মেরু-নিশীথের নাবিকেরা <br /> তৃতীয় পর্ব <br />  পার্থজিৎ চন্দ

মেরু-নিশীথের নাবিকেরা
তৃতীয় পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ

এগারো লাইনের কবিতার শরীরে সে প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। প্রথম লাইনে যে স্থানচ্যুত দ্বিতীয় লাইনেই তা চলে যাচ্ছে এক চিহ্ন থেকে আরেক চিহ্নের দিকে। এই লাইনটির পরাপাঠ কি আমাদের উপহার দেবে প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সে সব ধ্রুবকের ইশারা যাদের সাহায্য ছাড়া সৃষ্টিরহস্যের দ্বার বিন্দুমাত্র উন্মোচন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে? যে সমস্ত ধ্রুবকের সাহায্যে প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা গূঢ় রহস্যের দ্বার সামান্যতম উন্মোচন করেছে মানুষ, যাদের দ্বারা সে তৈরি করেছে ‘ইকুয়েশন’, যে সব ধ্রুবক-চিহ্নের অনিবার্য প্রয়োগ ব্যতিত ব্যর্থ হয়ে যায় সমস্ত ইশারা-সন্ধান জীবনানন্দ কি তাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন?

স্তব্ধ-ঘড়ি সময় ও জীবনানন্দের একটি কবিতা

দুপুর, রোদে ভেসে যাচ্ছে বালুতট; নারকেল-বনের ভেতর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ভাঙাচোরা চার্চ… চার্চের মাথা আকাশ ছুঁয়েছে প্রায়, অথচ সেটি ভাঙাচোরা। বহুদিন কোনও মানুষ তার কাছে আসেনি; এ নির্জন অহংকার ছেয়ে রয়েছে তার সমস্ত শরীর।
চার্চের শীর্ষদেশ থেকে কিছুটা নীচে, বেলফ্রে-টাওয়ারের নীচে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে একটি কাঠের ঘড়ি; হ্যাঁ, কাঠের ঘড়ি। বিশাল এক কাঠের ঘড়ি, তার শরীর আবলুশ-কাঠের… ঘন কালো। দুটি কাঁটা পাতলা কাঠের। সে দুটি একে অপরের গায়ে গা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
এ দৃশ্যের থেকে দূরে বসে আছেন একজন মানুষ; ঝাউপাতার আড়াল থেকে তিনি দেখে চলেছেন দৃশ্যটিকে।
দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে ও দৃশ্যটি মুছে যাচ্ছে… এই দৃশ্যের জন্ম ও মুছে যাবার উল্লেখমাত্র জীবনানন্দ দাশ এসে পড়বেন অবধারিতভাবে।
যে মানুষটি বসে আছেন তিনি নিশ্চিত জীবনানন্দ, তাঁকে আমি স্বপ্নে কোনও দিন দেখিনি; শুধু বুঝেছি ঝাউপাতার আড়ালে যিনি বসে আছেন তিনি জীবনানন্দ। কিন্তু যে দৃশ্যটি আমার কাছে স্বপ্নের থেকে বেশি কিছু (কারণ যে দৃশ্যটিকে আমি ব্যক্তিগত ‘নির্জনে’ নির্মাণ করতে পারি ও দর্শন করতে পারি) তার মধ্যে কেন সমুদ্র কেন গির্জা কেন ঝাউবন এবং কেনই বা বারবার ফুটে ওঠা সেই ‘ভয়াবহ’ ঘড়ি তার সন্ধান আমি কিছুতেই পাইনি।
দৃশ্যটিকে বিশ্লেষণ করতে করতে মনে হয়েছে জীবনানন্দের কবিতায় সমুদ্রের উল্লেখ সুপ্রচুর।
জীবনানন্দ উপনিবেশ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বারবার স্থান দিয়েছেন কবিতায়। এ কথাও বলা অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর কবিতার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রলক্ষণগুলির মধ্যে একটি হল উপনিবেশ স্থাপিত হবার প্রক্রিয়া; সে প্রক্রিয়ার নীচে চূর্ণ হয়ে যাওয়া মানুষের জীবন যৌনতা অর্থনীতি রাজনীতি-সহ বহু বহু বিষয়।
দৃশ্যের ঝাউবন সেই আড়াল নির্মাণ করছে যার সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার প্রত্যক্ষ যোগ।
কিন্তু ঘড়ি কেন? কেন স্তব্ধ ঘড়ি? এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিশ্চিত রয়েছে; সে দিকে যাবার আগে ঘড়িটির স্তব্ধতার দিকে একবার তাকানো যাক।
ঘড়িটির স্তব্ধতার দিকে তাকিয়ে যে কথাটা প্রথমে মনে হবে, যে মুহূর্তে ঘড়িটি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে মুহূর্ত থেকেই কী গির্জার ভেতর, গির্জাটিকে কেন্দ্র করে যে সময়-প্রবাহ তা কি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল?
এ ভাবনার ভেতর ফুটে ওঠে আরেকটি দৃশ্য’ও; তথাগত বসে আছেন… শেষ শীতের বিকেল। বিশাল চরাচর জুড়ে ফুটে থাকা ‘শূন্যতা’র মধ্যে ঝরে পড়ল একটি পাতা। গাছের শেষ পাতা; দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তথাগত। এ শূন্যতার ভেতর আশ্চর্য ঢেউ লক্ষ করে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে রয়েছেন।
এই যে ‘দীর্ঘ’ সময় তার শুরু কি ওই গাছের পাতা খসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে? না কি তথাগতকে কেন্দ্র করে অথবা তাঁর উপস্থিতি’কে গ্রাহ্য না-করে সমস্ত সৃষ্টি জুড়ে বয়ে চলেছিল ‘সময়’, গাছের পাতাটি খসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তথাগতের কাছে সে সময়-তরঙ্গে একটি নুড়ি এসে পড়ল! ওই যে ‘অংশ’টিকে আমরা ‘দীর্ঘ’ বলে চিহ্নিত করলাম তা আসলে সময়-প্রবাহের একটি অংশমাত্র, যেন এক মানুষ অতিদীর্ঘ ও অতি-স্ফিত নদী থেকে এক পাত্র জল তুলে ফিরে আসছে তার কুটিরে। নদীর সামগ্রিক রূপ তার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়; ওই এক আঁজলা জলেই তার নদী-স্পর্শ করে থাকা।
জীবনানন্দ তথাগত গির্জায় স্তব্ধ হয়ে থাকা ঘড়ি গাছের শেষ পাতাটির ঝরে পড়ার মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য ও সাধারণ উপাদান রয়ে গেল তা হল ‘সময়’। এ ‘সময়’ কি আমাদের চৈতন্যের দ্বারা নির্মিত বিষয়? না কি সময়ের অস্তিত্ব রয়েছে নুড়িগাছপাথরের মতো? এটি যদি ‘ডিসকভারি’ হয় তা হলে দুটি ঘটনার সাপেক্ষে কেন সময়’কে চিহ্নিত করতে হয়? হায়, কেন গাছ ও গাছের পাতা-ঝরার মধ্যবর্তী ‘বিষয়’কে আমরা ‘সময়’ হিসাবে চিহ্নিত করতে বাধ্য? আর যদি এটি ইনভেনশন হয় তা হলে প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের চেতনার কোন ‘সার্বজনীন’ রূপ তাকে এ পথে চালিত করে? সে ক্ষেত্রে সেই দীর্ঘ অন্ধকার বারান্দা-জুড়ে বাউলের কান্না একটু ভিন্ন রূপ পাবে, সে কেঁদে উঠবে, ‘হায়, গাছে গাছে কেন পাতা ঝরে যায়… হায় মন…।’

জীবনানন্দ’কে আবিষ্কার অনেক বড় ও গূঢ় একটি বিষয়; এ লেখায় অক্ষমভাবে দেখার চেষ্টা করতে পারি যে একজন জীবনানন্দ কি অকল্পনীয়ভাবে পাঠক’কে ভয়াবহ সব প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। সে প্রশ্নের মধ্যে দৃশ্যমানতার উৎসব নেই, বরং রয়েছে উদাসীন আভিজাত্য।
আমি এসব গূঢ় প্রশ্ন তোমাদের জন্য শিল্পের রহস্য মাখিয়ে রেখে গেলাম, হে পৃথিবী তোমাদের মাতৃভাষা যখন ধারণ করতে পারবে আমার সন্ত্রাস ও রহস্য তখন এ লেখার কাছে বসে একদিন সন্ধ্যায় খুঁজতে চেষ্টা কোরো কী কী লুকানো আছে সে রত্নদ্বীপে…।
জীবনানন্দের বহু বহু কবিতায় এটিই মূল-সূর হিসাবে বেজে যায়; কিন্তু এ লেখায় যে কবিতার সূত্রে এ পর্যবেক্ষণ সেটি উদ্ধৃত করা যাক,
‘স্থান থেকে স্থানচ্যুত হ’য়ে
চিহ্ন ছেড়ে অন্য চিহ্নে গিয়ে
ঘড়ির কাঁটার থেকে সময়ের স্নায়ুর স্পন্দন
খসিয়ে বিমুক্ত ক’রে তাকে
দেখা যায় অবিরল শাদা কালো সময়ের ফাঁকে
সৈকত কেবলি দূরে সৈকতে ফুরায়;
পটভূমি বার-বার পটভূমিচ্ছেদ
ক’রে ফেলে আঁধারকে আলোর বিলয়
আলোক’কে আঁধারের ক্ষয়
শেখায় শুক্ল সূর্যে; গ্লানি রক্তসাগরের জয়
দেখায় কৃষ্ণ সূর্য; ক্রমেই গভীর কৃষ্ণ হয়’।
-কবিতাটির নাম ‘স্থান থেকে’। এগারো লাইনের এই কবিতাটি অসংখ্যবার পড়বার পরেও বিস্ময় ঘুচতে চায় না। কবিতাটি শুরু হচ্ছে নিরাভরণ ভঙ্গিতে, কিছুটা বিবৃতি যেন লুকিয়ে রয়েছে প্রথম লাইনেই। যে মুহূর্তে জীবনানন্দ উচ্চারণ করছেন ‘স্থান থেকে স্থানচ্যুত হ’য়ে’ সে মুহূর্ত থেকে আমাদের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার শুরু এটি জানতে যে ‘কে’ বা ‘কী’ স্থান থেকে স্থানচ্যুত হয়ে এক চিহ্ন থেকে আরেক চিহ্নের দিকে চলে যায়।
এগারো লাইনের কবিতার শরীরে সে প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। প্রথম লাইনে যে স্থানচ্যুত দ্বিতীয় লাইনেই তা চলে যাচ্ছে এক চিহ্ন থেকে আরেক চিহ্নের দিকে। এই লাইনটির পরাপাঠ কি আমাদের উপহার দেবে প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সে সব ধ্রুবকের ইশারা যাদের সাহায্য ছাড়া সৃষ্টিরহস্যের দ্বার বিন্দুমাত্র উন্মোচন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে? যে সমস্ত ধ্রুবকের সাহায্যে প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা গূঢ় রহস্যের দ্বার সামান্যতম উন্মোচন করেছে মানুষ, যাদের দ্বারা সে তৈরি করেছে ‘ইকুয়েশন’, যে সব ধ্রুবক-চিহ্নের অনিবার্য প্রয়োগ ব্যতিত ব্যর্থ হয়ে যায় সমস্ত ইশারা-সন্ধান জীবনানন্দ কি তাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন?
এসব চিহ্নও কি প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনিবার্য ‘ফ্যাক্টরস’ যাদের খুঁজে পেয়েছে মানুষ? না কি, এগুলি আসলে ইনভেনশনের পথে মানুষের চৈতন্য দিয়ে নির্মিত চিহ্ন-সমূহ? দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রশ্নে অতি-গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি যে এই কবিতাটির আত্মার ভেতর প্রবেশ করবার জন্য বিন্দুমাত্র ‘প্রক্ষিপ্ত’ কোনও পথ নয় তা তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনে এসে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন কবি। তিনি জলের ধর্মে ও সাবলীলতায় বুনে রেখে দিয়েছেন দর্শনের প্রশ্নে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়ের – মানুষের তৈরি করা ‘প্রতারক’ সময়-ধারণার বাইরে কি রয়ে গেল মহাকাল-প্রবাহ, যা আসলে মানুষের সময়-ধারণার ভেতর লুকিয়ে থাকা ‘রিলেটিভিটি’কে নস্যাৎ করে দেয়?
তিনি লিখছেন, ‘ঘড়ির কাঁটার থেকে সময়ের স্নায়ুর স্পন্দন/ খসিয়ে বিমুক্ত ক’রে তাকে’। তৃতীয় লাইনের ছটি শব্দ অকল্পনীয় রকমের ‘ভারী’; এখানে লক্ষ করার স্থান থেকে স্থানচ্যুত হয়ে চলা সত্তা অথবা বিষয় ঘড়ির কাঁটার থেকে সময়ের স্পন্দন’কে খসিয়ে বিমুক্ত করে দিচ্ছে সময়’কে। ‘বিমুক্ত’ শব্দটির মধ্যে দিয়ে জীবনানন্দ মানুষের চৈতন্যের ভেতর ঘনিয়ে থাকা সময়ের স্বাভাবিক ‘temporality’-কে ছিন্ন করে দিচ্ছেন, সময়’কে তিনি দিচ্ছেন তার নিজস্ব প্রভা… আদি-অনন্তের প্রভা। খণ্ড-সময়ের পরিসরটিকে তিনি যেন এক লহমায় বিস্তৃত করে দিচ্ছেন মহাসময় পর্যন্ত। এবং চতুর্থ লাইনটি আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করল সময় নিয়ে জীবনানন্দের ধারণাকে; সময়-ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকা মানুষের ভ্রমাত্মক মনস্তাত্ত্বিক তিরটিকে তিনি নিপুনভাবে তুলে ধরে পর্যবেক্ষণের শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, ‘দেখা যায় অবিরল শাদা কালো সময়ের ফাঁকে…।’
শাদা ও কালোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়া ‘শুভ/ভাল’ ‘অশুভ/খারাপ’ ধারণা দিয়ে এই পঙক্তি’টিকে বিশ্লেষণ করতে চাওয়া আংশিক সত্য হতে পারে; কিন্তু তা সম্ভবত পূর্ণ সত্যের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না আমাদের। শুভ/অশুভের অতি-পরিচিত ধারণাটিকে সামনে রেখে কবি আসলে মহা-সময়ের গর্ভে লুকিয়ে থাকা খণ্ড খণ্ড ‘সময়’কে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কারণ এর পরেই লাইনেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি, ‘সৈকত কেবলি দূর সৈকতে ফুরায়;।’ ‘একটি’ সৈকতের অনিবার্যতাকে অতিক্রম করে আরও বৃহত্তর ও প্রসারিত কোনও সৈকতের দিকে যেন তিনি ইশারা করছেন। অথবা একটি সৈকতের বাস্তবতাটিকে তিনি অস্বীকার করে আসলে বহু-সৈকতের সমাহারে এক মহা-সৈকতধারার দিকে ইঙ্গিত করছেন, এমনটিও ভাবা যেতে পারে। অষ্টম ও নবম লাইনে আঁধারকে ‘আলোয় বিলয়’ ও ‘আলোককে আঁধারের ক্ষয়’ প্রয়োগের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিহ্বল হয়ে পড়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর থাকে না। এই আপাত-দ্বৈত ভূমিকা পালন করে চলেছে সেই পটভূমি, যে বারবার পটভূমিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
তা হলে কি জীবনানন্দ নির্দেশ করতে চাইলেন আঁধার ও আলো’ও পৃথক দুটি বিষয় নয়! লাইন দুটি বারবার পাঠ করলে নিশ্চিতভাবে মনে হতে বাধ্য, অন্ধকারের মধ্যে ফুরিয়ে আসছে আলো; আবার আলো’ও আসলে আঁধারের ক্ষয়িভূত হয়ে চলা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জন্ম নিয়ে চলেছে।
এখান পর্যন্ত এসে কবিতাটির অভিমুখ যখন প্রায়-নির্দিষ্ট হয়ে আসে আমাদের কাছে তখন জীবনানন্দ নিজের হাতে মুছে দেন আমাদের নিচু-বাস্তবতা থেকে উঠে আসা ‘এক্সপেক্টেশন’কে। ‘শেখায় শুক্ল সূর্যে; গ্লানি রক্তসাগরের জয়/ দেখায় কৃষ্ণ সূর্য; ক্রমেই গভীর কৃষ্ণ হয়’ – লাইন দুটি পাঠ করবার পর আমরা অনুভব করি এক সময়ে যা স্থান থেকে স্থানচ্যুত হয়েছিল, চিহ্ন ছেড়ে অন্য চিহ্নে গিয়ে সময়কে বিমুক্ত করেছিল সে-ই আসলে ‘শুক্ল সূর্য’কে আলো-অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্পর্কটিকে শিখিয়ে চলেছে।
কে যেন সভ্যতার ভেতর লুকিয়ে থাকা রক্তস্রোতের ভেতর থেকে উঠে এসে, মাছের কাঁটার সফলতার মতো ক্ষুদ্র ও নিচু গণ্ডির ভেতর থেকে উঠে এসে শুক্ল সূর্য’কে দেখিয়ে দিচ্ছে তার হননের ইতিহাস।
আলোক ও আঁধারের মধ্যে ঘনিয়ে থাকা দ্বিমুখী সম্পর্ক তো আসলে একই তূণ থেকে ছুটে যাওয়া দুটি তির, যা আবার ফিরে আসে তূণের কাছে। শুক্ল সূর্য ও কৃষ্ণ সূর্য দুটি অস্তিত্ব নয়; মানুষের হাতে মানুষের রক্তপাতই তাদের শুক্ল ও কৃষ্ণ করে তুলছে। ‘সভ্যতা’র ভেতর লুকিয়ে থাকা বা প্রকাশ্য হয়ে থাকা গ্লানি ও রক্তপাতের ছায়া গিয়ে পড়ছে সে সূর্যের গায়ে।
কবিতাটির শেষ চারটি শব্দের দিকে এবার একবার তাকানো যাক, ‘ক্রমেই গভীর কৃষ্ণ হয়।’ এখানে এসে স্তব্ধ হয়ে যেতে হবে পাঠক’কে; বেশ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যেতে হবে। তারপর তার সামনে থেকে সরে যেতে থাকবে একটি ক্যানভাস। এতক্ষণ পাঠক যে ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেদিকে তাকিয়ে তিনি দেখবেন ক্রমশ ‘কৃষ্ণ’ হয়ে আসছে সে বিশাল ব্যপ্তি।
তারও পর অনিবার্যভাবে একটি প্রশ্ন জন্ম নেবে – কার কাছে কৃষ্ণ হয়ে এল সেটি? এ সমূহ কার্যকলাপের দর্শক কে?
এ সমস্ত’র দর্শক আসলে মানুষের রক্তমাখা দুটি হাত ও তার চৈতন্য; মহাকালের পায়ের কাছে বসে সে দেখে চলেছে সময়স্রোত… খণ্ডসময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করছে মহাকাল’কে। কিন্তু তার চেতনার স্ফূরণ তাকে অবিমিশ্র আলোর জগতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ যে সভ্যতা সে নির্মাণ করেছে তার ভিত্তি, গূঢ় প্রণোদনা হিসাবে কাজ করে চলেছে রক্তপাত ও হননেচ্ছা। এ ‘সভ্যতা’র পথ ধরেই তার কাছে ‘কৃষ্ণ’ হয়ে আসছে বিশাল এক ক্যানভাস।
খণ্ডকালের মধ্যে বসে মহাকালের ইশারা দেখতে দেখতে মানুষের সম্ভবত এটিই একমাত্র ও শেষ ট্র্যাজেডি; জীবনানন্দ উন্মোচিত করে দিলেন এ মহাসত্যটিকে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    স্বপন নাথ 3 years

    পার্থজিত্ নতুন করে জীবনানন্দকে চেনাচ্ছো।দারুণ লাগছে । অসংখ্য ধন্যবাদ ।

    • comment-avatar
      Parthajit Chanda 3 years

      কী বলি! ভালোবাসা। সেইসব পুরানো দিনের কথা মনে পড়ছে খুব।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes