
কাশ্মীরি কবি অর্জন দেব মজবুর-এর কবিতা
ভাষান্তর ও ভূমিকা : সায়ন রায়
কাশ্মীরি কবিতায় অর্জন দেব মজবুর-এর আবির্ভাব এমন এক ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সময়ে যখন এক নতুন যুগের সূচনা হচ্ছিল, যে যুগকে কবি-লেখকেরা সম্ভাষিত করেছিলেন প্রতিশ্রুতিময় সহস্রাব্দ হিসেবে।ফলশ্রুতি হিসেবে কবিতায় যেসকল পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ছিল তা কেবল দৃষ্টিভঙ্গিগত ফারাক নয়।আঙ্গিক ও শৈলীতেও নতুনত্ব সূচিত হচ্ছিল।চিরাচরিত গজল রচনা না করে কবিরা নানা ধরনের পাশ্চাত্য আঙ্গিককে কবিতায় নিয়ে আসছিলেন।মনে হচ্ছিল কাশ্মীরি কবিতা তার পুরোনো খোলস ছেড়ে,চিন্তা ও শৈলীর ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্যকে সরিয়ে রেখে এমন এক প্রাণপ্রাচুর্যে স্পন্দিত হচ্ছিল যা এর আগে কখনো ঘটেনি। একদল কবি ও লেখক সমবেতভাবে এক নতুন ঝরনাধারায় অবগাহন করেন। ১৯২৪ সালে পুলওয়ামা জেলার জাইনাপোরা গ্রামে মজবুর জন্মগ্রহণ করেন।অল্পবয়সেই অনাথ হন।দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন।ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর এক কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কে কাজ শুরু করেন।এরপর আদালতে একটি কাজ জুটিয়ে নেন।অল্প কিছুদিন সেই কাজ করার পর তিনি লাহোর চলে যান।এখানে তিনি সংস্কৃত শিখতে শুরু করেন।লাহোরে রাহুল সাংকৃত্যায়নের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।রাহুল সাংকৃত্যায়নের কাছে তিনি মার্ক্সিজমের প্রভুত পাঠ নেন।তবুও বলা যায় পরবর্তীকালে প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্টের মূলস্রোতে তিনি ছিলেন না।তাঁর অবস্থান ছিল প্রান্তবর্তী।যদিও তিনি সমাজবিচ্ছিন্ন কবিতায় বিশ্বাস করতেন না।শ্রমিক,কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে তিনি সর্বদাই সচেতন ছিলেন।কিন্তু তাঁর কবিতায় কখনোই তা স্লোগানধর্মী হয়ে ওঠেনি।নদী,জঙ্গল,পাহাড়, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ,পর্বতশৃঙ্গের সৌন্দর্য হতদরিদ্রের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিশে গেছে তাঁর কবিতায়।তিনটি ভাষায় তাঁর দখল ছিল প্রশ্নাতীত—কাশ্মীরি,সংস্কৃত ও উর্দু। প্রভাবিত হয়েছেন কালিদাস,গালিব ও নাদিম-এর কবিতার দ্বারা।১৯৫৫-য় প্রথম কাব্যসংকলন প্রকাশিত হয়— 'কালাম—ই—মজবুর'।১৯৮৩ তে প্রকাশিত হয় 'দশাহার',১৯৮৭ তে 'দাযাভুনি কোসাম','পদি সাময়িক'(১৯৯৩) 'তিয়োল' (১৯৯৫)।কাশ্মীরি ভাষায় অনুবাদ করেছেন কালিদাসের 'মেঘদূত'।বেশ কিছু গবেষণা গ্রন্থ ও ছোটগল্প রচনা করেছেন।পেয়েছেন জম্মুর রাষ্ট্রভাষা সমিতি প্রদত্ত 'রাষ্ট্রভাষা সম্মান', 'বিতস্তা পুরস্কার', জম্মু-কাশ্মীর বিচার মঞ্চ প্রদত্ত 'সরস্বতী পুরস্কার'।২০১৫ সালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
একটি শিশুর মুখচিত্র
একটি শিশুর মুখচিত্র
ঝুলছিল
দেয়ালে
নাদুসনুদুস ছেলেটি
হাসছিল
আর
তার কিউপিডের মত মুখটি ছিল খোলা।
আমি বললাম :
“ তুমি আমার অপাপবিদ্ধ কৌমার্যের অতীত ?”
রামধনু হাসিটি মিলিয়ে গিয়েছিল
আর
ভাবনাবিভোর শিশুটি বলেছিল :
“ তুমি কি আমার কলুষিত ভবিষ্যৎ ?”
উত্তরটা এসে পৌঁছোলো আমার কাছে।
সাবালকরা স্মরণ করতে পারে না শুদ্ধতা
আর
শিশুরা জানে না কলুষতা।
কামনা
চেতনা অতি দ্রুতবেগে ছুটছিল
কেন্দ্রে
পৌঁছোবার জন্য
আত্মার নীচে বুকে-হেঁটে চলছিল আঁটসাঁট বিছে,
আগুনের শিখা অট্টহাসির সাথেসাথে ওয়াল্টজ্ নৃত্যরত,
উন্মাদের মত মেঘেরা ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে নাচছিল,
কাঁটায় আঠার মত আটকে গিয়েছিল ত্বক।
কিন্তু
পুরোনো কল্পনাগুলো
অপূর্ণই রয়ে গেল—
কল্পনা যা ভাসছিল আকাশে।
ফসিল
মুখটি শিলীভূত,
কণ্ঠ হিমায়িত,
হলদে দাঁত ঘর্ষণরত,
শিরাগুলি সঙ্কুচিত
আর
কপাল পেরেকবিদ্ধ।
চাহনিতে মাটিচাপা সভ্যতার
কাঁপা-কাঁপা আলোর ঝলক।
যা সত্যি
যা ভালো
আর যা সুন্দর
দীপ্তি ছড়ায়
এক জীবন্ত জীবাশ্ম অতীত যুগের।
যে তারাটি খসে পড়েছিল
অন্ধকার আকাশের একটি তারা
উঁকি দিয়েছিল
জানলার শার্সি দিয়ে।
আমি বলেছিলাম :
“ আমি একাকী তোমার মত…
একাকী একটা মাইল-ফলকের মত।”
শব্দরা ঘুরে বেড়িয়েছিল
কিন্তু বয়ে নিয়ে যায়নি কিছুই।
সবকিছুই থেকে গেল অনুক্ত।
আমার চোখ খুঁজে বেড়িয়েছিল তারাটিকে
কিন্তু
একটা বিদ্যুৎ
পুড়িয়ে দিয়েছিল কালো মেঘ।
খসে পড়েছিল তারাটি।
থমকে গিয়েছিল আমার দৃষ্টি।
চিহ্ন
পুরোনো ও মনোরম বই
ঢেকে রাখে সকল অর্থ।
আঁকাবাঁকা চিহ্নগুলো
লুকোয়
সারাৎসার।
ওরা জানতে চেষ্টা করেছিল
অর্থ
ওরা এমনকি ঘ্রাণ নিয়েছিল
চিহ্নগুলির
কিন্তু যা তারা দেখেছিল
এক ভীতিপ্রদ শূন্যতা।
ওদের বিহ্বল মুখগুলো জেনেছিল
যে
চিহ্ন হল
শক্তি
এবং
বিস্ময়।
মন
মাথায় একটা ভারী পাথর নিয়ে
সে তোতলাতে লাগল :
“ সবকিছু ছাই হয়ে যাবে
এমনকি পাখিরাও গাইবে না গান।”
রূপোর নূপুর হয়ে গেছে
কালো
এবং
স্তব্ধ।
মানুষেরা হারিয়ে গেছে মরুভূমিতে
আর
সূর্য অন্ধকার মেঘের পেছনে লুকিয়ে পড়েছে।
পর্বতগুলো মহাসাগরে ডুবে যাবে,
শুকনো খড় ইস্পাত হবে,
কুয়োর কানায় পৌঁছে যাবে জল।
আমার মন পারদ।
উন্মাদ !
থামতে জানে না—
এমনকি শোনেও না কিছু।
আবার তা জানলা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে
আকাশ জুড়ে
দৌড়ে বেড়াবে বলে।
তুষারমানব
এক শীতের সকালে
ওরা আমাকে তুষারমানব বানিয়ে তুলল।
এখন আমি দাঁড়িয়ে থাকি
ঋজু
এবং
শীতল।
লাল লঙ্কা আমার মুখ
কয়লার টুকরোগুলো আমার চোখ।
ডানহাতের লাঠিটা
আমার অবলম্বন।
আমার বাঁহাতটিও খালি নয়।
চারিদিক ঘিরে শুধু নীরবতা।
ওরা আসে আর আমাকে বলে :
“ হাসো
খেলো
নাচো
হাঁটো ”
কিন্তু আমি গলে যাই ধীরে,
অথর্ব হয়ে পড়ি ক্রমে
আর
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে যেতে থাকি সূর্যের তাপে।
আমার পায়ের পাতাকে ঘিরে যে লতা
লক্ষ্য করে
এই অদৃশ্য সংকোচন প্রক্রিয়া।
একজন কবির অসহায়তা
আমি শব্দ বুনতে পারি না
কারণ
সরঞ্জামগুলো চূর্ণ হয়েছে,
যে মন একসময় উন্মাদ হয়েছিল এখন শীতল,
চারাগাছটি শুকিয়ে গেছে,
সময়ের ডাক—জুয়াড়ি—জমে গেছে,
ছাই হয়ে গেছে শিশির,
সব খোলামুখগুলো ঢেকে দিচ্ছে ধুলো
থমকে আছে কুমোরের চাকা,
ভাঁড়ের ভাঙা টুকরোগুলোয় ভরে আছে ঘর
পুচ্ছ তুলে ময়ূরের নাচ শেষ
কাচের বাড়িগুলো কাত হয়ে পড়ে যাবার মুখে
ফাট ধরেছে জানলার কাচে
বারোটি চিহ্ন তালগোল পাকিয়ে আছে,
টুকরো টুকরো হয়ে আছে কুঞ্চিত হৃদয়,
সদ্যফোটা পাপড়িগুলো কাঁটাময় শক্ত পাথর,
ছিদ্র হয়ে গেছে পানপাত্রগুলি।
কবিতার জন্য আমি খুঁজি দেহহীন এক অস্তিত্ব
কিন্তু
স্যামসন বিচলিত
আর
মুক্তটি হয়েছে ছাই।
স্যামসন— ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইজরাইলের শাসক যিনি অসংস্কৃত,দুর্বৃত্ত ফিলিস্তিনদের বিরুদ্ধে শক্তিমত্তার পরিচয় দেন কিন্তু তার স্ত্রী ডেলায়লার দ্বারা প্রতারিত হন।


অনুবাদ খুব ভালো লাগল