
রিনি গঙ্গোপাধ্যায়-এর গল্প ‘ শিখীপাখা’
আজও সেই এক ব্যাপার! পৌনে দশটা বাজতে না বাজতেই হাজির হয়েছে। শিখী মাইগেট অ্যাপে দেখল ৮৭০৮ অটোটি হাউসিং এ ঢুকেছে। দেখেই তার মাথা গরম হয়ে গেছে। রোজ এতোবার করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই মোহনদা কথা শোনে না। পৌনে দশটা থেকে এসে বসে থাকে। শিখী দশটায় বেরোলেই সময় মতো কলেজে পৌঁছে যেতে পারে! শুধু শুধু আগে যাওয়ার মানে হয় না! তাছাড়া সকালবেলার সময়টা এতো দ্রুত ফুরিয়ে যায় যে ওই পনেরো মিনিট সময়টাও অনেকটা মনে হয়। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সামান্য এক্সারসাইজ করে নিয়ে মাকে ঘুম থেকে তোলে শিখী। ভালো করে মুখ ধুইয়ে, রাতের ইউরিনপট ক্লিয়ার করে মাকে
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দেয়। কোনো কোনোদিন বিছানার চাদর-টাদরও পাল্টে দিতে হয়। তারপর সকালের খালি পেটের ওষুধ খাইয়ে চা-বিস্কুট খেতে দেয়। নিজেও এক কাপ চা নেয়। কিন্তু বসে খাওয়ার সময় নেই। সকালের টিফিন, দুপুরের রান্না সবটাই করে বেরোতে হয় শিখীকে। ফলে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো থাকে তার। আগেরদিন রাতেই তাই সকালের রান্নার জোগাড় করে রাখে শিখী। সকালে উঠে মাছ বা মাংসটা ডিফ্রস্ড করে নিয়ে রান্না চাপিয়ে দেয়। মা একেবারেই আর মশলা দেওয়া খাবার খেতে পারে না। ফলে হালকা-পাতলা, প্রায় মশলাহীন রান্না করতে হয়। এরকম রান্না করাটাই বেশি কঠিন মনে হয় শিখীর। মশলার নিজস্ব স্বাদে রান্না এমনিই ভালো হতে বাধ্য। কিন্তু বিনে মশলার রান্না সুস্বাদু করা বেশ কঠিন। মা একসময় এতো ভালো রান্না করত! এখন তো একেবারেই বিছানায়। তাই তার আফসোসের সীমা নেই। দিনরাত নিজের মৃত্যু কামনা করে চলেছে! রান্নাবান্না খারাপ হলেই আজকাল মা থু থু করে ফেলে দেয়। খেতে চায় না। আর হাহুতাশ করে। শিখী তখন কি করবে ভেবে পায় না। আলুনি রান্না এর থেকে আর কত ভালো হবে! যাই হোক রান্না সেরে, স্নান করে কোনোরকমে একটু দই ওটস খেয়ে তৈরি হয়ে শিখীকে বেরোতে হয়। মাকেও সকালে বকে বকে ওটসই খাওয়ায়। তারপর ওষুধপত্র আছে। এসব করে বেরোতে তার দশটা বাজে। তাই মোহনকে বলা থাকে দশটায় আসার কথা। কিন্তু মোহন রোজ পৌনে দশটায় এসে বসে থাকবে আর শিখী ফ্ল্যাট থেকে বেরোলেই বলবে,ঔঔঔৌ আমি তো কতক্ষণ থেকে বসে আছি।
এতো আগে আসেন কেন আপনি? আপনার তো দশটায় আসার কথা?
আসলে আজ লাইনের সময়টা এমন গোলমাল হলো যে আগে এসে গেলাম।
আপনার তো রোজই সময়ের গোলমাল হয় দেখছি!
হে হে হে হে… না মানে ওই আর কি…
মোহন এমন করে কথাগুলো বলে যেন কোনো কথা সে গোপন করতে চাইছে! খানিকটা হেসে খানিকটা তুতলিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করছে!
কিন্তু এতো কথা বলেও মোহন পরদিন সেই পৌনে দশটাতেই আসে। শিখী মাইগেট অ্যাপে দেখে মোহন হাউসিং এ ঢুকেছে। মুশকিল হলো মোহনের রোজের এই এক কারবার বুঝেও শিখীর ওই সময়টা আরো বেশি তাড়াহুড়ো লেগে যায়। কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে শিখী সেটা নিতে পারে না। তার মনে হয় কত তাড়াতাড়ি সেই মানুষটার অপেক্ষার অবসান করতে পারবে সে! সে যত সামান্য ব্যাপারই হোক না কেন! অপেক্ষা শিখী নিতে পারে না। অথচ নিজে সে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে পারে। সেই ছোটো থেকে দিদিমণির সঙ্গে কথা বলার জন্য, স্যারেদের কাছে নোটস দেখাবার জন্য, লাইব্রেরিতে বই পাওয়ার জন্য, ট্রেন-বাসের জন্য, বাবার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, সর্বোপরি তনুময়ের জন্য, আর এখন মায়ের সুস্থতার জন্য অপেক্ষাই তো সে করে গেছে, করে চলেছে… অনিশ্চিত অনির্দেশ্য অপেক্ষা। তাই অপেক্ষা করার যন্ত্রণা বোঝে শিখী। অপেক্ষা আর উপেক্ষার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য করতে পারে না সে আর। তবে এই মোহনের ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা! রোজ রোজ কেন যে সে এসে বসে থাকে শিখী ঠিক বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব সমস্যা নিয়ে শিখীকে মোহন ফোন করে ছুটির দিনে।
ম্যাডাম, অটোটা স্টার্ট নিচ্ছে না! কি করি বলুন তো!
শিখী আকাশ থেকে পড়ে। অটো স্টার্ট নিচ্ছে না তো শিখী কি করবে! গ্যারেজে নিয়ে যান।
না ম্যাডাম, আসলে বলছিলাম কালও যদি স্টার্ট না নেয়, কাল আবার আপনার কলেজ আছে তো!
দেখুন আগে আজকের মধ্যে ঠিক হয় কি না!
হ্যাঁ, সে তো দেখবই। তবু জানিয়ে রাখলাম আর কি!
পরদিন মোহনের অটো ঠিক হয়ে যায়। মোহন যথারীতি পনেরো মিনিট আগে এসে বসে থাকে। তারপর শিখী নামলে বলে কাল তো গাড়ি গণ্ডগোল করছিল! ভাবলাম আজ যদি না আসতে পারি!
শিখী কোনো উত্তর করে না। তার মনের মধ্যে কেমন একটা সন্দেহ উঁকি মারতে থাকে। মোহন ইচ্ছে করে ছুটির দিনেও কথা বলার জন্য এসব হাবিজাবি বলে ফোন করে না তো! শুধু ছুটির দিনেই বা কেন! রাত তিনটে-সাড়ে তিনটের সময়ও মোহন ফোন করে। শিখী প্রথমদিন মাঝরাতে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে বুঝতে পেরে ধড়মর করে ঘুম থেকে উঠে ফোন ধরতে গিয়ে দেখে মোহন ফোন করছে! কার্যকারণ কিছুই বুঝতে না পেরে ফোনটা ধরতে গিয়ে দেখে ফোনটা কেটে গেল। ঘুম তখন শিখীর কেটে গেছে। বম্মা, ছোটো কাকিমা, মেজ মাসিমণি, মেজো মেসো সবার মুখগুলো একবার করে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। রাতবিরেতে নিশ্চয়ই কোনো খারাপ খবর এই ভেবেই তার মনটা দমে গেছিল। তারপর যখন মোহনের নামটা ভেসে উঠতে দেখেছে ফোনের স্ক্রিনে তখন এতোটাই অবাক হয়েছে শিখী যে কি করা উচিত বুঝতেই পারেনি। পরদিন মোহনকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছে হাত লেগে ফোন হয়ে গেছে ম্যাডাম। হে হে হে হে…
এমন ভাবে বলেছে যেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা! শিখী তাতে আরো খানিকটা অবাক না হয়ে পারেনি। লোকটা কি পাগল! মাঝরাতে হাত লেগে ফোন হয়ে গেছে! আর সেটা বলছে এরকম হেসে হেসে…
এমনটা মোহন মাঝে মাঝেই করে। প্রত্যেকবারই তার হাত লেগে ফোন হয়ে যায়। কিন্তু হাত লেগে ফোন হলেও সে ফোনটা কাটে না। ফোনটা বাজতে বাজতে পুরোটা রিং হয়ে থামে। কোনো কোনোদিন এমন দুবারও হয়। জিজ্ঞেস করলেই মোহন সেই একই উত্তর দেয়। শিখী তাকে কিছুই বলতে পারে না। ভিতরে ভিতরে বিরক্তিটা তার বাড়ে।
সেদিন প্রায় দশটা বাজছে। মোহন তখনও আসেনি। শিখী তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি। দশটায় নিচে নেমে মোহনের অটো দেখতে না পেয়ে সে অবাক হলো। তারপর মাইগেট চেক করে দেখল মোহন আজ হাউসিং এ ঢোকেইনি। মোহনকে ফোন করতে ফোনটা বেজে গেল। ধরল না। এদিকে শিখীর দেরি হয়ে যাচ্ছে। শিখী বারদুয়েক ফোন করল। দুবারই ফোন বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। শিখীর আর অপেক্ষা করার সময় নেই। সে তাড়াতাড়ি হাউসিং থেকে বেরিয়ে রানিং অটো ধরে বেরিয়ে পড়ল। কলেজের রাস্তাটা অল্প হলে কি হয়! দুবার অটো পাল্টাতে হয়! তারপর আবার এক-দেড় কিলোমিটার হাঁটতে হয়! রোদ-জলে এতোটা আর পেরে ওঠে না শিখী। তাই অটো বুক করে রাখে। যাতায়াতেই অর্ধেক এনার্জি চলে গেলে কলেজে গিয়ে পাঁচটা ক্লাস নেবে কি করে! বড়ো রাস্তায় পৌঁছে অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগোতেই একজন এগিয়ে এলো। দিদি, আপনি মোহনদার অটোতে যান তো!
হ্যাঁ, মোহনদার কী হয়েছে?
মোহনদার বৌ আজ সকালে মারা গেছে। হার্ট অ্যাটাক।
মোহনদার বৌ! শিখী আকাশ থেকে পড়ে! মোহনদার বৌ আছে না কি!
হ্যাঁ, তিনটে মেয়ে!
সে কি! তবে যে উনি বলেছিলেন উনি বিয়ে করেননি!
প্রথম প্রথম যখন মোহনের অটো বুক করেছিল শিখী তখন দু একটা কথাবার্তা হতো। ম্যাডামের হাজব্যান্ডও পড়ান?
না।
তাহলে? চাকরি করেন?
আমি বিয়ে করিনি।
ও, ম্যাডাম বিয়ে করেননি। মোহন একবার ডানপাশের লুকিং গ্লাস দিয়ে ম্যাডামকে ভালো করে দেখে নিয়েছিল। মাথায় কাঁচা -পাকা চুল। ম্যাডামের তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে! এখনো বিয়ে করেনি!
শিখী ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করেছিল আপনার ছেলেমেয়ে?
মোহন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিয়েছিল, আমিও বিয়ে করিনি ম্যাডাম।
শিখী বেশ অবাক হয়েছিল। বয়স হয়েছে তো অনেকটাই মোহনদার। বিয়ে করেনি! হতেও পারে। কার জীবনে যে কোন্ ব্যথা লুকিয়ে থাকে! শিখীর বিয়ে নিয়েও তো আত্মীয়মহলে কত কথা হয়! কেউ কেউ বোধহয় আন্দাজও করে শিখীর জীবনে অন্য কোনো গল্প আছে! শিখীর বোধহয় মন ভেঙেছে কোথাও! তাই শিখী বিয়ে করল না। কেউ কেউ গায়ে পড়ে সিমপ্যাথি দেখাতে আসে। শিখী তখন সরে যায় সেখান থেকে। তনুময় তার জীবনে না থাকলে কি তার জীবনটা অন্যরকম হতো! বিয়ে করে, গুছিয়ে সংসার করে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে সেও আর পাঁচজন ওয়ার্কিং মাদারের মতো ঘর -বার সামলাতো! তাতে আজ যারা তাকে সিমপ্যাথি দেখাচ্ছে তাদের কি প্রতিক্রিয়া হতো! ঠিক খাপে খাপ মিলে গেছে বলে স্বস্তি হতো! এটুকু শিওর যে শিখীর দুঃখে দুঃখী হওয়া তাদের হতো না। নিজেদের সিমপ্যাথি প্রকাশের জায়গা না পেয়ে তা নিন্দেমন্দয় পরিণত হয়ে যেত। যা হয় আর কি আত্মীয়দের মধ্যে। সামনে খুব গলাগলি। পেছন ফিরলেই গালাগালি। তা যাই হোক, মোহন বিয়ে করেনি শুনে বেশ খানিকটা অবাক হয়েছিল শিখী। মোহনকে অন্যরকম মনে হয়েছিল। সকলের তো পড়াশোনা করার সুযোগ থাকে না। তাই বলে মনটা তো আর মরে যায় না। মনের বিচিত্র রূপ। হয়তো মোহনের অকারণ হাসির মধ্যে ওর কোনো উদাসী চাওয়া লুকিয়ে রয়েছে! কে বলতে পারে!
তবে এই অন্যরকম ভাবনাটা শিখীর মনে বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। মোহনের আচরণই তার জন্য দায়ী। মোহন শিখীকে বিরক্তিতে ভরিয়ে তুলেছে। তবু শিখী যে কেন মোহনকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো অটো জোগাড় করে নিচ্ছে না! আসলে আবার অন্য অটোঅলার সঙ্গে কথা বলো! টাকাপয়সা ঠিক করো। ওরা তো বেশি চাইবেই। চারটে কথা খরচ করে মোটামুটি একটা সমঝোতার জায়গায় এসো। এসব ভালো লাগে না শিখীর। সারাদিনে পাঁচটা ক্লাস নেওয়ার পর তার কথা বলার, ভাবনা চিন্তা করার শক্তিটাই শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে মার সঙ্গেও হাতে গুনে দু একটা কথা হয়! কিন্তু আজ শিখী যা শুনল তাতে তো তার চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়। এতো বড়ো মিথ্যেটা মোহন বলল কেন তাকে! কি কারণ থাকতে পারে এর পিছনে! তবে কি শিখী যা সন্দেহ করছে তাই! মোহনের ম্যাডামকে মনে ধরেছে! প্রেমে পড়েছে মোহন! তাই রাতবিরেতে ফোন! তাই মিথ্যে! শিখীর মনে পড়ে কখনো কোনোদিন কলেজের কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে শাড়ি পরলেই মোহন জিজ্ঞেস করে, ম্যাডামের আজ কোনো প্রোগ্রাম আছে না কি! তারপর গোটা অটোর রাস্তাটা মোহন লুকিং গ্লাসের দিকে বারবার তাকায়। শিখী এসব দেখেছে। শিখীর সিক্স সেন্স বলেছে ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। তবু শিখী কিছুতেই মোহনকে তাড়াতে পারেনি। কিন্তু এমন জলজ্যান্ত মিথ্যেটা ধরা পড়ে গিয়ে শিখীর মনে হলো তার এবার একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
পরদিন মোহন সকালবেলা ফোন করল, ম্যাডাম, আজ আসব তো?
আপনি আসতে পারবেন?
হ্যাঁ ম্যাডাম। মোহনের গলায় সেই উচ্ছ্বাসটা নেই। একটু স্তিমিত লাগল।
শিখী তাকে চলে আসতে বলে ফোন কেটে দিল। মোহন আজও ঠিক পনেরো মিনিট আগেই এসেছে। শিখী আজও তাড়াহুড়ো করেই নেমেছে। আর মনে মনে ভেবেছে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল মোহন তাকে নিয়ে যাতায়াত করছে। রোজ তাড়াতাড়ি ও আসবেই। এতোদিনে তো শিখীর সেই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। তবু শিখী রোজ দশটা বাজার আগে থেকেই এতো তাড়াহুড়ো করে কেন! মোহন এসে বসে থাকলে থাকবে! শিখী তো নিজের সময় মতোই নামতে পারে। ওকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়ার তো কিছু নেই! কিন্তু তাহলে শিখী তাকে এতোটা গুরুত্ব দিয়েছে কেন! শিখী নিচে নেমে দেখল মোহন সাদা ধুতি, সাদা চাদর গায়ে দিয়ে এসেছে। শিখী কোনো কথা না বলে অটোতে উঠে বসে। মোহনও আজ কোনো কথা বলছে না। লুকিং গ্লাসে মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে। শিখী অন্যদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ তার বারবার চোখ পড়ে যাচ্ছে মোহনের দিকে। মোহনের খোলা শরীরটা, মোহনের ঘাড়, চুলের কাটিং, কলপ করা চুল, খোলা পিঠ… শিখী নিজের অজান্তেই তাকিয়ে আছে!
বারো-পনেরো দিনের মাথায় মোহন পুরোনো পোশাকে ফিরে এলো। আবার তার সেই উচ্ছ্বসিত ও উচ্চকিত কথা বলা শুরু হলো। অকারণে ছুটির দিনে বেলার দিকে ফোন শুরু হলো – ম্যাডাম কাল তো মিছিল আছে। অটো তো চালাতে দেবে না।
সে কি! আমি তবে কলেজ যাব কি করে!
কি বলি বলুন তো ম্যাডাম! হে হে হে হে…
একটা কিছু ব্যবস্থা করুন। মিছিলের জন্য কলেজ কামাই করব না কি!
ঠিক আছে ম্যাডাম! আমি দেখছি!
ফোনটা কেটে গেল। শিখী রান্না করছিল তখন। তার হঠাৎ কেমন মন খারাপ হয়ে গেল! কাল কলেজ যাওয়া হবে না! কিন্তু কলেজ যেতে তো শিখী ভালোবাসে না। কাজের জায়গায় যেতে কারই বা ভালো লাগে! আগে হলে এই সুযোগে শিখী প্রিন্সিপালের কাছে সি-এল চেয়ে বসত। আজ কিন্তু তার একবারও সে কথা মনে হচ্ছে না। খালি মনে হচ্ছে কাল যাওয়া হবে না! ভিতরে ভিতরে শিখী ছটফটঞঞঞঞ্জ করছে! খানিকক্ষণের মধ্যেই মোহনের ফোন। ম্যাডাম, আমি সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বললাম। কলেজের ট্রিপ বলে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমি কাল যাব ম্যাডাম।
শিখীর মন খারাপ এক মুহূর্তে কেটে গেল। শিখী দৌড়ে আলমারি খুলে ভালো একটা শাড়ি বের করল। কাল কলেজে সেজেগুজে যাবে। না, কোনো অনুষ্ঠান নেই। এমনিই।
এমন করেই চলছিল। শিখী মোহনকে তাড়িয়ে দেয়নি। ওর অটোতেই যাতায়াত করে। মোহন খুব দ্রুত গাড়ি চালায়। আগে শিখীর ভয় করত। মনে হতো এক্ষুনি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে। বারবার বিরক্তি প্রকাশ করত শিখী। এখন আর তার ভয় লাগে না। বরং এই গতিটাকে এনজয় করে সে।মোহন এখনো রাতবিরেতে ফোন করে। শিখী ফোন ধরে না। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়ে মোহনের নামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফোনটা যতক্ষণ ভাইব্রেট করে শিখীর ভিতরে কেমন একটা শিহরণ হয়। তারপর ফোনটা রেখে দিলেও বাকি রাতটা তার আর ঘুম আসে না।
সেদিন মোহন আবার ছুটির দিনে ফোন করেছে। ম্যাডাম, একটা কথা বলার আছে।
হ্যাঁ, বলুন। শিখীর হাতটা হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মোহন তাকে কী বলবে! শিখী যেন নিশ্বাস বন্ধ করে আছে মোহনের কথা শোনার জন্য।
মোহন বলে, ম্যাডাম, অনেকদিন তো হলো। এবার টাকাটা বাড়াতে হবে।
শিখী সামনের চেয়ারটায় বসে পড়েছে। তার কান দিয়ে হঠাৎ খানিকটা গরম হাওয়া বেরিয়ে গেল যেন। কোনোরকমে সামলে বলল, কত বাড়াতে হবে?
ওটা আপনি তিনশ করে দিন।
টাকার অঙ্কটা শুনে শিখী হিসেব করে দেখল মোহন অনেকটা বেশি চাইছে। না মোহনদা, অতোটা পারব না।
কত পারবেন?
আপনাদের যা রেট সেই অনুযায়ীই তো আমি টাকা দিই আপনাকে! এর মধ্যে দুবার তো আপনি না বলতেও বাড়িয়ে দিয়েছি।
আপনার সঙ্গে এতো বছরের সম্পর্ক। রেট দিয়ে কি হবে ম্যাডাম!
আমি অতো টাকা দিতে পারব না মোহনদা। আপনি একটু বুঝে বলুন।
না ম্যাডাম, তিনশ না দিলে আমিও পারব না!
মানে! আপনি আর আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন না!
না।
শিখীর কানে যেন কেউ গরম শিসা ঢেলে দিয়েছে। শিখী যেন শুনতে পাচ্ছে না ওপাশ থেকে কি বলছে মোহন!
ফোনটা কেটে যায়।
শিখী মোহনের নম্বরটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।