
ইতিহাস ও কবিতা
ওক্তাবিও পাস
ভূমিকা ও অনুবাদ – অনুপ সেনগুপ্ত
"মানুষ ও ইতিহাসের সম্পর্ক একরকম দাসত্ব আর মুখাপেক্ষিতার। কারণ আমরা যেমন ইতিহাসের একমাত্র মুখ্য চরিত্র, একইসঙ্গে তেমন তার কাঁচামাল ও তার জন্যে বলিপ্রদত্ত – আমাদেরই মূল্যেই তার একমাত্র সিদ্ধি। এই সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটায় কবিতা। কবিতা শুধুমাত্র তার সিদ্ধি খুঁজে পেতে পারে ইতিহাসের মূল্যে। কবিতার সকল সম্ভূতি – নায়ক, হন্তারক, প্রেমিক, রূপক, পাথুরে লিপির টুকরো, ধুয়া, শপথ, খেলার সময় শিশুর ঠোঁটে ছুঁয়ে যায় যে অনভিপ্রায়িক বিস্ময়, দাগি অপরাধী, কোনও মেয়ের প্রথম সহবাস, বাতাসে ভেসে বেড়ায় যেসব বাগধারা, আর্তনাদের টুকরো – এই সবকিছুই, তার সঙ্গে অপ্রচলিত শব্দপ্রকরণ, নতুন নতুন শব্দ, উক্তি – কখনও মুমূর্ষতায় আত্মসমর্পণ করে না, কোণঠাসা অবস্থায়, ঘাতপ্রতিঘাতে ভেঙে পড়ে না। "
১৯৪৮-৪৯ সাল নাগাদ UNESCO-র তৎকালীন ডিরেক্টর ও মেহিকান লেখক ও কবি খাইমে তোড়েস বোদেৎ ঠিক করলেন ষোড়শ শতক থেকে সমসাময়িক যুগ পর্যন্ত মেহিকোর কবিতার একটি সংকলন তৈরি করে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হবে। UNESCO-র সঙ্গে এই প্রকল্পের ব্যয়ভারবহনকারী সংস্থা ছিল OAS (অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস)। ওক্তাবিও পাসকে এই সংকলনের দায়িত্ব দিলেন বোদেৎ। UNESCO চেয়েছিল সেইসময় মেহিকোর জীবিত কবিদের মধ্যে আলফোন্সো রেইয়েসের সঙ্গে পাসের কবিতাও থাকুক এই সংকলনে। পাস প্রথমেই নিজেকে বাদ দিলেন এই যুক্তিতে যে তাহলে তাঁর প্রিয় জীবিত কবি সাবিয়ের বিয়েউড়ুতিয়া এবং হোসে গোরোস্তিসার কবিতাও রাখতে হয়। ১৫২১ (স্পেনের মেহিকো বিজয়) থেকে ১৯১০ (মেহিকো বিপ্লবের প্রারম্ভ) পর্যন্ত প্রায় চারশো বছরে চৌত্রিশজন কবির কবিতা বেছে নিলেন পাস। জীবিত কবি বলতে রইলেন একমাত্র আলফোন্সো রেইয়েস। পাস ফরাসি অনুবাদের দায়িত্ব দিলেন কবি ও অনুবাদক গি লেভি মানোকে। আর ইংরেজি অনুবাদের জন্যে UNESCO-র পক্ষ থেকে স্যামুয়েল বেকেটের নাম প্রস্তাব করা হল। পাস বা বেকেট কেউই তখন বিখ্যাত হননি। দুজনেই তখন প্যারিসে। ১৯৪৯-এ দেখা হল উত্তরকালের দুই নোবেল লরিয়েটের। বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গোদো’-র মতো নাটক তখন একের পর এক প্রযোজক ফিরিয়ে দিচ্ছেন, উপন্যাস ‘মলয়’-র জন্যেও কোনও প্রকাশক পাচ্ছেন না। তাই স্প্যানিশ না জেনেও ডিকশনারি ও স্প্যানিশভাষী এক বন্ধুর ভরসায় বেকেট এই দুঃসাহসিক অভিযানে রাজি হলেন শুধুমাত্র টাকার প্রয়োজনে। পরবর্তীকালে এলিয়ট ওয়েনবার্গারকে বেকেট বলেছিলেন, এই অনুবাদ করার সময় তাঁর মনে হচ্ছিল যেন কোনও ঘৃণ্য কাজ করছেন। বেকেটীয় স্পর্শে অনুবাদগুলো কিন্তু ভালোই উতরে গেল। ১৯৫৮-তে ‘Mexican Poetry – An Anthology’ – এই নামে সংকলনটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংকলনের জন্যে UNESCO পাসকে মেহিকোর কবিতার ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণামূলক লেখার কথা বলেছিল। তারই ফলশ্রুতি পাসের ‘Introduction to the History of Mexican Poetry’ প্রবন্ধ (মূল স্প্যানিশ থেকে যেটিরও অনুবাদ করেছিলেন বেকেট)। এখানে বাংলা অনুবাদের জন্যে অবশ্য সেই প্রবন্ধের শেষাংশই বেছে নেওয়া হয়েছে, কারণ তা আর কেবল একটি দেশের কবিতার আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সার্বিকভাবে কবিতা, ভাষা, সমাজ ও ইতিহাসের প্রবাহ সেখানে এসে মিশেছে।
সব কাব্যকারিত্বই ইতিহাস থেকে পুষ্টিসাধন করে, বলতে গেলে, ভাষা থেকে, প্রেরণা থেকে, পুরাণকল্প ও সমকালের ভাবপ্রতিমা থেকে নিজের প্রাণশক্তির রসদ সংগ্রহ করে এবং একইভাবে কবি যে ঐতিহাসিক ক্রমাগ্রসরণকে স্রেফ আত্মগত করতে বা তা পেরিয়ে যেতে চালিত হন – তা নিশ্চিত করে। কবিতার হিতের জন্যে প্রতিটি কাব্যকৃতিই হচ্ছে ইতিহাস ও কবিতার মধ্যে মিলনসাধনের প্রচেষ্টা। ইতিহাসের স্বৈরতন্ত্রকে কীভাবে পরিহার করা যায়, কবি সর্বদা তার খোঁজ করেন, এমনকি যে সমাজে তাঁকে বাস করতে হয়, তার সঙ্গে যখন একাত্মবোধ করেন – এমনকি ‘যুগের গতি’ বলতে যা বোঝায়, তাতে তিনি যখন অংশ নেন। এই চরম অবস্থা অবশ্য আধুনিক বিশ্বে ক্রমশ আরও কম কল্পনীয় হয়ে উঠেছে। কবিতার সব মহান পরীক্ষাই – তা সে যাদুমন্ত্র হোক বা মহাকাব্য, কিংবা হোক স্বয়ংক্রিয় লিখন – রান্নার কড়াইয়ের মতো হতে চায় কবিতা, যেখানে মিলেমিশে যায় ইতিহাস ও কাব্য, ঘটনা ও পুরাণকল্প, কথ্যভাষারীতি ও বাকপ্রতিমা, মিশে যায় সেই তারিখ যা আর কখনও ফিরে আসে না, মিশে যায় সেই উৎসবমুখরতা যেখানে প্রাণময়ী দিন গোপন উর্বরতার অধিকারিণী হয়ে কখনও ফিরে আসে নতুন যুগের সূচনা করতে। কবিতার প্রকৃতি সেই উৎসবের সঙ্গে তুলনীয়, দেওয়ালপঞ্জির একটা তারিখ হয়েও যা সময়ের ক্রমপরম্পরা ভেঙে বর্তমানের অভ্যুত্থান ঘটায় – যে বর্তমান পর্যায়কালিকভাবে ফিরে ফিরে আসে গতকাল বা আগামীকাল ছাড়াই। প্রতিটি কবিতাই উৎসব – বিশুদ্ধ সময়ের ঘনীভূত রূপ।
মানুষ ও ইতিহাসের সম্পর্ক একরকম দাসত্ব আর মুখাপেক্ষিতার। কারণ আমরা যেমন ইতিহাসের একমাত্র মুখ্য চরিত্র, একইসঙ্গে তেমন তার কাঁচামাল ও তার জন্যে বলিপ্রদত্ত – আমাদেরই মূল্যেই তার একমাত্র সিদ্ধি। এই সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটায় কবিতা। কবিতা শুধুমাত্র তার সিদ্ধি খুঁজে পেতে পারে ইতিহাসের মূল্যে। কবিতার সকল সম্ভূতি – নায়ক, হন্তারক, প্রেমিক, রূপক, পাথুরে লিপির টুকরো, ধুয়া, শপথ, খেলার সময় শিশুর ঠোঁটে ছুঁয়ে যায় যে অনভিপ্রায়িক বিস্ময়, দাগি অপরাধী, কোনও মেয়ের প্রথম সহবাস, বাতাসে ভেসে বেড়ায় যেসব বাগধারা, আর্তনাদের টুকরো – এই সবকিছুই, তার সঙ্গে অপ্রচলিত শব্দপ্রকরণ, নতুন নতুন শব্দ, উক্তি – কখনও মুমূর্ষতায় আত্মসমর্পণ করে না, কোণঠাসা অবস্থায়, ঘাতপ্রতিঘাতে ভেঙে পড়ে না। এরা অন্তিমতা পর্যন্ত পৌঁছোতে চায়, যৎপরোনাস্তি টিকে থাকতে চায়। কার্যকারণ থেকে মুক্ত করে নিজেদের। অপেক্ষা করে সেই কবিতার জন্যে যা এদের উদ্ধার করে স্বরূপ অনুযায়ী গড়েপিটে নেবে। ইতিহাস ছাড়া কোনও কবিতা হতে পারে না, শুধু তাই নয়, ইতিহাসের রূপান্তরসাধন ছাড়া কবিতার আর কোনও ব্রত নেই। ফলত সার্থক কবিতা মাত্রই বৈপ্লবিক, আর তা প্রলয়ের আভাস দেয়।
ভাষা – ইতিহাস ও সমাজের এই নির্যাস থেকেই তৈরি হয় কবিতা। তবে যেসব বিধি আমাদের কথোপকথন, যৌক্তিক সন্দর্ভকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের পেরিয়ে কবিতা চায় ভাষার পুনর্নির্মাণ। এই কাব্যিক রূপান্তর ঘটে ভাষার অন্তরতম প্রদেশে। কোনও বিচ্ছিন্ন একক শব্দ নয়, শব্দবন্ধ বা বাক্যাংশ হচ্ছে সেই কোষ – ভাষার সরলতম উপকরণ। কোনও শব্দ অন্য শব্দদের ছাড়া বাঁচতে পারে না। কোনও শব্দবন্ধও অন্যান্য শব্দবন্ধের সঙ্গ বিনা টিকে থাকতে পারে না।
বলা যেতে পারে, প্রতিটি বাক্যেই নিহিত থাকে অন্য বাক্যের সঙ্গে আত্মীয়তা। সে অন্য বাক্যের সংস্পর্শে ব্যঞ্জিত হয়। প্রতিটি শব্দবন্ধই কিছু ‘বলার ইচ্ছে’ তৈরি করে, নিজেকে পেরিয়ে আরও বড় কিছুর সর্বাঙ্গীন প্রকাশের ইঙ্গিত দেয়। ভাষা – সচল, পরস্পর পরিবর্তনীয় সব প্রতীকের সমাহার। প্রতিটি প্রতীকই আভাস দেয় – কোন ‘অভিমুখে’ সে চলেছে। এইভাবেই দ্যোতনা ও সংজ্ঞাপন শব্দের ‘এষণীয়তা’কে নির্ভর করে। কিন্তু যে মুহূর্তে কবিতা এদের স্পর্শ করে, তখনই এরা পাল্টে যায় ছন্দোবদ্ধ এককে অথবা ভাবপ্রতিমায়। স্বনির্ভর হয়, স্বীয় যোগ্যতা অর্জন করে। আর হঠাৎ সচলতা হারিয়ে ফেলে। গদ্যে কোনও ব্যাপারকে অনেক চালে বলা যায়, কিন্তু কবিতায় শুধুমাত্র একভাবে বলা ছাড়া উপায় নেই। কবিতায় শব্দের কোনও বিকল্প থাকে না। শব্দ এখন আর কিছু বলার ইচ্ছে নয়, বরং অনিবার্যভাবে যা বলা হয়েছে। অন্যভাবে বললে শব্দ আর এখন কোনও কিছুর ‘অভিমুখে চালিত’ হয় না। এটা-সেটা সম্পর্কে বলার জন্যেও না। কবি কখনোই ভয় বা ভালোবাসার কথা বলেন না: তিনি তাদের প্রত্যক্ষ করান। কবিতার শব্দ অনিবার্য, অপূরণীয়। শুধু নিজেদের আন্তঃসম্পর্ক ছাড়া তারা ব্যাখ্যাতীত। শব্দের ব্যঞ্জনা এখন আর উপচে পড়ে না, বরং নিজের অন্তঃস্থ হয়ে থাকে। ভাবপ্রতিমার লীলা আবার সেই ব্যঞ্জনার মধ্যে।
যে-সব বাস্তবতাকে পরস্পরবিরোধী ও অপরিবর্তনীয় মনে হয় তাদের একসুতোয় গাঁথাই কবিতার ভাবপ্রতিমার মূল কাজ এবং এরা যে বিবাদ, বিরোধিতাকে জাগিয়ে তোলে বা পুনর্সৃষ্টি করে, তা না হটিয়ে বা জলাঞ্জলি না দিয়েই এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। এই কারণে কবিতার ভাবপ্রতিমা যথার্থতই ব্যাখ্যাতীত। এখন কবিতার ভাষা কিছুটা সেই দ্ব্যর্থকতা পান করে যার সাহচর্যে বাস্তবতাও নিজেকে আমাদের কাছে পরিস্ফুট করে। ভাষার রূপান্তরসাদন করতে গিয়ে ভাবপ্রতিমা বাস্তবতায় পৌঁছোনোর দরজাই শুধু খোলে না, তা যেন বাস্তবতাকে নগ্ন করে তার চূড়ান্ত সংহতি প্রকাশ করে। প্রতিটা শব্দবন্ধ হয়ে ওঠে এক-একটা ভাবপ্রতিমা। কবিতাটি হয়ে ওঠে একটাই ভাবপ্রতিমা কিংবা ভাবপ্রতিমার অবিচ্ছেদ্য নক্ষত্রমালা। তথাকথিত বাস্তবতা মিলিয়ে গেলে যে শূন্যতা রেখে যায়, তা ভরে ওঠে বিষম, পরস্পরবিরোধী সব অবলোকনের ভিড়ে যারা অনিবার্যভাবে নিজেদের বিভেদ মিটিয়ে ইশারার সৌরজগতে রূপান্তরিত হতে চায়। কবিতা: সেই আবছায়া, অপভ্রষ্ট শব্দমালার মহাবিশ্ব যেখানে শব্দরা আলোকিত করতে পারে বা জ্বলে ওঠে যখনই কোনও ঠোঁট এসে তাদের ছোঁয়। কখনও কখনও কোনও কোনও বক্তার মুখে, সেই শব্দবন্ধ বা বাক্যাংশের কারখানা হয়ে ওঠে স্পষ্ট সত্যের উৎস যার আর প্রতিপাদিত হওয়ার দরকার নেই। তখন আমরা সময়ের পূর্ণতার মধ্যে প্রবাহিত হই। ভাষাকে চূড়ান্তভাবে কাজে লাগিয়ে কবি তাকেও পেরিয়ে যান। ইতিহাসকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কবি তাকে অনাবৃত করেন এবং দেখান কীসের জন্যে এর বর্তমানতা। সময় নাম তার।
যখন ইতিহাস আমাদের সন্দেহ করতে অমুমতি দেয় যে সে অর্থহীন বা অনিঃশেষ ভূতুড়ে মিছিলের বেশি কিছু নয়, তখন ভাষার অস্পষ্টতা ক্রমশ আরও চিহ্নিত হয়ে ওঠে এবং যে-কোনও প্রকৃত দ্বিরালাপে বাধা দেয়। শব্দরা ব্যঞ্জনা হারিয়ে ফেলে, আর তার ফলে হারিয়ে যায় তাদের সংজ্ঞাপনের ক্ষমতাও। নিছক ঘটনা-পরম্পরায় ইতিহাসের অবনমনে ভাষারও অবনমন ঘটে। প্রাণহীন কিছু প্রতীকের সংকলন হয়ে ওঠে ভাষা। মানুষ একই সব ব্যবহার করে, অথচ কেউ কাউকে বুঝতে পারে না। শব্দার্থের সহমতে পৌঁছোনো মানুষের নিষ্ফল প্রচেষ্টা। ভাষা কোনও প্রথা বা রেওয়াজ নয়, বরং সেই পরিসর বা মাত্রা যেখান থেকে মানুষ আর নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। প্রতিটি বাচনিক অভিযানই তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ; একটা শব্দকে ঘিরে সেখানে কোনও মানুষ তার ব্যক্তিসত্তা ও জীবনের সর্বস্ব পণ করে। কবি হচ্ছেন সেই মানুষ – প্রকৃত সত্তা যাঁর শব্দরাজির সঙ্গে এক হয়ে ওঠে। তাই একমাত্র কবিই নতুন দ্বিরালাপ সাধন করতে পারেন। বিশেষত আমাদের মতন কোনও যুগে যখন কবির নিয়তি – ‘donner un sens plus pur aux mots de la tribu.’ (‘জনগোষ্ঠীর শব্দরাজিকে বিশুদ্ধতর দ্যোতনা প্রদান’)।১ তার মানে সাধারণ ভাষা থেকে শব্দদের উপড়ে এনে কবিতায় তাদের নবজন্ম দেওয়া। এই পরিস্থিতি থেকেই উন্মেষিত হয় যাকে বলে আধুনিক কবিতার মন্ত্রগুপ্তি। কিন্তু মানুষ আর তার শব্দরাজি অবিচ্ছেদ্য। ফলে কবির বাইরে কবিতা যে মায়াবী সামগ্রী মেলে দেয়, কাব্যকারিত্ব সেখানে নিষ্পন্ন হয় না, বরং তা মানুষটিকেই আঁকড়ে ধরে নিজের অনুভবের কেন্দ্র হিসেবে। বৈপরীত্যগুলো শুধু কবিতাতেই নয়, মানুষের ভিতরেও মিশে একাকার হয়ে যায়। কবি ও কবিতা – এই দুইকে তখন আলাদা করা যায় না। র্যাঁবোর কবিতা আর র্যাঁবো নিজে তখন অবিচ্ছেদ্য। তাঁকে একরকম নিষ্ঠুর হিসেবে প্রতিপন্ন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর কবিতা নওল কিশোরের সেই অসিচালনা, যেখানে অবিশ্বাস ও দ্রোহের দ্যুতির ঝলকানি দেখা যায়। না, কবি আর তার উচ্চারণ অভিন্ন, এক। বিগত একশো বছর ধরে আমাদের সভ্যতার মহান কবিদের মূলমন্ত্রই তা-ই। পরাবাস্তবতার মতো শতাব্দীর শেষ বড় আন্দোলনের তাৎপর্যও এর থেকে আলাদা কিছু নয়। এমন কোনও স্বনামধন্য কবি নেই, এইসব প্রচেষ্টার মহিমায় যিনি অনাসক্ত থাকতে পারেন। এবং এই মহিমা শেষ অবধি থেকে যায় কবিদের ওইসব প্রচেষ্টার বিধ্বংসী উদ্যমের মধ্যে, দুঃসাহসে, থেকে যায় সেই দ্বৈততায় যা আমাদেরও দ্বিধাকৃত করে। কবিতা অচেনায়, অজানায় লাফ দেয়, নইলে সে কিছু নয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কবিতার পক্ষে বেহিসেবি দাবির কথা তোলা নির্বুদ্ধিতা। ইতিহাসের আধিপত্য আজকের মতো কখনও এতটা কায়েম হয়নি, ঘটনাবলীর চাপও ছিল না কখনও এতটা শ্বাসরোধকারী। ‘এরপর কী করতে হবে’ – এই অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশ আরও অসহ্য হয়ে উঠেছে, কাজটি করার জন্যে যেখানে আমাদের সম্মতির প্রয়োজন পড়ে না, আর যেহেতু তা মানুষকে সর্বনাশের পথে আর একটু এগিয়ে দেয় – তাই আরও গোপন, আরও বিচ্ছিন্ন, আরও বিরল হয়ে ওঠে কাব্যিক সক্রিয়তা। সমাজের প্রকাশ্য দ্বৈত ভূমিকায় তার অনুশাসন মেনে নিলে গতকাল একটা কবিতা লেখা বা প্রেমে পড়া ছিল যথেষ্ট বিধ্বংসী কাজ। আজ এইরকম ধ্যানধারণা বাতিল হয়েছে আর তার জায়গা নিয়েছে কতিপয় প্রতিপত্তিশীল শক্তি, জনতা আর প্রতিরোধের সমাহার। বাস্তবতা তার সমস্ত ছদ্মবেশ খুলে ফেলেছে, আর দেখা যাচ্ছে, কীসের নিমিত্ত আসলে সমসাময়িক সমাজ: বিষম সব ব্যাপারকে ‘সুসমন্বিত’ করা হয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর হুকুমমাফিক অথবা প্রচারণার জোরে, একে অন্যের থেকে যাদের আলাদা করা যায় নির্দয়তার মাত্রার বিচারে। এই পরিস্থিতিতে কাব্যিক সক্রিয়তা নিজেকে লুকিয়ে রাখে। যদি কবিতা উৎসবই হয়, তবে তা হয় বেমরসুমে, নির্জনতায় – সে এক গুপ্ত উৎসব।
কিন্তু কাব্যকারিত্ব নিজেরই অতীতের সব বিধ্বংসী ক্ষমতা আবার খুঁজে নিচ্ছে এই বিশেষ গোপনতায়, যৌনতা ও অতীন্দ্রিয়তায় তা সম্পৃক্ত, স্পষ্টভাবে প্রকাশিত না হওয়ার জন্যে যে বিধিনিষেধ নিজেও কম নিন্দিত নয় তার প্রতি একরকম হুঁশিয়ারি। সর্বজনীন ভাব বিনিময়ের মুক্ত বাতাসে শ্বাসগ্রহণ করতে গতকাল যাকে দরকার পড়ত, সেই কবিতা আজও শক্তি আর সংখ্যার কুহকিনীকে আমাদের ঘাড় থেকে নামায়। বলা হয় যে, কবিতা এমন এক মাধ্যম যার সাহায্যে মানুষ সেইসব ক্ষমতার বিরুদ্ধে ‘না’ বলতে পারে, যারা আমাদের সুবিন্যস্ত জীবন কখনও চায় না, বরং শাসন করতে চায় আমাদের অন্তরাত্মাকে। কিন্তু এই নিরাকরণ নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে যায় এমন এক ‘হ্যাঁ’-কে – যা তার নিজের থেকেও বড়।
……………………………
১.‘donner un sens plus pur aux mots de la tribu.’ (‘জনগোষ্ঠীর শব্দরাজিকে বিশুদ্ধতর দ্যোতনা প্রদান’) – মালার্মের Le Tombeau d’Edgar Poe ( The Tomb of Edgar Poe) কবিতার বিখ্যাত পঙ্ক্তি।

