অনির্বাণ বসু-র তিনটি গল্প

অনির্বাণ বসু-র তিনটি গল্প

উটপাখি

ভদ্রলোক বামপন্থী। সংসদীয় পথ থেকে আলাদা তাঁর বিশ্বাস। ওঁর সব পথ শুরু এবং শেষ হয় নিজের লাইব্রেরিতে। সেখানে এক কোণে একটা টেবিল-চেয়ার। পাশে ইজিচেয়ার একটা। অধিকাংশ সময়ই ওই আরামকেদারায় আধশোওয়া হয়ে কোনও-না-কোনও বই পড়েন তিনি। তারপর রাতের খাওয়া সারতে-সারতে ওই সময়টুকু টিভি-তে খবর দেখেন। টিভি দেখে আর খবরের কাগজ পড়ে তিনি পেয়ে যান দুনিয়ার যাবতীয় খবরাখবর।
ভদ্রলোকের এক মেয়ে। শহরের নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আপাতত শিক্ষকতার পাঠ নিচ্ছে। মাঝে-মধ্যেই মেয়ে অনুযোগের সুরে জানায়, রাজ্যে চাকরি নেই, পড়া শেষ করে কী করবে ইত্যাদি-ইত্যাদি। ভদ্রলোক ফুৎকারে উড়িয়ে দেন সেসব দুর্ভাবনা, জোরের সঙ্গে জানান খবরে দেখা মুখ্যমন্ত্রীর উদাত্ত ঘোষণার কথা : দশ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের যে-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ওঁর তরফে, মাত্র এক বছরের সময়কালেই তা বাস্তব করে দিয়েছেন তিনি। মেয়েটি, এত দিনের অভিজ্ঞতায় জানে, বাবা যা বলে সেটাই ঠিক বলে মনে করে যেহেতু, চুপ করে যায়। মেয়ের দিকে না-তাকিয়ে সেই সব সময়ে হাতের সামনে খুলে রাখা বইটির পৃষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন ভদ্রলোক।
দুপুরের রান্না সেরে খাবারগুলো টেবিলের উপর ঢাকা দিয়ে কাজের মেয়েটা বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। টিভি-টা চালিয়ে দিয়ে খেতে বসেন ভদ্রলোক। সরু চালের ভাত, ঝিঙে-পোস্ত, পাবদার ঝাল। প্রমাণ মাপের মাছখানার মাথা বেরিয়ে আছে পোর্সেলিনের বাটি টপকে। ঝিঙে-পোস্ত দিয়ে ভাত মেখে মেজাজে মুখে তোলেন প্রথম গ্রাস। টিভি-র পর্দা জুড়ে একটা মিছিল দেখাচ্ছে। অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের মিছিল। নিচে লেখা : চাকরির দাবিতে মিছিল। ভদ্রলোক অবজ্ঞাসূচক মাথা নেড়ে পোস্তর দিকে মন দেন।
পোস্ত শেষ করে পাবদার দিকে হাত বাড়ান ভদ্রলোক। টিভি-র পর্দায় সঞ্চালক খবর বলে যায়। ইনসেটে দেখা যায় মিছিলের উপর পুলিশের লাঠিচার্জের চলচ্ছবি। লম্বা শিরদাঁড়া থেকে মাছ আলাদা করেন তিনি। মুখে মাছের অংশ পুরে টিভি-র দিকে তাকান। একটি মেয়েকে কয়েকজন ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় বেশি দূর পর্যন্ত চ্যানেলের ক্যামেরা পৌঁছায় না। আহত মেয়েটির কপাল থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। এলোচুলে মুখ ঢাকা। হঠাৎই মেয়েটির বাঁ হাতে নজর যায় ভদ্রলোকের। দু’টি ছোটো পাখি উড়ে যাচ্ছে; ফরসা হাতের উপর গাঢ় সবুজ রঙের উল্কি। খাবার ছেড়ে উঠে পড়েন তিনি। এঁটোহাতে রিডিংরুমে এসে নিজের মোবাইল ফোনখানা খুঁজতে থাকেন। আধখাওয়া পাবদা মাছ আঢাকা পড়ে থাকে।


প্রতিবিপ্লবী

অবশেষে রাষ্ট্র টোটালিটেরিয়ান হল। এমনটা যে হবে, হতে চলেছে অচিরে, আগে থেকেই আঁচ করেছিলেন কেউ-কেউ। আগেভাগে বুঝে ফেলেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সাহিত্যিকও ছিলেন সেদিন।
এমনই এক লেখক, বিপদের আগাম সম্ভাবনায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন আগেভাগে। নিজেকে রাষ্ট্রবিরোধী লেখক বলে থাকেন তিনি; বলে এক অনির্বচনীয় শ্লাঘা বোধ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর সব লেখাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
রাষ্ট্র অতঃপর সর্বগ্রাসী হল। একে-একে পুড়িয়ে ফেলা হল সব গান, সব গল্প। কোনও সাহিত্যিকই বাদ গেলেন না, প্রত্যেকের লেখা ছাই হয়ে গেল রাষ্ট্রের নির্দেশে। শুধু এই পালিয়ে-যাওয়া লেখকের কোনও লেখায় আগুন দিল না রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী।
লেখকের কানে পৌঁছল সেই সংবাদ। লেখক ফিরে এলেন দেশে। রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি লিখে জানালেন, তাঁর লেখা রাষ্ট্রবিরোধী; অতএব পুড়িয়ে দেওয়া হোক সেইসব। তাতেও কাজ না-হওয়ায় হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের বাড়ির সামনে গিয়ে বসলেন লেখক। খানিক পরে দেখলেন, তাঁকে তুলে দিচ্ছে না কেউ, ভরে দিচ্ছে না জেলে, চড়িয়ে দিচ্ছে না শূলে।
হতাশ হয়ে লেখক ফিরে এলেন নিজস্ব আস্তানায়। লিখতে বসলেন নতুন করে।
তারপর থেকে একটা করে কবিতা শেষ হয়, গল্প শেষ হয়, নাটক শেষ হয়, প্রবন্ধ শেষ হয়, এমন-কি উপন্যাসও আর লেখক চিৎকার করে ওঠেন উল্লাসে : আমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আমার লেখা রাষ্ট্রবিরোধী।

(বের্টোল্ট ব্রেখ্‌ট্‌-কে মনে রেখে)


মুদ্রারাক্ষস

সেই তখন গ্রামে ইয়াব্বড়ো একটা গাছ ছিল। গাছ বলেই সে নড়াচড়া করত না মোটে। শুধু হাওয়া দিলে, তার তাল আর ছন্দে দুলে উঠে জানান দিত নিজের অস্তিত্ব। গাছটার সামনেটায় ছিল একটা কোটর। কোটরের মুখের চারপাশটা ছাল-বাকল জুড়ে অদ্ভুত একটা আদল নিয়েছিল। হঠাৎ করে কেউ দেখলেই চমকে যেত। দেখলেই মনে হত, একটা থুত্থুরে বুড়ি বুঝি তার লোলচর্মসার মুখ নিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসছে। সেই কোটরের শুরু দেখা যেত, শেষের তল মিলত না। কোথায় কোন অন্ধকারের অতলে গিয়ে মিশেছে সেই পথ, জানত না কেউ।
গ্রামে প্রায়ই ডাকাত পড়ত। মশাল জ্বেলে হইহই করে আসত আর লুঠে নিয়ে যেত গৃহস্থের সবটুকু সঞ্চয়; টাকাকড়ি, সোনাদানা—এই সব। ঘরের ভিতর লুকিয়ে রাখার যো নেই : ডাকাতে রক্ষে নেই, সিঁধেল চোর দোসর! অথচ সম্পত্তি যতটুকু যা বাঁচানো গেছে এবং আগামী দিনগুলোতে আরও যতখানি সাশ্রয় করতে পারবে, সেই সবটুকুকে তো বাঁচাতে হবে লুঠ হওয়ার থেকে; ফলে গ্রামপ্রধান একটানা তিন দিন ধরে অনেক ভেবে-চিন্তে ফয়সালায় পৌঁছলেন : গ্রামের সবাই নিজেদের সব সম্পত্তি লুকিয়ে রাখবে বড়োগাছের বুড়িমুখো কোটরে। প্রধানের কথামতো কাজ করল গ্রামবাসীরা।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল নির্বিঘ্নে। মাঝে কয়েকবার ডাকাতদল ডাকাতি করতে এসে কিছুই না-পেয়ে লোকজনকে মারধোর করে ফিরে গেল যে-পথে এসেছিল, সে-পথেই। চোরেরাও হতোদ্যম হয়ে বোধহয় অন্য গ্রামের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছিল ততদিনে। তবু, আরও নিশ্চিন্ত হতে গ্রামপ্রধান দু’জন পাহারাদার বসালেন গাছটার কাছে।
দিন কেটে যায়, মাস ঘোরে, নতুন বছর আসে। বুড়িমুখো কোটরকে এখন হাঁ-মুখ কোনও বৃদ্ধ রাক্ষসের মতো ঠেকে। অবসরে তাকে ঘিরে-থাকা দুই পাহারাদার আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে।
একদিন বৃষ্টি নামল মুষলধারে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। জল বাড়তে-বাড়তে ঢুকে গেল ঘরের উঠোনে, দালানে। গোটা রাত জুড়ে সেই প্রবল বৃষ্টি আর সচকিত বিদ্যুৎ ভয়ার্ত করে রাখল সকল গ্রামবাসীকে। পরদিন সকালের দিকে থেমে গেল সব ঝঞ্ঝা। ধীরে-ধীরে জল শুষে নিল মাটি। মানুষ বেরিয়ে এল বাইরে। দূরে পড়ে আছে গাছখানা। গতরাতের ভয় আচমকা উধাও; নিজেদের সম্পদের জন্য তখন সবাই একছুটে গাছের কাছে।
গাছের কোটর থেকে মাটির ভিতর পর্যন্ত কোথাও কিচ্ছু নেই। উলটে একটা অগভীর কিন্তু প্রশস্ত সুড়ঙ্গ চলে গেছে সোজা প্রধানের বাড়ির দিকে। সবাই মিলে এবার প্রধানের বাড়ি। ফটক হাঁ করে খোলা, সেখানেও আর কেউ অপেক্ষায় নেই তখন।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (3)
  • comment-avatar
    Gouranga Sribal 5 years

    তিনটি গল্পই পড়লাম। রূপক ও প্রতীকের ব‍্যাঞ্জনায় গল্পগুলি এইসময়ের। প্রতিটি গল্পের মাধ্যমে বতর্মান রাজ‍্য ও কেন্দ্র সরকারের কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। প্রথম গল্প ‘উটপাখি’তে দেখানো হয়েছে কয়েক মাস আগে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। রাজ‍্যসরকারের বিরুদ্ধে বেকার শিক্ষিত যুবকযুবতীদের কর্মসংস্থানের দাবিতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল। এতে পুলিশের লাঠিচার্জ। জখম আহত ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে নামকরণ বুঝতে এ পাঠকের একটু ব্যক্তিগত সমস্যা ঠেকছে। এবং ভদ্রলোকের মেয়েটি কীভাবে কখন মিছিলে যোগ দিল সে ব‍্যাপারটা লেখক প্রচ্ছন্নভাবেও বলেননি। দ্বিতীয় গল্প ‘প্রতিবিপ্লবী’তে দেখি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লিখেও একজন লেখক বেঁচে যান। ভয়ে দেশছাড়া হলেও পরে দেশে ফিরে দেখেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আসলে সরকার এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছে যে প্রকৃত সরকারের দীর্ঘস্থায়ীত্ব চায়। সরকার তার বিরোধিতার কারণগুলি খতিয়ে দেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চায়। তৃতীয় গল্প ‘মুদ্ররাক্ষস’ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের ব‍্যাঙ্কিং নীতির বিরুদ্ধে। চোরের ভয়ে সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রপ্রধানের কথায় ব‍্যাঙ্কে টাকা রাখে। সাধারণ মানুষ তাদের বিপদের সময় সে টাকা পায় না। দেখা যায় রক্ষকই ভক্ষক হয়ে সে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের যে কষ্ট সেই কষ্ট থেকে যায়। তিনটি গল্পই খুবই ভালো।

  • comment-avatar
    শীর্ষা 5 years

    ভালো লাগল তিনটি গল্পই। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বড়ো বাস্তব!

  • comment-avatar

    চমৎকার দাদা! খুব ভালো লেগেছে

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes