প্রণাম, আশি বছরের এক তরুণ
পার্থজিৎ চন্দ
‘ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় ন’জন অভিযুক্তের মধ্যে আমিই ছিলাম শেষ ব্যক্তি যাকে ইউএপি-এ ধারায় বন্দি করে ইরাওয়াদা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসা হয়েছিল। …২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর পুণে পুলিশ রাত আট’টায় আমাকে গ্রেফতার করে, পরের দিন আমাকে সেশান কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয় ও সেখান থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
নভেম্বরের ২৭ তারিখে আমাকে আবার জুডিশিয়াল কাস্টডিতে নেওয়া হয়। তারপর এক দুঃস্বপ্নের রাত, শীতের রাত্রি, আমাকে ফাঁসি-ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে আমার সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া সহকর্মীরা আগে থেকেই বন্দি-দশা কাটাচ্ছিল।
সেল নম্বর কুড়ি, একদম শেষ প্রান্তে থাকা একটি কুঠুরি, কুঠুরিটির ঠিক সামনে ফাঁসির মঞ্চ। একটি মাত্র ছোট দেওয়াল, ফাঁসির দড়িটি চোখের সামনে দুলে চলেছে সব সময়। এই ফাঁসির দড়ি দুলতে দেখা আমার কাছে নতুন নয়। একই রকম একটি ‘গুঞ্জ’-এ ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমাকে রাখা হয়েছিল। ‘গুঞ্জ’-এ ফাঁসির আসামিদের রাখা হয়। সেকেন্দ্রাবাদ জেলা সংশোধনাগারে ফাঁসির দড়ি ঝুলতে আমি আগেই দেখে ফেলেছি।
…মাঝে মাঝে বন্দির সংখ্যার হেরফের ঘটে, দু’একজন করে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বা বিচারাধীন বন্দিকে এখানে আনা হয়, কিন্তু মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দির সংখ্যা সব সময়েই এক-সংখ্যাটা কুড়ির উপর। এদের মধ্যে দু’জন মুসলিম রাজনৈতিক বন্দি, তাদের বয়স যথাক্রমে পঁয়তাল্লিশ ও পঞ্চাশ বছর, তারা ২০০৮ সালের মুম্বই ট্রেন বিস্ফোরণের অভিযোগে অভিযুক্ত। অরাজনৈতিক বন্দিদের মধ্যে দু’জন মুসলিম। বাদবাকি বেশিরভাগই দলিত, অন্তজ শ্রেণীর মানুষ। দু’একজন ছাড়া তাদের বেশিরভাগই নিদারুণ গরিব। তাদের মধ্যে দু’একজন হয়তো শিশু-ধর্ষণের মত জঘণ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু বাদবাকি বন্দিরা ক্ষমতাশালীদের হাতে খুন হওয়া বিচারব্যবস্থার শিকার। যেমন একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – এক মারাঠি যুবতী কয়েকজন দলিতের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল, মহারাষ্ট্রে মারাঠিদের মধ্যে সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কিন্তু বেছে বেছে গ্রেফতার করা হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল কয়েকজন নিরাপরাধ দলিত তরুণকে। দু’একজন বাদে সবারই বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে।
…আমরা সবাই নিশ্চয় এতদিনে বুঝে গেছি কেন ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭’র এলগার পরিষদের মিটিঙ-কে মাওবাদী তকমা দেওয়া হয়েছিল, কেন ১০১৮’র ১ জানুয়ারির ভীমা-কোরেগাঁও হিংসার সঙ্গে একে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। লেখক অমিতাভ ঘোষ তাঁর একটি চিঠিতে আমাকে লিখেছেন, তিনি নকশাল-আন্দোলনের ঝোড়ো দিনগুলিতে কলকাতায় ছাত্রাবস্থা কাটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি সেই আন্দোলনকে সমর্থনও করতেন না। কিন্তু ভীমা-কোরেগাঁও মামলার সঙ্গে তিনিও নকশাল-আন্দোলনের কোনও মিল খুঁজে পান না।
সত্যিটা হল এই যে, এটি আসলে হিন্দু-ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এক চক্রান্ত। কোটি কোটি দলিত, আদিবাসী, মুসলিম আর পিছিয়ে পড়া মানুষদের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র, এমনকি এক শ্রেণীর মারাঠীও এদের ষড়যন্ত্রের শিকার…’
-আশি ছুঁইছুঁই এক কবি গরাদের আড়াল থেকে লিখেছিলেন এক কথাগুলি। গরাদের আড়ালে তাকে বন্দি করার প্রচেষ্টা কোনও খামতি রাখেনি রাষ্ট্র কোনও দিন। অন্তত এই কাজটিতে কোনও রকম গাফিলতি দেখিয়েছে সরকার-বাহাদুর এই অভিযোগ কেউই করবেন না। বারবার তাঁকে আর্মস-কেস ‘দেওয়া’ হয়েছে, বিস্ফোরক যে তিনি সঙ্গে নিয়েই ঘোরেন এ-বিষয়ে রাষ্ট্র নিশ্চিত। ছাত্রছাত্রীদের খেপিয়ে তুলতে তিনি যে দক্ষ, এতদিনে সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁর কবিতাই এসবের পক্ষে সব থেকে বড় ও অকাট্য প্রমাণ। তিনি তাঁর দিকে ওঠা সব অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করবার পক্ষে কথা বলে থেমে থাকেন না, রাষ্ট্রকে চরম ‘রেডিকিউল’ করে চলেন। রাষ্ট্র পড়ে মহাবিপদে, কারণ এই আশি-বছরের তরুণ দিগন্ত কাঁপিয়ে হাহা করে হাসতে হাসতে মাটিতে মুখ গুঁজে দেন, যে মাটির তাঁরও সে-মাটি থেকে ফসল আর ঘামের গন্ধ নেন।
কলকাতা একদিন দেখেছিল এক অসামান্য কৌশল, টিয়ার-গ্যাসের শেল কুড়িয়ে পুলিশের দিকে ছুড়ে দিত তরুণেরা। সেটি শুধুমাত্র একটি কৌশল ছাড়িয়ে আজ আরও বড় মাত্রা নিয়ে ধরা দেয়, ক্ষমতার সামনে ‘নিরস্ত্র’ মানুষের লড়াইও হয়তো ‘অস্ত্রহীন’ নয়। মার খেতে খেতে সে নিজেই খুঁজে নেয় বিকল্প পন্থা, অস্ত্রের মুখ ঘুরিয়ে দেয়। ভারভার রাও তেমনই এক পথ। ভারভারা রাও আসলে কোনও একজন মাত্র কবি নন, তিনি এক বিকল্প পন্থা। ক্ষমতার আস্ফালণের সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের অস্ত্র সরবরাহ করবার অভিযোগে অভিযুক্ত ভারভারা নিজেই এক ‘বিকল্প’ ক্ষমতার সন্ধান দেন তাঁর লেখায়। তিনি লেখেন,
‘আমি ওদের বিস্ফোরক পৌঁছে দিইনি
আমি ওদের বিস্ফোরক বিষয়ে কোনও পরামর্শও দিইনি
তোমরাই লোহার জুতো দিয়ে
পিপড়ের ঝাঁকে পা দিয়েছিলে
আর ক্ষতবিক্ষত মাটি থেকে উঁকি দিয়েছিল
প্রতিশোধের আগুন
আসলে তোমরাই মৌমাছির ঝাঁক খুঁচিয়েছ
তোমাদের লাঠি দিয়ে
তোমাদের সাজানো বারান্দায় ফেটে পড়েছিল
ভয়ার্ত ও রাগি মৌমাছিদের গুঞ্জন
যখন জনগণের বুকের মধ্যে
বিজয়ডঙ্কা বেজে উঠেছিল
তোমরা তাকে শুধু এক ব্যক্তিবিশেষের ভেবে ভুল করেছিল
সাজিয়েছিলে বন্দুক
আর সমস্ত দিগন্ত জুড়ে ঝমঝম করে বেজে উঠেছিল বিপ্লবের গান’
জনগণের ‘শত্রু’ হয়ে ওঠা ক্ষমতাকে সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন ভারভারা, অনঙ্গ-আঁধারেও তিনি দেখেছিলেন সে-শত্রুর চারটি পা…তার কান আসলে টেলিপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ। রেডিও থেকে অবিরাম ঘোষিত হয়ে চলে তার বার্তা। কিন্তু চমকে উঠেছিলাম মাত্র তিনটি পঙতি পড়ে,
‘In what discourse
Can we converse
With the heartless’
-মানুষের সঙ্গে মানুষের কথোপকথন হতে পারে, কিন্তু যারা হৃদয় উপড়ে ফেলে ক্ষমতার শিখরে আরোহন করে রয়েছেন তাদের কাছে দলিত ও অবদমিতের কান্না পৌঁছানোর কথা নয়।
আজ বিশ্বগ্রামের মধ্যে রাষ্ট্রও তার রূপ বদল করছে দ্রুত। এক একটি ন্যারেটিভ সুকৌশলে বুনে দেওয়া হচ্ছে, কাউন্টার-কালচারের ধারা বদলে যাচ্ছে দ্রুত। পোস্ট-সেকুলার পর্বে ‘রিলিজিয়ন’-এর ফিরে আসা বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। প্রতিবাদের প্রশ্নে রাষ্ট্র ও লেখকের মধ্যে সম্পর্ক আপাতভাবে দেখলে বেশ ‘মধুর’। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেকের মনেই এই সন্দেহ বেশ জোরালো হয়ে দানা বেঁধেছে যে রাষ্ট্র যখন ব্যক্তিকে ভার্চুয়াল ‘স্বাধীনতা’ দিচ্ছে প্রতিবাদের…লেখককে স্বাধীনতা দিচ্ছে ‘নিয়ন্ত্রিত’ প্রতিবাদের তখন এই আশি-বছরের ‘বৃদ্ধ’ নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রবিরোধী কাণ্ডে লিপ্ত। সেই লিপ্ত হওয়া রাষ্ট্রপ্রধান’কে হত্যা করার প্রচেষ্টা পর্যন্ত বিস্তৃত হতেই পারে।
এর একটিই উত্তর, না এবং না।
সমস্যাটি ঘনিয়ে তুলেছেন ভারভারা নিজেই, তিনি ওই ‘নিয়ন্ত্রিত’ প্রতিবাদের মাত্রাটিকে বিস্তার দিয়েছেন। ভারভারা লিখছেন,
‘আপনারা যারা ধনী হয়ে জন্মেছেন
তারা ভাগ্যবান
আপনারা ধুরন্ধর
আপনাদের ভাষাতেই বলতে হয়
‘জন্মেছেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে’
আপনাদের প্রতিবাদ বেশ সুন্দর
আমাদের দুর্দশা ভয়ংকর
আপনারা ধুরন্ধর
আপনারা বাসের কাচ ভেঙে ফেলতে পারেন
সুচারুভাবে
সুর্যকিরণের মতো সুচারুভাবে
আপনারা শিল্পের দক্ষতায়
টায়ারের হাওয়া খুলে দেন
আর পুলিশ নীরব হয়ে দেখে
রাইফেলের ওপর ঝুলে থাকে তাদের থুতনি’
-এখানেই ভারভারা সব থেকে বড় ‘থ্রেট’। তিনি নির্ভুলভাবে চিনতে পারেন রাষ্ট্র আর প্রতিবাদের মধ্যে ধূসর অঞ্চলটিকে। তিনি ভেঙে দেন সেই সীমানা, বারবার রেডিকিউল করেন ক্ষমতাকে।
ভারভারার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ক্ষমতার আসলে প্রতিবাদ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। কারণ প্রতিবাদের সীমানা শেষপর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয় সে নিজেই। ক্ষমতা অনেক বেশি ভাবিত ভারভারার হাতে ‘রেডিকিউলড’ হয়ে যাবার বিষয়ে। টেম্পস্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন কবি তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবে, তাকে নাঙ্গা করে দেবে বারবার – এটি যে কোনও ক্ষমতা-কাঠামো ও রাষ্ট্রের পক্ষেই মেনে নেওয়া কঠিন। শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব।
এই অসহায়তা থেকেই রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকে আমদানি করতে হয় ‘রেডিকিউলিং’ নানান ট্যাগ। ঠিক এই পথেই আমদানি হয় ‘আর্বান নকশাল’ নামক ট্যাগ। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ক্ষমতা আসলে ভারভারার ওই তাচ্ছিল্যের হাসির দিকে ছুড়ে দিতে চায় এই টার্মটিকে।
হায় রাষ্ট্র, হায় ক্ষমতা – নশ্বর মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে একদিন নিশ্চিত। কিন্তু ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করা মানুষের হাসি ফুরায় না। দশক থেকে শতক পেরিয়ে সে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। অতিমারিতে আক্রান্ত কবির মুক্তি নেই গারদ থেকে।
কিন্তু মানুষের মুক্তি আছে। নিশ্চিতভাবেই আছে। আজকাল সাড়ে-চারশো বছর আগে এক বন্দির কথাও মনে পড়ে মাঝে মাঝে। শোনা যায় তিনি বলেছিলেন, ‘হায়, আমি বললেই কি আর সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরবে?’
ক্ষমতা, তোমার গরাদ আছে…কিন্তু এক কবির তাচ্ছিল্য অতিক্রম করার শক্তি নেই।
নেই এবং নেই…