শিবালোক দাস-এর কবিতাগুচ্ছ
দিনের শেষে ক্ষয়ে আসে অঙ্গুরীয়
এখনো বিহ্বল হয়ে দৈর্ঘ্য আমার
কেটে যায় প্রাত্যহিক পরিমাপে, তখন
তাদের আমি ঘুড়ির ক্ষতের সামনে এনে
দাঁড় করাই। এ যাবৎ ফেটে যাওয়া সমতল
তারা চিনে রাখুক সমস্ত ইন্দ্রিয়ে।
না, ছুঁয়ে যাওয়ার আগে যে শেষ বিন্দু
পড়েছে অমৃতের, তার শরীরে তখন মোচড়
দেয় সহস্র শস্য। চোখ ফোটে রোজ।
পা বাড়ালেই পাওয়া যায় গোপন জন্ম,
যাকে ভেঙেছ ভালোবেসে মুহুর্মুহু, তার
প্রতিটা রাত অবশিষ্ট থাকে।
ঘুরতে ঘুরতে সাদা পাতা দৃষ্টিহীন হয়ে আসে।
দুহাতে তুমি তাকে পূর্ণ করো, যতক্ষণ না দিনের
শেষে ক্ষয়ে আসে অঙ্গুরীয়।
ডাক
আগুন ছোট হয়ে আসে চারিপাশের।
যতদূর জানি, পিঁপড়েরা ঝাঁপ দেয় না
বরং দূরে সরে যায়। যতক্ষণ শিখায় পা
রেখে আমি হেঁটে যাই, মনে হয় ভোর হয়ে
আসছে হাত বাড়ানোর সাথে সাথেই।
তবুও তুমি উঠে দাঁড়িয়ে সেই অবশিষ্ট
শিখায় শুকিয়ে নাও মধুমেহ।
আর গাছেদের দাও শেষ ডাক।
তাদের কঙ্কাল ভেঙেছে মাটিতে।
একটু একটু করে ঢেকে আসে চুম্বন।
একটু একটু করে পুড়িয়ে ফেলা মুখে
যখন কারো হাতের আঁজলায় গড়িয়ে
আসে নদী, তখন মনে হয় হিমবাহ আমার
পায়ের উপর থেকে তুলে নিতে পারেনি…
পারেনি তুলে নিতে অবশ হয়ে যাওয়া আলো।
আমি পা রাখলে বরং কেউ নিঃশব্দে হাত
রাখে। মধ্যভাগে আমার টলমল প্রমাদে
সরিয়ে রাখে ভুল। কেউ কি আমাকে সত্যি
ভালোবাসে। নিস্তব্ধ পায়ে বন্ধ করে দরজা ?
এখনও একতারা বাজে
পায়ের ফাঁকে এখন ঘাসের মুগ্ধতা
মনে হয় দেওয়াল ছুঁয়ে গেছে।
তাই শেষ পর্যন্ত তুলে নিই রক্ত
যখন ছায়া আড়াল হয় নীরবে।
বালিশের নিচে কবেকার বেসুরো
ধুলোর রেখা আমায় মনে করায়
তোমার অমৃতযোগ ? বলতে পারি না।
তাই এখনও একতারা বাজে…
তুমি ডুবসাঁতারে খুলে রাখো পোশাক
যাতে নামে একটি তরঙ্গ, তারপর…
শেষ কবে মনে পড়েছে সা কে টেনেছ
শ্বাসে ? তারপর ভালোবেসেছ, মনস্তাপ!
একটি কাক এসে আঁকড়ে ধরে মাটি,
যার কাছে সমস্ত অস্তিত্বে হাজার নেপথ্যে
আমি ধরে রাখি আয়না।
তারপরও বলবে আমি তীক্ষ্ণতায় তোমাকে
ছুঁয়ে দিই, জলের পরিবর্তে তোমাকে
ফেলে রাখি শেয়ালকাঁটায়?
সা আমার আকাশ জুড়ে মেঘ এনেছে।
সে কান্না আমি ধরে রাখি মেঘমল্লারে।
তাই এখনও একতারা বাজে।
বিশ্বাসঘাতক ও পাগলের প্রলাপ
প্রতিটি সন্ধ্যা আমার ঘরের সিঁড়ি
বেয়ে উপরে উঠে এসে আমার
চোখ দুটো চেপে ধরে বলে–
আমি আর হতে চাই না অন্ধক !
নিভে আসা তাপের কাছে এত
চিৎকার, আমার বুক থেকে খসে
পড়ে ছিন্ন, কতগুলো ডানাকাটা
সূর্যোদয়, আমি পা রাখি ফাঁকা হাওয়ায়।
বিশ্বাসঘাতক, তুমি পাগলের প্রলাপের
কাছে দাঁড়াতে, দাঁড়াতে, পাথর হও।
এই আগুন যা আমি শুষে নিতে পারি
রোজ, এই আগুনকেই আমি ভয় পেতাম।
কাঁটা আমার জন্মের উপর ছড়ানো,
একবার রক্ত ফুটে ওঠে দোদুল্যমান দ্বীপে,
চুপ! চুপ! কেউ সরিয়ে ফেলছে ঘন বন।
প্রতিটি সন্ধ্যা আমার ঘরের দরজার সামনে
একটি চিহ্ন রেখে যায়, আমি সেই চিহ্ন ধরে
পাথর হয়ে যাই, পূর্ণ করে দিই পাগলের প্রলাপ
ও বিশ্বাসঘাতক, তারা ফুটে থাকে প্রতি রাতে।
আমি পাথরের উপর লিখে দিই এক নতুন
ছন্দ, এক নতুন করপুট, শূন্য হাতে বেঁচে
থাক তেত্রিশ কোটি দেবতাদের মুখমণ্ডল !
জাদুঘর
ছড়িয়ে দিচ্ছ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দরজার সামনে
যাতে মানুষ হিসেবে আমি আরেকটু ছুঁতে
পারি মাটির ঝুরঝুরে পতন, আঙুল যতটা
বেড় পায় ঠিক ততটাই তুলে আনতে পারি জল।
বেঁধে দাও, বেঁধে দাও, মুহ্যমান সমস্ত বন্ধ
মহাসাগরের নিজস্ব গান, খিদের ভেতর
আমি গিলে ফেললাম আগুনে পুড়ে ওঠা সোনা।
ঠিক তখনই দেখলাম জাদুঘর আমায় দিচ্ছে
থামিয়ে, তোমার ভেতর তখনও চোখ খোলার
অবকাশ নেই, পুড়ে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি, পুড়ে
ছাই হয়ে যাই শিশুর মতো, মাধ্যাকর্ষণ এবারও
তুমি আমায় গ্রহণ করতে পারলে না, কেন ?
মাস্তুল
তাপ ক্রমশ নীল হয়ে আসছে,
যদি তার মধ্যস্থলে নামিয়ে এনে
তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি…
তার জন্য আমার জিভ টেনে
ছিঁড়ে ফেলতে হয়।
যে পাপে আমার দেবদারু হাতছাড়া,
তাকে পাশে এনে বসাই। মায়াময়।
তুমি কি তোমার হারানো মাস্তুল পেয়েছ ?
প্রত্যুত্তরে সে সমস্ত গ্রন্থি আলাদা করে।
ম্লান বড় ধীর। বরং অনঙ্গ হওয়া ভাল।
তাপ ক্রমশ নীল হতে হতে মধ্যস্থলে একটি
প্রশ্ন চিহ্ন রাখে– হারানো মাস্তুল খুঁজে পেলে ?