ছোটগল্প <br /> ফাঁদ <br /> সুমিত নাগ

ছোটগল্প
ফাঁদ
সুমিত নাগ

“There is no greater agony than bearing an untold story inside you” —Maya Angelou

সময় নাও, সময় নাও। সময় নাও, যতক্ষণ-না নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারো। গল্পটা এখনই শুরু করতে হবে, এমন কোনও নিয়ম কিন্তু নেই। অপেক্ষা কর, খানিক স্বপ্নের মতো, খানিক দুঃস্বপ্নের—আলো-আঁধারিতে হারিয়ে যেতে যেতে অপেক্ষা কর। সে আসবে যখন, তখনই তোমার আসল কাজ শুরু। তখনই, হতে পারে, তোমার মুক্তি।

এটা উপদেশও ভাবতে পারো, অথবা সাজেশান। যা খুশি।

যা হোক, এখানে যখন তুমি এসেছ তখন গল্পটা জানতে তুমি আগ্রহী। কোথা থেকে শুরু করা যায় তাহলে? পুরনো দিনের গল্পের মতো একেবারে শুরু থেকে, শৈশবে—বিলডাঙস্রমানের মতো? নাকি মাঝখান থেকে এক টুকরো তুলে নিয়ে তাকে অনুসরণ করবে? নাকি শেষ থেকে, পিছন থেকে, সামনের দিকে এগোনো? ফ্ল্যাশ-ব্যাক ভাবছ? ক্রনোলজি এলোমেলো করে? টাইমলাইন ঘেঁটে? নাকি আরও অন্য কোনও নতুন টেকনিক, অন্য কোনও অধুনা-আবিষ্কৃত ফর্ম? থিম নিয়ে কী ভেবেছ? চরিত্র নিয়ে? ছকে নিয়েছ প্লট? নাকি তুমি প্লটার নও, প্যান্টসার—অপেক্ষা করছ প্রথম লাইনের জন্য, স্বর্গ থেকে নেমে আসবে?

কিস্যু এসে যায় না। তুমি ইতিমধ্যে গল্পে ঢুকে গেছ। নিজের মতো করে বানাবেও সেটা। না-বানিয়ে থাকতেও পারবে না।

না, কেউ সাহায্য করতে পারবে না তোমাকে। এই যে তুমি দাঁড়িয়ে আছ বৃষ্টি মাথায় করে, বন্ধ চায়ের দোকানের সামনে, যাও-বা একেকটা গাড়ি পিচ-রাস্তার খানাখন্দে জমা-জল ছিটিয়ে-ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে তোমার সামনে দিয়ে, তোমার দেখানো হাত অগ্রাহ্য করে—তারই মধ্যে, ঝুপ্পুস ভিজে তুমি, কাঁপছ ঠাণ্ডায়, ভাবছ, এখন বৃষ্টি ভিজলে নির্ঘাৎ ভীষণ জ্বর নাচচ্ছে তোমার কপালে—সেই তোমাকে কি কেউ সাহায্য করতে আসছে? সন্ধে নামছে, একেই বৃষ্টিতে আবছা দৃষ্টিপট, মোবাইল ফোনে চার্জ আছে, কিন্তু ভিজে, খারাপ হয়ে যাবার ভয়ে বন্ধ-করে পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছ। এভাবে আর কতক্ষণ?

অবশ্য, তোমার কাউকে ফোন করার নেই। তোমার কাউকে জানাবার নেই যে, তুমি আজ বাড়ি ফিরতে পারবে কি পারবে না। তোমাকে কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করারও আছে কি এই দুরবস্থায়? রক ফোন-কলে? কেউ নেই। কেউ নেই। এতদূর চলে আসার পর তুমি একাকী, অসহায়।

এমন অবস্থায় তুমি দূরে একটা কাকতাড়ুয়া দেখতে পেলে। ক্ষেতের মধ্যে, ধান ক্ষেত—ওহ, তুমি এখনও চারপাশে ভালো-করে তাকিয়ে দেখনি, না? দেখো, তাকিয়ে দেখো, চায়ের দোকানটা ঠিক রাস্তার পাশেই। আর কোথাও, কোনোদিকে—যতটা দু’চোখ যায় কিচ্ছু নেই। ওপরে স্লেট-মোছা-জলের ধূসর আকাশ, সামনে জলের আলপনা-আঁকা চকচকে পিচের রোড আর চারপাশে সবুজ-সবুজ ধান ক্ষেত—বুক-জলে ডুবে দাঁড়িয়ে আছে। আরও দূরে তাকালে বৃষ্টিতে আবছা-হয়ে-আসা দিগন্তরেখা। এমন দেখেছ কখনও? কোনোদিনও? ভালো করে তাকিয়ে দেখো।

ভালো করে তাকিয়ে দেখো, মেঝেতে বেশ কিছুটা রক্ত জমে আছে। রক্তের সঙ্গে মিশে আছে যেন কারো ঘিলু—চ্যাটচ্যাটে লাল ম্যাঙ্গো জেলির মতো, থকথকে। ঘরের ওই কোণে বসে বসে কাঁপছে একটা লোক। চোখ দু’টো বিস্ফারিত। মুখ-বাঁধা, হাত দু’টোও পিছ-মোড়া করে বাঁধা, তার শরীরে কোনও পোশাক নেই। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, পা-দুটো সামনে ছড়িয়ে বসে থাকার ফলে তার লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই তিনটিতেও ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। যেন এক হিম-আতঙ্ক তাকে গিলে ধরেছে, সে চিৎকার করতে চায় কিন্তু পারছে না। তার মুখ-বাঁধা বলে, কিংবা আতঙ্কেই চিৎকার করতে ভুলে গেছে। কে লোকটা? তুমি ভাববেই। আর রক্তই বা কার? তুমি ভাবতে ভাবতেই, লোকটার কাছে গেছ। ভাবছ, মুখের বাঁধন খুলে দেবে কিনা। লোকটাকে তো আহত বলে মনে হচ্ছে না, তার শরীরে রক্তের কোনও দাগ নেই। এত কাঁপছে কেন? কার ভয়ে? তার চোখের সামনেই কি কাউকে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে বা থেঁতলে…? ওহ, তোমার নিজেরই গা-গুলিয়ে উঠল।

অন্ধকারাছন্ন ঘর, সবজেটে দেওয়াল, যেন শ্যাওলা জমেছে। বাইরে সে-ই অঝোর-ধারে বৃষ্টি। আশ্চর্য! তুমি তো এইমাত্র ধানক্ষেতের সামনে ছিলে। এখানে এলে কী করে? সব গুলিয়ে যাচ্ছে, না?

তোমার চিন্তা-স্রোত ছিন্ন হল। “আঁআঁআঁআঁআঁ,” লোকটা চিৎকার করার চেষ্টা করছে এবার। মুখ-বাঁধা থাকায় এক জান্তব শব্দ বৈ কিছুই বেরোচ্ছে না। ঠকঠক-করে কাঁপছে। মাথা দোলাচ্ছে। তুমি কিছু না-বলে, লোকটিকে সামান্য সরিয়ে, তার পিছ-মোড়া-করে-বাঁধা হাত দু’টো খুলে ফেলতে থাকলে। ওহ, একটা ছুরি বা ধারালো পাত জাতীয় কিছু থাকলেও ভালো হত। শক্ত দড়ি, কব্জিতে যেন কেটে বসে আছে। তুমি চেষ্টা করতে থাকলে, চেষ্টা করতেই থাকলে—খুলতেই হবে তোমায়, রোখ চেপে যাচ্ছে যেন। ছেলেবেলায় বাড়িতে মিস্ত্রির-কাজ হলে তুমি ভাড়া-বাঁধা দেখতে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠায়—এরকমই শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁশগুলো বাঁধত বটে। এই ঝামেলার মধ্যেও তোমার শৈশব মনে পড়ে যাচ্ছে। নস্টালজিয়া। কী অদ্ভুত! লম্বা লম্বা নখ থাকলেও হত। কার যেন লম্বা লম্বা নখ ছিল, একেকটা একেক রঙে রাঙানো—তোমার কোন বান্ধবীর? আঃ! এসবও মনে পড়ছে কেন এখন? যত জ্বালা!

একটা পাক খুলে গেল। আরও একটা। ধৈর্য ও পরিশ্রমে কাজ দিয়েছে। আর একটু টানাহেঁচড়া করতেই, ফস করে খুলে গেল হাতের বাঁধন।

লোকটা খুলে-যাওয়া দু’হাতের কব্জিতে আঙুলের চাপ দিয়ে দিয়ে দেখছিল। দড়ি চেপে-বসে গভীর দাগ হয়ে গেছে। সে মুখের বাঁধন খুলে ফেলল। হাঁফাচ্ছিল। তুমি তাকে ভালো করে দেখতে থাকলে। ছোট-করে ছাঁটা চুল, কয়েকদিনের পুরনো দাড়িগোঁফ গালে, ডায়মন্ড শেপের মুখ, উজ্জ্বল চোখ, ভাঙা নাক, শ্যামলা রঙ। চেহারা শক্তপোক্ত, চওড়া কবজি, মাসলগুলো টানটান, মেদহীন। বুকে বেশ ভালো পরিমাণ রোম। নাভির নিচেও।

কিন্তু, লোকটা কে? এখানে এল কী করে? এ-জায়গাটাই বা কোথায়? ভাবছিলে তুমি। কী করেই বা চলে এলে এখানে?

ঠিক সেই মুহূর্তে লোকটা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল তোমার ওপর। একবার ঘাড়ের ওপর, আর একবার পেটে ও পাঁজরের মধ্যিখানে—দু’টো প্রচণ্ড আঘাত তোমাকে একেবারে কাবু করে ফেলল। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লে তুমি। চোখে অন্ধকার দেখছ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। লোকটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছ। কী, সেটা বলে দিতে হয় না।

লোকটা এবার তোমাকে মেঝেতে উপুড় করে ফেলে, তোমার হাত পিছ-মোড়া-করে বাঁধতে থাকল। সেই দড়িতেই। বাঁধতে-বাঁধতেই তোমার মাথাটা, সজোরে ঠুকে দিল মাটিতে। আঃ! তুমি ককিয়ে উঠলে। ডান রগের কিছুটা ওপরে আঘাত—বুঝতে পেরেছ, রক্ত গড়াতে আরম্ভ করেছে ক্ষতস্থান থেকে—ফেটে গেছে নিশ্চিত।

হাত-বাঁধা শেষ হলে, সে খুলে নিতে থাকল তোমার পোশাক। এক-এক করে। অন্তর্বাসটুকুও বাদ দিল না। সেই পোশাক পরে সে বেরিয়ে গেল ঘরের দরজা দিয়ে। ফিরেও তাকাল না।

তুমি মেঝেতে পড়ে আছ এখনও। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছ। বাঁ-গাল মেঝের ওপর। ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে, চোখের কোণ বেয়ে নেমে এসে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে। অনেক কষ্টে, ঠিক তারই মতো উলঙ্গ অবস্থায় তুমি ঘরের কোণে পৌঁছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসলে। চোখের অন্ধকার কেটেছে কি একটুও? শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়েছে? হাঁফাতে-হাঁফাতে তুমি ভাবছ কী হয়ে গেল, কোথা থেকে? দাঁড়িয়ে তো ছিলে ধানক্ষেতের সামনে, বৃষ্টি-ভেজা শরীরে। তখনই একটা কাকতাড়ুয়া তোমার চোখে পড়ে। তারপর, কী হল? কী করে এই ঘরে এলে তুমি? কার রক্ত-মাখা ঘিলু ওটা? লোকটাই বা কে, যাকে বাঁচালে? সে-ই বা এমন করল কেন তোমার সঙ্গে? অকৃতজ্ঞ!

এসব ভেবে, তুমি কিছুই পাবে না। কারণ, তুমি গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছ। শুনতে এসেছিলে, নিজেই সাধ-করে, কেউ জোর করিনি। তুমি এসেছিলে। ভুলে যেও না। আমারও কোনও দোষ নেই। এছাড়া আমার কিছু করারও ছিল না।

ওই লোকটা আমিই ছিলাম। ইয়েস, মি! তোমাকে ডেকে আনলাম এই ঘরে, আমাকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু, দু’জনে একসঙ্গে মুক্ত হতে পারি না। আমার গল্প শেষ হল। তাই আমি মুক্ত। এখন বন্দী তুমি। মুক্ত হতে গেলে, এবার তোমাকেও গল্প বলতে হবে, টেনে আনতে হবে নতুন কাউকে। গল্পের কী সেটিংস বাছবে, কী কী চরিত্র নির্মাণ করবে, কী প্লট, কীরকম ভাষা—সেসব তোমার নিজস্ব ব্যাপার। যেমন আমি আমার মতো করে সাজালাম। বাদ দিলাম যা-কিছু প্রয়োজন নেই, যা-কিছু তোমাকে আকৃষ্ট করবে না, টেনে আনবে না আমার গল্পের মধ্যে—সেসব কিছু। কাকতাড়ুয়া দেখার পর, তুমি এই ঘরে কী করে এলে—এসব ব্যাখ্যা করার কোনও দরকার কিংবা সদিচ্ছা আমার নেই। আমি যা-কিছু বানাতে পারতাম, যা-কিছু—বানালাম। যা তোমাকে নেশাগ্রস্তের মতো টেনে আনল, বন্দী করল। আমার কাজ এখানেই শেষ, আমার গল্পটা তুমি শুনে নিয়েছ। আমি মুক্ত। এছাড়া আমি আর কী চাই? এবার যদি জানতে চাও আমার গল্পটা সত্যি না মিথ্যে—তাহলে বলব, ‘সমস্ত শিল্পই প্রোপ্যাগান্ডা’, অরওয়েল বলেছিলেন, শোনোনি?

আগেই বলেছি, দোষ তোমার। আমি ডাক দিইনি, তুমি নিজেই এই ফাঁদে পড়তে চলে এসেছিলে। তাই, মুক্তি পেতে চাইলে, এবার তোমার কাজ শুরু কর। গল্প-ফাঁদতে হবে। তবে, তাড়াহুড়ো করো না। মনে পড়ে, আমি প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম— সময় নাও, সময় নাও। সময় নাও, যতক্ষণ-না নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারো। গল্পটা এখনই শুরু করতে হবে, এমন কোনও নিয়ম কিন্তু নেই। অপেক্ষা কর, খানিক স্বপ্নের মতো, খানিক দুঃস্বপ্নের—আলো-আঁধারিতে হারিয়ে যেতে যেতে অপেক্ষা কর। সে আসবে যখন, তখনই তোমার আসল কাজ শুরু। তখনই, হতে পারে, তোমার মুক্তি।

এটা উপদেশও ভাবতে পারো, অথবা সাজেশান। যা খুশি।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    Shyamashri Ray Karmakar 4 years

    ভাল লাগল সুমিত। অন্যান্য গল্পের চাইতে আলাদা

  • comment-avatar
    Rajesh Ganguly 4 years

    একেবারে অন্যরকম। এক অন্তস্থ মোনোটনি তিরতিরে বয়ে চলেছে মেঘলা আকাশতলে ঝাপসা বিধুরতার ঐশ্বর্যে…চকিতে রৌদ্রক্ষরণে যখন তার চকচক করে ওঠার মুহূর্তপালন…তখনই সম্বিত ফিরে পাওয়া জানিয়ে দিচ্ছে, এক অচেনা দিগন্তরেখায় সন্ধ্যে নেমে আসছে, নাঃ কোন তারা ফোটেনি, অন্ধকার যেন প্রাঞ্জল মায়ার মত জড়িয়ে রইল স্নায়ু। পাঠশেষে সমস্যা দাঁড়ালো এই লেখাকে ক্যাটেগোরাইজ করতে গিয়ে। দেখা গেল কোন পরিচিত ব্র্যাকেটস্থ করা গেলনা। অথচ বর্জনীয়ও নয় মোটেই। ইতিমধ্যে ভালোলাগা মোমের মত গলতে গলতে জমে উঠছে মোমদানের পদতলে। আকার বদলে গেল, অথচ চরিত্র বদলালো না বলে বোঝা গেল এক আশ্চর্য ম্যাজিকের ভেতর কখন যে ঢুকে পড়েছি, টেরই পাইনি…জাদুকরের প্রশান্ত হাসিটি হাউইয়ের মত সাঁ করে বেরিয়ে গেল চেনাজানার সীমানা ছাড়িয়ে।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes