ক্রিকেট: প্রেম থেকে অপ্রেমে  <br /> মণিশংকর বিশ্বাস

ক্রিকেট: প্রেম থেকে অপ্রেমে
মণিশংকর বিশ্বাস

১.
নিউজিল্যান্ড টিমকে আমার বেশ লাগতো। আন্ডাররেটেড মনে হত। দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান মার্টিন ক্রো, অলরাউন্ডার ক্রিস কেয়ার্নস, ক্রিস হ্যারিস। ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রথম পিঞ্চ হিটার ওপেনার মার্ক গ্রেটব্যাচ। ওয়ানডে-তে দীপক প্যাটেলের স্পিন বল দিয়ে শুরু বোলিং আক্রমণ। আর সর্বোপরি দ্য গ্রেট স্যার রিচার্ড হ্যাডলি তো আছেনই। তো যখন ২০০১ সালে প্রথম নিউজিল্যান্ডে যাই, আমার ধারণা ছিল না, যে ক্রিকেট ইন্ডিয়াতে যা, তার ৫০ ভাগের এক ভাগও না ও দেশে। রাস্তায় র‍্যানডম কাউকে ক্রিকেট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে খুব সম্ভব সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে, “আই ডোন্ট নো, ম্যান!”। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটা সত্যি ১০০ জনের ভিতর ১০ জনও পাওয়া যাবে না যে জীবনে কখনো ক্রিকেট ব্যাট বা বল হাতে নিয়েছে। যেরকম কলকাতার রাস্তায় একশ জনের মধ্যে একজনকেও হয়তো পাওয়া যাবে না যে হকি স্টিক হাতে নিয়েছে কখনো। আবার আমার ধারণা একজনও ক্রিকেট প্রেমিক প্রবাসী ভারতীয় পাওয়া যাবে না, যে আমার এই কথাগুলিকে সমর্থন করবে। কারণ? প্রত্যেক ইন্ডিয়ান বিদেশে এসেও সময় পেলেই এখানে ওখানে, পিকনিকে, পার্কে, যেখানে সেখানে, ক্রিকেট খেলে, মূলত অন্য ইন্ডিয়ানদের সাথে। তাদের সন্তানরাও স্কুল কলেজে ক্রিকেট খেলে। সঙ্গে কিছু স্থানীয় জুটে যায় অবশ্যই। এই রেশিও ১০০০-এ ১০০-র বেশি হবে না। এদিকে ইন্ডিয়ান ছাত্রদের ১০০ জনের ভিতর ১০০ জনই ক্রিকেট খেলে। যেহেতু শারীরিক সক্ষমতা, দক্ষতা ইত্যাদিতে কিউই, অজিরা অনেক এগিয়ে, তাই স্কুল টিমে রেশিও দাঁড়ায় ১০ ইজ টু ২ ( ২ জন ভারতীয়)। বা আজকাল এই রেশিও ইন্ডিয়ানদের পক্ষে আরও বেশি হচ্ছে কখনো কখনো। কিন্তু যদি একজন ভারতীয় মাইগ্রান্ট “আমি ইন্ডিয়ান, ক্রিকেট আমার রিলিজিয়ন” এটা আনলার্নিং করে দেখতে পারে, তাহলে দেখবে ওভার অল কিউই বা অজিদের কারোরই ক্রিকেট সম্পর্কে ব্যাপক কোনো উৎসাহ নেই। এবার সেই অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন আসবে, তবে এরা বিশ্বমানের টিম করে দেখাচ্ছে কী করে? কেননা যারা খেলে, তাঁরা প্রফেশনাল। তারা এই খেলাটায় ভালো বলেই ক্রিকেটটাকে প্রফেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবং ক্রিকেট দুনিয়ার সবাই জানে ইন্ডিয়ার বদান্যতায় ক্রিকেটে আজকাল ভালোই টাকা-পয়সা আছে। আসলে গেমস অ্যান্ড স্পোর্টসে এই কিউইরা বা অস্ট্রেলিয়ানরা, গড়পড়তা ভারতীয়দের থেকে অনেক ভালো। তাছাড়া ভারতীয়রা অনেক ভালো খেলবার পর, তারপর সিদ্ধান্ত নেয় সে খেলাটিকে পেশা হিসেবে নেবে কিনা। অন্যদিকে এখানে কিউই অথবা অস্ট্রেলিয়ানদের দেখেছি, যারা খেলাটা ইন্টারেস্ট নিয়ে খেলে, তাঁরা প্রথম থেকেই খেলাটাকে প্রফেশনালি নেয়, সে সাঁতারই হোক আর ফুটবল, ফলে ওই খেলাটায় তাঁরা অনেক উচ্চমানে পোঁছে যায় দ্রুত। ছোটবেলা থেকে শুনতাম, অমল দত্ত প্রায়ই বলতেন, “আমি পেশাদার কোচ”, তখন বুঝতাম না পেশাদার কথাটার এত গুরুত্ব কেন! আজ বুঝি। ভারতে একজন কসাই বা রাজমিস্ত্রি, মূলত হাতুড়ে। কিন্তু এসব দেশে এক জন কশাই বা রাজমিস্ত্রিও পেশাদার। এবং তার কাজটা সে প্রফেশনালি কোর্স করে বা অ্যাপ্রেনটিস থেকে, বিভিন্ন সার্টিফিকেশন, সেফটি কোর্স কমপ্লিট করে তবেই তিনি কসাই বা রাজমিস্ত্রি! নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যা আমি যখন প্রথম যাই ৪.৫০ মিলিয়ন, এখন বেড়ে হয়েছে ৫.১৬ মিলিয়ন। আবার ফুটবলও একদম জনপ্রিয় খেলা নয়। তো এই ছোট্ট জনসংখ্যার দেশটি ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের মূল পর্বে এই নিয়ে দুবার খেললো। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা ২৬.০১ মিলিয়ন। শুধু অলিম্পিক মেডেলের দিকে তাকালেই বোঝা যায় দেশটি গেমস অ্যান্ড স্পোর্টসে কত ভালো। এখানে অনেকে বলবেন, ভারতে সুযোগ সুবিধা নেই। কোটি কোটি মানুষ কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের পানীয় জল সঠিক পুষ্টিকর খাবার, সর্বোপরি সঠিক প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করব, ঠিক কতজন ক্রিকেটার এই মুহূর্তে আমাদের দেশে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বলে আপনার ধারণা? একটি পরিসংখ্যান বলছে, ৫ কোটির বেশি মানুষ ভারতে ক্রিকেট খেলে, এর মধ্যে ৩ মিলিয়ন ক্রিকেটার রেজিস্টার্ড প্লেয়ার (জেলা, মহাকুমা, রাজ্য, উইনিভার্সিটি, বিভিন্ন লোকাল লিগ, ডিভিশন, ক্লাব ইত্যাদি)। মানে প্রায় একটা দেশের সমান জনসংখ্যা। এত মানুষ ক্রিকেট খেলে, তবু ৪.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার রাগবি-পাগল দেশ নিউজিল্যান্ডের রাগবি-বিশ্বে যে আধিপত্য ক্রিকেট বিশ্বে ভারতের কিন্তু সেই আধিপত্য নেই। এবং ক্রিকেটেও যতবার ইন্ডিয়া নিউজিল্যান্ডে খেলতে যায়, ইন্ডিয়াকে বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়! (এই লেখা যখন লিখছি তখন শুনলাম নিউজিল্যান্ডের কাছে দেশের মাটিতেই নাস্তানাবুদ হচ্ছে ইন্ডিয়া!)
নিশ্চিত করেই ইংল্যান্ড সাউথ আফ্রিকা, প্রতিটি দেশের কাহিনীই এক। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া ক্রিকেট জনপ্রিয়তার নিরিখে তৃতীয় শ্রেণীর একটা খেলা। আর, খুবই অপ্রিয় শোনাবে, শুধু এই কারণেই ভারত ক্রিকেটে একদম প্রথম শ্রেণীর একটি দেশ। আজ যদি হল্যান্ড, জার্মানি, বা জাপান এরকম ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রথম সারির দশটি দেশ সিরিয়াসলি ক্রিকেট খেলতে শুরু করে, আমি জানি না, ভারতীয় উপমহাদেশের ক’টি দেশ প্রথম দশে টিকে থাকবে!

২.
সেদিন থেকে নয়, যেদিন থেকে অজয় জাদেজা, মহম্মদ আজহারউদ্দীন, কপিলদেব, হান্সি ক্রোনিয়ে, সেলিম মালিক হয়ে বেটিং কেলেঙ্কারির জল গড়াল মহম্মদ আমির, মহম্মদ আসিফ পর্যন্ত। সেদিন থেকে ক্রিকেট আর তেমন করে দেখি না, যেদিন থেকে মনে হয়েছে বিদেশী কর্পোরেট আর মিডিয়া হাউজগুলির প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার পিছনে! একটু পিছন থেকে বলি, আমি সেইরকম ক্রিকেট ফ্যান ছিলাম, যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে অ্যাওয়ে সিরিজের লাল বলের ক্রিকেট দেখব বলে সারারাত জেগে থাকতাম। নাহ্‌ ঠিক বোঝাতে পারলাম না! মোদ্দা কথা টেস্ট ক্রিকেটেরও প্রতিটি বল দেখতে চাইতাম। ওয়ানডেরও। বড় ব্যাটসম্যানদের শ্যাডো প্রাকটিসও মিস করতে চাইতাম, দুটি বলের ফাঁকে যদি সেখানে বিজ্ঞাপন না থাকতো! একসময় থাকতোও না বিশেষত অ্যাওয়ে সিরিজগুলিতে। যাইহোক ভারতীয় উপমহাদেশে কবে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার আকাশের দিকে মুখ করে হাঁটতে শুরু করলো, সেটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। ভারত যখন ৮৩-তে ওয়ার্ল্ডকাপ জেতে, আমি তখন শুধু হাফপ্যান্ট না, ক্রিজের যে দুটো এন্ড থেকেই ব্যাট ও বল করা হয়, এটাও সম্ভবত জানতাম না। পাড়াগাঁয়ে সবে তখন, ঘরে ঘরে নয়, প্রত্যেক পাড়ায় সম্ভবত একটা করে টিভি— এরকম ভাবেই বোধহয় টিভি কেনা হত! তারপর আমরা বড় হতে হতে ভারত পরপর অনেকগুলি ট্রফি জিতল, বেনসন অ্যান্ড হেজেস, রথম্যানস কাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আমাদের বয়সী অবশ্য সবারই মনে আছে, বিশ্বকাপের কিছুদিন পরেই ভারতে একটা প্রতিশোধের সিরিজ খেলতে এসেছিল ওয়েস্টইন্ডিজ। ব্যক্তিগত ভাবে আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, যে এই সিরিজ ভারতে ক্রিকেটের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তার পিছনে একটা নেগেটিভ পাবলিসিটি হিসেবে কাজ করেছিল, এইভাবে যে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ! এদেরকে আমরা হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছি!!

মিডিয়া, হঠাৎ-পাওয়া গুপ্তধনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যেমন সত্যি, তেমন এও সত্যি খেলাধুলায় ভারতের আর সত্যিই কিছু ছিল না! রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে এর পরের দশকেই পিভি নরসীমা ভারতে প্রধানমন্ত্রী হয়েই মুক্ত অর্থনীতি ও বিভিন্ন আর্থিক সংস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। যদিও কেরি প্যাকার ভারতের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডকাপ জেতবার অনেক অনেক আগেই ক্রিকেটেও যে বাণিজ্য সম্ভব সেটা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা বাণিজ্য-সম্ভব ক্রিকেট যে এই পর্যায়ে কখনো পৌঁছাবে, তা প্যাকারও সম্ভবত ভাবেননি। যাইহোক মুক্ত-বাজার অর্থনীতির সময় থেকেই বেশ কিছু বিদেশী ব্রডকাস্টিং কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশকে পাখির চোখ বানায়। স্পনসরশিপ ইত্যাদি থেকে প্লেয়ার, মিডিয়া হাউস, সংগঠক, ক্রিকেট প্রশাসক বা গভর্নিং বডিগুলি রাতারাতি বড়লোক হয়ে ওঠে। ফলও হাতেহাতে মেলে। ভারতের পরে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান (১৯৯২) ও শ্রীলঙ্কা (১৯৯৬)। এর ঠিক চার বছর পরে বাংলাদেশ টেস্ট খেলবার অধিকার অর্জন করে। অনেকের ধারণা ডালমিয়া বিরাট উপকার করেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের। বিষয়টা আর কিছুই না, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ উপমহাদেশে, ক্রিকেট ততদিনে জনপ্রিয়তম খেলা। আর এই খেলায় আরেকটি দেশের মূলধারার এলিট লিগে অংশগ্রহণ, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনীতম ক্রিকেট বোর্ডের নিজেদের স্বার্থেই চাইবার কথা। ডালমিয়া অবশ্য আফগানিস্তানের অংশগ্রহণ (২০১৪ থেকে অ্যাসোসিয়েট মেম্বারশিপ) দেখে যেতে পারেননি। যদিও তাঁর আমলেই অ্যাসোসিয়েট সদস্য সংখ্যা বাড়ে। আইসিসির পকেটও ডালমিয়া ভরে দিয়েছিলেন। ততদিনে টিভি সাদাকালো থেকে রঙিন, অ্যান্টেনা টিভি থেকে কেবল টিভি, ডিশ টিভি! ক্রমে আমাদের ছোটবেলার মতো টিভি আর কোনো লাক্সারি কমোডিটি নয়। টিভি ঈশ্বরের মতো। সর্বত্র। টিভি ও মিডিয়া রাইট বিক্রি করে ক্রিকেটে অভাবনীয় টাকা আমদানি করেছিলেন ডালমিয়া অ্যান্ড কোং।
যাইহোক, যারা এই লেখাটা এই অব্ধি সহ্য করেছেন, তারা যদি এরপরও বলেন, যে বিদেশী কর্পোরেট শক্তি দ্বারাই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এই উপমহাদেশে প্লান্টেড, এতে সেটা প্রমাণিত হয় না। তাদেরকে আমি বিনীত ভাবে বলব, না সত্যিই আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই এর। তবে কর্পোরেট-উপনিবেশবাদ ওভাবে প্রমাণ রেখে কাজও করে না। এটা অনেকটা এরকম, যে সুস্মিতা সেন, ঐশ্বর্য রাই আরও বেশ কয়েকজন ‘বিশ্বসুন্দরী’ বা ‘মহাবিশ্বসুন্দরী’ হয়ে বিদেশী কসমেটিক্স ব্রান্ডগুলিকে ভারতের বিশাল অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। যদিও প্রমাণ করা যাবে না কিছুই। ঠিক একইভাবে বিদেশী মিডিয়াহাউজগুলির টাকা ভারতীয় উপমহাদেশে চোখের আড়ালে থেকে ক্রিকেটকে বিশেষত ‘পাজামা ক্রিকেট’কে জনপ্রিয় থেকে জনপ্রিয়তর করে তুলেছিল। এমন নয় ভারতীয় প্লেয়াররা প্রতিভাবান ছিলেন না! কিন্তু এরপর যা বলব, আমি নিশ্চিত তা আমাকে অনেকের কাছে আরও অপ্রিয় করে তুলবে! ভারতীয় প্রতিভাবান ক্রিকেটারদেরও, এইসব মিডিয়া হাউজগুলিতে (যেখানে তখন পর্যন্ত টাকা খাটতো বিদেশী কর্পোরেটদের) চাকরি করা কমেন্টেটর এমন ভাবে ‘দেখাতেন’ যে তাঁরা যে এঁদের খেলতে দেখছেন এ তাঁদের ভগবৎ দর্শন হচ্ছে। এক প্রবীণ সাংবাদিকের লেখায় পড়েছিলাম, নিজে তো দেখেইছি, একটা নিখুঁত কভার ড্রাইভের পর বা লং অনের উপর দিয়ে শচীন একটা ছয় মারলে টিভি ভাষ্যকাররা যারা মূলত ওয়ার্ল্ডটেল-এর চাকুরে, এমন ভাবে বলতেন যে এরকম অলৌকিক শট এই ধরাধামে একমাত্র শচীনের পক্ষেই সম্ভব! শচীনের সঙ্গে ততদিনে (১৯৯৫ তে) মার্ক ম্যাসকারেনহাসের ওয়ার্ল্ডটেলের ৩০ কোটি টাকার চুক্তি হয়ে গেছে। তখনকার দিনের কথা ভাবলে, এই টাকার অংকটা শুধু লোভনীয় নয়, অকল্পনীয়ও বটে। আবারও বলি শচীন অসাধারণ ক্রিকেটার কিন্তু তাকে ‘ঈশ্বর’ করে তুলেছিল ভারতীয় গণমাধ্যম ও টিভি কমেন্টটররা। আর এই টিভি কমেন্টেটররা সবাই চাইতেন তাদের চুক্তির যেন নবীকরণ হয়। কেননা এত ইজি-মানি বোধহয় আর কিছুতেই নেই। এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে যেখানে সবসময়ই আমরা ঈশ্বর খুঁজি এবং নিজেরা ভক্ত হতে চাই, ভারতের ক্রীড়াজগত যেন এরকম একজনের অপেক্ষাতেই ছিল। যা অবশ্য ক্রমে ক্রিকেটকে আরও শক্ত করে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছে। এর পর একের পর এক ক্রিকেট হিরো এসেছে ভারতে এবং উপমহাদেশে। ফলে ক্রিকেটের এই পূজা পর্যায়ে, ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া আর কোথাও ক্রিকেট যে মেইনস্ট্রিম কোনো খেলাই নয়, এটা সমর্থকরা বুঝতে চাননি বা তাদেরকে অ্যাক্টিভলি ভুলিয়ে রাখা হয়েছে। এবার যা বলব, তা আগেও বহুবার বলা হয়েছে, তবু আরেকবার বলি। বলুন তো ক্রিকেটে টেস্ট প্লেয়িং নেশন ক’টা? ১২ টা। শেষের দিকে টিমগুলি অবশ্য পাতে নেবার যোগ্য নয়। এই কটা দেশ খেলে মানে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান চারটি দেশ সবসময়ই প্রথম দশে! ভারত তো ইদানীং কালে সবসময়ই প্রথম দুই বা তিনে! ক্রিকেটে যারা টাকা ঢালেন, আর আমাদের দেশি মিডিয়াও এই বিষয়টা খুব ভালো করে জানেন। যাই ঘটুক না কেন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, এমনকি বাংলাদেশও এই একটি খেলায় প্রথম ৭/৮ টা দেশের মধ্যে থাকবে। তাই আজও স্পনসরাররা তাড়া করে ফেরে এই খেলাটাকে। বিরাট জনবহুল একটা উপমহাদেশ। আর সেখানে মার্কেট ধরবার জন্য সব বহুজাতিক কোম্পানিগুলি হেদিয়ে মরছে। ক্রিকেট তাই এইসব কর্পোরেট বহুজাতিকদের জন্য এক আদর্শ খেলা। প্রত্যেক ওভারের মাঝে বিজ্ঞাপন। একটা ওয়ানডেতে ৯০/১০০ টা , এমনকি নয়া সার্কাস টি-টুয়েন্টিতে মিনিমাম ৪০/৪২ টা ব্রেক! একটা আইপিএল ম্যাচেও তাই, অন্তত ৪০ বার বিজ্ঞাপন করবার সুযোগ। ক্রিকেট একটা মহান খেলা, তারপরেও কেউ সন্দেহ করবে!

৩.
সত্যি বলতে কী প্রায় ৮ বিলিয়ন জনসংখ্যার পৃথিবীতে প্রায় পৌনে ২ বিলিয়ন মানুষের প্রিয় ক্রিকেট। সংখ্যার বিচারে নট ব্যাড! কিন্তু এই জনপ্রিয়তা শুধু প্যাশনের জায়গাতেই যদি সীমাবদ্ধ থাকত, অর্থাৎ আমি বা আমরা ক্রিকেট পাগল—এরকম যদি হত, কিচ্ছু বলার থাকতো না। যেরকম দক্ষিণ ভারতীয়রা দক্ষিণ ভারতীয় ফিল্ম বলতে পাগল! কিন্তু ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ঠিক এই জায়গায় থেমে নেই। কর্পোরেট শক্তি চায়, এই সময়সাপেক্ষ খেলাটি এ ভাবেই জনপ্রিয় থাকুক উপমহাদেশের মাটিতে! সত্যি বলতে কী এই খেলাটির ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। উপমহাদেশের বাইরে কোনোদিনই এই খেলা জনপ্রিয় হবে না! একটা জোকস আছে না, যে খেলার ভিতর দিব্যি লাঞ্চ করা যায়, চা খাওয়া যায় সেটা আর যাই হোক খেলা নয়! জোকস অ্যাপার্ট, যতই অর্জুনা রনতুঙ্গা, ডেভিড বুনেদের যুগ অতীত হোক না কেন, যতই ফিটনেস আইকন ক্রিকেটাররা খেলাটাতে দাপিয়ে বেড়াক না কেন, ক্রিকেটে সেই অর্থে অ্যাথলেটিসিজম অনেক কম। সমস্যাটা ঠিক এখানেই। ক্রিকেট খেলা হিসেবে যে গুরুত্বপূর্ণ নয় সেটা কর্পোরেট উপনিবেশবাদ, মিডিয়া হাউজ— এরা কেউই চায় না যে, উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ জানুক। আমরা যারা নিজেদেরকে ‘দেশী’ বলে ভাবি, আমাদের ইগো এত বেশি এবং আনলার্নিং এত কম, যে প্রবাসী ভারতীয়দের পক্ষেও জানা অসম্ভব, যে ক্রিকেট উপমহাদেশের বাইরে কোনো মেইনস্ট্রিম খেলাই নয়! ক্রিকেট অলমোস্ট একটা পার্ট-টাইম খেলা! টিভিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো খেলা হচ্ছে না, দু’ওভার ক্রিকেট দেখে নিলাম! বা নিউজিল্যান্ডাররা যেরকম বলেন ক্রিকেট সম্পর্কে, “আওয়ার সামার গেম”! নিউজিল্যান্ডে সামার অবশ্য দেড়-দুমাসের! অথচ উপমহাদেশে সারাবছরই ক্রিকেট।
কবাডি একটা ক্লাসিক এক্সাম্পল! অনেকেই হয়ত জানেন, হয়ত জানেন না, কবাডিতে ভারত অবিসংবাদিত ভাবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! অথচ কাউকে শুনেছেন, এই নিয়ে গর্ব করতে! আমি ২০/২৫ বছর বিদেশে আছি, বিদেশের মাটিতে কখনো কোনো ভারতীয়কে এই নিয়ে গর্ব করতে শুনিনি! কথাই বলতে শুনিনি! কেন? উপমহাদেশ বাদ দিয়ে বেশিরভাগ দেশে কবাডির কোনো জনপ্রিয়তাই নেই! এমনকি অলিম্পিকেও নথিভুক্ত করা যায়নি এই খেলাটিকে। যেমন ক্রিকেটও নেই। কিন্তু ক্রিকেট সাদা চামড়ার লোকজন খেলে। কবাডি সাদারা এখনও পর্যন্ত খেলে না। যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমি সত্যিই চাই কবাডি অলিম্পিকে থাকুক। দেশ একটা পদক পাক। কিন্তু ভারতের জাতীয়বাদী সরকার বা তাদের প্রতিনিধিরা সেটা এখন পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি। তবে এই খেলাটির প্রসঙ্গেও আমি সন্দেহ প্রকাশ করি। যদি এই খেলাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উপমহাদেশের বাইরে, এটা যেরকম বডি কনট্যাক্টস গেম, তাতে ভারতের আধিপত্য সত্যিই কত দিন অচ্ছুত থাকবে তাতে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়! আমি অনেক সময়ই মজা করে বলে থাকি, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ফিজি, ইত্যাদি যে কোনো একটা প্রথম সারির রাগবি প্লেয়িং নেশনের জাতীয় দলকে ১ মাস ট্রেনিং দেওয়া গেলে, মনে হয় না ‘বিশ্বসেরা’ ভারতীয় কবাডি প্লেয়াররা কবাডি খেলায় ওদের সামনে দাঁড়াতে পারবে! বিশ্বাস হচ্ছে না? আমাকে আপনার হীনমন্য ভারতীয় মনে হচ্ছে? যে কোনো দুটি প্রথম সারির জাতীয় দলের রাগবি ম্যাচ দেখুন। ওই স্পিড, স্ট্যামিনা, মাসল স্ট্রেন্থ, এনডিওরেন্স, ফিটনেস, আপনি যে কোনো রাগবি ম্যাচ দেখলেই বুঝবেন, আমার এই অনুমান কতখানি বাস্তব সম্মত এবং একেবারেই ছেলেমানুষি মজা নয়!
তো যে কথা বলছিলাম। ভারত কোনোদিনই গেমস অ্যান্ড স্পোর্টসের বিশ্বমঞ্চে কিছুই না। ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দুই নারী ও পুরুষ দৌড়বিদ, মিলখা সিং ও পি টি ঊষা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পাননি ‘একটুর জন্য’! অথচ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলি কিন্তু প্রত্যেকেই, ইউএসএ, চিন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের কথা ছেড়েই দিলাম, ১৫-২০ টা পদক পায় ৩/৪ টে সোনা পায়! কিন্তু সামান্য হলেও ভারত আগের থেকে কিঞ্চিৎ উন্নতি করেছে। গত অলিম্পিকে নীরজ চোপরা সোনা পেয়েছেন। তার আগে অভিনব বিন্দ্রা ২০০৮ সালে। যদি ভারতীয় মিডিয়ার অ্যাটেনশান আর স্পনসরারদের ক্যাশফ্লো আরেকটু ডিস্ট্রিবিউট হত ঠিকঠাক, কে বলতে পারে ভারত আরেকটু ভালো করতো না! কিন্তু সেই সম্ভাবনা ক্রিকেট একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। প্রথমত একজন তরুণ খেলোয়াড় সে যদি একজন ক্রিকেটার হতে পারে ও আইপিএলও খেলতে পারে তাহলেই কেল্লা ফতে! সে কেন, সাঁতার কাটতে যাবে বা সাইক্লিং-এ যাবে, যেখানে সারা পৃথিবী তার শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় গুলিকে তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে? আর ঘরের মাঠের প্রতিযোগিতাগুলিতে? সেখানে টাকা নেই!

৪.
অন্য আরেকটা ক্ষতিও হচ্ছে। সেটা আমার মতে আরও সাঙ্ঘাতিক। না না ক্রিকেটের সেই হেলমেট না-পরা তরুণ গাভাসকারের ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে মাইটি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্টবোলারদের বিরুদ্ধে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করে আসা বা ভিভ রিচার্ডসের ডেনিস লিলি-জেফ টমসনকে চিউইং গাম চিবোতে চিবোতে অনায়াস ঔদ্ধত্যে ঠ্যাঙানো বা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক অতীতেও ভিভিএস লক্ষ্মণের ইডেনে ফলোঅন করতে নেমে মহাকাব্যিক ইনিংসের যে রোমান্টিকতা, আইপিএল যুগে তা প্রায় অন্তর্হিত হতে চলেছে, সেই নিয়ে দীর্ঘশ্বাস নয় এটা! আমরা যারা ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থানে শঙ্কিত, এটাও অনেকটা তেমনি। বরং এটাকে এখনো চিহ্নিত করা যায়নি বলে ভয় হওয়া স্বাভাবিক!
ক্রিকেট ঘিরে একটা ফেক প্রাইড, একটা অদ্ভুতুড়ে জাতীয়তাবাদ নির্মিত হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে এর শিকড় আরও গভীরে যাচ্ছে। এই তো বছর কয়েক আগের মারিয়া শারাপোভা স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ডেভিড বেকহ্যামের পাশের রয়াল বক্সে যে মানুষটি (শচীন তেন্ডুলকার) বসে আছে তাকে চেনেন না। ব্যাস অমনি তখনকার টুইটারে ট্রেন্ড শুরু হয়ে যায়, #whoismariasharapova
ভারতীয় ট্রোলরা, ট্রোল শুরু করে দেয় এই বলে যে এত বড় সাহস হয় কি করে শারাপোভার, ক্রিকেটের ঈশ্বরকে চেনে না! ‘ভক্ত’-রা এমনও বলতে শুরু করে যে ওহে মারিয়া, তোমার টুইটারে ফলোয়ার ১.১ মিলিয়ন আর আমাদের ঈশ্বরের ৪.২ মিলিয়ন! ফেসবুকেও তোমার থেকে দেড়গুণ বেশি ফলোয়ার! তোমার এত সাহস!
ইন্ডিয়ান ক্রিকেট-প্রেমিকরা নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা দাবী করেন! ছোট্ট ঘটনা? না। বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না। এমনকি এটা যারা দাবী করে ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে টুকে নিউটন মধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেছিলেন, বা গণেশ পৃথিবীর প্রথম প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ, মহাভারতের যুগে ওয়াইফাই কানেকশন ছিল, তাদের জাতীয়তাবাদ থেকে এই ঘটনা খুব দূরে নয়। আমি জানি আমার অনেক প্রিয় মানুষ আছেন যারা মূলত অভ্যাসবশতই ক্রিকেট ভালোবাসেন, তারা এই লেখাটা পড়ে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হবেন আমার প্রতি। ক্রিকেট যারা ভালোবাসেন, তাদের ভিতর কী সব নাম আছে! জেফ্রি আর্চার, হিউ জ্যাকম্যান, স্টিফেন ফ্রাই, রাসেল ক্রো, এরিক ক্ল্যাপটন, মিক জ্যাগার, আমাদের রামচন্দ্র গুহ! অনেকের অদ্ভুত লাগবে বললে, হ্যাঁ এইসব মানুষদের ক্রিকেট প্রেম আলাদা জাতের। ব্যাপারটা এরকম যে একজন অত্যন্ত চিন্তাশীল মানুষও মাছ-ধরার ভিতরে তার শ্রেষ্ঠ বিনোদন খুঁজে নিতে পারেন! এমন কাউকে কাউকে জানি, যারা মাছ ধরে সেটাকে আবার ছেড়ে দিয়ে আসেন। ওই ধরাটুকুতেই তাঁদের আনন্দ! ক্রিকেটেও জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে এমন সব স্বর্গীয় আনন্দ আছে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের খেলাতে যেরকম এক দেশের সমর্থকরা অন্য দেশের সমর্থকদেরকে যে ভাবে, যে ভাষায় আক্রমণ করেন, তাতে মনে হয় না, আজকের ক্রিকেট সমর্থকরা ক্রিকেটের সেই আনন্দ নিতে জানেন! ক্রিকেট এখন কত বলে কত উইকেট বা কত রানের খেলা!
বেশ মনে আছে, গত বছর, বিশ্বকাপ শেষে যেদিন অস্ট্রেলিয়া কাপ হাতে নিল, একটা আতশবাজিও বাজিও সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ফাটেনি! অন্যদিকে এখন অস্ট্রেলিয়ায়, আগে নিউজিল্যান্ডে দেখেছি, ভারতের সঙ্গে যে কোনো ক্রিকেট ম্যাচে ভারতীয় দর্শক সংখ্যা, স্থানীয় দেশের সমর্থকদের তুলনায় বেশি। এমনকি এও শুনেছি, সাধারণ গ্যালারিতে ভারতীয় দর্শকদের উৎপাতে এখন স্থানীয়রা আরও কম যেতে শুরু করেছেন! অন্যদিকে ভারতীয় ব্যাটসম্যানের পুশ করা বল থার্ডম্যানে ফিল্ডারের হাতে গেলেও, বল যেহেতু অনেকটা দূর ট্রাভেল করেছে, ভারতীয় সমর্থকরা ঢোল, তাসা ইত্যাদি পেটাতে শুরু করে! এত হৈ চৈ করে যেন ক্রিকেট না, সামনে একটা যুদ্ধ হচ্ছে আর ভারত প্রমাণ করছে তারা পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বা অপ্রতিদ্বন্দ্বী!
এই ফেক প্রাইড, এই অদ্ভুতুড়ে জাতীয়তাবাদের শিকড় আগেই বলেছি, যতদিন যাচ্ছে আরও গভীরে যাচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান, ভারত-বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলা হলেই যে সব অযৌক্তিক, অশালীন তর্ক-বিতর্ক উঠে আসে, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় তাতে যে কোনো সুস্থ রুচির মানুষের খারাপ লাগার কথা। আমার তো অসহ্য লাগে! সারা বছর আন্তর্জাতিক খেলা হচ্ছে, কখনো টেস্ট, কখনো ওয়ান ডে, কখনো টি টুয়েন্টি, তারপরেও বিভিন্ন আইসিসি টুর্নামেন্ট, সবমিলিয়ে ক্রিকেট-বিনোদন সবচেয়ে অঢেল এবং সস্তাও। আর এই সুযোগে বাড়ছে আস্ফালন! আমরা সেরা, আমাদের অমুক ব্যাটার তোমাদের ওই ব্যাটারের থেকে অনেক ভালো, আমাদের এই বোলারের একার যা উইকেট সংখ্যা তোমাদের সবক’টা বোলারের মিলিত উইকেট-সংখ্যা তার চেয়ে কম! আমাদের ওপেনারের এতগুলি সেঞ্চুরি আছে, আমাদের উইকেট কিপারের অতগুলি ক্যাচ! আর হবে নাই বা কেন ক্রিকেটে রেকর্ডের কোনো ইয়ত্তা নেই। অগুনতি রেকর্ড! ওডিআইতে সবচেয়ে বেশি মেইডেন, টি-টুয়েন্টি সবচেয়ে বেশিবার হাফ সেঞ্চুরি! কেউ টেস্টে অলরাউন্ডার হিসেবে সবচেয়ে দ্রুত ১০০০ রান ও ১০০ উইকেট নিয়েছে তো কেউ একদিনের আন্তর্জাতিকে সবচেয়ে বেশি মেইডেন ওভার করেছে! অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সবচেয়ে বেশি রানের কৃতিত্ব বা ওয়েস্ট ইন্ডিজে মাটিতে ডেবিউ করে ওই সিরিজে সবচেয়ে বেশি রান। এ সবই কৃতিত্বের, কিন্তু ক্রিকেটে এরকম হাজার খানেক রেকর্ডের কথা ভাবা যায়! আর ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ রেকর্ড ভালোবাসে। অনেক দিন আগের কথা ক্রিকেট নিয়ে বিলেতের এক ইউনিভার্সিটি একটা রিসার্চ করেছিল। সেখানে ওঁরা দেখিয়েছিলেন একজন ব্যাটসম্যানের একটা ইনিংস ওই টিমের জয়ের জন্য বা হার বাঁচানোর জন্য ঠিক কতখানি প্রভাবশালী ছিল। মজার কথা হল ওই সবচেয়ে ‘প্রভাবশালী’ লিস্টে শচীনের একটাও ইনিংস ছিল না। কিন্তু শচীন যেহেতু প্রচুর রান করেছেন, অনেক রেকর্ড করেছেন, তাই তিনি হলেন ক্রিকেটের ভগবান! অবশ্যই শচীন জিতিয়েওছেন অনেকবার, কিন্তু ভগবান? আমার আপত্তি থাকবে এই নিঃশর্ত ভক্তগিরিতে। কিছুদিন আগেই অভয়াকাণ্ডে সৌরভ, ডোনা এবং ওঁদের কন্যার প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম! দেখছিলাম প্রচণ্ড সমালোচনা হচ্ছে! শচীনও বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে টুল-কিট প্রতিক্রিয়া দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন! শুল্ক বাঁচিয়ে ফেরারি গাড়ি নিয়ে এসে, সে গাড়ি বেঁচে দেওয়ার কথা ছেড়েই দিলাম! আমি অবশ্য শচীন, সৌরভ, বিরাটদের, বিরাট দোষ দেখি না। এঁরা প্রফেশনাল। হ্যাঁ একটা পর্যায়ে পৌঁছে ভারতীয়রাও ‘প্রফেশনাল’ হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত! কিন্তু আমি তাঁদের দিকে আঙুল তুলব, যারা ভাবেন, এঁরা সব ভগবান বা (কলকাতার) রাজপুত্র! অথবা আঙুল তুলব মিডিয়া-ফৌজের দিকে যারা লাগাতার ক্রিকেট কভারেজ করে আমজনতাকে এই পর্যায়ের অন্ধ-ভক্ত হতে বাধ্য করে। এই তো কিছুদিন আগেই দেখছিলাম এক নামকরা ভারতীয় ক্রিকেট লিখিয়ের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট ছিল এই বিষয়ে যে, অশ্বিন নাকি ওয়ার্নের চেয়েও বড় স্পিনার! কেননা পরিসংখ্যানে অশ্বিন এগিয়ে আছে! অথচ পরিসংখ্যান যে ক্রিকেট নয়, এটা ওই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ আমার চেয়েও ভালো জানবার কথা। সম্ভবত। আমাদের মনে আছে এক সময় কলকাতার ক্রিকেট লিখিয়েরা লাগাতার ‘প্রমাণ’ করতেন গাভাসকার নাকি ডন ব্রাডম্যানের চেয়েও বড় ব্যাটসম্যান! ঠিক এইগুলিই ভারতীয় জনমানসে গভীর প্রভাব ফেলতে ফেলতে আজ এক রোগের মহীরুহ তৈরি করেছে, যার অপ্রয়োজনীয় বিষাক্ত রেণু শ্রমজীবী বা নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের গায়ে এসে তো পড়েছেই, এমনকি চিন্তাশীল মানুষ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সবাই আক্রান্ত! মেইনস্ট্রিম বলিউড আর ক্রিকেট এই দুটিই যেন ক্রমশ ক্ষতিকারক অ্যাডিকশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর দু’টির পিছনেই রয়েছে কর্পোরেট হাউজগুলি, যারা নিজের মুনাফা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না। ক্রীড়াক্ষেত্রে ভারতের উন্নতি তো অনেক দূর কী বাৎ!

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80