অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br />  একাদশ পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
একাদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের একাদশ পর্ব।

পূর্ব প্রকাশিতর পর

১১

তমোনাশ নিয়োগী, যাকে সবাই টম বলে ডাকত, তিনতলার অ্যাকাউন্টসে বসত। প্রথম জয়েনিং-র দিন থেকে টানা এক সপ্তা ওদের নিচের রিসেপশনে বসিয়ে রেখেছিল। দক্ষিণী ছবির ভিলেনের মতো চেহারা টমের। বিদিশাদের মফস্বলে সিপিএমের এক মাসলম্যানের নামও ছিল টম, যে তার বাবাকে একবার ট্রেন থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছিল। কারণ বাবা লোকাল কমিটি মানে এল সি-র সর্বগ্রাসী ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।আশির দশকে বিদিশারা যখন ফাইভ সিক্সে পড়ে, তখনি এই এল সি-র সর্বময় ক্ষমতা টের পায়। কারো ভাড়াটে তুলতে, কারো ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা করতে, এমনকি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যেও এল সি ঢুকে পড়তে শুরু করে। বিদিশাদের একতলার ভাড়াটে তুলতেও সেই এল সির শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। অবশ্য বাবা সেসময় মজফরপুরে থাকত, ওদের লোকাল গার্জেন ছিল গোবিন্দকাকু, সেই কাকু উপায়ান্তর না দেখে এল সিকে ডাকতে বাধ্য হয়। আসলে যাকে তুলতে হবে, সে এক মহাপুরুষ গোত্রের লোক। ভদ্র কথায় তার সঙ্গে পারা সম্ভব নয়। অথচ যখন সে এসেছিল, সবাই রীতিমতো মুগ্ধ। মুগ্ধ হবার মতোই চেহারা। টকটকে গায়ের রঙ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কট্টর বামপন্থী বলে নিজেকে আর অসাধারণ গান গায়। বিশেষত মান্না দের সেমি ক্লাসিকাল গানগুলো। আর জেসু দাসের ওই গানটা, চিতচোর ছবির, যব দীপ জ্বলে আনা, ওর মুখেই প্রথম শোনা, আজো কানে বাজে সেই গান। ফলে প্রবাল মজুমদার ঢুকে পড়ল একেবারে বাড়ির অন্দরে। মার সঙ্গে গানের সখ্য গড়ে উঠতে সময় লাগল না। তখন প্রবাল মজুমদার প্রতি মাসে ভাড়া দ্যায় কিনা কে খেয়াল রাখে। তারপর তার বিয়ে হল এ বাড়িতে থেকেই, মাদারহাটের একটি মেয়ে চাঁপার সঙ্গে। চাঁপাদের ঝান্ডা ওঁচানো বাড়ি।পার্টির মিছিল, মিটিং-এ যারা প্রচুর লোক জড়ো করতে পারঙ্গম, দাস ক্যাপিটালের নাম শোনা তো দূরের কথা, ক্লাস ফোর অব্দিও পৌঁছয়নি। চাঁপার বাপের অকাল মৃত্যুর পর, শুধু বাড়ির নয়, সারা পাড়ার অঘোষিত নেত্রী হয়ে উঠেছিল চাঁপার মা, কাগজকলমে তার নাম বাসনাবালা দাসী।চিৎকার করার ক্ষমতা তো বটেই, দরকার পড়লে হাত চালাতেও আটকাত না বাসনাবালার। পাড়ায় পাড়ায় এরকম মানুষজন দরকার পড়ছিল পার্টির। সেই বাসনাবালার মেয়ে চাঁপার হঠাৎ শখ হল সে গান শিখবে। সেই সুবাদে প্রবাল মজুমদার ও বাড়িতে ঢুকল। বাসনাবালার বিঘের পর বিঘে পান বরজ, পেয়ারাবাগানের লেখাজোখা নেই, প্রবাল মজুমদার গজল শুনিয়ে চাঁপাকে গেঁথে ফেলল। বাসনাবালা দেখল তার মেয়ের তুলনায় রাজপুত্তুর পাত্র আপনা থেকেই দোরগোড়ায় এসে হাজির।এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ফলে চাঁপার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল কন্দর্পকান্তি প্রবালের। বিয়ে, বউভাত সবেতেই পাত্রপক্ষ বিদিশারা। তাই উপহারে তো সোনার দুল দিতেই হয়। চাঁপা নতুন বৌ, রান্না জানে না, তাই বিদিশার মা দুজনকেই চারবেলা রেঁধেবেড়ে খাওয়ায়, মাঝে মাঝে গানের আসরও বসে, কিন্তু আগের মতো আর জমে ওঠে না। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। চাঁপা আর প্রবাল দুজনেরই আচার আচরণে উদ্ধত ভাব ফুটে ওঠে, একদিন রান্না নিয়ে বাঁকা কথা শোনায় প্রবাল, বিদিশার মা থাকতে না পেরে বলে ওঠে ‘এবার থেকে নিজেরাই রান্না করে নিও। বিয়ে করেছ যখন, সংসারী হও। আর ছ মাসের তো বাড়িভাড়া বাকি পড়ে আছে।’
এই কথায় প্রবাল মজুমদার প্রবল রেগে গেলেও নিজের ইন্টেলেকচুয়াল ভাবমূর্তির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কিছু সূক্ষ শ্লেষাত্মক কথা বলেছিল মাত্র, কিন্তু চাঁপা, সে তো বাসনাবালার মেয়ে, তার খোলা নর্দমার মতো মুখ বেরিয়ে এল নিমেষেই। কথায় কথায় চিৎকার, নোংরা গালাগালি, পাড়ার ছেলেদের এনে হুমকি-এসব চলতে লাগল। বিদিশা আর ওর দাদাকে নিয়ে মা তখন দোতলায় থাকে। বাবা মজফরপুরে। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে নিচে নামাটাই একটা আতংকের ব্যাপার হয়ে গেল। দুবেলা চাঁপার সামনে দিয়ে স্কুলে যাতায়াত ছিল একটা ভয়াবহ ব্যাপার। গোবিন্দকাকু প্রথমে প্রবালকে ভালভাবে বোঝাল, তারপর মাদারহাটে গিয়ে বাসনাবালার সঙ্গেও কথাও বলল। বাসনাবালার ভাই, দেওর -এরা সবাই কাকুর পূর্ব পরিচিত, এক গেলাসের সঙ্গী বলা যায়। প্রবাল ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল
‘আরও দুটো রাস কাটিয়ে যাব ভাবছি এ বাড়িতে। খুব পছন্দ আমার লোকেশনটা। সামনেই রথ, রাসমঞ্চ’
বাসনাবালা বলেছিল ওঠাবার চেষ্টা করলে কুরুক্ষেত্র করবে সে। এর মধ্যে আবার প্রবালের পক্ষে কথা বলার জন্যে তার এক বন্ধু হাজির হয়েছিল। তার নাম মহীতোষ ঘোষাল। সে একজন কবি, বহুদিন পর্যন্ত তার একটা কবিতার বই বাড়িতে দেখেছে বিদিশা। ‘ছিঁড়ে আনব অমাবস্যার সূর্য’।
অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে গোবিন্দকাকু লোকাল কমিটিকে ডাকল। লোকাল কমিটি মানে দিলীপ চক্রবর্তী, কার্যত টম। তারা প্রথমে আসতেই রাজি ছিল না। কারণ বাবাকে তারা মোটেই পছন্দ করে না। বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে রফা হল, প্রবাল মজুমদার উঠে গেল। এক পয়সা ভাড়া না দিয়েই অবিশ্যি। লোকাল কমিটিকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা বিদিশা অনেক পরে জেনেছে, যেমন জেনেছে বাচ্চা হবার পরেই বাচ্চা সুদ্ধু চাঁপাকে বাপের বাড়িতেই ফেলে চলে যায় প্রবাল মজুমদার, টাকা আর গয়না নিতেও সে ভোলেনি। পরে জানা যায় এটাই তার পেশা। চেহারা আর গান দিয়ে এইভাবে সে সম্পন্ন ঘরের মেয়েদের পটায় আর তারপরে সব হাতিয়ে পালায়।
ফরোয়ার্ড প্রেসের রিসেপশনে যখন তমোনাশ নিয়োগী ওরফে টম তাদের বসিয়ে রেখেছিল, তখন পাড়ার সেই টমকে মনে পড়ে গেছিল বিদিশার।
ইউনিয়নের লোকেদের একেবারেই নাকি অন্ধকারে রেখে তাদের রিক্রুটমেন্ট হয়েছিল।প্রেসের সাতশ কর্মী জানেই না ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি ব্যাপারটা কী, খায় না মাথায় দ্যায়।তাই তাদের ঢুকতে দেওয়া হবে না প্রেসে।বিদিশারা রুদ্ধশ্বাসে ভাবছিল এখুনি একটা দারুণ ঝাড়পিট শুরু হবে। কিছুই হয়নি। কিছুদিন পর থেকেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। তবে এর মধ্যে বিদিশার খুব জ্বর হল, আসতে পারল না দিন সাতেক। আর জ্বর থেকে উঠতে না উঠতেই বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হল। নয় এগারো তো অনেক পরে, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ছবিটা ওদের জাতীয় জীবনের কত গভীরে ঢুকে গেছে,তিন দশক পরে তা টের পাওয়া যাচ্ছে। কারফিউ উঠে যেতে নতুন করে শুরু হল তার নানান রুটে অফিস যাওয়া।
সাউথ সেকশনে ট্রেন ধরে শিয়ালদা। সেখান থেকে নর্থে গিয়ে ট্রেনে ডানকুনি লোকালে বরানগর অথবা মেন লাইনের অন্য ট্রেন ধরে বেলঘরিয়া।বরানগর স্টেশন একদম ডানলপ ব্রিজের গায়েই, অনেক উঁচুতে। সাতাত্তরটা সিঁড়ি ভেঙে নামতে হয় নাকি, কে যেন বলেছিল।হবেও বা। বিদিশা দুএকবার গোণার চেষ্টা করে ছেড়ে দিয়েছিল। কেউ হয়তো এসে কথা বলেছে, কিংবা ও নিজেই অন্য কিছু দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেছে, তাই গোণার খেই হারিয়ে গেছে। বিদিশা যখন পেছন ফিরে নিজের সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান করে, তখন বরানগর স্টেশনের সিঁড়ি গুনতে না পারাটাও তার এক অসাফল্য হিসেবেই ধরে। এই বরানগর স্টেশনটির সঙ্গে আর একটি জনশ্রুতিও জড়িয়ে ছিল, ক্রমে ক্রমে সে কথা সে জানতে পারে। এর স্টেশন মাস্টার ছিল বিমান মজুমদার, ফরোয়ার্ডের ওয়ার্কস কন্ট্রোলার সুবীর মজুমদারের বাবা, ফরোয়ার্ডের যেসব কর্মীরা এই স্টেশনের ওপর দিয়ে যাতায়াত করত, তাদের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য, সেই সুবাদেই তাঁর ছেলেকে তিনি কাগজের রিল টানা ইত্যাদির কাজে ঢুকিয়ে দেন ফরোয়ার্ডে। সেই ছেলে, যাকে দিয়ে সবাই চা আনাত, যার চাকরি পাকা হয়নি অযোগ্যতার কারণে, সে কীভাবে এখানকার ওয়ার্কস কন্ট্রোলার হয়ে ফিরে এল, সে একটা ইতিহাস। চাকরি করতে এসে এসব কথাও কানে আসত বিদিশার। ঠিক কানে আসা নয়, সবাই এসে বলত তাকে এসব, প্রথম বৈরিতা কাটিয়ে বেশির ভাগ কর্মীই তাকে খুব আপন করে নেয়, অনেকে একটু প্রেম প্রেম নজরেও তাকায়। একজন প্রতিদিন বিকেলে বলত ‘অ্যাকাডেমি যাচ্ছি, যাবেন?’ কেউ কেউ বাড়ি নিয়ে গিয়ে মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চাইত, প্রচুর নেমন্তন্ন আসত বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা গৃহপ্রবেশের। কিন্তু সুবীর মজুমদার বলে দিয়েছিল এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে, তাই সেটাই সে মেনটেন করে এসেছে বরাবর। আজ মনে হয় সেটা ভুল।সামাজিকভাবে মিশেও পেশাদার দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব। সুবীর মজুমদার আসলে তার গ্রহণযোগ্যতাকে ভয় পেয়েছিল, সে চায়নি বিদিশার মাস বেস তৈরি হোক। সেই সময় এটা বোঝেনি সে। সুবীর মজুমদারের নির্দেশে যেহেতু অফিসে গাম্ভীর্য বজায় রাখতে হত, তাই বাকি কর্মীরা তাদের কৌতূহল মেটাতে চেষ্টা করত যাতায়াতের পথে। আর কতভাবেই না অফিসে আসা যাওয়া করত বিদিশা। ট্রেন পথে বরানগর বা বেলঘরিয়া তো বটেই, বাস পথেও সে গেছে এসেছে প্রথমদিকে, যখন ট্রেনের রাস্তা জানা ছিল না। শিয়ালদায় নেমে হকার্স কর্নার দিয়ে হেঁটে জগত সিনেমার সামনে দিয়ে বাসে ওঠা।ফ্লাইওভারের নিচে দুটো রাস্তা দুদিকে বেঁকে গেছে। একটা জগত সিনেমার দিকে, অন্যটা ছায়া স্টোর্স পেরিয়ে ছবিঘরের দিকে, যে রাস্তাটা কলেজ স্ট্রিট গেছে। কতবার অন্যমনস্কভাবে ও ছবিঘরের গলিটায় ঢুকে পড়েছে, আবার হুঁশ ফিরতে ফিরে এসেছে জগতের গলিতে। ২৩০ আর ২৩৪। এই দুটো বাস যেত ডানলপ ছাড়িয়ে রথতলা অব্দি।ফরোয়ার্ড প্রেসে একটা স্টপ দিতে বাধ্য হত বাসগুলো, এত লোক নামত। ডানলপ ব্রিজ ছাড়ালেই দূর থেকে ফরোয়ার্ডের লোগোটা দেখা যেত আকাশে ঝুলে আছে।মোটামুটি এই তিনটে রুটের মধ্যে সবচেয়ে ঘটনাবহুল ছিল বেলঘরিয়ারটা। বরানগর স্টেশন অবশ্য খুব আকর্ষণ করত তাকে। নির্জন স্টেশন। বহু পরে ওর একটা কবিতায় ফিরে এসেছিল সেই অনুষঙ্গ-

‘নির্জন স্টেশনের মতো কিছুই আমাকে টানে না,
এখানে সারাদিনে কোন ট্রেন দাঁড়ায় না,
শুধু হিল্লোল তুলে চলে যায়,
আমিও কখনোই নামতে পারিনি সেখানে,
শুধু
বুকের মধ্যে ধরে রেখেছি
একটা নির্জন স্টেশন…’

সত্যিই বরানগর স্টেশন বুকের মধ্যে ধরা ছিল। খুব বেশি লোক নামত, উঠত না বরানগরে, যতদূর মনে পড়ে, যাত্রীদের অনেকেরই গন্তব্য ছিল দক্ষিণেশ্বর। নির্জন স্টেশনটা খুব টানত তাকে। স্টেশন আর স্টেশনঘর। যেখানে নাকি ওর সাক্ষাৎ বস সুবীর মজুমদারের বাবা বিমান মজুমদার বসতেন একদা।বারবার চোখ চলে যেত ওই দিকে।সকালে এদিক দিয়ে এলেও, এদিক দিয়ে ফিরেছে কি কখনো? ডানকুনি লোকাল অনেকক্ষণ অন্তর অন্তর ছিল, ওর অফিস ছুটির সময়ের সঙ্গে ট্রেনের সময় মিলত না, সেটা তো একটা কারণ বটেই, তাছাড়া ভাঙ্গাচোরা, নির্জন বরানগর স্টেশন মেয়েদের জন্যে আদৌ নিরাপদ নয়, তাও অফিসের লোকরা কানের কাছে পাখিপড়ার মতো বলত। তারাই ওকে বেলঘরিয়ার রুট চেনাল। বড়রাস্তা পেরিয়ে একটা গলিপথ ধরে ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজের পাশ দিয়ে হাঁটলে মিনিট দশ বারোর মধ্যে বেলঘরিয়া স্টেশন পৌঁছে যাওয়া যেত। বেলঘরিয়াকে সবাই বলত বুলগেরিয়া। সে এখানকার আগাগোড়া লাল ভাবমূর্তির জন্যে কিনা কে জানে। মেন লাইন, তাই দাঁড়াতে দাঁড়াতেই ট্রেন পাওয়া যেত, আর ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হলেও লোকসান ছিল না। প্লাটফর্মের বুক স্টলে দেদার ভালো বই। ওখানেই বলতে গেলে আধুনিক এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় বিদিশার। শাণিত কুঠার, যুবমানস, এইরকম কত পত্রিকা মনে পড়ে। তবে শান্তি করে দেখার উপায় ছিল না, যারা অফিসে ওর কাছে ঘেঁষতে পারেনি, তারা এসে আলাপ জমাতে ব্যস্ত হয়ে উঠত। কত কী কৌতূহল তাদের। কে কে আছে বাড়িতে, বিদিশা রান্নাবান্না জানে কী না, বাড়িতে বউদির সঙ্গে ওর ঝগড়া হয় কিনা। বিদিশা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারত না। ও লোকগুলোকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারত না। একে তো ও গাড়িতে আসত না, আসত পাবলিক ভেইকেলে, সেই কোন সুদূর মফস্বল থেকে। যাতায়াতেই পাঁচ ছ ঘণ্টা কেটে যেত, আর এগুলো ছিল নর্মাল দিন। একেকদিন, ট্রেনের ওভারহেডে কারেন্ট থাকত না, একেকদিন বিটি রোডের বিখ্যাত জ্যামের খপ্পরে পড়ত। এক সন্ধেয় তো ডানলপ থেকে শিয়ালদা আসতে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা লেগেছিল।সেসব দিনে ওর ছোট শহরের স্টেশনে নেমে রিকশায় যখন চড়ত, চারিদিক নিঝুম হয়ে গেছে। তবু ওর একটুও ভয় করত না।রবীন্দ্র ভবন আসতেই ও রিকশাওলাকে বলত বড় রাস্তা ছেড়ে ভটচায্যি পাড়ার গলি দিয়ে যেতে। হয়তো জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। দুপাশের গাছপালাকে সেই জ্যোৎস্নায় গাঢ় কালচে সবুজ দেখাচ্ছে।রিকশার শব্দে একটা কুকুর সচকিত হয়ে উঠল, বাঁদিকে দত্ত পাড়ার রাস্তা ছেড়ে রিকশা সোজা চলছে, ওর মন কী এক অপার্থিব আনন্দে ভরে উঠছে, সেদিন হয়তো নতুন শেখা সি প্লাস প্লাস ল্যাঙ্গোয়েজে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের একটা মডিউল ডেভেলপ করে ফেলেছে, সেদিন হয়তো ওর এক আশ্চর্য নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, সেদিন হয়তো জানলার ধারের একটা সিট পেয়ে ও একটা নতুন কবিতা লিখেছে। সে ছিল প্রতি মুহূর্তে আবিষ্কারের পৃথিবী। ও নিজেকে আবিষ্কার করতে করতে চলেছে, আর তখন তো মোবাইল ফোন আসেনি, যে ওর এই একান্ত উন্মোচনের মুহূর্ত ভেঙে দেবে।
এইরকম এক দিন ও সিদ্ধান্ত নেয় বাসরুট ছাড়ার।যদিও সকালের দিকে বাসে আসার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল, শ্যামবাজারের পর থেকে অচেনা ভুগোল দেখা। গোপাল লাল ঠাকুর রোড, সিঁথির সার্কাস ময়দান, আর সবচেয়ে বড় টান তো ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের ক্যাম্পাস, ঘন আমবনের ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া বাড়িগুলি, ভেবে শিহরিত হত বিদিশা যে এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে থাকতেন মাঝে মাঝে, ওর এক একদিন ইচ্ছে করত, অফিস না গিয়ে এখানে নেমে পড়ে।
সেদিন এক সন্ধের ট্রাফিক জ্যাম ওকে নিয়ে এসেছিল ট্রেন রুটে। ওকে সবাই গাইড করে নিয়ে যেত প্রথম প্রথম। তারপর রাস্তাটা মুখস্থ হয়ে গেছিল। কোন গলির পর কোন গলি, ডানদিক, বাঁদিক, কখন ‘আস্তানা’ নামের বাড়িটা আসবে, সব সব। ধীরে ধীরে এই রাস্তা ওর প্রিয় হয়ে উঠল। সকালে অবশ্য হাঁটত না, অটোয় আসত। সেখানে একবার মজার ঘটনা ঘটেছিল। বেলঘরিয়া নেমে অটো করে যেতে যেতে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ।তাঁর নিজের লেদ কারখানা। ধরা যাক তাঁর নাম রামবাবু। ভাববাচ্যে কথা বলতেন। কী করা হয়? শুনলেন ফরোয়ার্ড প্রেস। অ ছাপাখানা! জোর করে অটোভাড়া দিতেন রোজ। ছাপাখানা মানে খুব দুস্থ ভাবতেন নিশ্চয়।
একদিন শুধোলেন –ক কেলাস অব্দি পড়া হয়েছে? কেলাস এইট?
বিদিশা বলল, আর একটু বেশি।
এরপর কথোপকথন এগোল এইরকমভাবে-
-তাহলে দশ কেলাস?
-আর একটু বেশি
-বারো কেলাস? (কিঞ্চিৎ অধৈর্য)
-আর একটু বেশি
এইভাবে শিব্রামী স্টাইলে গুপ্ত কথা আস্তে আস্তে ভেঙ্গেও বিপর্যয় ঠেকানো গেল না। রামবাবু জেনে গেলেন বিদিশা পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ছাপাখানায় কালিঝুলি মাখছে। ওঁর চোখে তীব্র ভর্তসনা ফুটে উঠল –ছিঃ!
হায় একি সমাপন! তারপর থেকে উনি আর বিদিশার অটোভাড়া তো দেনই নি, উপরন্তু দেখলে না চেনার ভান করেছেন।
এ নিয়ে একটা চরম গল্প, যাকে বলা যায় হাইট অব হাইটস, শুনিয়েছিল ফরোয়ার্ডের মিহির স্যান্যাল। একবার হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে। একজন ছাতা ছাড়া ভিজছে দেখে এক ভদ্রলোক করুণায় গলে তাকে ছাতার নিচে ডাকলেন। তারপর কথায় কথায় শুধোলেন, মশায়ের কী করা হয়?
উত্তরে অন্য লোকটি বললেন, একটা ছাপাখানায় কাজ করি।
এটা শোনার পর নাকি ভদ্রলোক ছাতা থেকে সেই ছাপাখানার কর্মীকে বার করে দিয়েছিলেন!
এইরকম এক সন্ধেতে ফিরতে ফিরতে বিদিশার মনে হয়েছিল ও কতদিন বিকেল দেখেনি। সেদিনই কি ও সারারাত জেগে পড়ে শেষ করেছিল সমারসেট মমের ‘মুন অ্যান্ড দা সিক্স পেন্স’? আর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাকরি ছাড়ার?

( ক্রমশ)

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes