“বাতাস আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে শুধু ক্রিস্টোফারের জন্য”
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কবি অংশুমান কর-কে কথা প্রসঙ্গে একজন তরুণ কবি একদিন বলেছিলেন যে অমিতাভ মৈত্র বাংলা কবিতা লেখেন না । অমিতাভ মৈত্রের শারীরিক মৃত্যুর পর এই কথাটি আমাকে ঘিরে ধরেছিল । কারন এই প্রশ্ন একদিন ছিল আমারও । তাঁর কবিতা প্রথম পড়ার পর তো আমারও এই প্রশ্ন জেগেছিল মনে । কবিতাকে কি কবির দেশের আলো হাওয়া সময়সংলাপ মাখতেই হবে ? কবিতাকে কি এমন অতিনির্ধারিত সূত্রাবলী দিয়ে ঘেরাও করে রাখতে পারি আমরা ? চারপাশের পৃথিবী যদি উঠে না আসে লেখায় তাহলে কি সেই কবির লেখা আমরা পড়ব না ? তাহলেই কি বলে উঠব যে বাংলায় কবিতা লিখতেন না উনি ?
এ আসলে ভেবে দেখার মতই বিষয় যে, সত্যি কেন এমন কবিতা আমরা চাই যেখানে নিজের দেশ নিজের সময় নিজের চারপাশ থাকবে ? আসলে লেখা থেকে ঠিক কী যে আমরা চাই তার হয়তো সাধারণ কোন সূত্র তৈরি করার মতো এই লেখকের ক্ষমতা নেই, তবু একটা অবজেক্টিভ তো এটা অবশ্যই যে পাঠক হিসাবে আমরা নিজেকে পেতে চাই সেখানে । আয়নায় নিজেকে দেখার আনন্দ থাকেই, তার সঙ্গে তারচে বেশি কিছু আমরা পেয়ে থাকি সেখানে । কিন্তু পাওয়ার আনন্দও কবিতায় ঘেরাও হয়ে থাকে অজস্র নীরবতার মধ্যে, আবিস্কারের মধ্যে । মনে হয়, প্রকৃতিরই মতো বোবা যেন একটি কবিতা ! প্রকৃতি এক আশ্চর্য ভাষায় নিরন্তর আমাদের সঙ্গে কথা বলে চলে, কবিতাও তাই । সে যা বলে না সেটাও সে বলতে চায় । এই মহাজগত নীরবতায় বোবা হয়ে আছে, কবিতাও বোবা হয়ে আছে শব্দে বাক্যে ভাষায় যতক্ষণ না তাকে আমরা পাঠকেরা নিজেদের মতো নির্মাণ করে না নিচ্ছি, ততক্ষণ তা গভীর সংকেত আর নীরবতার ঈশারায় আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় । কিন্তু অঘ্রানের হাওয়া বললে সঙ্গে সঙ্গে যে অনুভূতি আমাদের হয় তা “বরফ ঝড়ের জন্য আমাদের নৈশভোজ খানিকটা দেরি হয়ে যায়” পড়লে হয় না । হয় না কারন তা এনে দিচ্ছে আশ্চর্য অচেনা একটি চিত্র । আমাদের চারপাশ কোনটি ? যে রাজ্যে আমি জন্মেছি সেটাই ? অথবা যে দেশে আমি বড়ো হয়েছি ?
কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কি তাই ? কবিদের যে বলা হয় এই পৃথিবীর unacknowledged legislature, অন্তত শেলী তাই ভেবেছিলেন , তাহলে কি সেটা মিথ্যে ? ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় বা সুদূর লাদাখে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা কি আমার ঘটনা হতে পারে না ? তাহলে রবীন্দ্রনাথ কেন আফ্রিকা কবিতাটি লিখলেন ? কেনই বা পাঞ্জাবের জালিয়নওয়ালাবাগ-এর ঘটনায় কবি বিচলিত হলেন ? এ কি তাহলে নিজের দেশের বলেই ঠিক আছে ? কবিতার পাঠক কি তাহলে এমনই সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন ?
মানুষ বেড়াতে যায় কেন ? অন্য দেশের উদ্বোধন করতে ? নিজের দেশের থেকে সাময়িকভাবে ছুটি নিতে ? বহিঃপ্রকৃতিকে আবিস্কার করতে ? নাকি তার সঙ্গে নিজেরই আত্মার একটা যোগ তৈরি করতে ? বেড়াতে যাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে একটা তো এটা অবশ্যই যে সে অচেনাকে আবিস্কার করতে চায়, পরিচিত পৃথিবীর বাইরের জীবনকে সে জানতে চায় ! এইখানে এসে হয়ত আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের দিকে আকর্ষণের একটা কারণও অনুভব করা যেতে পারে । বাইরের প্রকৃতি যে কেবলিই এক অন্তঃপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে চায়, সে তো কেবল কথার কথা নয় । আসলে পোশাক বা ভাষা বা জল-হাওয়া আলাদা হলেও শিল্পীরা শেষমেশ ছুঁয়ে দেখতে চান মানুষের মন, এই মরজগতে তাদের অবস্থান অথবা এই মহাজগতে সেই অবস্থানের কী সৌন্দর্য সেসব তারা গানে গল্পে কবিতায় প্রকাশ করতে চান । তার একটা কারণ তো এটা অবশ্যই যে এই ভুবন এখন তো গ্রাম ! তুরস্কের মানুষ অথবা নরওয়ের, ইংল্যান্ডের অথবা আফ্রিকার —– একে অপরের সঙ্গে যে আমরা গভীরভাবে যুক্ত সে প্রত্যক্ষভাবে আলোকিত মানুষ অনুভব করেছে । সেজন্যেই বিষ্ণু দে-র কবিতার বিদেশি পুরাণের গল্প অথবা এলিয়টের জেরোনশিয়ন ভুলে যেতে পারেন না পাঠক । এলিয়টের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন বাঁকুড়ার মাস্টারমশাই অথবা রমা রোলার সঙ্গে কালিদাস নাগ , হারমান হেসে লিখতে পারেন সিদ্ধার্থ অথবা মৃত ওয়েনের মা সুশান ওয়েন-এর কাছে শুনতে পাই যে মৃত্যুর আগের দিন ওয়েন পড়ছিলেন রবীন্দ্রনাথের – আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব ! তাহলে আমাদের লেখায় কেন মায়েস্ত্রো আসতে পারে না, কেন ক্রিস্টোফার হতে পারে না আমাদেরই কোনো চরিত্রের নাম, যখন ‘হরি’- নামের ছেলেটিকেও এমনকি তার বন্ধুরা মজা করে ‘হ্যারি’ নামে ডাকে ?
ম্যাডাম এম অথবা পিয়ানো অথবা ছড়ানো পাওডার অথবা হেরিং মাছের গন্ধ নিয়ে অমিতাভ মৈত্রের কবিতাজগত । অবগাঢ় মাংস, কর্কট চিহ্ন , বররফের স্তূপ, তামাক পাইপ থেকে শিস , ছুড়ি ও কাঁটার খোঁজ , ভেড়ার রক্ত, বাইবেল, নগ্নতা, চর্বি, আত্মশুদ্ধির রবিবারসমূহ, অন্ধ খরগোশ, সাদা বলের টকটক আওয়াজ, আলো আর টেবিলের প্রাপ্তবয়স্ক খেলাগুলি ( আশ্চর্য এখানে খেলাগুলির আগে প্রাপ্তবয়স্ক শব্দটি এলো !!) , পাপবোধ , শহরের চাপা হিংস্র রাত্রি, কুয়াশা , রেস্তরাঁ, হত্যা, পচা ফল মৃতদেহ, গরম লোহার মতো চোখ —- এইসব কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতাজগতে থাকে । অসম্ভব মাংসের জগত, অসম্ভব পাপবোধের আর ভয়াবহ হিংস্রতার জগতে নিয়ে যান আমাদের কবি অমিতাভ মৈত্র । আমাদের গতানুগতিক শীতল আর ভণ্ডামিমাখানো তথাকথিত কবিতাজগতের প্রতিস্পর্ধি হয়ে ওঠেন তিনি । না, শীতল ও গীতল কবিতা লিখতে চাননি অমিতাভ মৈত্র । পাঠককে এমন পৃথিবীতে নিয়ে আসেন যেখানে সে দিশেহারা হয়ে যায় !
দুই
টানেলের ভেতর থেকে চাপা গলায়, খুব চাপা গলায় –‘ক্রিস্টোফার!’
যে ঘুম জড়ানো চোখে উঠে দাঁড়াচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, সে ক্রিস্টোফার নয়।
মাথা গুঁজে রুদ্ধ গলায় যে কেঁদে উঠছে — ‘ আমি না!’ ক্রিস্টোফার নয় সে
বাতাস গুঞ্জরণময় হয়ে উঠছে — কে ক্রিস্টোফার! কে!
বাতাস লাল হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে, ক্রিস্টোফারের জন্য ।
খেলাধুলার হাতি নিয়ে একজন সাদা বুড়ো বৃষ্টির মাঠে দাপাদাপি করছে
আর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে নিচ্ছে— বলা যাবে না কী দেখছে সে ।
বাতাস আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে শুধু ক্রিস্টোফারের জন্য ।
(লোহা/ পিয়ানোর সামনে বিকেল)
ক্রিস্টোফার । একজন অশুভ নিয়তি তাড়িত কেউ , যাকে ধরা যায় না । সে আসছে জানতে পারছি । কিন্তু তার আগমন সংবাদ পাওয়া যায়নি ! কিন্তু বাতাস আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে তারই জন্য, এমন একটা বিকেল দেখতে পাচ্ছি । আর একটা টানেল যেন দেখতে পাচ্ছি , দেখতে পাচ্ছি যেন সিনেমা, তার টুকরো টুকরো ছবির মন্তাজ, একটা ঠাণ্ডা বিকেল ! যেন একটা বিদেশি ছবির মন্তাজ দেখতে পাচ্ছি । এক একটা লাইনের মধে অসীম এক একটা স্পেশ — জাম্প কাট । বলা বাহুল্য এ হল একটা অপরাহ্নবেলার ছবি । যে প্রদোষকালে ছড়িয়ে আছে একটা ঠাণ্ডা আলো । একটা টানেল যেখান থেকে চাপা গলায় আওয়াজ – ক্রিস্টোফার ! যেন একটা থ্রিলার শুরু হচ্ছে এমন মনে হয় ! এর পরে একটি মানুষের পিছন দিক আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ক্যামেরা থেকে সেই টানেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে , দর্শক ( পড়তে হবে পাঠক) তাকে ক্রিস্টোফার ভাবতে পারেন , কিন্তু সে ক্রিস্টোফার নয়, আর একটা মাথা গুঁজে কান্নার আওয়াজ যে বলছে সেও ক্রিস্টোফার নয় , এমনই একটা কৌতূহল তৈরি করছেন কবি যা সাধারনত আমরা দমবন্ধ-ক্রা রুদ্ধশ্বাস কোন থ্রিলারে থাকে, আমরা বুঝতে পারছি যে ক্রিস্টোফারকে খোঁজারই চেষ্টা করে যাওয়া হচ্ছে। বাইরের প্রকৃতির বর্ণনা পাচ্ছি আমরা — বাতাস লাল হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে, ক্রিস্টোফারের জন্য । কিন্তু এত যে কৌতূহলী করে তোলা হল পাঠককে ক্রিস্টোফারের কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া গেলম না । আর ওমনি ওই ধ্বনি আর নাম ব্যাচার্থকে অতিক্রম করে আমাদের এক অসীম সম্ভাবনার দিকে নিয়ে গেল । কবিতাটির শেষ লাইনটি আরও রহস্যময় হয়ে উঠলো, যেখানে কবি লিখছেন – বাতাস আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে শুধু ক্রিস্টোফারের জন্য । এর আগে প্রায় একইরকমের একটা লাইন আমরা পেয়েছি। শুধু ‘আস্তে আস্তে’ শব্দদুটিকে এগিয়ে দিলেন আর ক্রিস্টোফারের আগে ‘শুধু’ শব্দটি প্রয়োগ করলেন …
অথচ লেখাটির নাম লোহা । কেন ? লেখাটির সঙ্গে সামান্যতম যোগও যে পাচ্ছি না ! তাহলে লেখাটির নাম লোহা কেন হল ? তাহলে কি লোহা শব্দটির যে প্রবল কাঠিন্য সেদিকে ইঙ্গিত করছেন কবি ? এমনিতে লেখাটি একটা থ্রিলিং অথচ ধাতব অনুভূতি তৈরি করে । লেখাটি নিয়ে যদি স্ক্রিপ্ট লেখা হত তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে একটি ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষের অস্বস্তিকর ধ্বনি রাখতাম । এসব ভেবেও দিশেহারা হয়ে যেতে হয় পাঠককে ! একটা কবিতার নামকরণ যে কখনও এমনভাবে হতে পারে ভাবতে পারেনি ! সমস্ত কবিতাটি পড়ে যে অনুভূতি হয় তা যদি ধ্বনিতে প্রকাশিত হয় তাহলে তা যে শব্দ-অভিঘাত সৃষ্টি করে কবিতাটির সেটাই নাম !
ঠিক এখানেই কবি অমিতাভ মৈত্রের নিজস্বতা , তাঁর কবিতা একটা বা দুটো পড়লে মনে হবে যে কীই বা এমন … কিছুই তো অভিঘাত তৈরি হল না , অন্য অনেকের ক্ষেত্রে যেমন একটি কবিতাই অনেক কিছু বলে এবং সেই একটি লেখাই একটা অরগ্যানিক এন্টিটি তৈরি করতে পারে, অমিতাভ মৈত্র ঠিক তার উল্টো , তিনি আসলে সৃষ্টি করতে পারেন একটা দর্শনের, ভারহীনতার অসামান্য সামগ্রিকতা যার ঘোর তাঁর কবিতাজগতে আছে , সেই কবিতাজগতে ঢুকতে গেলে পড়তে হবে তাঁর কবিতা একের পর এক , একের পর এক …
সেখানে শুধুই পাঠককে তাড়িয়ে নিয়ে বেরাবে এক অশুভ পাপবোধ আর নিয়তি তাড়িত হাওয়া। ছত্রে ছত্রে লেগে থাকবে একধরণের চাপা সন্ত্রাস, মৃত্যু আর ঠাণ্ডা মাংস, ভারতীয় বাস্তবতা থেকে সে বোধহয় খুব দূরে নয় ! আর থাকলেও বা কী ? কথায় আছে না লাফটার হ্যাজ নো ফরেন একসেন্ট !!