এক টুকরো রোদ উঠুক কালো মেঘের ফাঁকে
অচিন্ত্য মাজী
খুব বিপদসঙ্কুল আর ভয়ঙ্কর এই সময়। আমাদের বেঁচে থাকার চৌহদ্দিতে দামাল কালো প্রেতাত্মা থাবা গেঁড়ে বসে আছে, আমাদের শিরদাঁড়ার প্রতাপকে অলক্ষ্যে খুবলে খুবলে খাচ্ছে, সেই চালাক দানোর হিসহিস আর্তনাদ ধূসর ধোঁয়ার ফাঁস হয়ে রগড়ে নিচ্ছে বিবেক ও প্রতিশ্রুতি। আমরা একটি আঁধার ঘোমটার তলায় লুকিয়ে আছি। আশ্চর্য থকথকে বর্ম দিয়ে ঘিরে রেখেছি যাবতীয় প্রেম ও প্রতিজ্ঞা। স্বার্থসিদ্ধির চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে যেতে মশগুল হয়ে উঠেছি অহেতুক ঈর্ষার জ্বলনে।
কবি অভিজিৎ ঘোষ কারবার করেন এই সকল কুহকগুলিকে নিয়ে। সংবেদনশীলতা তীব্র বলেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারেন বোবা ছায়াছবির সেই অবরুদ্ধ নকশাগুলিকে, শোনেন শীতল কুঞ্চিত জরায়ুর ভিতর নষ্ট ভ্রূণের কাতরানি। তিনি দেখতে থাকেন মধ্যবিত্ত জীবনের নিস্তরঙ্গ ক্ষোভহীন যাপনের এক তীব্র তামাশাকে। গভীর ঝাপটা চাই সেই দূর্গের নিরেট পাথর ভেঙে মানবিকতাকে তুলে আনার জন্য। কিন্তু তমসাকে মোকাবিলা করার জন্য যে ঝুঁকি চাই তা কি আজ মধ্যবিত্তের বুকে? মাঝে মাঝে গণ্ডি কেটে বেরোনোর ক্ষীণ অনুনাদ শোনা যায় কিন্তু পরক্ষনেই কোনো মরীচিকায় হারিয়ে যায় সমস্ত উত্থান। অভিজিৎ ঘোষ তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত “কতদিন মিছিলে হাঁটিনি তিলোত্তমা” কবিতার বইটিতে এইসব গোপন ভাঙচুরকে তুলে ধরেছেন। অবশ্য বিচার বিশ্লেষণের ভার তাঁর হাতে নেই। মধ্যবিত্ত বোধের অক্ষমতা আর ভীরুতার বিশেষ বিশেষ প্রবণতাগুলিকে আপন পর্যবেক্ষণ দিয়ে এঁকে চলেন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে। গভীর পর্যবেক্ষণে বস্তুর ভেতরের উপাদানকে প্রজ্ঞা দিয়ে তুলে আনার পাশাপাশি চেনান হাহাকার ও মুখোশের খোলসগুলিকে। তাঁর দেখার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে আশ্চর্য নিরাসক্তি যার ফলে প্রতিটি বিষয়কে তিনি এমনভাবে দেখেন যার মধ্যে অশ্লীলতা ধরা দেয় না।
সমস্ত চতুরতা, অতিসন্নিবেশ এবং নিপুণ টান থেকে সরে এসে জীবনের গভীরে দৃষ্টিকে নিক্ষেপ করেন বলে মধ্যবিত্তের ন্যাকামো আর ভন্ডামি কবিতার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। কবিতায় এমন এক দ্রোহের সঞ্চার করেন যা আমাদের মেকি অনুভূতি আর বাচালতা ছিঁড়ে দেয়। অতিমাত্রিক প্রদর্শিত কবিতার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ব্যাপক। বোধের গভীরে নিভৃত লড়াইয়ের আস্বাদ তার কবিতাকে দেয় এমন এক মাত্রা যা আমাদের প্রচণ্ড কৌশলগুলিকে প্রত্যাঘাত করে চূড়ান্ত সত্বাকে উপস্থাপিত করে। জীবনের বিশাল ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে যাপনের কথামালা যা বিবিধ আকুতির গন্ধে মিলিয়ে যাচ্ছে।
জীবনের জটিলতার বহুমাত্রিক স্বরকে প্রতিফলিত করতে গিয়েই সত্বার অনিবার্য টানাপোড়েন এসে যায় স্বাবাভিক ভাবেই। কারণ কবিতা তো স্থবির সমাজেরই প্রতিনিধি। তার একটি সত্বার রূপান্তরের জাড্যধর্মে আচ্ছন্ন, যেখানে পরিণতির গোপন জিজ্ঞাসাগুলি লালিত হয় অন্যদিকে তিনি ক্ষয়িষ্ণু, তেজহীন গড্ডালিকায় ভাসমান। আমরা দেখতে পাই মাঝে মাঝেই দ্বৈত সত্বার বিরোধ কাঁদে, সংকটের বহুমাত্রিক আবেগ ছড়িয়ে যায়-
প্রতিরাতে শপথ ভেঙে পড়ে
টুকরো টুকরো ছড়িয়ে যায়
স্তব্ধরাতের চাহনি ঘিরে ফেলে দশদিক
যেন গোগ্রাসে গিলে ফেলবে এখুনি…
ঘরের এককোণে
সদ্য অঙ্কুরিত একটি স্বপ্ন
আতঙ্কে বন্ধ করে চোখ…
ফারুক দু’হাত মেলে
আড়াল করে- আদরে
কোলে তুলে নেয়…
ঘরের এককোণে…
(ফারুক-আমি-ফারুক)
চৈতন্যের ভেতর আত্মগোপন করে থাকা ভীরুতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কথা ভাবছে এই ফারুক নাম্নী কবির দ্বিতীয় পুরুষে। কিন্তু অহর্নিশ টানাপোড়েনে সেই সত্বা বারবার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। তবুও এই টালমাটাল অন্তর্দবন্দ থেকেই ফারুক দেখিয়ে দিচ্ছে প্রকৃত বাস্তবতা এবং তাকেও অতিক্রমণ করে সত্যের ভিন্ন রেখটিকে। গড়পড়তা ছাঁচে ঢালা জীবন যখন ধুঁকতে থাকে একঘেয়েমির তাপে এবং একেই যখন নির্বাণ বলে ভাবতে ভাবতে হোঁচট খায় ভেতর থেকে তখন এই বাস্তবতা থেকেই ভিন্ন বাস্তবতাকে ছেঁকে নেয় ফারুক-
‘উচ্চমাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট কর- ব্যস
আর কোন চিন্তা নেই
জীবন চলবে গড়গড়িয়ে…’
এখন বুঝি-
উফ, কত বড় মিথ্যা
ফারুক অবশ্য বলে-
কিছু কথা মিথ্যে হয় না
শুধু মিথ্ হয়ে থেকে যায়…
(ফারুক-আমি-ফারুক)
ফারুক আসলে একটি আঘাত, একটি ঝাপটা একটি চাপড় যা মেরুদন্ড হয়ে এলে আবার শির উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায় কিংবা ভেতরের পচনকে এক খাবলায় তুলে নিয়ে আঘাত মারে। মানুষ যখন নিজেরেই তৈরি করা কদর্য বৃত্তে আটকে যায় তখন সেই ফাঁস থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে না আর কোনোভাবেই এইসময় প্রয়োজন হয় আকস্মিক ধাক্কার। কিন্তু দেবে কে? ফারুক হল সেই ইন্ধন যা ছাইচাপা আগুনকে আবার বের করে নিয়ে আসে, তীব্র ধিক্কারে ভেঙে দেয় হঠকারিতা আর বুজরুকি শ্লেষের বিষে জ্বালিয়ে দেয় সুখী দেমাক-
প্রতি সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে
এক জীবন্ত লাশ
দুর্গন্ধ ছড়ানোর আগেই
ফারুক ল্যাভেন্ডার স্প্রে করে
আরেকটু রাত নামলে
ঠান্ডা জলে গা-হাত-পা ধুয়ে দেয়
পাউডার মাখায়…
খুব যত্ন নিয়ে তৈরি করে
পরেরদিন আবার লাশ হওয়ার জন্য…
(ফারুক-আমি-ফারুক)
আবার কবি তাঁর ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, ইচ্ছে যা অবদমিত, ফুটিয়ে তোলেন অদ্ভুত রহস্যমোড়া রূপকে-
শেষ পর্যন্ত
শার্লক হোম্স্কেই ডাকা হচ্ছে
ফারুক শুনল না,
বলেছিলাম ফেলুদাকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে,
(ফেলু মিত্তিরের বয়স অবশ্য পঁয়ত্রিশেই আটকে আছে
আর বক্সীবাবু ছেলের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত)
সামনের মাসেই আসছেন, সঙ্গে
ওয়াটসন সাহেব আসবেন কিনা এখনও চূড়ান্ত হয়নি
আর এয়ারপোর্টে কড়াকড়ির জন্য
কোকেন আনছেন না,
ফারুক ওনার জন্য
বীরভূমের এক গ্রাম থেকে
আফিম জোগাড় করেছে,
যত্ন করে তালা দিয়ে বাক্সে তুলে রেখেছে
কোন তদন্তে মিস্টার হোম্স্ আসছেন-
এ-বিষয়ে ফারুক মুখে কুলুপ এঁটেছে
তবে বলে রেখেছে-
উনি এলে কিছুটা তালিম ও নেবে
ওর বহু দিনের শখ…
(ফারুক-আমি-ফারুক)
বারুদ, বন্দু্ক, বোমা, প্রতিকার, বিপ্লবের নামে আঁতকে ওঠা বাঙালিকে, নিজের হাল বৃত্তের ভেতর আটকে থাকে বাঙালিকে,- অপরের উন্নতিতে কাতর বাঙালিকে অন্তরের গভীর থেকে একটি ধাক্কার তরঙ্গ তুলতে চেয়েছে ফারুক। এই ফারুক কবিরই আরেক রূপ। হয়তো কাব্যের প্রথম অংশটির নাম তাই ‘ফারুক-আমি-ফারুক’। দিশেহারা, দ্বিধাগ্রস্ত মানুষকে দিতে চায় প্রকৃত বাঁচার আস্বাদ। চকচকে জৌলুষময় ধাতুকে যারা সোনা বলে ভুল করে এসেছে এতকাল সেই ঠুনকো বাহারের ক্ষয়িষ্ণুতা দিয়েই তাকে যাচাই করিয়ে নিতে চাই ফারুক। ফারুক তাই আসলে আমাদের অন্তরের সত্য।
কাব্যের দ্বিতীয় অংশ ‘কতদিন মিছিলে হাঁটিনি তিলোত্তমা’। এখানে কবির দ্বিতীয় সত্বা অনুপস্থিত। বরং যে সংকট আগে ছিল তার অনেকটাই কবি জয় করে ফেলেছেন। এখন তিনি অনেক স্থির, জীবনের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন। এই পরিণতিই তাঁকে লিখিয়ে নেয়-
………
বেলা গড়িয়ে যায় দু’পহরে
পালিয়ে যাই, ফুসফুস লাফায়
ছটফট করি…
পালান বাগদি’রা কড়া নেড়ে নেড়ে ফিরে যায়…
সন্ধে বেলায় হিসেবে বসি-
কত হল খরচ, কত জমা…
কতদিন মিছিলে হাঁটিনি তিলোত্তমা…
(কতদিন মিছিলে হাঁটিনি তিলোত্তমা)
এখানে কবি প্রতিবাদের রোমান্টিক সত্ত্বার দিকে নজর ফেরান। অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করলে কোনকিছুই সফলতা পায় না। বরং চাই ধৈর্য। নিজেদের দূর্বলতাগুলিকে নিজেদেরই আবিষ্কার করতে হবে। এই রুদ্ধশ্বাস সময়ে দরকার খুব ধীর হয়ে থাকার সমস্ত অবিন্যস্ত বাড় ছেঁটে ফেলে নিজেকে আরো নিভৃত ও গভীর করে তোলা, আর চাই তীব্র এক তেজের জন্য আরাধনা-
ঝড় তোল, একটা ঝড়
মৃদুমন্দ নয়, জোর একটা
ঝড়, কাঁপিয়ে দিক
গ্রাম, গঞ্জ, শহর
একটা জোরে ঝড় উঠুক
উড়িয়ে নিয়ে যাক সব গ্লানি,
দিন দিন সঞ্চিত অসুখ,
আর অন্যায় চোখ রাঙানি।
(-ঝড়)
প্রথম অংশে কবি অনেক বেশি অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জর, দ্বিতীয় অংশে অনেক বেশি ঝলসে ওঠার আবেগে মননশীল। আত্মাকে খনন করে তিনি উপনীত হয়েছেন এই সত্যে- ‘কতদিন মিছিলে হাঁটিনি তিলোত্তমা’। কবি লিখছেন-
আমার মস্তিষ্ক জুড়ে
ছড়িয়ে ছিল উদ্দাম রোদ্দুরের সংকেত
সেই বার্তা
ধমনীরা পৌঁছে দিল
কোষেদের ঘরে ঘরে
কোষেরা বড় মৌলবাদী
সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন
শুনতেই চায় না
এখন রোদ্দুরদের যেতে হবে
অন্য কোন গাঁয়ের খোঁজে…
(উদ্বাস্তু)
তাই প্রয়োজন আত্মার বিকাশ, চৈতন্যের বিবর্তন। বাইরের সমস্ত প্রতাপকে চিনে নিয়ে তার মোকাবিলায় অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন। তাই ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছেন সত্যকে প্রতিস্থাপনের জন্য-
অনেক অনেক লিড নিয়ে
এগিয়ে রয়েছ,
তাই এখন স্ট্র্যাটেজি নিতে হবে
অনেক ভেবে।
এখন চুপচাপ রয়েছি,
মেপে নিচ্ছি
জল-স্থল-আকাশের
ঠিকঠাক অনুপাত,
তারপর মোক্ষম সময়ে
পড়বে আমার দান…
(পিশাচদের প্রতি)
তেজ ও স্বপ্নের উপাসনায় এই অংশটি আরো জীবন্ত ও দীপ্ত হয়ে উঠেছে।