বছর। সিংভূমের বর্তমান রাজা জগৎ সিং এর কন্যা চিত্রলেখা, প্রিয় সখী মেঘমালা এবং একজন আগন্তুককে নিয়ে নানা উত্থান পতন এবং ঘটনাক্রমের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেছে এই কাহিনি।

প্রথম পর্ব

ফুলডুংরি টিলা

সমতল থেকে বেশ কিছুটা উপরের দিকে উঠে গেছে পাথুরে পথ। অশীতিপর বৃদ্ধের মেরুদন্ডের মতো বাঁকানো। ছোট বড়ো নানা আকারের পাথর বিছানো। এবড়ো খেবড়ো অসমান। কোথাও পথ এতোটাই বন্ধুর যে রীতিমতো বেগ পেতে হয় চড়াইতে ওঠার সময়ে। বাঁকা পথ ধরে কিছুটা যাওয়ার পরে একেবারে সোজা উপরের দিকে উঠে গেছে। যত উপরের দিকে যাওয়া যায় ততই খাড়া পথ। একটু অসাবধান হলেই গড়িয়ে নীচেয় পড়তে হবে। হাত পায়ের হাড়গোড় ভাঙ্গার চাইতে পাথরে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাতের আশংকাই বেশী। আনকোরা পথিককে তাই এ পথে চলতে গেলে যথেষ্ঠ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

মহুয়া- পলাশ- শাল এবং সেগুন গাছে ঘেরা টিলাটি। নীচ থেকে দেখলে মনে হয় শত শত বৃক্ষ নিঃশব্দে পাহারা দিচ্ছে। ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠে গেছে গাছগুলো। যে ভাবে সেনাপতি ব্যূহ রচনা করেন যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকটা তেমনি। সুউচ্চ বৃক্ষের শীর্ষ পল্লবের সঙ্গে প্রতি রাতে নক্ষত্রের পত্র মিতালী হয়। সন্ধ্যের পর পরে গাছেদের ভিতরে ফুরফুরে একটা আমেজ লক্ষ্য করা যায়। যেন দয়িতের জন্যে অপেক্ষা রত রমণী। বৃক্ষ সমাবেশের দরুণ টিলার চতুর্দিক বেশ ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ। শীতে শুকনো পাতায় ঢাকা পড়ে যায় পথ ঘাট। বর্ষায় সবুজে সবুজে মিশে যায় আকাশের নীল নীলিমা।

মাটি থেকে প্রায় দেড়শ ফুট উপরে সেই টিলার উপরে একটা শাল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা আছে একজন ভিন দেশী যুবক। যুবকটির চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। হাত দুটিও পিছ মোড়া করে বেঁধে রাখা আছে।

বহুক্ষণ তাকে এই অবস্থায় রেখে গেছে দুইজন নগর রক্ষী। জঙ্গলে পরিকীর্ণ এই টিলার এতো উপরে খুব প্রয়োজন না পড়লে সাধারণতঃ কেউই আসে না। টিলার পাদদেশে আদিবাসী গ্রাম। বেশ কয়েক ঘর আদিবাসী মানুষের বসবাস। মাটির বাড়িগুলোতে আলপনা আঁকা। উপরে খড়ের ছাউনি। নিকান উঠোন। উঠোনের এক কোণে বাঁধা আছে শূকর, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত কিছু প্রাণী। কিছু কিছু বন্ধনহীন অবস্থায় চড়ে বেড়াচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই তারা স্বগৃহে ফিরে আসে। তারা স্বাধীন হলেও ঘরের প্রতি তাদের প্রত্যেকের একটা অদ্ভুত মায়া আছে। যেমন আছে এখানকার মানুষগুলোর। সন্ধ্যের সাথে সাথে তারা ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করে। সারাটাদিন বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত এরা। কেউ পাথর ভাঙ্গে কেউ নদী থেকে বালি আহরণ করে কেউ জঙ্গল থেকে সাপ, বেজি, পাখি, বন মোরগ ইত্যাদি জন্তু জানোয়ার শিকার করে তাদের ছাল এবং মাংস বিক্রী করে। কেউ কেউ নানা ওষধি গাছ-গাছড়া, শিকড়- বাকড় এবং জড়ি- বুটির ব্যবসা করে। পুরুষদের মতো আদিবাসী মহিলারাও সারাটাদিন বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। পুরুষদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বালি তোলা, পাথর ভাঙ্গার কাজ ছাড়াও কেউ কেউ গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাবিজ-কবচ শিকড়-বাকড়, মন্ত্রপূতঃ তেল, জলপড়া দিয়ে রোগ সারায়। কারো দাঁতে ব্যথা, ঘুমের ভিতরে প্রস্রাব করা, মহিলাদের ঋতুজনিত সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব, বশীকরণ মন্ত্র ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে তারা।

এই টিলার একেবারে উপরে বহু প্রাচীন এক মন্দির আছে। আদিবাসীদের দেবীর থান। একটি সরু প্যাঁচানো পথ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লাটিমের গায়ে জড়ানো সুতলির মতো ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেছে। প্রাচীন বৃক্ষছায়ায় লোক চক্ষুর অগোচরে আছে বহু প্রাচীন সেই মন্দির। ভগ্ন প্রায়,জীর্ণ পরিত্যক্ত পাথুরে দেওয়ালে বন্য লতার আচ্ছাদন। মন্দিরের ছাদে বট অশ্বত্থেরা নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠেছে। ছাদ এবং দেওয়াল বহুদিন বন্য গাছ এবং লতা-গুল্মদের দখলে। মন্দিরের ভিতরে বিগ্রহ বলতে বড় একটি পাথর খন্ড। তাতেই তেল সিঁদুরের প্রলেপ। মন্দিরের অভ্যন্তর ধূলো-বালিতে পূর্ণ। নিত্য কারো পা পড়ে না এখানে। কালে ভদ্রে কিম্বা বছরের কোনো এক বিশেষ সময়ে কেউ কেউ আসে এখানে পূজো দিতে। কাল ভেদে অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশেষ এক দেবতার উত্থান হয়। আবার কখনো কোন এক অশুভ শক্তির আগমনে সেই দেব মাহাত্ম্য চাপা পড়ে যায়। অথবা নতুন শক্তিশালী কোনো দেবতা তার জায়গা নেয়। তখন নতুন দেবতার আরাধনায় মানুষ মেতে ওঠেন। দেবতাদের রূপ পাল্টায় পূজার রীতি নীতি বদলে যায়। ঈশ্বর অলক্ষ্যে বসে হাসেন। তবু আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখার চেষ্টা করে। যুগ যুগ ধরে তাদের এই পূজা পদ্ধতি এবং যাপন প্রণালীর খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না।

যুবকটি এ স্থানে কেন এসেছিল সেটা ক্রমে জানা যাবে।

এতদূর উপরে উঠে সে একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে একটা গাছের ছায়ায় বসেছিল। শাল গাছটি অদ্ভুত ধরণের। ক্লান্ত পথিকের বসার জন্যেই বুঝি তার অমন আকৃতি। যুবকটি বহুক্ষণ সেই গাছের ছায়াতলে অপেক্ষা করছিল। একজনের আসার কথা আছে। সেই ব্যক্তিটির কাছ থেকে একটা জিনিস নেবার কথা আছে। আর তারপরেই তাকে তার প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।

অপেক্ষমান মন নিয়ে সে সেই প্রাচীন শাল বৃক্ষের নীচেয় দাঁড়িয়েছিল। গ্রীষ্মের দাবদাহ এই বৃক্ষগুলি অনেকটাই শুষে নিয়ে শীতল বাতাস এবং ছায়া দান করছে। বড়ো মনোরম এই স্থান। ঘুরতে ঘুরতে পথিক খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঘর্মাক্ত শরীরটা কোনোমতে টেনে নিয়ে এসে এই স্থানে এসে দাঁড়ালো। খাঁড়া পথ ধরে উপরে উঠতে তার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। এখন এই ছায়া শীতল স্থান তাকে অনেকটাই স্বস্তি দিচ্ছে। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে যখন ঝিম ধরে এল তখন সে বসার জন্যে উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে লাগল। তখনি অদূরে নজরে পড়ল এই প্রাচীন শাল বৃক্ষটিকে। পথিক দেখল শাল গাছের গুঁড়িটা বড়ই অদ্ভুত। প্রায় হাত তিনেক ভূমিতে আনত হয়ে একেবারে খাঁড়া উঠে গেছে। যুবকটি আনত গুঁড়িটির উপরে প্রথমে বসল। কিছুটা সময় বাদে দুই পা সামনের দিকে প্রসারিত করে চিৎ হয়ে শুয়ে গুড়িটিকে আরাম কেদারার মতো ব্যবহার করল। গাছটির গুঁড়িতেই পিঠ পেতে অর্ধশয়ন করল। তার এই স্বাচ্ছন্দ্য শোওয়ার ব্যবস্থাটিকে সে দেবতার আশীর্বাদ বলে মনে করল। মধুর বাতাস বইছে। ঝিরি ঝিরি বাতাসে শরীরের ক্লান্তি দূর হল। জঙ্গলের ভিতর থেকে পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছে সে। ক্লান্তি অপনোদনের এটাও মোক্ষম এক দাওয়াই। পথিক চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগল মন মুগ্ধকর বিচিত্র সেই সুর। কত ধ্বনির সমাবেশ।

অল্প সময়ের ভিতরে তার দু’চোখে ঘোর তন্দ্রা নেমে এলো।

হঠাৎ তার ঘুম ভাঙ্গল অদ্ভুত এক শীতল স্পর্শে। তার পদ যুগল খালিই ছিল। জুতো খুলে সামনের দিকে পা মেলে বেশ নিরলস ভঙ্গীমায় শুয়েছিল। দীর্ঘ পথ হেঁটে পা দুখানি একটু উন্মুক্ত হতে চাইছিল। পথিকের মনে হল সেই শীতল স্পর্শ পা বেয়ে শরীরে উপরের দিকে উঠে আসছে। এই অভূতপূর্ব অনুভূতি তাকে মুহূর্ত্যের ভিতরে সজাগ এবং সতর্ক করে দিল। সে দেখার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল তার চোখ দুটি বাঁধা পড়ে গেছে। খুব শক্ত করেই কে যেন তার চোখ বেঁধে রেখেছে। সে যখন গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল তখনই হয়তো কেউ এ কাজ করে থাকবে। সে তার হাত দিয়ে বন্ধন মুক্ত করতে গিয়ে আবার ধাক্কা খেল। দেখল তার হাত দুটিও বাঁধা আছে পিছনের দিকে সম্ভবত গাছের গুড়ির সঙ্গে। এদিকে সেই শীতল স্পর্শ তার পা থেকে কোমর, পেট বুক পুরো শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

যুবক শিহরিত হলো। এ স্পর্শ তার মস্তিষ্কে অশনি সংকেত বয়ে আনল।

এক সময়ে গলার কাছে চলে এলো সেই শীতল আগন্তুক।

পথিক ভয়ে আড়স্ট হয়ে পড়ল। যখন সে নিশ্চিত বুঝতে পারল প্রাণীটির পরিচয়। সরীসৃপটির হিল হিলে জেরা জিহবার স্পর্শ রীতিমতো অনুভব করতে পারছে। গলার কাছে তারপরে চিবুক স্পর্শ করতে লাগল সেই জিহবা।

এই অনুভূতি যে কতটা ভয়ংকর এবং মুহূর্তে হৃদ স্পন্দনকে থামিয়ে দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত।

পথিক স্বয়ং মৃত্যু দূতকে যেন বন্ধ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করল।

যমরাজ নিজেই এসেছেন তাকে নিতে। আহবান করছে তাকে। এই অনুভূতি পথিককে মুহূর্ত্যের ভিতরে বিহবল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তুলল।

শীতল পরশ এবারে তার মাথার উপরে উঠে এল। মনে হল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে তার কপালসহ মাথাটাকে রজ্জুর মতো বেষ্টন করতে লাগল অদৃশ্য সরীসৃপটি।

এই শীতলতা যে কতটা ভয়ংকর অসহনীয় হৃদয় বিদীর্ণকারক হতে পারে সেটা ভুক্তভুগী ছাড়া আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়।

এই জাতীয় ভয়ংকর আর রোমহর্ষক ঘটনা ইতিপূর্বে তার জীবনে কখনো ঘটেনি। পথিক দাঁতে দাঁত চেপে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে লাগল।

প্রতি পল অনুপলের নিখুঁত পরিমাপ সে করতে পারছে। সময়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ যেন এই মুহূর্তে তার হিসাবের ভিতরে ধরা দিল। এত সূক্ষ্ম সময়ের হিসাব সে আগে কখনো করতে পারেনি। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ পরিমাণ সময় যেন সে ধরতে পারছে, তার মস্তিষ্ক এখন এতটাই সক্রিয়। পথিক মৃত্যুদূতের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে মরার মতো নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইল।

দুই

শাল-পিয়ালের ঝর্ণা তলায়

কতক্ষণ এই রকম ভয়ংকর পরিস্থিতির ভিতরে কাটল সেটা পথিক জানে না। কারণ কিছু সময়ের জন্যে সে জ্ঞান হারিয়েছিল। হয়তো আতংকে তার চেতনা মুহূর্ত্যের জন্যে লুপ্ত হয়ে যায়।

এমন সময়ে কয়েকজন মানুষের গলার শব্দ শুনে তার চেতনা ফিরে আসে। পথিক মনে করার চেষ্টা করে সে কোথায় এখন? সে বাঁধা আছে কেন?

ইত্যাদি প্রশ্ন মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই আতংক আবার ফিরে এল। সে অনুভব করার চেষ্টা করছে সেই আতংকবাদী প্রাণীটি এখন তার ধারে কাছে অবস্থান করছে কিনা।

মানুষের গলার স্বর শুনে সে যেন প্রাণ পেল।

চোখ বন্ধ থাকায় বুঝতে পারছে না মানুষগুলো কারা। তার কোনো ক্ষতি করবে কি?

তবে একটু আগে সে যে মৃত্যুর স্পর্শ পেয়েছে তার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো ভয়ংকর ঘটনার তুলনা চলে না। এখন আর সে মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে না।

যুবক ভিন দেশী। তাই সে এদেশের ভাষা বুঝতে কিছুমাত্র পারল না। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

লোকগুলো সং খ্যায় চার পাঁচ জনের বেশী নয় বলেই তার অনুমান। প্রত্যেকের ভিন্ন স্বর তাদের তফাৎ করে দিল। যুবক ভাষা বুঝতে না পারলেও তারা যে এক কঠিন সমস্যায় পড়েছে সে ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করছে সেটা বুঝতে পারছে।

কিছু সময় বাদে একজন তাকে গাছের গুঁড়ি থেকে মুক্ত করল। তারপরে তার চোখের বাঁধন খুলে দিল। মুখ বাঁধা থাকল পূর্বের মতো। চোখ খুলে দিতেই সে চোখ মেলে তাকাল।

ভেবেছিল আলোর দেখা পাবে। কিন্তু তার পরিবর্ত্যে সে অন্ধকার দেখল।

ঘন অন্ধকারে ব্যপ্ত চতুর্দিক। এক বিন্দু আলোর দেখা নেই। এতো গাঢ় অন্ধকার যুবক কিছুই উপলব্ধি করতে পারছেনা। দিনের বেলার পাখিদের কলতান শুনে সে মুগ্ধতা অনুভব করেছিল তাদের কুজনে ঘুমিয়ে পড়েছিল এখন তার পরিবর্ত্যে ঝিল্লীর একটানা কলরব শোনা যাচ্ছে। কানে তালা লাগান সেই শব্দ। সেই শব্দ ছাপিয়ে এখন দূরে শিয়ালের ডাক শুনতে পেল। এক শিয়ালের সঙ্গে অনেক শিয়ালের মিলিত ডাক ভয়ের উদ্রেক করল। পরক্ষণেই আদিবাসী পল্লী থেকে সারমেয়দের ডাক শুনতে পেল। শৃগালের ডাক মুহূর্তের ভিতরে চাপা পড়ে গেল।

কুকুরের ডাক তাকে বুঝিয়ে দিল কাছাকাছি মানুষের বাসস্থান আছে নিশ্চয়ই। এগুলো বন্য কুকুর নয়। গৃহে পালিত পশু। সে তাদের ডাক শুনলেই অনুমান করা যায়। সে ভিন দেশি হলেও বেশ কিছুদিন হল এ অঞ্চলে তার যাতায়াত আছে। স্থান সম্পর্কে একেবারেই সে অজ্ঞাত নয়। তবে সব জায়গায় তার পা পড়েনি। তবে মোটের উপরে নতুন জায়গা সম্পর্কে তার একটা প্রাথমিক ধারণা আগে থেকে তৈরী হয়েই ছিল।

কুকুরের দল ক্রমশ যেন এইদিকেই এগিয়ে আসছে বলে তার মনে হল। এর ভিতরে তার চোখ অন্ধকারকে কিছুটা হলেও আত্মস্থ করে ফেলেছে। অন্ধকারের ভিতরে অস্পষ্ট কিছু কিছু জিনিস সে দেখতে পাচ্ছে। নক্ষত্রের আলোতে দেখতে পাচ্ছে তার থেকে সামান্য কিছুটা দূরে দুটি অশ্ব দাঁড়িয়ে আছে। তাদের লাগাম ধরে আছে দুইজন ঘোড়সওয়ার।

কিন্তু রক্ষী কিম্বা ঘোড়সওয়ারদের মুখচ্ছবি স্পষ্ট নয়। তাদের মাথার টুপি আর পোশাক আশাক দেখে সে এটুকু বুঝেছে এরা হয় রাজ অনুচর নয় তো রক্ষী।

রক্ষী দুইজন এগিয়ে এসে যুবককে ইঙ্গিতে উঠে আসার কথা জানাল।

আমায় কী করতে হবে বলুন?

যুবকের কথার মানে না বুঝলেও তারা যুবকটিকে হাত ধরে ঘোড়ার কাছে নিয়ে এলো। ঘোড়ার পিঠে চড়ার জন্যে ইশারা করল।

যুবক ঘোড়ার পিঠে চড়ার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। তার উপরে এই অন্ধকারে কোথায় পা দিয়ে উঠতে হবে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছিল না। কিন্তু সে বুদ্ধিমান। তাই দুইবারের চেষ্টায় ব্যর্থ হলেও তৃতীয়বারের জন্যে প্রস্তুত হলে একজন এগিয়ে এসে এক জায়গায় পা রেখে ঠেলে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিল। সামনে একজন রক্ষী এবং পিছনে আর একজন রক্ষী এগিয়ে চলল সেই বন পথ ধরে। প্রথমে তারা সকলে টিলা থেকে নীচেয় নেমে এল। পথিক সামনে পিছনে হেলে তাল রক্ষা করল। কিছু সময়ের ভিতরে সে ব্যাপারটা রপ্ত করে ফেলল। এখন আর তার চলতে কোনো রকম অসুবিধা মনে হচ্ছে না। বরঞ্চ বেশ রাজসিক ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। বেশ হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়াটিকে সে প্রথম দেখল আরো খানিকটা পথ পেরিয়ে কিছুটা নীচেয় নেমে আসার পরে। এখানে জঙ্গল না থাকায় আকাশের মৃদু আলোতে দেখল খুব সুন্দর দেখতে ঘোড়াটি। তাহলে কি এটা কোনো রাজার ঘোড়া? তাকে কি রাজার কাছে নিয়ে যাচ্ছে? রাজার আদেশে কি তাকে রাজার সামনে উপস্থিত করবে?

পথ খুবই সংকীর্ণ এবং ঢালু। ঘোড়া খুব সাবধানে নখের উপরে ভর দিয়ে পাথুরে পথ ধরে নামতে লাগল। দুই এক বার পা হড়কে গেলেও পর মুহূর্ত্যে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে তাল সামলে চলল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ। মাঝে মাঝে ডাল পালার আঘাত এসে লাগছিল গায়ে মাথায় চোখে মুখে।

এক জঙ্গল ছেড়ে আর এক জঙ্গল। আবার চড়াইয়ে উঠতে লাগল। তবে এবারে পথ ততটা খাঁড়া নয়। আস্তে আস্তে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে গেছে। এদিকের জঙ্গল ঘন হলেও লতা গুল্মের আধিক্য কম। বেশীর ভাগ মহীরুহ। নক্ষত্রের আলোতে মনে হল শাল আর সেগুন গাছের আধিক্য। মাঝে মাঝে মহুয়া পলাশ গাছ আছে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে গাছ গুলো উপরের দিকে উঠে গেছে। মনে আছে আকাশ স্পর্শ করার বাসনা প্রবল গাছেদের।

চলতে চলতে দূর থেকে জলের ক্ষীণ ধারার শব্দ কানে আসছে। ক্রমশঃ সেই শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। ঝর ঝর করে অনেক উপর থেকে জল পড়লে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনি।

আশে পাশে কি তাহলে কোনো ঝর্ণা আছে?

আরো খানিকটা পথ তাকে চলতে হল। রক্ষী দুইজন নিজেদের ভিতরে কথা বলেই চলেছে। পথিক তার এক বর্ণ বুঝতে পারল না। তবে সে এখন আর শঙ্কিত নয়, বরঞ্চ রাতের অন্ধকারে এই পথ চলা তার বেশ ভালো লাগছে। অন্য রকমের এক অনুভূতি হচ্ছে। তবে একটা চিন্তা আছেই। আজ যে তার এক জনের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। আজ কি সেই অমাবস্যা?

নাকি অমাবস্যা পেরিয়ে গেছে?

আজ কী এত সব ঘটনা ঘটে গেল পর পর? নাকি এর মাঝে কয়েকদিন কেটে গেছে?

নাহ, তাই বা কি করে হয়। তেমন হলে তার শরীর জানিয়ে দিত। দুই তিন দিনের অনাহারে থাকা কেমন অনুভুতি সেটা সে না জানলেও কিছুট অনুমান করতে পারত। বোধ হয় আজ সেই দিন।

কিন্তু, যে তার জন্যে আজ অপেক্ষা করবে বলেছিল সুবর্ণরেখার তীরে সেই সুন্দরী কি সত্যি সত্যি এসে ফিরে গেছে?

এখন কত রাত কিছুই সে অনুমান করতে পারছে না। আকাশে চাঁদ দেখলে তবু বুঝতে পারছে রাত কতটা গভীর হয়েছে।

জলধারার শব্দ ক্রমে প্রকট হচ্ছে। সুন্দর এক সঙ্গীতের সুর বলে মনে হচ্ছে।

সেই সুরের উৎস সন্ধান করতেই যুবক সামনের দিকে তাকাল। অন্ধকারের ভিতরে সে লক্ষ্য করল অদূরে পাহাড়ের উপর থেকে একটা জলধারা নেমে এসেছে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সেই জলধারা নেমে যাচ্ছে সমতলে পথ খুঁজে। তারই শব্দ কানে আসছে। গাছের ডালে পাতায় পাথরে পাথরে প্রতিহত হয়ে অদ্ভুত এক শব্দ অনুরণিত হচ্ছে। পথিক মোহিত হল সেই সুরের জাদুতে। অন্ধকার রাত্রিতে দুগ্ধ ধবল এই ঝর্ণা অদ্ভুত এক মায়ালোকের সৃষ্টি করেছে।

রক্ষী দুই জন সেই ঝর্ণার ধারে একটা মহুয়া গাছের সঙ্গে প্রথমে ঘোড়াটিকে বেঁধে রাখল।

তারপরে পথিকের হাত দুটি পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেলল গাছের ডালে। ইশারায় জানিয়ে গেল এখানে কিছু সময় অপেক্ষা করো।

দিনের বেলা হলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হতো। এখন অস্পষ্টতার সঙ্গে অনুমান আর কল্পনা মিশিয়ে নিয়ে বুঝতে হচ্ছে। তাতে অন্য একটা মাত্রা পাচ্ছে জায়গাটা। প্রকৃতি অন্য রূপে ধরা দিচ্ছে।

যুবক ভাবছে তাকে এই জঙ্গলের পথ ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

সেই কোন সকালে তাকে ধরে গাছের গুঁড়িতে বেঁধে রেখেছিল। তারপরে এখন রাত। কত রাত আন্দাজ করতে পারছে না।

আজ কী বার? মনে করার চেষ্টা করল। বৃহস্পতি, শুক্র কেটে গেছে। আজ সম্ভবতঃ শনিবার।

কোন তিথি? সে জানে কি?

না, মনে করতে পারছে না।

আকাশে তো চাঁদ ওঠার কথা। কিন্তু এখনো চাঁদ ওঠেনি। উঠবে কিনা সন্দেহ। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার।

আজ কি তাহলে অমাবস্যা?

হঠাৎ ওর মনের আকাশে একটা সন্দেহ সংশয় দেখা দিল।

আজ কি তাহলে সেই কৌশিকী অমাবস্যা!

কথাটা মনে পড়তেই তার সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলে গেল। এখানে আসার পরে লোক মুখে শুনেছে কৌশিকী অমাবস্যাতে জঙ্গলের ভিতরে আছে জাঙ্গুলি মায়ের মন্দির। খুবই জাগ্রত সেই দেবী। আজ কি সেই জাঙ্গুলি মায়ের মন্দিরে বলি আছে? সকলে আজ রাতে কি সেখানে যাবে?

তাকেও কি সেখানেও নিয়ে যাবে?

এমন তো নয় তাকেই জঙ্গুলি মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলি দেওয়ার জন্যে?

কথাটা ভাবতেই তার শরীরের সমস্ত রোমকূপ খাঁড়া হয়ে গেল।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS Wordpress (0)

demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
Checking your browser before accessing...