অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গল্প -‘ ঊষা’র ঘর
সাইকেলের পিছে অতিরিক্ত দুটো চাকা নিয়ে ঘুরছে পাকু। যেন কোনও শিশুর আনন্দে ছড়িয়ে দেওয়া দুটো পা হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে উড়তে থাকা চুলের সাথে উচ্ছ্বাস জানাচ্ছে। চাকা দুটো ওকে বাড়তি সুরক্ষা দিয়েছে। হুট বলতে ভারসাম্য হারানোর ভয় নেই। সে আপনমনে বড় রাস্তায় সাইকেল ঘোরাচ্ছে। কখনও ঢুকে পড়ছে বসন্ত চৌধুরীর অরক্ষিত বাগানে, কখনও দত্তদের লোহার গেটে বেকায়দায় ধাক্কা খেয়ে বহু কসরতে পিছিয়ে আসছে। পিছিয়ে আসার আগে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, মান্না মাঠের রাস্তা দিয়ে রিমো আসছে।
যে কোনও সময়ে বৃষ্টি নামতে পারে। দুপুরবেলার রোদ মুছে গেছে কখন, টের পায়নি ময়ূখ। আজ কি তবে পয়লা বৈশাখ? হবে হয়ত। এখন ভোরের মতো আলো। গভীর ঘুমের পরে সময় গুলিয়ে যাওয়ার মতন আলো। যেমনভাবে গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকে ঊষা। ওর কি সময় গুলিয়ে যায়? বলেনি কখনও। আজ ওর ঘুমন্ত মুখ ফেলে রেখে দরজা ভেজিয়ে চলে এসেছে ময়ূখ। ট্রেনে উঠেছে, পথে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেছে, খুঁজে খুঁজে এখানে আসতে বেলা গড়িয়ে গেছে। এখন দত্ত বাড়ির রকে বসে পাকু আর মাঠ পেরিয়ে উঠে আসা রিমোর কথা শুনছে সে।
রিমো লোভীর চোখে হেসে বলল, ‘কী রে পাকু, তোর নতুন সাইকেল?’
সাহেবি আমলের লোহার মিনার কবে যে বসানো হয়েছিল কেউ জানে না। বছর বছর সেটার গায়ে সবুজ রং বসানো হয়। মিনারটাকে ঘিরে সাইকেলে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে পাকু বলল, ‘হ্যাঁ রে। নতুন ক্লাসে উঠেছি বলে দাদান কিনে দিল।’
‘দেখি, দেখি… হেব্বি! একটু চালাতে দিবি?’
‘না। কেন দেব! তোর মা তো চুরি করেছে!’
‘মা চুরি করেছে। আমি তো করিনি। দে না একটু চালাতে। একপাক ঘুরেই দিয়ে যাব।’
‘দেব না ভাগ। তোর মা চুরি করল কেন?’
‘দাদান পুলিশ ডাকতে গেল কেন? দুল ফিরিয়ে দিলে পুলিশ ডাকতে হয়?’
‘পুলিশ না ডাকলে শাস্তি কেমন করে হবে? চোর-পুলিশ খেলায় দেখিসনি কেমন চোরের পিছনে পুলিশ দৌড়য়?’
‘পুলিশ খালি দৌড়য় নাকি? ধরতে পেলে খুব মারে।’
‘মারবেই তো। চুরি করা খারাপ কাজ। ভাত মুখে নিয়ে বসে থাকা খারাপ। পড়তে না বসা খারাপ। খারাপ কাজ করলে মারবেই তো।’
‘পুলিশ মা’কেও মারে?’
‘কী জানি! দাদান বলেছে, দুল পাওয়া গেছে বলে কম মারবে।’
‘মা’কে সবাই মারে। সকালবেলা পুলিশ মারল। রাত্তিরবেলায় বাবা এসে মারল। আমারও পিঠে পড়ল। খাওয়া হল না।’
‘তোর খিদে পেয়েছে? হজমি গুলি খাবি?’
‘আছে? দুটো দে তো। আচ্ছা, তিনটেই দে।’
সাইকেল থামিয়ে নেমে দাঁড়াল পাকু। ফ্রকের সামনে লেসের কাজ করা বাহারি পকেট থেকে চকচকে রূপোলী মোড়কে আটক হজমিগুলি বের করে রিমোর হাতে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মুখে চালান করে রিমো বলল, ‘এবারে একটু সাইকেলটা দিবি? একপাক ঘুরে এসেই দিয়ে দেব। মা কালীর দিব্যি।’
‘তোকে সাইকেল দিলে মা মারবে খুব। দাদানকে বলে দেবে। তারপর দাদান পুলিশ ডাকবে, আমাকে ধরিয়ে দেবে।’
‘বড়ো মামী দেখতে পাবে না। আর পুলিশ তো খালি মা’কে মারে। তোকে মারবে কেন? আমি এই যাব আর এই আসব। দে না বাবা একটু!’
‘মা যদি তিনতলার জানলা দিয়ে দেখে?’
‘আমি তোর সাইকেল নিয়ে লুকিয়ে পড়ব বসন্তদের ঝোপে।’
‘ঠিক তো?’
‘ঠিক।’
অল্প একটু সরে দাঁড়াল পাকু। সাইকেলের গোলাপি হ্যান্ডেলে হাত রেখে চোখ বড় হয়ে গেল রিমোর। সামনে একটা গোলাপি ঝুড়ি। আনন্দে মেলা থেকে কেনা নিজের লাল সানগ্লাসটা রেখে দিল ঝুড়িতে। তারপরে ছোট্ট প্যাডেলে চাপ দিল। মাখনের মতো গড়িয়ে গেল পরীর সাইকেল। বাঁই বাঁই করে এগিয়ে গেল মাঠের দিকে।
ময়ূখ ভাবছে ঊষার মতো ঘুমের অসুখ কি তাকেও ধরল? অদ্ভুত ঠাণ্ডা বাতাস চারদিকে। কুয়াশার মতো আলো। বৃষ্টিটা আসি আসি করে আসছে না। নববর্ষের দিনে এমন থমথমে শীত বড় একটা দেখা যায় না। বৃষ্টি নামুক, বৃষ্টি নামুক। বৃষ্টি নামলে সে উঠে যাওয়ার অজুহাত পাবে। বৃষ্টি না হলে তাকে এখন বসিয়ে রাখবে দত্ত বাড়ির রকে পাশে এসে বসা লোকটা। লোকটার গায়ে কালো জামা, কালো প্যান্ট। বড়ো বড়ো চুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। মুখে গোঁফ-দাড়ির জঙ্গল থেকে লালচে ফর্সা মুখ বোঝা যায়। তোতনদা। বোতাম ভাঙা শার্টের পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে বলল, ‘লাইটার আছে?’
ময়ূখ বলল, ‘না।’
‘দেশলাই?’
‘তা-ও না।’
‘ধুর! ফালতু লোক যত!’ আচমকা রাগে বিড়িটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল তোতনপাগলা। তক্ষুনি দৌড়ে এসে একগাল হেসে পাকু বলল, ‘তোতনদা, তোমার বন্ধু আসেনি?’
‘আসেনি। মামাবাড়ি গেছে।’
‘যায়নি। আমি জানি।’
তাচ্ছিল্যের স্বরে তোতনপাগলা বলল, ‘তোকে বলেছে! আমি জানি। মামাবাড়ি গেছে। আর ফিরবে না। মামাবাড়ি গেলে কেউ ফেরে না। আমাকে বলে গেছে।’
পাকু বিজ্ঞের চালে বলল, ‘ঊষা মামাবাড়ি যায়নি। বিনুদের পুজোবাড়িতে কাঠের পুতুল দেখতে গেছে।’
দুঃখী মুখ করে বসে থাকে তোতনপাগলা। কাঠের পুতুল দেখতে গেল বন্ধু, তাকে নিয়ে গেল না! পরক্ষনেই খুশি হল। মনে হয় ডেকেছে। চিলঘরে যখন বাবা তাকে বেঁধে রেখেছিল, তখন ডেকে গেছে। তাই শুনতে পায়নি তোতন। নীলপুজো দিতে যাওয়া মেয়েদের সেদিন অ্যায়সা ভয় দেখিয়েছে, গলি ছেড়ে পড়িমরি করে ছুটল মেয়েগুলো। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল তোতন। বাড়িতে খবর গেলে বাবা একটুও চিৎকার করল না। শুধু হাত ধরে টেনে এনে চিলঘরে বেঁধে রাখল। কাল সারাদিন বন্দি ছিল। আজ দুপুরে বাবা বেরোতেই মা এসে চুপিচুপি দড়ি খুলে দিল। রাজার মতো একতলায় নেমে এল তোতন। এতসব ঘটনার ঘনঘটায় ঊষা কখন যে কাঠের পুতুল দেখতে গেল, তাকে নিয়ে গেল না। ভাবতে ভাবতে চোখ পিটপিট করে সে। আর দেখে জামায় আঁকা শালুক ফুল নিয়ে তেমাথা মোড় থেকে দৌড়ে আসছে শালুক। ছুটতে ছুটতে এসে বলে, ‘তোতনদা দেখো, নতুন জামা!’
‘কেন? আজ কি পুজো?’
‘আজ তো পয়লা বৈশাখ। তোমার নতুন জামা কই?’
‘আমাকে বেঁধে রাখে, আবার নতুন জামাও দেবে! হুহ! তাহলেই হয়েছে!’
‘বেঁধে রাখলে কেউ নতুন জামা দেয় না?’
‘কেউ দেয় না। তুই এমন নায়িকা সেজে যাস কোথায়?’
ছোটো ছোট্ লাল নীল কাচের চুড়ি ঘুরিয়ে শালুক বলল, ‘নায়িকাদের দেশে যাচ্ছি গো। সক্কাল হলেই চলে যাচ্ছি।’
‘সেটা আবার কোথায়?’
‘বম্বে গো বম্বে! নাম শোনোনি?’
পাকুর খুদে খুদে চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এল, ‘বম্বে! ওরে বাবা! শাহরুখ খান থাকে!’
শালুক উৎসাহ পেয়ে বলল, ‘শাহরুখ খান থাকে। নায়িকারাও থাকে।’
তোতন ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আমারও বম্বে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। রোজ বেঁধে রাখে বলে যাওয়া হয় না। আমিও বম্বে যাব।’
শালুক সতর্ক হয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে কিন্তু যেতে পাবে না। আমাকে রমেশ কাকা নিয়ে যাবে। সক্কাল হলেই নিয়ে যাবে।’
তোতন ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘সে আবার কে?’
‘রমেশকাকাকে চেন না? চটকলে মা, বাবার সঙ্গে কাজ করে। আমাদের ঘরে আসে। আমাকে এই নতুন জামা দিয়েছে, চুড়ি দিয়েছে। কাকার সঙ্গে যাব, রেলগাড়িতে দু’দিন ধরে নাচতে নাচতে যাব!’
পাকুর বিস্ময় কাটে না, ‘অতদূরে যাবি, ইস্কুলে বকবে না?’
শালুক বলল, ‘আমি তো আর এই ইস্কুলে পড়ব না। সেখানে সমুদ্দুর আছে। সমুদ্দুরের ধারে ইস্কুলে ভর্তি হবো।”
‘তোর মা বাবার জন্য মনখারাপ করবে না?’
‘মনখারাপ করবে কেন? আগে আমি যাচ্ছি। দুই দিন পরে মা বাবা চলে আসবে। এখন চটকলে অনেক কাজ তো, তাই দেরি করে যাচ্ছে।’
তোতন মিনতির সুরে বলল, ‘আমাকেও সঙ্গে নে না। ঊষাটাকেও ডাকি? আমরা সবাই মিলে যাই? বম্বে যাই?’
‘রমেশকাকা বকবে যে! দাঁড়াও বাপু, আমি নায়িকা হয়ে এসে তোমাদের নিয়ে যাব।’
তোতনের আবার রাগ চড়ে গেল, ‘ভারী তো তোর রমেশ কাকা! বেশি বেশি! যা তো, আমি একাই যাব। এক্ষুনি বম্বে যাব! তোর আগেই পৌঁছব।’
শালুক দমবার পাত্রী নয়। সে হিহি করে হেসে বলে, ‘সেখানে তুমি থাকবে কই? তোমার পয়সা কই?’
তোতনও তেড়ে ঝগড়া শুরু করে, ‘সমুদ্দুরের ধারে থাকব। এক পেট জল খাব। তোর সঙ্গে দেখা হলে চিনব না। এক্ষুনি যাব, দেখবি?’
শালুক মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমিও চিনব না। যাও তুমি!’
তোতন ঝটকা মেরে উঠে পড়ে, ‘তাই যাচ্ছি!’ তারপর ময়ূখের দিকে ঘুরে একগাল হেসে বলল, ‘চলি ব্রাদার! আমাকে এক্ষুনি একবার বম্বে যেতে হবে!’
হন্তদন্ত হয়ে তোতন পাগলা বেরিয়ে গেল আর ময়ূখের খেয়াল হল অন্ধকার হয়ে আসছে। আসন্ন অন্ধকার পাকুও দেখেছে। দেখে তার মুখ শুনিয়ে গেছে। রিমো তার সাইকেল ফেরত দিয়ে যায়নি এখনও। তার সাধের নতুন সাইকেল নিয়ে রিমো কি হারিয়ে গেছে? বিপদের মুখে শালুককে সবজান্তা ঠাওরাল সে।
‘শালুক, তুই জানিস রিমো কোথায় গেছে?’
‘জানি না তো! ওর মা’কে পুলিশে ধরল। তারপরে ও আর খেলতে আসে না তো!’
‘আজ এসেছিল। আমার নতুন সাইকেল নিয়ে গেছে।’ বলতে গিয়ে পাকু প্রায় কেঁদে ফেলল।
শালুক সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘তা হলে মনে হয় ও ছেলেধরা হয়ে গেছে!’
পাকু আরও ভয় পেয়ে বলল, ‘ছেলেধরা হয়ে গেলে সাইকেল ফেরত দেবে না?’
ইস্কুলের চশমা আঁটা দিদিমণির মতো গম্ভীর হয়ে শালুক বলে, ‘কী করে দেবে? সাইকেল রেখে বস্তা এনেছে তো। বস্তা নিয়ে সব পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেখলে কাগজ কুড়োয়। না দেখলে বস্তায় ছেলে পুরে নেয়।’
‘মেয়েদেরও পুরে নেয়?’
‘নাহ! তুই, আমি, ঊষা… আমরা তো মেয়ে। আমাদের ভয় নেই। ছেলেধরা মেয়েদের ধরে না। কখনও শুনেছিস ‘মেয়েধরা’?’
‘তা শুনিনি। কিন্তু সাইকেল না পেলে দাদান খুব মারবে। আমাকেও পুলিশে ধরিয়ে দেবে!’
‘একটু না হয় মার খেয়ে নিস। আমি তো রোজ মার খাই। কী হয়েছে তাতে? পুলিশে ধরিয়ে দিলে তুই পুলিশকে বলিস রিমোকে ধরে আনতে।’
‘ঠিক বলেছিস। তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি।’
‘বুদ্ধি আছে বলেই তো আমি কাল নায়িকা হতে যাচ্ছি। কত দূরে যাচ্ছি!’
আচমকা কানে টান পড়তে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে শালুক। ময়ূখ দেখে এক বেঁটেখাটো লাল চুলের রোগা মহিলা শালুককে ভাঙা স্বরে বকছে। কান ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ‘বলেছিলাম না দোদিন না বেরুতে! হারামজাদি!’
শালুক মুখে মুখে জবাব দেয়, ‘খেলতে এসেছিলাম তো একটু!’
‘খেলা! খেলা তোমার বার করছি দাঁড়াও! কাল যাওয়া আর আজ তোমার খেলা!’ শালুককে মারতে মারতে নিয়ে গেল ক্ষয়াটে মহিলা। পাকু তা দেখে আরও ভয়ে ময়ূখের কাছে ঘেঁষে এল। পরমুহূর্তেই ভয়ের মুখে হাসি ফুটল। মান্না মাঠের রাস্তা দিয়ে রিমো আসছে। সাথে তার গোলাপি সাইকেল। সামনে এসে সাইকেল থামিয়ে বলল, ‘নে তোর সাইকেল। হেব্বি জিনিস।’
পাকু ক্ষেপে গেল, ‘তুই দেরি করলি কেন?’
‘আরে…’ আঙুলের কড় গুনে রিমো বলল, ‘চারদিন পরে ভাত খাব তো। মা উঠে জানলা দিয়ে পয়সা দিল, চাল তেল আনতে বলল। তোর সাইকেল নিয়ে হু হু করে গেলাম আর এলাম। আজ ভাত খাব রে!’ আনন্দে তার চোখ চকচকে হয়।
নতুন বাহনটিকে পাকু প্রায় জড়িয়ে নিল। রিমো পিছু ডাকল, ‘কাল আসবি? একপাক ঘুরেই সাইকেল দিয়ে দেব।’
‘দাদান যদি না মারে আসব।’
বসন্ত চৌধুরীর বাগানের পাশে নতুন সাইকেলে পাকু অদৃশ্য হল। ভাত খাওয়ার আসন্ন আনন্দে মাঠের ওধারে রিমো দৌড়ে গেল।
দুই কানের পাশের শিরার যন্ত্রণাটা উঠে যাচ্ছে। উঠে ব্রহ্মতালুতে বাসা বাঁধছে। ময়ূখের এখন গা গুলিয়ে উঠছে। এমন গা গুলিয়ে ওঠে ঊষারও। ঘুমের ঘোরে কথা জড়িয়ে যায়। মাথার শিরায় রক্ত জমাট বাঁধে। ঘুম ভাঙলে বমি হয়। চিনতে পারে না তাকে। যখন চিনতে পারে না, তখন ময়ূখ ক্ষুব্ধ হয়। তারপরে কান্না পায়। ভাবে, এর চেয়ে জীবনের সাথে জীবন জড়িয়ে না পড়া ঢের ভাল ছিল। ঊষা কি তার শুধুই বর্তমান? অতীতের ঊষাকে ভালবাসেনি সে? তার হারিয়ে যাওয়া কোশ, তার বেড়ে ওঠার পাড়া, তার মস্তিষ্ক, তার স্মৃতি সবটার মধ্যে নিজেকে জড়িয়েছিল ময়ূখ। তার সমস্ত হয়ে ওঠা আর না হয়ে ওঠা নিজের মধ্যে ধারণ করে ভালবেসেছিল তাকে। তবে কেন ঊষা তা বোঝে না আর? চোখ খোলে না কেন? ঘুমের ঘোরে কাদের খোঁজে? ময়ূখকে চিনতে পারে না কেন আর?
‘তোতনদা আসেনি?’
ধীরে ধীরে মুখ তুলল ময়ূখ। শ্যামবর্ণা, প্যাঁকাটির মতো চেহারার শিশুকন্যা আবার বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ? তোতনদা এসেছিল?
ময়ূখ বলল, ‘এসেছিল। এখন বম্বে চলে গেছে।’
‘ইসস রে! আমার যাওয়া হল না। কাঠের পুতুল দেখতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল!’
ফের গা গুলিয়ে ওঠে ময়ূখের। যন্ত্রণা বাড়ছে। সে কথা চালিয়ে যায়, ‘রোজ কাঠের পুতুল দেখতে যাস?’
‘রোজ কেউ যায় নাকি? রোজ একটু একটু করে পুতুল তৈরি হয়। বিনুর জেঠু কাঠ কেটে আনে। তারপর কতসব যন্ত্রপাতি দিয়ে কাঠের ওপর মুখ খোদাই করে, গা খোদাই করে। তারপরে পালিশ করে। পালিশ বোঝো তো? আমি সেসব বসে বসে দেখি আর বিকেলে খেলতে আসি।’
ময়ূখের হাসি পায় সে ‘পালিশ’ বোঝে না ভেবে। সে বলে, ‘আজ আসিসনি কেন? তোর বন্ধুরা সব চলে গেল তো।’
‘আজ আমার মনখারাপ ছিল। সকালের নতুন জামা বিকেলে আসবে বলেছিল। আসবে না আর। অবরোধ হয়েছে। অবরোধ জান? ট্রেন চলতে চলতে থেমে যায়। অনেকক্ষণ চলে না। মা বাবা ফেরে না।’
ময়ূখ এবার মজা পায়, ‘নতুন জামা হয়নি বলে খেলতে এলি না? এ ভারি অন্যায়!’
‘আসতাম তো। মূর্তি শেষ হলেই চলে আসতাম। কিন্তু বিনুদের নতুন দাদু এসেছে। এসে আমায় বাথরুমে বন্ধ করে রাখল সারা বিকেল। কত কাঁদলাম, ছাড়া পেলাম না। তাই তো দেরি হল?’
চোখ বিস্ফারিত করে ময়ূখ বলল, ‘সে কী রে! খুব বদমাইশি করেছিলি নাকি?’
‘না না। নতুন দাদুটা খালি আমাকে চান করাতে নিয়ে যায়। যখন তখন চান করতে আমার ভাল লাগে না। বারবার চান করলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে না বল? তাই তো আজ দাদুর হাত কামড়ে দিয়েছি। তারপরে বাথরুমে বন্ধ করে রাখল।’
ময়ূখের মাথা ঝিমিঝিম করছে। তার পাশে বসে আছে ঊষা। বসে বসে পা দোলাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করছে, ‘তুমি কোথা থেকে এলে? বাড়ি যাবে না?’
সে ধীরে ধীরে বলল, ‘কী করে যাব? অবরোধ যে!’
‘ও হ্যাঁ। অবরোধ তো। অবরোধ আমার ভাল লাগে না। খুব খিদে পেয়ে যায়।’
‘যেখানে থাকিস খেয়ে নিবি তো। কত রাত হয় বলা যায়?’
‘কেমন করে খাব? সন্ধে অবধি থাকা তো। তারপরে রাত হলে ওরা রুটি খায়, আমার লজ্জা করে। মা ফিরলে তবে খাই।’
‘আর অবরোধ না উঠলে?’
‘না উঠলে আমার ইচ্ছে করে রেললাইন ধরে সোজা দৌড়ে যাই। ট্রেন থেকে মা বাবাকে খুঁজে আনি। সোজাই তো রাস্তা বল?’
বৃষ্টি নামল। প্রথমে টিপটিপ করে। তারপরে বড় বড় ফোঁটা দ্রুত ভিজিয়ে দিল দত্ত বাড়ির রকের সামনে সাদা রাস্তাটা। সাথে কিছুদূরের ইস্টিশনে রেলের বাঁশি শোনা গেল। ঊষা লাফিয়ে উঠল, ‘ওই শোনো ট্রেন যাচ্ছে। অবরোধ ফুরিয়ে গেছে।’ হাত দুটো উপরে তুলে ফ্রকের ঘের বরাবর দুই পাক নাচল ঊষা। তারপরে হেসে বলল, ‘মা আসছে। বাবা আসছে। আমি মোড়ের মাথায় যাই হ্যাঁ। তুমি বাড়ি যাও। আমার মা আসছে… আসছে…’
তেমাথার মোড়ে ছুটে গেল, হারিয়ে গেল ঊষা। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। উঠে হাঁটতে শুরু করে ময়ূখ। হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারছে তোতনপাগলার ভাষা। মালগুদামের কাছে বম্বে যাওয়ার ট্রেন ধরতে গেছে তোতনপাগলা। অবরোধে একটাও ট্রেন আসেনি। শেষকালে যখন অবরোধ উঠল, তখন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ট্রেন ধরা হয়নি তার। চাকার তলায় আটকে পড়েছে।
শুধু দুপুরে, না বিকেলে, নাকি সন্ধেয়… ঠিক কখন যে ঊষা চলে গেছে, বুঝতে পারছে না ময়ূখ। দ্রুত হাঁটছে সে। শেষ কাজ বাকি আছে।