
নভেম্বরের জল – অলোকরঞ্জন অমিতেশ
সম্রাট সরকার
অবৈধ শব্দগুলো অবহেলে পরপর সাজানোর পর-
গড়ে ওঠে একফালি কবিতায় চিত্রিত রঙিন চাদর
হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় সে চাদর সন্ধ্যাযামে,
স্বর্গপথে সকবি দিয়েছে উড়ান –
তদ্পৃষ্ঠে বসে অলোক দু-হাতে তুমুল কুড়ান
‘রক্তমেঘ’ ঘেঁটে ঘেঁটে মগ্ন, ঋজু ‘স্কন্দপুরান’
আজ বাবার অন্যতম প্রিয় কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত মারা গেছেন। সুদূর জার্মানিতে। আর বাবা এই ক’টি লাইন সন্ধ্যেবেলায় একটা বই-এর মলাটের নিচে লিখে সরিয়ে রেখেছে। আমি গত কয়েকমাস হল বাবার সব লেখা প’ড়ে দেখার পারমিশান পেয়েছি। বই-টার নাম “রক্তমেঘের স্কন্দপুরান”। সেই কবির কি সব কবিতার বই-এর নাম! “মরমী করাত”, “তুষার জুড়ে ত্রিশূল চিহ্ন”, “জ্বরের ঘোরে তরাজু কেঁপে যায়”, “ঝরছে কথা আতস কাঁচে”, “আয়না যখন নিঃশ্বাস নেয়”। নামগুলোর মধ্যে একটা অদ্ভুত ছন্দ রয়েছে। ঠিক যেমন একটা বই আছে – কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের ‘এই যে পূরবীকথা বলো’। বাক্যগুলো যেন একটু অন্যরকম। একবার শুনলে মন ভ’রে না। নামগুলো এমন এক জায়গায় এসে ছেড়ে দেয় যে সেখান থেকে আরো কিছুটা দিব্য হেঁটে যাওয়া যায়। বারবার আনমনে বলে যেতে থাকি বইগুলোর নাম। একটা কী যেন সুর, এটুকুই বুঝি। বাকি সব মাথার ওপর দিয়ে। ‘করাত কী ক’রে ‘মরমী’ হয়? ‘দুর্বিপাক’ কী ক’রে ‘মনোমুগ্ধকর’ হয়? ‘গোলাপ’ কী ক’রে ‘রাজনৈতিক’ হয়? বুঝে কাজ নেই! বাবা বলে এখন এরকম কৌতূহল মনে পুষে রাখলেই হবে। ওটাই আসল। এই পৃথিবীর কত কিছু আছে। সব বোঝা যায় এক জীবনে!
সেই কবি তো নিজেই লিখেছেন ‘যৌবনবাউল’ বইতে–
তবু কি আমার কথা বুঝেছিলে, বেনেবউ পাখি,
যদি বুঝতে পারতে
নারী হতে।
আমাকে বুঝতে পারা এতই সহজ?
কারুকেই বোঝা যায় নাকি!
শুধু বহে যায় বেলা, ঈশ্বর নিখোঁজ;
কিংবা বুঝি এ-দুঃখ পোশাকি,
না-হলে কি করে আজও বেঁচে আছি রোজ,
বেনেবউ পাখি!
বেনেবউ পাখিকে ডেকে যে কবিতা, তাকে না বোঝার আক্ষেপ দুঃখ, সে তো ওপর ওপর। কারণ কাউকে যে সবটা বুঝতে পারা যায়না কবি স্বীকার করে নিয়েছেন। আর এই আবহে নিখোঁজ হয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর। যেহেতু আমাদের বিশ্বাস তিনি সব জানেন। তাহলে তিনিও অন্তর্যামী নন! এই স্বীকারের সাহসে অলোকরঞ্জন বেঁচে থাকেন। কবিতা লেখেন। তবে আরো অনেক ভাবনার নদী বয়ে চলেছে কবিতাটার পাশ দিয়ে। তদের জলকে ছুঁতে পারলাম না। তাই আপাতত এই! বাবা এটুকু ব’লে নোটবুক লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কৈশোরের সমস্ত না-বোঝার সাহসে কবিতার বই ঘাঁটতে থাকি।
সাহস ক’রে ‘মরমী করাত’ হাতে নিয়েছি। এই বইটা ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার’ পেয়েছিল। কি এর মানে? একটি বাক্যও বোঝা যায়না। অথচ বইটার ভেতর বাবা লিখেছে –
গভীর থেকে গভীরতর শোকে
কখনো নিজের স্বপ্ন-পরিজনে
পরিবেষ্টিত, ব্যাথাতুর এক হাত।
লিখে চলেছে
- বলেছি ‘করাত’,
তাকে এবার কল্পরক্তালোকে
ডেকে আনো
- ঘুমে জাগরণে
বিদ্ধ করো ‘মরমী’ বিশেষণে।
এইবার নাকি ‘করাত’ ‘মরমী’ হয়ে ক্ষান্ত হল। ক্ষুরধার নিঃসঙ্গ করাত ‘মরমী’ নামে এক নরম পড়শি পেল। তাহলে আবার প্রশ্ন ‘তহবিল’ কী করে ‘নভোনীল’ হয়? ‘শুকতারার’ অনুপস্থিত ‘আলোয়’ কী ভাবে ‘বিপর্যয়ের চিঠি, পড়া গেল?
লেখা থামিয়ে বাবা বলে -উঠোনের অবিন্যস্ত ‘শিউলি’ ঠিক যেভাবে সুদূরের পরিপাটি ‘টিউলিপ’-কে পড়শি পায়!
আমাদের পড়শি দক্ষিণের মাঠ । আমরা রোজ মাঠে যাই। আমাদের চাষের মাঠে যাই। এই রোগব্যাধির কাল আমাদের যেন দক্ষিণের মাঠে শস্যের মত বুনে দিয়েছে। আমরা শাক-সব্জি হয়ে, ধান হয়ে ফ’লে রয়েছি সে মাঠে। এমনিতেই সারা বছর ধান, ঘাসের বীজের অভাব নেই। তিলে মুনিয়াদের খুব মজা। ধান খায়। ঘাসের বীজ খায়। আমি সবসময় ওদের মধ্যে সেই টেকো মুনিয়াটাকে খুঁজি। সে কি আছে ওদের মধ্যে? আমি যার বুকের স্পন্দন টের পেয়েছি? যাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি দক্ষিণের মাঠে? ধুস্ যাকে হারিয়ে দিয়েছি তাকে আবার কেউ খোঁজে? তাহলে তো আর হারিয়ে দেওয়ার মানে থাকে না। আমি দেখি ঘাসের ডগা দিয়ে, খড় দিয়ে শীতকালেও মুনিয়াগুলো বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে। উঠোনের সামনের দেবদারু গাছের মধ্যে বাসা বেঁধেছে ওরা। পাতার আড়ালে। বারান্দা থেকে অবশ্য পরিষ্কার দেখা যায়, ওরা কি করে সারাদিন। মানে কখন বাসায় ঢোকে, বেরোয়। আর এখন দেবদারু গাছের দিকে মুখ ক’রে বসে আছে বাবা। এই নভেম্বর মাস। আমাকে কোলের কাছে বসতে বলল। আমি মুখোমুখি বসলাম। বাবার তাতে আপত্তি নেই। দু-হাতের মধ্যে মুনিয়াদুটো ব্যস্ত ভাবে আসা যাওয়া করছে। ওদের সমস্ত কর্মকান্ডের মধ্যে ঝড়ে পড়ছে একরকমের ছন্দ আর জীবনবোধ। যেন ভালো করে জানে কি ভাবে বেঁচে থাকতে হবে। ঠিক সময় বুঝে খাবার নিয়ে আসছে। আর বাবা একটা নোটবুকে সব লিখে রাখছে। পাশে ট্রাইপডের ওপর বাবার পেল্লাই ক্যামেরাটা রাখা। দেবদারু গাছের দিকে তাক করে। লেখায় ছবিতে সব বন্দি হয়ে চলেছে, ছন্দ আর জীবনবোধ। কতক্ষণ পর পর বাচ্চাদের খাওয়ায়। কোন বাচ্চাটাকে বেশি খাওয়ায়, এইসব। সামনে একটা বই পড়ে আছে। নাম ‘এভাবে এত বিষ’। কবিতার বই। কবির নাম অমিতেশ মাইতি।
দেখতে দেখতে মুনিয়ার সংসার বাড়ে। তিনটে থেকে চারটে বাচ্চা হাঁ-মুখ করে খাবার চায়। বাবার কলম আর ক্যামেরা দুই চলে। মাঝেমাঝে মা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এলে নোটবুকটা লেখে। পাশে পড়ে থাকে দুই কবি। অলোকরঞ্জন আর অমিতেশ। আর আমি খেয়াল করি নভেম্বর এলেই বাবা অমিতেশের সমস্ত বই তাক থেকে নামিয়ে ফেলে। নভেম্বর মাস নাকি অমিতেশের মুখোমুখি হওয়ার মাস। তাঁর কবিতার বইয়ের নামও খুব সুরেলা। “অতল করতল”, তিমিরবরণ প্রতীক যখন”, “মেঘ স্তূপ ব্যথা”। বাবা কিন্তু অমিতেশের বই পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেয় না। বলে আরেকটু বড় হও। মৃত্যুচিন্তা, মৃত্যুবোধ আসুক তারপর। আমি খুঁজে পাই অমিতেশের কাব্যসমগ্রের মুখবন্ধ লিখেছেন অলোকরঞ্জন। কি সুন্দর দুটো শব্দ আবিষ্কার করি। ‘সংলাপশরিক’ আর ‘দ্বিতীয়রহিত’। অদ্বিতীয় নয়। আচ্ছা, আমি কি বাবার সংলাপশরিক এই নভেম্বর মাসে?
এভাবে একসময় মুনিয়াদের দেবদারুর সংসার সমাপ্ত হয়। কিন্তু তারা দেবদারুসারি ছেড়ে যায়না। মুনিয়াদের এক মিষ্টি স্বভাব আছে। ওরা ওদের বাচ্চাদের তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে দেয়না। মা-বাবা-বাচ্চারা অনেকদিন একসাথে থাকে। নভেম্বরের শেষে একদিন প্রবল বৃষ্টি হয়। মাঝ-হেমন্তের বেআক্কেলে বৃষ্টি। দেবদারুর নীচের খন্দে জল জমে। জল জমে আমাদের উঠোনের খন্দেও। আমার মত একটা কিশোর মুনিয়া, ওর গায়ে এখনও ঠিকমত রঙ ধরেনি পর্যন্ত – ওরা স্নান করতে আসে খন্দে জমা হিমশীতল জলে। দলবেঁধে স্নান করে। বাবা আর আমি, হেমন্তের দুই সংলাপশরিক, দেখি সেই জলে পড়ন্ত বিকেলের ‘রক্তমেঘের’ ছায়া। কবিতার সব বই উঠে শুধু পড়ে থাকে অমিতেশের ‘মায়াশিকলের গান’। সবাই পালক ঝেড়ে উঠে গেলেও সেই কিশোর স্নান করতেই থাকে। জলে ঢেউ খেলে। জলের আরশিতে ‘রক্তমেঘ’ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আবার নির্মিত হয় ও পরক্ষণেই ভেঙে যায়। মুনিয়ার ছোট্ট শরীর জলের নীচে হারিয়ে যায়। আবার ভেসে ওঠে। ডুবে যায়। নভেম্বরের জল – রক্তমেঘ তার বুকের স্পন্দন টের পায়। ভেজা পাতায়, ঘাসের ডগায় জলের ফোঁটা ছিটকে পড়ে। সে মাথা তুলে চারিদিক দেখে আর ডুব দেয়। তার অনন্ত স্নান শেষ হয় না যেন। আমি আর বাবা দুই সংলাপশরিক কথা বলি –
– বাবা, ওই যে বড় মুনিয়াটা সতর্ক স্নান শেষ করে উড়ে গেল ওর কি নাম দেওয়া যায়!
– অলোকরঞ্জন রাখলে কেমন হয় পাবলো?
– এবার বলো, ওই যে মুনিয়াদের আলুথালু বাসা? ভেজা খড়ের টুকরো পাক খেয়ে দুলছে বাসা থেকে?
– ওই খড় ‘মায়াশিকল’ না হয়ে যায়না!
– আচ্ছা, এই যে ঘাসের অন্ধকারে সহস্র জলকণার স্ফটিক? তাকে কি বলবে?
– বাংলা কবিতা!
– আর এই যে জল, রক্তমেঘের প্রতিচ্ছবি নিয়ে, ছোটো ছোটো ঢেউ…
– পুরীর সমুদ্র যদি বলি?
– আর এই যে কিশোর মুনিয়াটা, যার স্নান এই নভেম্বরের বিকেলে, ডুব দিয়ে ডুব দিয়ে, শেষ আর নেই!
– ওই তো আমাদের অমিতেশ!!