ধারাবাহিক উপন্যাস   মনে রবে কিনা রবে  (৪-৫ পর্ব)  মোনালিসা ঘোষ

ধারাবাহিক উপন্যাস মনে রবে কিনা রবে (৪-৫ পর্ব) মোনালিসা ঘোষ

চার

ক্রমশঃ দম আটকে আসছিল। বাথরুমটা সত্যিই এত নোংরা ও দুর্গন্ধময়। অথচ দুর্গন্ধটা নাকে আসছিল না। এটা সেই পরিচিত বাড়িটার দোতলার বাথরুম, যেটা ছিল ভুলোমনার স্বপ্নের বাথরুম।এই বাথরুমের শুকনো মেঝেতে কতবার চিৎপাত হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশকুসুম ভেবেছে সে ।সেই বাথরুমটাকে প্রাণপণে পরিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিল সে। ভারতীয় পদ্ধতির প্যান ছিল সেটা। ছ্যাতলা পড়ে পড়ে লালচে হয়ে গেছিল। গু জমে ছিল।
গর্তের মধ্যে পড়ে গেছিল চিরুনী। ভুলোমনার রোখ চেপে গেল। সে মারাত্মকভাবে ঘষাঘষি করে আজ গু-এর বংশকে নির্বংশ করবেই, এমনি পণ করে বসল। ফলে ব্লিচিং-এ, অ্যাসিড-এ তার হাত খসখসে হয়ে যাচ্ছিল। প্রাণপণে বাথরুম পরিষ্কার করে যাচ্ছিল ভুলোমনা। বাথরুমটার এমন একটা জায়গাও ছিল না যেটা একটু পরিষ্কার।সাধের বাথরুমের এ অবস্থা কেন সম্ভবত এই প্রশ্নটাই ভুলোমনাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে কুরে কুরে খাচ্ছিল। চিরুনীটা বার করা গেল অবশেষে। জমা জলের একটা হিল্লে হল। একটা মরণ-বাঁচন লড়াই-এর শেষে হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলার কথা। কিন্তু কাহিল হওয়া হালাত নিয়ে ভুলোমনা দেখল নাক বন্ধ, হাত পা ভেজা খসখসে, বুকে চাপ, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ঘুম ভেঙে দেখল শ্বাসকষ্ট সত্যিই হচ্ছিল ভুলোমনার।ফলে,কম্বলটা সরিয়ে নিঃশ্বাস নেবার জন্য গুরুংদের দেওয়া ঘরটাতে শুয়ে শুয়ে হাওয়া হাতরালো সে। গভীর অন্ধকার ছিল তখন। রাতের অন্ধকারের পরতে পরতে পাহাড়ি অন্ধকার ঢুকে ঘাপটি মেরে বসেছিল। এইরকম অন্ধকারের রাজ্যে সব ভুলে যাওয়া ভুলোমনা নিজেকে খুঁজে পায়।তাই সে অন্ধকার পছন্দ করে। কিন্তু এখন তার দরকার ছিল হাওয়া। ওগো, হাওয়া কি নেই ভরা পৃথিবীতে? হাওয়া দাও, হাওয়া। আর্তনাদ করছি।এ কেমন স্বপ্ন ? নোংরার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে গিয়ে আরও নোংরায় নিমজ্জিত হওয়া ! এর থেকে পালাতে পালাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে ভুলোমনার।আর তখনই বেবাক ভুলে যেতে হবে ক্রমশঃ একটু একটু করে নোংরায় ডুবে যাবার কথা। মন আর নিতে পারবে না। সে ঘুমিয়ে পড়বে একটা বিশাল সময়ের জন্য।
আপাতত ভুলোমনা চাইছিল হাঁপরের মত শ্বাস টেনে নিতে ।সে কিছুক্ষণ খাটের ওপর বসে রইল। দরজা খুলে প্রকৃতির শরণাপন্ন হল না মোটেও। কারণ ঘরের ভেতরকার গরম আর বাইরের ঠাণ্ডার তফাতটা শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। বসার পর ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট কমে আসছিল ভুলোমনার। এইসময় দরকার ছিল স্যালবেয়ার জাতীয় ইনহেলারের । যে ইনহেলারটা ভুলোমনার ওষুধের বাক্সে গাদাখানেক ওষুধের ভিড়ে পড়ে থাকে। সেটাকে দুচোক্ষে দেখতে পারে না ভুলোমনা। ওটার জন্য ওরাল থ্রাস হয় বলে ভুলোমনার ধারণা।
হঠাৎই ভুলোমনার ফিক্ করে একটু হাসি পেল। হাসির কারণ ইন্দ্রনাথ। ইন্দ্রনাথকে যদি এ সময় জিজ্ঞেস করা হত, কেমন আছেন, সে নির্ঘাৎ গলাটাকে বেমক্কা গম্ভীর করে উত্তর দিত, দিব্য আছি। ঘোরতর ঝকমারির মধ্যেও ইন্দ্রনাথের অভ্যেস হল, গর্বের সঙ্গে উত্তর দেওয়া আ-মি দিব্য আছি । ভুলোমনার মনে হত, ভীষণ ঝুটঝামেলা অপমান ও হেনস্থার মধ্যে আকাশের মেঘের ওপর বসে বসে পা দোলাচ্ছে ইন্দ্রনাথ।মেঘ এখানেও কত। গায়ের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে চলে যায়। হাত দিয়ে মেঘ ধরে দেখেছে ভুলোমনা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে দেখেছে, নাকের মধ্যে দিয়ে যদি কিছুটা মেঘ ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলা যায়। আঙুলের ফাঁকে ঢুকে থাকার মত অন্ধকারের ফাঁকে অন্ধকার সেঁধিয়ে থাকা এ রাতে একা একা ভুলোমনার আবার খুব হাসি পেল। হাসিটা পেল নিজের কথা ভেবে। নাক দিয়ে জবরদস্তি পেটে মেঘ ভরে ফেলার মত একটা প্রেমকেও ভুলোমনা নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করার চেষ্টায় ছিল। প্রেমটা মেঘের মতনই ফস্কে গেছে।
হঠাৎ খুব জেদ চাপল ভুলোমনার ।এই যে আধ্যাখ্যাঁচড়া মনে পড়া, স্মৃতি খামচে বেড়ানো, এরকমভাবে আর কত! এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। অতীত বলে একটা জিনিস আছে, যেটা ভুলোমনা প্রায় হারিয়ে বসে আছে। তার একটা বর্তমান আছে এবং বর্তমানটা তার কাছে যথেষ্ট। একটা ভবিষ্যৎ ওত পেতে বসে থাকার মত তার সামনে থাবা গেড়ে বসে আছে, যাকে নিয়ে ভুলোমনার মাথাব্যথা নেই আদৌ। সে বর্তমানে আছে, বর্তমানেই মজে আছে। এভাবে থেকে যাওয়া যায়। এই থাকাটা বেশ। এটা অনেকটা চিকুর মত থাকা। বর্তমান সর্বস্য জীবন। কিন্তু ভুলোমনা সমাজবদ্ধ জীব। অন্তত সমাজ মাঝে মাঝে উনুনের মধ্যেকার কয়লা উসকানোর মত এই কথাটা ভুলোমনাকে জানিয়ে দেয়। তখন ভুলোমনার মন উসখুস করে। তার একটা অতীত ছিল, যেটা খামচা খামচা করে মুছে গেছে। কোন এক সামন্ত তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। সেই সামন্ত মাঝে মধ্যে ফোন করে। টাকাকড়ির খোঁজখবর নেয়। ওষুধপত্রের।কখনও কখনও নতুন কোন খবর দেওয়ার চেষ্টা করে। যেমন সোনামনিকে মনে আছে তো? সোনামণি? খুব ভালো গান করত। গান গাইতে গাইতে আপনা আপনি তার চোখ দিয়ে জল পড়ত। অথচ, গলা ধরে যেত না। আরে, যাকে তুমি বলতে জলজ্যান্ত সিনেমা। সিনেমাই বটে। কারণ, তোমার মনে হত ওরকম সিনেমাতেই হয়। দৌঁড়ায়, কাঁদে, নাচে, কিন্তু এতকিছুর সঙ্গে গান গাইতে গলা ধরে না, হাঁপায় না…একটু পজ দিয়ে সামন্ত বলল, মনে পড়ছে?
খুব নিস্পৃহ গলায় বলল ভুলোমনা- তো, হয়েছেটা কি? সামন্ত আরও উৎসাহের সঙ্গে বলল, মনে পড়ছে ? ভুলোমনা আরও নিস্পৃহ গলায় বলল, প্লিজ, কাম টু দ্য পয়েন্ট। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। একটা ছোট্ট হাই তুলল ভুলোমনা। বেগতিক দেখে সামন্ত বলল, না, না, ঠিক আছে। ওই বলছিলাম আরকি! সোনামণির একটা বাচ্চা হয়েছে। তুমি দেখলে…
শেষ করতে না দিয়ে ভুলোমনা বলল, আচ্ছা, রাখছি।খুবই ক্লান্ত লাগছিল তার। বড় ক্লান্তি! কি করত সে মানে মিঠুয়া, সোনামণির বাচ্চাকে দেখলে? সামন্ত এমন ভাবে বলছিল যেন হাড়িতে জল ভর্তি করে রাখা মাগুর মাছের মত খলবল খলবল করে উঠত।
আরেকটা ছোট্ট হাই চাপতে চাপতে ভুলোমনা সুটকেস খুলল। সুটকেসটা সে বড় একটা খোলে না। কারণ, দরকারি সব জিনিসই থাকে তার ওয়ার্ডরোবে। সুটকেসে পড়ে থাকে কখনও সখনও দরকার হতে পারে এমন কিছু জিনিসপত্র। যেমন একটা দড়ি, মোমবাতি, দেশলাই একটা আপেল কাটার ছুরি, যত্ত সব। একটা ঢাউস এ্যালবাম আছে। তাতে মান্ধাতার আমল থেকে ইদানিংকাল অবধি বাছাই করা যত ছবি সাজিয়ে গুছিয়ে সামন্ত তাকে দিয়েছে। যদি এ্যালবাম উল্টে পাল্টে ভুলোমনার ভুলোপনা কিছু কমে। অ্যালবাম পারতপক্ষে ভুলোমনা দেখে না। দেখতে বিরক্তি লাগে। এ্যালবাম খোলামাত্রই সার সার মুখ বেরোলো। অনেক মুখ চেনা, আধ চেনা, অথবা চেনা-চেনা। কিন্তু মুখগুলো সম্পর্কে কোন আগ্রহবোধ করল না ভুলোমনা। এমন খটখটে শুকনো চড়া-পড়া মন কবে থেকে তার হল কে জানে! ঘটনাগুলো চেষ্টা করলেই মনে পড়বে। হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কোলে ন্যাড়ামাথা পিকা। তার দাদার মেয়ে। তার মুখে ভাত হচ্ছে। তাকে সাতসকালে তার কচি মাথা দাড়ি কামানোর রেজার দিয়ে ন্যাড়া করেছিল বাবা। সে সময় বাবা বেদম টেনশনে ছিল।পিকাটা ছিল মহা বজ্জাত। ছোটবেলা থেকেই মেথরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। সে প্রায়ই মেথরটার ঝ্যাঁটা ধরে টানাটানি করত। আর মেথরটা পাছে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায় সেই ভয়ে কাক তাড়ানোর মত করে হুস হুস করে পিকাকে তাড়াত। মেথরটার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, সে নীচু জাত, তাকে পিকা ছুঁলে নিশ্চয় পিকার জাত যাবে। জাত আবার কোথায় যাবে! জাত কি করে যায়? পিকা নিশ্চিন্তমনে বেধড়ক বদমাইশি করে যেত।
বিষয়টা মজার। এরকম অসংখ্য মজার কিম্বা অমজার বিষয় অ্যালবামটার যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিল।
অ্যালবাম উল্টোতে উল্টোতে সেই বাড়িটা বেরোলো। যার বাথরুম পরিষ্কার করতে গিয়ে ভুলোমনা গোটা স্বপ্নটায় নাজেহাল হচ্ছিল। বাড়িটা ওরই । এই বাড়িটা চেনা। একসময় এই বাড়িটায় মহাসুখে দিন কেটেছে ভুলোমনার। একসময় বাড়িটার সামনে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন হচ্ছিল। সেই সুবাদে লম্বা লম্বা গর্ত খুঁড়ে দু-পাশে তাগাড় করা মাটি উঁচু করে রাখা ছিল। মাটিতে দেখতে পাওয়া যেত অজস্র শামুকের খোল।মিঠুয়াদের খেলাই ছিল রোজ বিকেলে সারা বিকেল জুড়ে সুন্দর সুন্দর শামুকের খোল খুঁজে বেড়ানো। সে যে কি এক নেশা চেপে বসেছিল। জীবনের সমস্ত উদ্দেশ্য যেন গিয়ে জড়ো হয়ে বসেছিল শামুকের পেছনে। এক বিকেলে বেভুল হয়ে ঝিনুক, শামুক খুঁজে মরছিল ভুলোমনা যে তখন আসলে মিঠুয়া ছিল। হঠাৎ পা স্লিপ করে হড়কে যায়। মোহিনীর পা ধরে ঝুলছিল সে। সেই পা-টা ছিল একমাত্র উঠে আসার রাস্তা। মোহিনীর চিৎকারে অন্যরা ছুটে এসে টেনে হিঁচড়ে তুলেছিল মিঠুয়াকে।
সারা অ্যালবামে কোথাও ইন্দ্রনাথের ছবি নেই। থাকার কথাও নয় অবশ্য।ইন্দ্রনাথ ভুলোমনার কাছে ছিল লুকিয়ে রাখা জিনিস। সঙ্গোপনে। কোন প্রমাণ থাকবে না, তার আর ইন্দ্রনাথের মধ্যে কি হয়েছিল বা কি হতে হতেও হয়নি।
ইন্দ্রনাথ ভুলোমনাকে আড়াল করে রাখত, তার জীবনে। তার কিছুটা কারণ হয়ত লিপি। লিপির সঙ্গে লিভ টুগেদারের ঝুটঝামলা ঢোকাতে ইন্দ্রনাথ চাইত না।অথচ এখন স্মৃতির টুকরোর সুতো ধরে গর্তে পড়ে থাকা ভুলেমনা অ্যালবামটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে একমাত্র ইন্দ্রনাথের স্মৃতির টুকরো হাতড়ে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে আসার চেষ্টা করছে। শেষমেশ বাস্তবে ফিরে আসার একটা মরিয়া চেষ্টা ভুলোমনা করবেই, যদিও এখন সেই আন্ডরগ্রাউন্ড ড্রেন হওয়ার বিশাল টানেলটা, যেটা ছিল নোংরা জলে ভর্তি, অন্ধকার ও স্যাঁতসাঁতে,যাতে কিলবিল করছিল নানা ধরণের পোকা , ভুলোমনার মন সেখানেই আটকে ছিল । জীবনের প্রতি আর কোন আগ্রহ ভুলোমনা বোধ করছিল না। আবার মিঠুয়া হয়ে সেই জীবনে ফিরতে তার অসম্ভব ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু বাস্তবটা জানার এক অদম্য ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসে ছিল। বাস্তবটাকে জেনে তারপর তাকে পোশাকের মত খুলে ফেলে সে এগিয়ে যেতে চাইছিল একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।কিন্তু ভুলোমনাকে ভাবনায় পেল। ছোটবেলার ভাবনা। তার খেলুড়েদের ভাবনা।
ছোটবেলায় তাদের মধ্যে একটা মজার খেলা ছিল। মোহিনী ছিল তাদের দলকর্তা। সে রোজ খানিকটা দৌড়ে গিয়ে তার বা-হাত আর ডান হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিত। আর ওরা ছুট্টে গিয়ে দুদিক থেকে দুজন মোহিনীর হাত ধরত। যারা যেদিন হাত ধরতে পারত তারা নিজেদের সেদিনকার মত গর্বিত বোধ করত। কত সহজেই তখন আনন্দগুলো ভুসভুস করে আকাশে উড়ে বেড়াত। হাত পাতলেই আনন্দরা উড়তে থাকা কার্পাস তুলোর মত হাতের চেটোয় এসে পড়ত।
সেদিন গেছে। তবে সেসব দিনেও মধ্যে মধ্যে রাক্ষুসীরানীর অবির্ভাব ঘটত। বিভিন্ন রূপে । একবার খেলুড়েদের মধ্যে এক রাক্ষুসীরাণী এসে পড়ল।মোহিনীর ডানহাতের হকদার হল সে। মোহিনী বিনা প্রচেষ্টায় তার ডানহাতটা তাকে ছেড়ে দিয়ে কৃতার্থ বোধ করল। সেই রাক্ষুসী যথার্থ অর্থে রাক্ষুসীই ছিল যায় নাম ছিল মিলন। কেন কে জানে মিঠুয়ার ওপর সে উঠল ক্ষেপে। বলল, তার এমন লোক জানা আছে যে তাদের বাড়ি থেকে তাদের বাবা-মা শুদ্ধ ঘাড় ধরে উচ্ছেদ করতে পারে, তারপরেও সে ক্ষান্ত হল না, সে বলল, লরি ডেকে নাকি বাড়ির ইঁটগুলোও গুণে গুণে তুলে নিয়ে যেতে হবে। এই অসম্ভব ভয়ের কথায় মিঠুয়া প্রথমে শিহরিত হল, তারপর ঝরঝর কেঁদে ফেলল। দৌড়ে সে বাড়ি চলে গেল। অজানা ভয়ঙ্কর ভয়ে সে বারান্দায় এসে খেলুড়েদের দেখল। দেখল, মিলন ওকে ভ্যাঙচাচ্ছে। ‘একজনের বাড়ি ভাঙা হবে’। তাজ্জব হয়ে দেখল অন্যরা কেউ তার প্রতিবাদ করছে না। আবার তারা যে আদৌ খুব বিচলিত তা-ও মনে হচ্ছে না । যেন একটা অত্যন্ত আম ঘটনার মত এটা শেষ হবে।
তারা প্রতিক্রিয়াহীন! মিঠুয়া আরেক চোট কাঁদল। তারপর মিঠুয়া কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে তাদের আসন্ন দুঃসময়ের কথা সবিস্তারে বলল। কিন্তু মা সামান্যই শুনলেন। আর অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বললেন, শুধু শুধু কেউ এরকম করবে কেন? লোকের খেয়ে-দেয়ে অনেক কাজ আছে। আর এসব করা এত সোজা নাকি? তুমি কত বোকা, কেঁদে মরছ!
মিঠয়া কেঁদে কেঁদে বলল, আমি ওদের সঙ্গে খেলব না। ততোধিক নিস্পৃহ গলায় মা বলল, খেলিস না যা। ঝামেলা মিটে গেল।
মিঠুয়া যখন হাইড্রেনে পড়ে যাচ্ছিল।তখন কিন্তু এই মিলনই আরও খেলুড়েদের সঙ্গে পরিমড়ি দৌড়ে এসে হেঁইয়ো বলে মিঠুয়াকে টেনে তুলেছিল।
অ্যালবামে খেলুড়েদের সকলের ছবি নেই। মিলনের একটা ছবি থাকলে ভাল হত। বড় হতে হতে বুঝেছিল মিঠয়া বড় দুঃখে না বুঝে-সুঝে মিলন রাক্ষুসীরাণী হয়ে গেছিল। সেটা আরেকটা গল্প।কিন্তু মিলনের জীবনের খুঁটিনাটি ভুলোমনার চোখের সামনে উঠে এল। একবার দেখা হলে সে মিলনের দিকে শুধু একবার তাকাত। সেই তাকানোর মধ্যে দিয়ে মিলনকে বলত, আমি আছি তোর জন্য।
এমন একটা ঘোরতর সম্ভাবনা ঘটবে কি ঘটবে না, তার নেই ঠিক, সম্ভাবনাটা ভুলোমনার ভাবনা হয়ে তার পাশে নেচে নেচে বেড়াচ্ছিল। ভুলোমনা মিছিমিছি বসে বসে ভাবনাটার সঙ্গে একটু কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলল। অ্যালবামে মা আছে। মায়ের ছবিগুলোর ওপরে হাত রাখল ভুলোমনা। ছবিটাকে ছুঁল সে। আর সঙ্গে সঙ্গে একরাশ ঘুম এসে ছেঁকে ধরল তাকে। মা মানে ঘুম।মা মানে মনের আরাম। মা মানে পরম শান্তি। মা মানে আর কিছু মনে না পড়া। মা মানে কিছু মনে পড়ার দরকার না হওয়া।

পাহাড়ে তখনও চাঁদ ডোবেনি। অথচ সুর্যের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃতি পাশ ফিরছিল আসলে । তাই ভুলোমনাও পাশ ফিরল। অ্যালবাম বন্ধ করে ছিল সে আবার তলিয়ে গেল গাঢ় ঘুমে।

চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত

পাঁচ
সন্ধেবেলাটা ছিল মোমো বানানোর মরশুম। চাচীর কাছে টেকনিকটা শিখে নিচ্ছিল ভুলোমনা। ময়দার লেচিটা বেলতে হবে খুব পাতলা করে। তা নাহলে মোমো হবে মোটা । মোড়কের জায়গাটা বিচ্ছিরি হয়ে থাকবে। বেশী পুর দেওয়া যাবে না আবার। তাহলে মোমো সেদ্ধ হবার সময় ফেটে যাবার উপক্রম হবে। রাশি রাশি মোমো বানানো হল। তাল তাল ময়দা মাখাই ছিল। একজন ক্রমাগত লেচি কেটে গেল। একজন লেচিগুলোকে গোল্লা পাকালো। দুজন বেলতে থাকল। আর দুজন চাচী আর ভুলোমনা ক্রমাগত পুর পুরে মোমো বানিয়ে গেল। এক জন ফটাফট স্টাফ্ট মোমো গুলোকে সাজাতে লাগল। সাজানোর কাজগুলো করছিল দেবেন্দ্র আর আরেক ভাই হীর। সে ছিল খুবই গম্ভীর প্রকৃতির। কথা কম কাজ বেশী বোধহয় তার জীবনের মোটো ছিল। সে হাসতও কম।অবশ্য পাহাড়ীরা হাসে কম এটা লক্ষ্য করে দেখেছে ভুলোমনা। ভয়ঙ্কর সিরিয়াস মুখ করে থাকে। ব্যক্তিত্ব বজায় রাখে তারা ওইভাবে। অথচ রাস্তাঘাটে দেখো, যখন কাজে বেরিয়েছে একা , এমনিই হয়ত দাঁড়িয়ে আছে, তখন সাজির মত ব্যাগ নিয়ে সুন্দর সুন্দর হাওয়াই চটি-পরা মেয়েগুলো হেসে হেসেই সারা হয়। যাকে দেখে , তাকে দেখেই হাসে! বাচ্চাগুলোও তাই, কোত্থেকে যে এত হাসি তাদের পায় কে জানে? গাড়ি দেখলে লাফিয়ে লাফিয়ে হাততালি দিয়ে দিয়ে হাসে।
গুরুং হাসে-টাসে।তবে গুরুং-এর হাসি শহুরেদের হাসির মত। উচ্চশিক্ষিত পোঁচপড়া শহুরে ম্যানেজমেন্ট রপ্ত করার পর গুরুং হাসি পাল্টে গেছে খোদ পাহাড়ীদের হাসির থেকে। গুরুং-এর সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং হলে অ্যাটেনেশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রাজ ভাইয়া সুরেন্দ্র ভাইয়া হীর বা বাকী সব এ বি সি ডি ছেলেদের দলও হাসে না। তারা নিঃশব্দে মানুষ বুঝে নেয় এবং কর্তব্যে অটল থাকে। এদের মধ্যে শহুরে ছাপ স্পষ্ট নয় তত, কিন্তু পড়াশুনোর ছাপ স্পষ্ট।
এইসব অগাধ গাম্ভীর্য আর হাসিমুখ পাহাড়ীদের মাঝখানে ভুলোমনার ভুলোপনার শেষ হয় না। পাহাড় তাকে ডাকে, আয়, আয়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সূর্য ডোবে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে পাহাড়ে। হঠাৎ নিঝঝুম হয়ে যায় পাহাড়। আর বাড়িতে বাড়িতে কাজের ধরণ নিমেষে যায় বদলে।
দেবেন্দ্র একাকার হয়ে থাকে, এসব কিছুর মধ্যে। মনের সুখে থাকে।খায়-দায়, গান গায়, তাইরে নাইরে না জীবন। তাইরে নাইরে না করতে করতেই পরিশ্রমও করে যায় দেবেন্দ্র। যেন যে কাজটা করছে সেটা এই প্রকৃতির মত স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ।
মোমো বানাতে বানাতে একসময় চাচী বলে, ব্যাস হয়ে গেছে।কত মোমো তখন বানানো হল কে জানে? চারশো পাচশো? বোর্ডাররা খাবে সব।ভুলোমনাকে নেশায় ধরেছিল মোমো বানানোর।মোমোর গঠনশৈলী নিয়ে গভীর ভাবনাচিন্তায় মগ্ন ছিল ভুলোমনা। কিন্তু চাচীর ‘ব্যস হয়ে গেছে’ বলার মধ্যে এমন একটা কম্যান্ড ছিল ভুলোমনাকে উঠতেই হল। এদের বাড়ির মহিলারা খুব সহজে কম্যান্ড করতে পারে। এটা বোধহয় বহুলোক একসঙ্গে একান্নবর্তী হয়ে থাকার ঝামেলায় স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্সের কারণে। স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্স জিনিসটাকে খুব খারাপ লাগে ভুলোমনার। আমি এগজিস্ট করছি, সেটা স্বইচ্ছায় না অনিচ্ছায় সেটা সম্পর্কে কোন প্রমাণ নেই। প্রথমে, জবরদোস্তি ধরে নিতেই হবে, আমার এগজিস্ট করাটাই দারুণ একটা বড়সড় ব্যাপার। ব্যাপারটার একটা গভীর অর্থ আছে।অর্থটা যে কি সেটা আমি বুঝি বা না বুঝি সেটার একটা নির্ঘাৎ অর্থ আছে। এটা একটা হাইপোথিসিস। তারপর আমার কাজ হল, সারাজীবন ধরে হাবিজাবি নানান ঝামেলায় জড়িয়ে সেই অর্থটাকে খুঁজে বের করা। খুঁজে বের করার প্রতিটা পদক্ষেপ বেশ স্ট্রাগলসাম। তবুও স্বইচ্ছায় সেই স্ট্রাগলকে ঘাড়ে করে নিয়ে খামোখা লড়াই করতে করতে বেঁচে থাকাকে বলে স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্স।
ভুলোমনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে দেখল, গুরুং হন্তদন্ত হয়ে অফিস ঘরের দিকে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে গুরুং নানা ধরণের কাজের মধ্যে আছে।ভুলোমনাকে দেখে হাসল গুরুং । ভুলোমনা বলল, বুঝতে পেরে গেছি।
গুরুং বলল, কি?
দুটো হাতের চেটো দেখিয়ে ভুলোমনা বলল, মোমোর লেচিটা কতটা পাতলা করে বেলতে হবে সেটা।গুরুং আবার হাসল।সহজ একটা হাসি ।
অফিস ঘর আর গুরুংদের বাড়ির মদ্যিখানে লাগোয়া যে বৈঠকখানা ঘরটা আছে, সেখান থেকে চার-পাঁচজন লোক বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। লোকগুলো যেতে যেতে আশ্চর্যজনকভাবে মাথা নাড়াচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল ওরা যেন নিজের মনে কি ভাবছে।কে জানে হয়ত, স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্সের অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে।মনে হচ্ছিল, অর্থটা সম্ভবত তখুনি তখুনি ওদের মাথায় ঢুকেছে ।তাদের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভুলোমনা গুরুংকে বলল, ওরা কারা?
-ওরা আশেপাশের লোকজন। কাছেপিঠেই থাকে।
-এখানে ওরা দল বেঁধে কি করছিল?
-ওরা ঠাকুরজীর কাছে এসেছিল।
এই সেই ঠাকুরজী যার জন্য কিছুদিন আগেই তিনদিন ধরে সংকীর্তন চলছিল।সেই ভয়ানক জগঝম্প এখন থেমেছে। চতুর্দিক শান্ত এবং ঝলমলে। ভুলোমনা গুরুংকে জিজ্ঞেস করল,
-ঠাকুরজী মানুষটা আসলে কে?
প্রশ্নটা করার পর ভুলোমনা দেখল, গুরুং-এর মধ্যে আর সেই ব্যস্ত ব্যস্ত ভাবটা দেখা যাচ্ছে না।এমনিতেও ভুলোমনার সঙ্গে সবসময় গুরুং ধৈর্য্য ধরে কথা বলে। সম্ভবতঃ গুরুং-এর ধারণা ভুলোমনা একজন অসুস্থ মানুষ। তাই তার সঙ্গে কথাবার্তা বলাটা জরুরী । ডাক্তারেরা বলে থাকে, মানসিকরোগীদের পক্ষে একা থাকা নিরাপদ নয়।একা হলেই তারা প্রচুর আগদুম-বাগদুম ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করতে পারে! তার কুফলস্বরূপ তার অসুস্থতা বেড়ে যেতে পারে। গুরুং লোকটা অতিরিক্ত বুদ্ধিমান। তাই এতসব মাথায় রাখতে পারে। আবার এও হতে পারে, যে সামন্ত হয়ত গুরুংকে এইসব বলে-কয়ে রেখেছে।গুরুং বেশ রয়ে সয়ে একটা পাথুরে বসার জায়গার ওপরে বসে ভুলোমনাকে বলল,
-ঠাকুরজী আসলে একজন রিমপোচে। উনি রি-ইনকারনেটেউ, মানে…
ভুলোমনা গুরুং-কে থামিয়ে বলল,
-যিনি নিজের ইচ্ছেয় পুর্নবার জন্মগ্রহণ করেছেন, মুক্তপুরুষ হয়েও।
-হ্যাঁ ।আই মিন, আমরা সকলেই বিশ্বাস করি উনি রি-ইনকারনেটেউ।
-হয়ত, রি-ইনকারনেশন ব্যাপারটা হিন্দুধর্মে বা বৌদ্ধধর্মে থাকলেও অনেক হিন্দুই এটা তেমন বিশ্বাস করে না ।ভুলোমনা আবার গুরুংকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি করি! আমি মনে করি পুনর্জন্ম হয়। সজ্ঞানে, যা ওই রিমপোচের হয়েছে বা অজ্ঞানে যা আমার বা তোমার হয়েছে। কিন্ত, উনি যে একজন সত্যিকারের রি- ইনকারনেশন হওয়া মুক্ত বুদ্ধ আত্মা, তার প্রমাণ কি?
গুরুং একটুও দ্বিধা না করে, শান্তস্বরে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বলল, ‘উনি রি-ইনকারনেটেড, তার প্রমাণ আছে।
-যেরকম?
-সাধারণতঃ এরকম কেউ জন্মালে তার জন্মের পরেই তার বাবা-মা কোন না কোন কারণে মারা যায়। ওনার বাবা-মা মারা গেছিল!
এরকম কাণ্ড কাকতালীয় হতেই পারে। সাধারণ লোকে এগুলোকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের যুক্তিবাদী প্রমাণ করতে ভালবাসে।যেন সবার ওপরে যুক্তি শ্রেষ্ঠ তাহার ওপরে নাই।
ভুলোমনার গুরুং-এর কথাগুলোকে কাকতালীয় ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল । সে পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে।এ জন্মের যে গাদাগুচ্ছের কথা সে ভুলে মেরে বসে আছে, পুনর্জন্মে চাইলে সে সব মনেও করা যেতে পারে। মনে করা যেতে পারে, এমনকি ছাতার মাথা হয়েছিল যে তার মস্তিষ্কের কিছুটা অংশ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ভুলোমনা হাত-পা নেড়ে জেগে নড়েচড়ে বেড়ালেও সে জাগছে না!
ভুলোমনা বলল, এ জন্মে বসে বসে পরের জন্মগুলোর অ্যাকশন রিপ্লে দেখতে পাওয়া, ব্যাপারটা মজা পাওয়ার জন্য বেশ ভাল।বাবা-মা মারা যাওয়া ছাড়া আর কি কি প্রমাণ আছে যে, উনি রি-ইনকারনেটেড।
গুরুং বলল, আছে। শরীরের মধ্যে কিছু চিহ্ন, যেটা আমরা তেমন বুঝি না। আর কিছু ব্যবহার, যেমন রিমপোচে তিন বছর বয়সে আগাগোড়া গীতা মুখস্ত বলতেন।উনি উপনিষদ থেকে অনর্গল শ্লোক আবৃত্তি করতে পারতেন এবং তার মানে ব্যাখ্যা করে পণ্ডিতদেরও খুব সহজে বুঝিয়ে দিতে পারতেন। উনি ছিলেন অসম্ভব রকমের নির্লোভ। খুব ছোটো থেকেই কারুর অসুখ করলে অত্যন্ত সহজভাবে উনি তার সেবা-শুশ্রূষা করতেন।এ ব্যাপারে তাকে শিখিয়ে দিতে হত না। আর এছাড়া উনি ছিলেন শ্রুতিধর। যে কোন জিনিস একবার শুনলেই মনে রাখতে পারতেন, এখনও পারেন।
এই সমস্ত কথাই ভুলোমনার ঘোরতর ভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। সে বিশ্বাস করল। বিশ্বাস করার পর সে খুব আরাম বোধ করল। কোন সংশয় নেই। সব উপদ্রবকারী অবিশ্বাসগুলো ভয় পেয়ে পেছু হটে অশরীরীর মত মিলিয়ে গেছে। সেইসব ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া অবিশ্বাসগুলো বোকার মত ইতস্তত প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।তারা এমন মানুষদের অপেক্ষায় আছে যাদের ঘাড়ে তারা ভুতের মতন ভর করতে পারে। তারপর সেই মানুষগুলোর মাথার পোকা নড়িয়ে তাদের অবিশ্বাসী বুদ্ধিগুলো দিয়ে চালিয়ে তারা মহানন্দে রাজত্ব করবে।তাদের মাথার ঘিলু খুঁটে খেয়ে অবিশ্বাসগুলোর এত রমরমা হবে, যেন তারা চুলের মধ্যে, বাড়বাড়ন্ত হতে থাকা উকুন।
ভুলোমনা এইসব বাজে অবিশ্বাসগুলোকে বিদায় করে গুরুংকে বলল, বিশ্বাসে মিলায়ে বস্ত্তু তর্কে বহুদূর! বলেই তার মনে পড়ে গেল, শিব যখন সতীকে কাঁধে নিয়ে ধেই ধেই করে তান্ডব নৃত্য জুড়েছিল, এসব গল্প ভুলোমনাকে বলত তার ঠাকুমা। ভুলোমনা কেবলই তাকে জিজ্ঞেস করত, এসব সত্যি ঘটেছে ? ঠাকুমা নির্দ্বিধায় বলত, হ্যাঁ, একেবারে সত্যি। ভুলোমনার রোখ চেপে যেত। কে বলেছে তোমায়? কেউ দেখেছে? ঠাকুমা তর্ক করতেন না।বলত, সব সত্যি। সমুদ্র মম্থন সত্যি। দক্ষযজ্ঞ সত্যি। নৃসিংহ অবতার সত্যি। সব সত্যি। তখন ঠাকুমার মুখে ভুলোমনা শুনেছিল ওই প্রবাদটা।বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর । সে গুরুংকে বলল, আমাকে দেখাবে রিমপোচে কে? গুরুং বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়। কেন নয়? এসো। গুরুংকে দেখে মনে হচ্ছিল সে একটা কাজের মতো কাজ পেয়েছে এবং সেটা করতে চলেছে। আবার দু-পা হেঁটে ঘরে ঢুকে যদি দেখা যায় রিমপোচে নেই, তাহলেও গুরুং-এর কোনো আফশোস হবে না। সে ধরেই নেবে, রিমপোচেই জানে সে কখন কার সঙ্গে দেখা করবে বা আদৌ দেখা করবে কিনা! গুরুং-এর হাতে কিছুই নেই অতএব তার উদ্বেগেরও কিছু নেই।
কিন্তু রিমপোচেকে পাওয়া গেল, ঘরের মধ্যেই। তিনি সশরীরে বসে আছেন ঘর আলো করে। একটা চৌকির ওপরে জাজিম পাতা। তার ওপর আসনের মত কিছু। রিমপোচে বসে আছেন বৌদ্ধ লামাদের মত হলুদ রঙের কাপড়ের ওপরে মেরুন রঙের জোব্বা ও চাদর গায়ে দিয়ে। গুরুংরা নাকি হিন্দু ? রিমপোচে তবে কি? হিন্দু না বৌদ্ধ? যাকগে, যা খুশী হোক সে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবার মত কিছু নেই। তার ঘরে ফায়ারপ্লেসের তাকের ওপর ক্যান্ডেল স্ট্যান্ডের ওপর মোমবাতি লাগানো। কিউরিও শপে পাওয়া যাওয়া আইটেমগুলোর মত করে ঘরটা সাজানো। সারা ঘরে চাইনিজ ডিজাইনের কার্পেট পাতা। সোফা রয়েছে একধারে। সোফার ওপরেও কার্পেটের আসন পাতা। সারা ঘরে রমরম করছে শীতের ছোঁয়া। ভেড়ার লোমের চাদর, ইয়াকের হাড় দিয়ে তৈরি ডিব্বা, চামচে, ধূপদানী। সাদা সিল্কের মাফলার, যেগুলো কোনো বোর্ডার গেস্টহাউস ছেড়ে রওনা হওয়ার সময় গুরুংরা গলায় পরিয়ে দেয়। বলে, যাত্রা শুভ হোক। সাদা সিল্কের কাপড়ের মাফলারগুলো নাকি অত্যন্ত শুভ।
রিমপোচে তাকাল ভুলোমনার দিকে।ভুলোমনা তাঁর পা ছুঁলো । নিমেষে আসনের তলা থেকে বেরিয়ে এল তিনশ টাকা। ভুলোমনার হাতে দিয়ে রিমপোচে বলল, রাখো। ভোজবাজির মত। ভুলোমনা দেখল আসনের তলায় এরকম রাশি রাশি টাকা ছড়ানো আছে। আর স্বচ্ছন্দে সেগুলো রিমপোচে বিলিয়ে দিচ্ছে মানুষদের। মানুষরাই এরকম দশহাজার, বিশ হাজার টাকা প্রণামী হিসেবে রিমপোচেকে দিয়ে যায়। যেমন স্বচ্ছন্দে রিমপোচে সেসব গ্রহণ করে, তেমনি স্বচ্ছন্দে রিমপোচে সেগুলো দু-হাতে বিলোয়। বেশ মজাদার মানুষ একজন। ভুলোমনার মনে হল, সে এক মস্ত শিশুসুলভ ব্যক্তিত্বের সামনে এসে পড়েছে।
রিমপোচে হাসলেন ভুলোমনাকে দেখে। বললেন, সমতলের মানুষ পাহাড়ে এসেছো ? ভুলোমনা বলল, হ্যাঁ।
-কেমন লাগছে জায়গাখানা?
-ভুলোমনা বলল, বেশ। রিমপোচে হাসলেন। বললেন, কালই বেড়াতে বেরিয়ে এই দ্যাখো না, এই পাথরটা পেয়েছি। সাদার মধ্যে কালোর ছিটে। আমার ভারী পছন্দ হল। তাই কুড়িয়ে নিয়ে এলাম। দেখবে, বেড়াতে বেরিয়ে আরও কত কি এরকম পছন্দসই জিনিস পাই। ওহে,ওই বাটিটা দাও তো। রিমপোচের হুকুম পাওয়ামাত্র একজন তটস্থ ভঙ্গিতে হুকুম পালন করার জন্য তৎপর হল। রিমপোচের হুকুম! সে কি যে সে কথা! ভয়, ভক্তি এবং শ্রদ্ধা মিশে সে এমন এক জগাখিচুড়ির মিশেল হয়েছিল তাজ্জব হয়ে গেল ভুলোমনা। সে ভাবল, এই শিশুর মত মানুষটিকে এরা এত ভয় পাচ্ছে কেন ? গুরুং সেখানে ছিল না। ভুলোমনাকে পৌঁছে দিয়েই পালিয়ে গেছিল।মানে, সেও বেজায় সম্ভ্রমে কাবু হয়ে পড়েছিল ।
রিমপোচে বাটি পেয়ে মহাখুশী। বিভিন্ন সাইজ এবং শেপের একটা একটা করে পাথর তুলে দেখাতে লাগলেন ভুলোমনাকে। বাটি থেকে বেরোলো একটা ছিপি, কোনো বোতলের হবে হয়ত, অথচ চকচক করছে। -এইটা পেয়েছি। তুলে ধরলেন রিমপোচে। ভুলোমনা কাছে এসে বসল। চৌকির কাছে। তার খুবই পছন্দ হচ্ছিল ব্যাপারস্যাপারগুলো।
এই প্রত্যেকটা কুরিয়ে পাওয়া পাথর বা জিনিসগুলোর পেছনে একটা করে গল্প আছে। চাইলে আমরা সেই গল্পগুলো বানাতে পারি। সে বলল রিমপোচেকে। রিমপোচে বলল, কি মজার? একটা গল্প বল তো শুনি। এই ধর এইটা।
তিনটে ফ্যাকড়া বেরোনো শুকনো মত ছোট একটা কাঠের টুকরো, কোন গাছের ডাল হবে সেইটা সে দিল ভুলোমনাকে। ভুলোমনা বলল, কাঠঠোকরা গর্ত করছিল গাছটার গায়ে থাকবে বলে। তখন কাঠঠোকরার ঠোঁটের আঘাতে খসে পড়ে এটা । দেখুন, কিরকম চেঁচে দেওয়া ভাব কাঠটায়। এটা পড়েছিল গাছের নিচে।তার ওপর শিশির পড়ে ভেজা ভেজা আর বৃষ্টি।তারপর একদিন এমন রোদ ওঠে, কাঠের টুকরো শুকিয়ে মুচমুচে হয়ে গেল। দুটো লোক তাকে মাড়িয়ে চলে গেল একজনের পায়ের ধাক্কায় সে একটু রাস্তার দিকে এসে পড়েছিল, এমন সময় তুমি ওকে পাও।
ছেলেমানুষের মত হাততালি দিয়ে হেসে উঠল রিমপোচে।আর ভুলোমনা অবাক হয়ে ভাবল, সমস্ত সম্ভ্রম ভুলে সে কিভাবে তুমি বলে ফেলল, রিমপোচেকে।
দুজনে মিলে যখন এরকম ভীষণ খেলায় মশগুল, তখন রিমপোচে বলল, স্কোয়াশ, আদেশ পালনের মত করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন একটা গোটা স্কোয়াশের বোতল এনে হাজির করল। রিমপোচে বলল, ওকে দাও। ও মাঝে মাঝে খাবে।
তারপর রিমপোচে ওকে একটা সাদা সিক্লের মাফলার পরিয়ে দিল। ভুলোমনার মনে হচ্ছিল সে আর রিমপোচে বন্ধু হয়ে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু মাফলার পরার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ সম্ভ্রম গ্রাস করল ভুলোমনাকে। তার মনে হল, হঠাৎ কোত্থেকে একটা পাহার প্রমাণ দূরত্ব এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, তাদের সামনে। রিমপোচের চোখে চোখ রাখল সে। আর কথাটা বলল, মনে মনে, কেন এরকম করলে?
রিমপোচে তার দিকে তাকাল। একটা ধুনি এগিয়ে দিল তার সামনে। সেখানে থেকে অগরুর গন্ধ বেরোচ্ছিল। তার ভাপ নিল ভুলোমনার দুহাত বাড়িয়ে। মনে মনে, তাকে কে যেন বলল, দূরে না গেলে কাছে আসছ বুঝবে কি করে? চমকে উঠল ভুলোমনা। একটা চামর উঠিয়ে ভুলোমনার মাথায় ছোঁয়ালো রিমপোচে তখনই ভুলোমনা টের পেল, সে অনন্তকাল রিমপোচের সামনে বসে থাকলেও রিমপোচে ওকে যেতে বলবে না। আর তখনই সে উঠে পড়ল, টাকা আর স্কোয়াশ নিয়ে। সে রওনা হল তার ঘরের দিকে। তার খুব গভীরভাবে জন্মান্তরে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল। আর তখনই দড়াম দড়াম করে হাতুড়ির ঘা পড়ল বুকে। ইন্দ্রনাথ জন্মান্তর মানে না।

পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    ইন্দ্রাণী দত্ত 2 years

    আখ্যানের স্লোপ লক্ষ্য করার। অতীত, বর্তমান, স্বপ্ন, বাস্তবের খুঁটিনাটিতে বিচরণ চরিত্রটির মনের, সেই ভাবনাকে অবলীলায় অনুসরণ করছে গদ্য। এত সাবলীলভাবে, এমন স্বচ্ছন্দে যেন জল গড়িয়ে নামছে,গন্তব্য অবশ্যম্ভাবী নির্দিষ্ট, অথচ চলনটি মেঘের মত – এই তল থেকে ঐ তলে চরে বেড়াচ্ছে, হাওয়া উঠলে কোথায় যাবে ঠিকঠিকানা থাকবেনা।
    বেশ কিছু টাইপো রয়েছে। আর ‘মেথরটা’ ভয়ংকর পীড়াদায়ক, বস্তুত সমস্ত প্রাপ্য প্রশ‌ংসা, ভালোলাগা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। এডিট করার দাবি র‌ইল।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    404 Not Found

    Not Found

    The requested URL was not found on this server.


    Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80