হতাশা ও রবীন্দ্রনাথ    সৌভিক গুহ সরকার

হতাশা ও রবীন্দ্রনাথ সৌভিক গুহ সরকার

রবীন্দ্রনাথ আমার ও আমার মতো অসংখ্য মানুষের আত্মজীবনের অংশ। সেই ‘ওপারেতে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা-তে হাত ধরেছিলেন তিনি। আজ এই বয়সে এসে আমি তাঁর হাত আঁকড়ে ধরছি। আরও তীব্রভাবে। কবিতা, গান, গদ্য, নাটক— আজ যেন সব কিছু ম্লান হয়ে যায় ওই লোকটির ব্যক্তিত্বের সামনে। এখন ওঁকে পড়ি। ওঁকে খুঁজি। ওঁর সামান্য চিঠিপত্রে। কোথাও কাউকে করা কোনো মন্তব্যের ভেতর।‌ রবীন্দ্রনাথের একটি জনপ্রিয় সাফল্যমণ্ডিত মূর্তির বাইরে— যে-আমার অন্ধকারের রবীন্দ্রনাথ, আমার হতাশার রবীন্দ্রনাথ— এই লোকটি আমাকে আমার মধ্যবয়সে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।‌ আমি আমার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওঁর পতন দেখি, যন্ত্রণা দেখি— একটা খাঁচার মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে লোকটা ছটফট করছে। একটা সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়া সংসার নিয়ে বিপর্যস্ত। সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন। কী হবে? কীভাবে জীবন এগোবে? ওদিকে শান্তিনিকেতনের পাঠশালাও কিছুতেই দাঁড়াচ্ছে না। আজ এই শিক্ষক আসে, তো কাল ওই শিক্ষক যায়। দুশ্চিন্তায় ডুবে রয়েছে লোকটা। ঠিক এইখানে তাকিয়ে থাকি আমি। চূড়ান্ত হতাশার মুহূর্তে কী করছেন মানুষটা? সব কিছু ছেড়ে দিয়ে নেশায় ডুবে যাচ্ছেন? সেটাও হতে পারত। কিন্তু হচ্ছে না। মানুষটি যেন অতল হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। নিজের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। তাকে চাবুক মারছেন। গানে মারছেন। কবিতায় মারছেন। আর যেখানে গান নেই, কবিতা নেই— সেখানে চিঠিপত্র। যেখানে তাও নেই। যেখানে তিনি নিঃসঙ্গ, চূড়ান্ত হতাশাগ্ৰস্ত— সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন কর্মকে অবলম্বন করে। আমি লক্ষ করে দেখেছি যে জীবনের চরমতম দুর্দিনেও, তিনি তাঁর কর্তব্য ত্যাগ করেন নি। অথচ আমরা তো করি। ভালো লাগছে না, মন ভালো নেই, যা করেছি সব শূন্য— এইসব তো আমাদের মনের মধ্যেও নিয়ত উঁকি দিয়ে যায়। তাঁরও দিত।‌ আমার তমিস্রা দিয়ে আমি তাঁর অন্ধকার ছুঁয়ে দেখি। সেই আঁধারের মধ্যে দেখি অক্লান্তকর্মা এক পুরুষকে, যিনি শত আঘাতেও ভেঙে পড়ছেন না। এর মানে কিন্তু এই নয় যে তাঁর নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হচ্ছে না। হয়েছে তো। নোবেল পুরস্কার পাবার কয়েকদিনের মধ্যেই হয়েছে। যশোধরা রায়চৌধুরী একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন, সেখানেই দেখতে পাওয়া যাবে রথীন্দ্রনাথকে লেখা সেই চিঠি। তিনি সুইসাইডাল সেখানে। আত্মঘাত পর্যন্ত চলে যাচ্ছেন। কিন্তু খাদের আগে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। এইখানে আমার রবীন্দ্রনাথ। এই ঘুরে দাঁড়ানোর ভেতর। রবীন্দ্রনাথের ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনের ইঙ্গিত তাঁর গানে, কবিতায় রয়েছে। রক্তকরবীতেও রয়েছে। নিঃসঙ্গতা, শূন্যতাবোধ, কর্মের অর্থহীনতা— এগুলো ফিরে ফিরে এসেছে। গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভেতরে ভেতরে তাঁকে। ঠিক এই জায়গায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আলাদা হয়ে গেলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রখর ছিল না। সবার থাকে না। তিনি খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার তুঙ্গে উঠেও কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ব্যবসায় ও জমিদারিতে সফল হলেন না। কাদম্বরী যখন চলে গেলেন তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ৩৫ বছরের তরুণ যুবক। তবুও তিনি নিজেকে সরিয়ে নিলেন। লড়লেন না। রবীন্দ্রনাথ লড়েছেন। সারাজীবন। তিনি কি ব্যবসায় লোকসান করেন নি? করেছেন। বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে দিনের পর দিন দুশ্চিন্তায় ভোগেন নি? ভুগেছেন। তিনি কি নিয়তির চাবুক সহ্য করেন নি? দশ বছরের রেণুকার বিয়ে দিলেন। সেই মেয়ে বাঁচল না। কী মারাত্মক অপরাধবোধ তৈরি হতে পারে একজন পিতার মনে? আর শমীন্দ্র? তাঁর মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের জীবনে কাদম্বরীর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় আঘাত। এছাড়া শান্তিনিকেতন নিয়ে পদে পদে অপদস্থ হচ্ছেন। অবলা বসুর সঙ্গে প্রায় সম্পর্ক ছিন্ন হবার জোগাড়। কেন? তিনি শান্তিনিকেতন সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। আবার সেই রবীন্দ্রনাথ পরে রেগে গিয়ে বলছেন, ‘কী পাপ করেছিলুম? বিশ্বভারতী?’ রবীন্দ্রনাথ জীবনের এই শতসহস্র হতাশার সঙ্গে মহাকাব্যিক যুদ্ধ করেছেন। নিজের অন্তরে। মার খেয়ে লুটিয়ে পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছেন। ঠাকুর পরিবারে এমন লড়াকু ব্যক্তিত্ব দ্বারকানাথ ছাড়া কেউ ছিল না। দ্বারকানাথও এত যন্ত্রণা দেখেন নি। রবীন্দ্রনাথ হাল ছেড়ে দিতে পারতেন অতুলনীয় প্রতিভাবান জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো, কিন্তু ছাড়লেন না।‌ মধ্যবয়সে এসে অন্ধকারের ওজন বাড়ে। বুকের ওপর হাতি চলে। কী পেরেছি, তার চেয়ে এককোটি গুণ বড় হয়ে ওঠে কী পারিনি। কী আর হবার সম্ভাবনামাত্র নেই। এই সত্য মেনে নিতেই হয়। নির্মম হলেও। নিজের কাছে নিজে ঋজু হয়ে দাঁড়াতে না পারার সংকোচ তৈরি হয়।‌ নিজেকে করা প্রতিশ্রুতিগুলো থেকে ক্রমাগত নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার খেলা চলে। আত্মপ্রতারণার আগুনে দগ্ধ হয় হৃদয়। তখন সত্যই অবলম্বন। নিরেট। নির্মম। কঠোর। নিজের পায়ের তলায় কাল্পনিক মাটি নয়, সত্যকারের ভূমির প্রয়োজন হয়। তখন ওই লোকটিকে দেখি। দেখি ওঁর মধ্যবয়স। ওঁর দাঁতে দাঁত চেপে ক্রমাগত নিজেকে কর্মে নিয়োজিত রাখার নিরলস প্রচেষ্টা। দেখি, হতাশার মেঘে ক্রমশ আচ্ছাদিত হতে হতেও চাবুক মেরে নিজেকে তুলে পুনরায় উদ্যোগ বজায় রাখার তপস্যা। ঐখান থেকে শক্তি আসে। আলো আসে। নিজেকে কর্মপথে নিয়োজিত রাখার বাতাস আসে। কত কবি সাহিত্যিক শিল্পী এসেছেন— তাঁদের সৃষ্টি ভালো লেগেছে। কিন্তু কারোর জীবন আর সৃষ্টি এক হয়নি এভাবে। রবীন্দ্রনাথে সব একাকার। পদে পদে আঁকড়ে ধরতে হয় তাঁকে। কোনো মহৎ বাণীর জন্যে নয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিকে তিনি কীভাবে দেখেছেন, কীভাবে সেটাকে গ্ৰহণ করেছেন— এটা দেখার জন্যে। তাঁর অহমিকা, তাঁর পতন, তাঁর হতাশা, তাঁর লড়াই— আলোর জন্যে আকুতি, নিজেকে বারবার সংশোধন করার প্রচেষ্টা— ভুল হলে সেটা মেনে নিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করার উদারতা— এইসবগুলো দেখি। এইখানে জীবন। দগদগে। ফাট-ধরা। এইখানে আমার রবীন্দ্রনাথ। এখন। আহত এবং হতাশাগ্ৰস্ত মনকে পুনঃপ্রজ্জ্বলিত করে তাকে উচ্চতার দিকে প্রবাহিত করতে পারার শিক্ষা তাঁর জীবন আমাদের দেয়।

চারপাশ অস্থির এখন। এত মৃত্যু আর বোমার মধ্যে নিজেদের লেখাগুলো হাস্যকর এবং অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। এক অপরিসীম শূন্যতার বোধ গ্ৰাস করে। এই সময় তাঁর কাছে ফিরি। আমাদের তো আর ফেরার জায়গা খুব বেশি নেই! এক মহাকাশব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি দূরে একটা কুঁড়েঘর। সেখানে নক্ষত্রের মতো এক লন্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মধ্য বয়সের রবীন্দ্রনাথ।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes