আদুনিসের কবিতা  <br /> কাব্যগ্রন্থ: দামেস্ক মিহ্যারের গান <br />পর্ব: পৃথিবীর প্রান্ত <br />  ভূমিকা ও ইংরেজি থেকে ভাষান্তর:- দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য

আদুনিসের কবিতা
কাব্যগ্রন্থ: দামেস্ক মিহ্যারের গান
পর্ব: পৃথিবীর প্রান্ত
ভূমিকা ও ইংরেজি থেকে ভাষান্তর:- দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য


ভূমিকা

.

আদুনিসের কবিতার অন্তর্লোকে যেন এক চিরন্তন শোকপালনের আবহ — গভীর নিরাসক্তির এক হোমাগ্নি তাঁর লেখায় জ্বলতে থাকে। ক্রমশ আগুনের সেই কুণ্ড থেকেই উঠে আসে আগামীর ধারণা। তাঁর লেখার একদিকে থাকে বিলয় — অন্যদিকে পুনর্গঠনের এক বন্ধনহীন ব্যগ্রতা। এই তীব্র বৈপরীত্যের গ্রন্থনাই হয়তো আদুনিসের কবিতার অন্তর্গত প্রাণ — বাঁচার জন্যই তাঁর কবিতার ‘আমি’ চায় আত্মবিসর্জন, সুখের জন্যই পুড়িয়ে দিতে চায় তার সুগন্ধ। বিপন্নতায় ডুব দিয়ে, অশ্রুনদীর অতল থেকে মৃতদের করোটির কাদাজল ছেঁচে এক স্বপ্নস্বাধীনতার দিকে যেতে চায় সে:

আমি হাঁটি আর তারারাও হাঁটে আমার পিছনে

ওদের আগামীর দিকে।

গোপনীয়তা মৃত্যু আর যা কিছু জন্ম নেয়

আর কালো যত অবসাদ

আমার পায়ের ছাপকে হত্যা করে

আর রক্তকে করে তোলে সজীব।

একজন কবি বা লেখকের অন্তর্জগতে জাতির ইতিহাসের সারাৎসার সঞ্চিত থাকে — সেই ইতিহাসবোধ কবিকে ক্রমাগত নির্মাণ করে নেয়। আরবি ভাষাবিশ্বের ইতিহাসের প্রায় সমস্ত যুগেই অস্ত্রের ঝনঝনানির শব্দ — তার সভ্যতার সব পথেই গাঢ় কালো হয়ে শুকিয়ে থাকে বীজিতের রক্ত, সমস্ত সিংহাসনেই গুপ্তহত্যা এবং ক্ষমতাদখলের অভিজ্ঞান।

.

. আদুনিসের মাতৃভূমি সিরিয়া। ভাবলে অবাক হতে হয়, মেসোপোটেমিয়ার পরেই পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার আলো এইখানেই ফুটেছিল একদিন, এখানকার মানুষই প্রথম পশুপালন ও চাষাবাদ রপ্ত করেছিল, এখানেই প্রথম লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে — খ্রিস্ট জন্মের দু’হাজার বছরেরও আগেকার কথা সে-সব!

.

কবির মনের সমস্ত রক্তপাত শোষণ করে নেয় তাঁর অক্ষরমালা — কবিতার পরতে পরতে ভেঙে পড়ার ঝোড়ো শব্দ পাওয়া যায়। তাঁর কবিতা কোনো সত্য ও সুন্দরের শান্ত, ধ্যানলব্ধ শব্দমালা নয় — শুকনো কান্নার মরচে দাগ ধরা এক-একটি বাক্যবন্ধ উঠে আসে তাঁর কলম থেকে। অনন্ত ক্রোধ কবিকে লিখিয়ে নেয় ধুলোয় লুটিয়ে থাকা শতাব্দী প্রাচীন চাবুকের কবিতা — ঈশ্বরকে খুন করে, দুমড়ে-মুচড়ে সে গড়ে নিয়ে চায় এক লোকায়তিক দেবতাকে:

মৃত্যু আমাদের অপেক্ষায়,

আমাদের সৈকত হল ঘনিষ্ঠ নিরাশা, আর তাকে আমরা

গ্রহণ করেছি

একটা সমুদ্রের মতো, শীতল ইস্পাতের মতো সেই জল

যত পেরোই,

বাইরের সীমা ছুঁয়ে দিতে লড়াই করি হরদম,

আমরা চলে যাই সেই ভগবানের কথা না শুনেই,

আমরা চাই এক ভিন্ন ঈশ্বর, এক নতুন ঈশ্বর।

আদুনিসের কবিতা আদ্যন্ত পুরুষালি — ছুরির মতো ধার তাঁর শব্দগুলিতে, গুপ্তঘাতকের ছায়ায় ছমছমে তাঁর কবিতার পরিসর। পাঠককে তাঁর লালিত অভ্যাস সযত্নে সরিয়ে রেখে তাই এই কবিতালোকের গুহায় প্রবেশ করতে হয়:

.

ক্ষয়িষ্ণু এক নৈঃশব্দ্যে, অবরোধের মধ্যে

ধুলোর গায়েতে আমি কবিতা লিখি

একটা কাকের পালক দিয়ে।

আমি জানি, আমার চোখের পাতায় কোনো আলো নেই —

কিছু নেই, শুধু আছে ধুলোর সজ্ঞা।

.

সিরিয়ার লাটাকিয়ার কাছে এক অজ গ্রাম কোয়াসাবিনের এক কৃষক পরিবারে আদুনিস অর্থাৎ আলি আহমেদ সৈয়দ ইসবারের জন্ম হয় ১৯৩০ সালে। ১৪ বছর বয়সে প্রথমবারের জন্য ইশকুলে যাবার সুযোগ পান তিনি। তাঁর ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য ১৯৫৫ সালে একবছর তাঁকে বন্দিজীবন কাটাতে হয়। ছাড়া পাবার পর তিনি বইরুত চলে যান এবং লেবাননের নাগরিকত্ব নেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ‘কবিতা’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬০ নাগাদ সুফি ভাবধারার আদলে এক সুক্ষ স্যুরিয়ালিজমের মিশ্রণে নতুন এক কবিতাধারা গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতি আবার তাঁকে প্যারিসে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে।

.

এখানে যে কবিতাগুলির বাংলা তর্জমা করা হয়েছে, সেগুলি ১৯৬১ সালে রচিত তাঁর ‘দামেস্ক-মিহ্যারের গান’ কাব্যগ্রন্থের ষষ্ঠ পর্ব ‘পৃথিবীর প্রান্ত’ থেকে নেওয়া। আরবি ভাষা না জানা থাকায় বর্তমান অনুবাদককে বইটির ইংরেজি ভাষান্তরের সাহায্য নিতে হয়েছে।

.

এই কবিতাবইটি যেন তাঁর আত্মবিস্ফোরণের পদাবলি যেখানে কবিতার “আমি’ এক “অভিশপ্ত মিহ্যার”। সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলে আবার তাকে স্বপ্নজাত করে নেবার আর্তি এই কবিতাবইয়ের প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে ।

প্রার্থনা

.

বাতাসের জন্য আমি এই সমুখ আর পিছন গড়ে তুলি, আমার গড়নকে তাদের ধরে রাখতে দিই। প্রত্যাখানের এক অবয়ব গড়ে নিই আমি, নিজেরই সঙ্গে তার তুলনা করি। মেঘেদের থেকে নিই লেখার পাতা আর কালি এবং ধুয়ে ফেলি যত আলো।

.

যা আমি ছেড়েছি সবই আকাশ ধারণ করে, অশ্রুরও আছে সেই তল যেখানে আমার লেখা; বনফুলেরও সেই কারুকাজ আছে যা দিয়ে সাজাই নিজেকে; পাইনের আছে এক সুঠাম কোমর, যে আমার জন্য হাসে, তবু কারোকেই পাই না যে ভালোবাসব তাকে। মৃত্যু হে, অনেক বেশি কি এই চাওয়া, নিজেকে ভালোবাসার জন্য?

.

আমাকে আমিই নিজে ঘুম পাড়াই। আমার আঙুল থেকে পথ গড়ে নিই, আমার চোখের মতো গোলাকার এক পরিসর গড়ে তুলি। এমন জলের কণা বানাই আমি, আমারই তৃষ্ণা যাতে মেটানো যায় না। আমি হাওয়ার মতো, তবু পাল নেই আমার — এমন আবহ এক গড়ে তুলি, বাগানের মুখোমুখি দাঁড়ায় নরক। নতুন নতুন কত শয়তান যে কল্পনা করি, দ্রুত ছোটাই তাদের আর বাজি ধরে ছুটি।

.

আমারই ধুলোতে আমি চোখ ঝামটাই। প্রাচীন তন্ত্রীগুলি বাজিয়ে তুলি, পূর্বপুরুষদের যত স্মৃতি ফের জেগে ওঠে। আমি বয়ন করেছি তাদেরই সব রঙ, তাদের সূচের আগায় রঙ তুলে দিই। আমি ক্লান্ত হই, নীলচে-নীলে আমি নিই বিশ্রাম — ক্লান্তি আমার সূর্যের মতো ঝলসায়, চন্দ্রের মতো আভা দেয়।

.

পৃথিবীকে মুক্ত করে আকাশকে কয়েদ করি আমি। তারপর ঝাঁপ দিই আলোর কাছে বিশ্বাসী হয়ে থাকতে, পৃথিবীকে জটিল, মোহন, অস্থির আর বিপদজনক করে তুলতে; ঝাঁপ দিই সীমানা ভাঙতে।

.

দেবতাদের রক্ত এখনো গরম রয়েছে আমার পোশাকে। শঙ্খচিলের কান্না আমার লেখার পাতার থেকে উড়ে যেতে চায় — তাই আমার শব্দ বয়ে চলে যেতে হবে আমাকেই…

.

.

জোব্বাটা

.

আমাদের বাড়িতে একটা জোব্বা আছে

আমার বাবার জীবন-মেপে কাটা,

কঠিন শ্রমে সেলাই দেওয়া।

.

ওটা আমাকে বলে — তার খড়ের মাদুরে, তুমি

ছিলে পাতাহীন একটা ডালের মতো,

এবং তার ভাবনায় ছিলে তুমি,

সবসময় এবং চিরটাকাল।

.

আমাদের বাড়িতে একটা জোব্বা আছে,

বাতিল, ছেঁড়াখোঁড়া;

হাওয়ার তারসে, সেটা আমাকে

বাবার চুন-পাথরের ছাদে তুলে নিয়ে যায়,

ওই জোব্বার ফুটোগুলো দিয়ে আমি দেখি

বাবার জড়িয়ে রাখা দুটো হাত,

তার হৃদয়, যে বেদনা বসতি করেছিল সেখানে

আমাকে ঘিরে থাকে আর রক্ষা করে, প্রার্থনায় ঢেকে দেয় আমার পথ,

আমাকে ছেড়ে যায় যেন কোনো বাঁশির মতো, অরণ্যের মতো, কোনো গানের মতো।

.

.

আমার দিগন্ত এক অঙ্গীকার

.

যেতে যেতে, আমার নিজের ছাপ বয়ে নিয়ে যাই,

ওই বালির তৃষ্ণা আমার ভিতরে,

সমুদ্রকে পেরিয়ে চলেছে প্রতিটি কদমে।

কে আমি? কোন ভালোবাসার জন্য আমি বেঁচে আছি?

আমার দিগন্ত এক অঙ্গীকার, আমার দু’চোখ আছে অপেক্ষায়।

.

ভালোবাসা — নষ্ট করো আমায়, বয়ে যাও

আমার বিহ্বলতায়, পেরিয়ে যাও তীরভূমি,

ঝিনুকগুলোকে ওদের মুরশিদের কথা জানতে চাও:

ওদের গভীরে কী গোপনীয় রেখে দিই আমি ?

ওদের চোখের পাতায় কোন স্বপ্ন রেখেছি ?

আমার বিহ্বলতা এক রক্তের স্তোত্র আমার বুকেতে,

আগুন থেকে জেগে উঠছে ধূপকাঠি, আগুন জ্বালায় —

.

কে আমি ? কোন ভালোবাসার জন্য আমি বেঁচে আছি ?

আমার দিগন্ত এক অঙ্গীকার, আমার দু’চোখ আছে অপেক্ষায়।

একটা না-ফোটা আগামী আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে,

আর যদি সূর্য আমাকে পেয়ে যায় আমি আমাকে হারাব।

.

.

পুবের সৌন্দর্য

.

যখনই মনে হয়

পুবের সৌন্দর্য দেখতে হবে,

যখনই গোধূলি ডাক দেয়,

.

আমার চোখের ওপর পথ মুছে যায়।

.

.

আমার অস্থিরতা

.

দিগন্তে আমার অন্ধকার,

আমার অস্থিরতা —

আমার বাঁচার পথ রুদ্ধ করো, বাঁধো চেপে, দু’টুকরো করো,

উড়িয়ে দাও ঝড়ে, পুড়িয়ে দাও।

.

হয়তো এর ছাই থেকেই

নতুন এক ভোর খুঁজে পাব।

.

.

বস্তুর অন্ধকারে

.

ভালোবাসি বস্তুর

অন্ধকারে থেকে যেতে, ওদের গোপনীয়তায়।

সৃষ্টির গভীরতা ছুঁতে ভালোবাসি,

বিশ্বাসের মতো উড়ে যেতে,

দীপান্তরী কোনো শিল্পের মতো,

নামহীন এক অস্বচ্ছতার মতো, যা নিশ্চিত নয় —

.

প্রতি আগামীতেই, আমার পুনর্জন্ম।

.

.

সেই নক্ষত্রেরা

.

আমি হাঁটি আর তারারাও হাঁটে আমার পিছনে

ওদের আগামীর দিকে।

গোপনীয়তা মৃত্যু আর যা কিছু জন্ম নেয়

আর কালো যত অবসাদ

আমার পায়ের ছাপকে হত্যা করে আর রক্তকে করে তোলে সজীব।

.

আমি তো সে-ই যার পথচলা শুরু হয়নি এখনো,

আমার কোনো পথ-দেখানো তারকাও নেই —

.

আমি হেঁটে চলি আমারই আমির দিকে,

আগামীকালের দিকে,

আমি হাঁটি আর তারারাও হাঁটে আমার পিছনে।

.

.

প্রসববেদনা

.

কার জন্য ভোর আমার চোখের জানলা দুটো খোলে

আর আমার পাঁজরের মধ্যে দিয়ে রাস্তা করে নেয় ?

মৃত্যু কেন আমার সত্তাকে উপড়ে ফেলে

আর সময়ের তালে তালে আমার জীবনকে বাঁধে ?

.

আমি জানতাম: আমার রক্ত সময়ের গর্ভ,

আমার ওষ্ঠে সত্যি জন্ম নেয়।

.

.

এক

.

পৃথিবী আমার সঙ্গে একাকার,

ওর চোখের পাতা আমার থেকেই নেওয়া।

পৃথিবী আমার সঙ্গে একাকার, আমার স্বাধীনতার সঙ্গে,

আমাদের মধ্যে কে তাহলে অন্যকে সৃষ্টি করবে ?

.

.

মৃত্যুর দুটি গান

.

যেন সে কোনো মৃত্যু যখন সে হেঁটে যায়,

নৈঃশব্দ্যে শ্বাসরুদ্ধ;

সে আমারই সঙ্গে এমনকী ঘুমেরও ভিতর।

.

মৃত্যুর হাত, আমার পথের দড়িগুলো পাকিয়ে তোলো:

সে-অজানা আমার মন নিয়ে চলে গেছে।

মৃত্যুর হাত, একে পাকিয়ে তোলো

যাতে অসম্ভবের গুহামুখ খুলে দিতে পারি

আর চারপাশের পৃথিবীটাকে দেখতে পাই।

.

.

আমি খুঁজি অর্থ

.

আমি নিজের অস্তিত্বকে এক বাহিনির মধ্যে খুঁজি

যা আমাকে পৃথিবীটা ধ্বংস করে দিতে বলে,

যা আমাকে গড়ে তুলতে বলে পৃথিবী।

.

আমি নিজের ভিতর আর যৌবনের ভিতর

সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দামি এক আগামীকে খুঁজি।

.

আমি খুঁজি অর্থ,

আমি তার ভিতরেই ঈশ্বর আর পৃথিবীকে ঠাঁই দেব।

.

সেই জাদুবুড়ি

.

এক জাদুবুড়ি তার ধূপগুলো জ্বালাল

আমার ভুরুতে, গভীর এক স্বপ্নে গেল ডুবে

তার দু’চোখের পাতাদুটো হল তারা।

.

ও সাতকালের জাদুবুড়ি, আমাদের বলো

সেই ঈশ্বরের কথা সবেমাত্র জন্ম নিয়েছে যে, বলো:

তার চোখে পুজো করার মতো কিছু কি আছে?

.

.

ইচ্ছা

.

আমার একটা ইচ্ছা আছে

তাকে ঠিক ইচ্ছা বলা যায় না,

এতকালের ফোঁপরা বুক ভরে না তাতে।

সব কিছু সেই দিকেই তবু ছুটে যায় যেন

এ ছাড়া আর কিছুই তারা জানে না।

তারা বলে, এ ছাড়া আমি শূন্য।

.

যেন তা তার নিজের থেকেও বড়ো,

উঁচু হতে হতে ছড়িয়ে যায়

কিন্তু খুশি হতে পারে না কিছুতেই:

নিজের অস্তিত্বকে ছেড়ে যেতে চায়

এই পৃথিবী আর আকাশকে জড়িয়ে নেবে বলে।

.

.

ওই পথগুলো

.

আমার গতকাল হল আগামী, আর পৃথিবী এক স্তোত্রগান

যা গলে যায় — গলে যায় আমার মুখে আর আমার ভালোবাসায়।

সকালের অর্থ জন্ম নেয় আমার দু’চোখে,

যত পথ আমার সঙ্গেই শুরু হয়।

.

.

আমি আলো নিয়ে বাঁচি

.

আমি আলো নিয়ে বাঁচি, আমার জীবন

এক ভেসে-যাওয়া সুগন্ধ,

আমার প্রতিটি পল এক-একটা বছর,

আমি আমার এই দেশের এক স্তোত্রকে ভালোবেসেছি,

এমন এক স্তোত্র যা রাখালেরা সকালের মতো বয়ে নিয়ে গেছিল।

একটুকরো ভোরের মতো তাকে সূর্যের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল তারা,

প্রার্থনা করেছিল সেই স্তোত্রেই এবং মরেও গিয়েছিল —

.

যখন তোমার ঠোঁটে মৃত্যু হেসে ওঠে,

জীবন কেঁদে মরে তোমাকে পাবার জন্য।

.

.

যাত্রা

.

এক নিশ্চল যাত্রী:

সূর্য, কে আমাকে তোমার পদধ্বনি দিল ?

.

.

সীমানা

.

যদি জল হতাম, পৃথিবীকে শতচ্ছিন্ন করে

ধুলোর তলায় ঢুকে যেতাম,

শিশির আর কুয়াশার

মতো দিন কাটাতাম।

.

যদি মেঘ হতাম,

রাখালদের জন্য এক ঝরনা হয়ে যেতাম

প্রেমিকদের জন্য টাঙিয়ে দিতাম তাঁবু।

.

যদি এক মাঠ হতাম, যদি হতাম ফসল,

খুঁজে নিতাম ঋতুর রহস্য কীভাবে জেগে ওঠে

গমের ফসলে, কেমন করে সেই চাকা ঘুরে চলে।

.

আমার উপস্থিতির কোনো সীমা নেই, আমার আকাশে

লেখা আছে “ছাই”, লেখা আছে “কয়লা,”

কেননা আমি মজ্জা, কেননা আমি রক্ত।

.

আমার সীমানা আমি ভালোবাসি আর ঘৃণা করি

ভালোবাসি বলে এই সীমা —

এছাড়া কি আর কোনোই রাস্তা নেই

এই সত্তাকে বয়ে নিয়ে চলার ?

.

.

পৃথিবীর প্রান্ত

.

যা-কিছু হতে পারে তা আমাকে স্পর্শ করে না, সে যাই নিয়ে আসুক

আনন্দ বা বেদনা।

আমি আমার নীতিমালা বয়ন করে নিই

আমার স্তোত্রের ভিতর,

আমি আশ্রয় খুঁজি,

আমি এক পৃথিবীকে খুঁজে বেড়াই

পৃথিবীর প্রান্তে যার শুরু।

.

.

আদম

.

আদম আমাকে ফিসফিস করে বলল,

ওর গলা বসে গেছে

নৈঃশব্দ্য আর গোঙানিতে —

.

“পৃথিবীর পিতা আমি নই,

কখনো কোনো বাগান দেখিনি আমি,

আমাকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে চলো।”

.

.

পাথরের দ্বীপ

.

আমার প্রতিটি পদক্ষেপেই জেগে ওঠে

পাথরের এক দ্বীপ,

স্ফুলিঙ্গের এক দ্বীপ —

.

তার ঢেউগুলো নিশ্চল,

তার সৈকত গেছে সমুদ্রযাত্রায়।

.

.

কাকের পালক

.

আমি আসি — ফুল নেই মাঠ নেই কোনো,

আমি আসি ঋতুহীন একা।

.

আমার কিছুই নেই বাতাসে বা বালির পরতে,

কিছু নেই সকালের সাজে,

শুধু আছে তরতাজা রক্ত

আকাশের সাথে ছুটে যায়,

নবীর মতোই আমার ভুরুতে বসা পৃথিবীতে দেখো

অগুনতি পাখির উড়ান।

.

আমি আসি ঋতুহীন একা,

ফুল নেই মাঠ নেই কোনো,

আমার রক্তের মধ্যে ধুলোর ঝরনা।

আমার দু’চোখে আমি করি বসবাস,

আমাকে লালন করি দুটি চোখ দিয়ে —

.

বেঁচে আছি, কেটে যায় দিন সেই অপেক্ষায়

কোনো এক জাহাজের জড়িয়ে রয়েছে সেটা থেকে-যাওয়াকেই,

একটি জাহাজ যেটা ডুব দেয় জলের অতলে

যেন কোনো স্বপ্নে অথবা বিহ্বলতায়,

যেন চলে যায়, ফিরে আসা হবে না জেনেই।

.

ক্ষয়িষ্ণু এক নৈঃশব্দ্যে, অবরোধের মধ্যে

ধুলোর গায়েতে আমি কবিতা লিখি

একটা কাকের পালক দিয়ে।

আমি জানি, আমার চোখের পাতায় কোনো আলো নেই —

কিছু নেই, শুধু আছে ধুলোর সজ্ঞা।

.

দিনের সঙ্গে এক রেস্তোরাঁয় আমি বসে আছি,

কাঠের চেয়ার আর

সিগারেট উচ্ছিষ্টগুলো নিয়ে,

বসে আছি অপেক্ষায়

বিস্মৃত এক সাক্ষাতের আশায়।

.

মাথা হেঁট করে আমি দোয়া করতে চাই

ডানাভাঙা পেঁচার কাছে,

জ্বলন্ত কয়লার কাছে, হাওয়ার কাছে

আমি দোয়া করতে চাই

আকাশের আচ্ছন্ন সেই তারকার কাছেও,

মৃত্যুর কাছে আর ব্যাধির কাছে,

আমার শুভ্র দিনগুলো পুড়িয়ে দিতে চাই,

আমার গানগুলো আর লেখার খাতা,আমার কলম

আর দোয়াতদানি,

আমার সুগন্ধ ঢেলে সেসব পোড়াব,

যার হোক কাছে আমি প্রার্থনা করি

জানে না যে কখনো সে-প্রার্থনা কী।

.

আমার পথের মধ্যে বইরুত পড়েনি

বইরুত ফোটেনি — দেখো আমার মাঠ।

কোনো ফল ফলায়নি ও — দেখো একবার

পঙ্গপালের ওই ঝাঁক আর বালিতে ছাওয়া আমার জমির দিকে,

আমি একা — ফুল নেই নেই কোনো ঋতু,

আমার ফলের সঙ্গে আমি একা থাকি

গোধূলি সময় থেকে ভোরবেলা অবধি

বইরুত পেরোই আমি তাকে না দেখেই,

বইরুতে থাকি আমি তাকে না দেখেই,

একা থাকি ফল আর ভালোবাসা নিয়ে,

দিনের সঙ্গে আমি ছেড়ে চলে যাই,

অন্য কোনোখানে আমি চলে যেতে চাই।

.

.

ভোর তার তন্তু ছিঁড়ে দেয়

.

ভোর তার তন্তু ছিঁড়ে দেয়,

ধুলোর ওপরে সে চোখের পাতা রাখে,

এবং আমার দুই হাত মাস্তুল

জড়িয়ে রয়েছে সেই নৈঃশব্দ্যের পাল।

.

আমার জানালাগুলো হারিয়ে গিয়েছে–

আর কোনো ফুল নেই, বই নেই আর,

আমার কুলুঙ্গি জুড়ে আমি থাকি একা,

আমার দুর্বল তন্তু আছে সাথে, আছে এক কাক।

.

.

সেই দরজা

.

সপ্তাহের পর সপ্তাহ তার চোখের পাতা

দরজার কাছে থাকে সঙ্গোপনে,

বিছানাতেই তার শরীর হারিয়েছে।

সে খুঁজেই চলেছে, তার হৃদয় সেই দরজাটাতেই ফের,

কখনো যে-দরজায় কেউ কড়া নাড়েনি।

.

তার ইচ্ছে হল কাঁদে:

“কী মহৎ, কী অমূল্য সেই অশ্রুবিন্দুগুলি

যার নদী আমার প্রিয়জনেদের তাদের জাহাজে তুলে দেয়।”

.

.

কে তুমি?

.

আমার চোখ একটা প্রজাপতির শরীরে,

ভয় আমার গানগুলোকে আঘাত করে।

— কে তুমি?

— এক দিগভ্রান্ত বল্লম,

এক ঈশ্বর যে প্রার্থনা ছাড়া বাঁচে।

.

.

নতুন নূহ

.

নৌকায় আমরা ফেলে এসেছি, আমাদের দাঁড়গুলো

ভগবানের এক শপথ, এবং আমরা বেঁচে গেছি

যখন মনুষ্যত্ব গেছে মুছে

বৃষ্টি আর কাদার তলায়।

ঢেউয়ের মাথায় আমরা ভেসে গেছি,

জগৎ যখন মরার বাঁধনরশি

তাতেই আমরা বেঁধেছি জীবন সবার।

আমাদের এক দোয়ার জানলা ছিল আকাশ এবং আমাদের মাঝখানে:

.

“হে ঈশ্বর, শুধু আমাদেরই তুমি বাঁচিয়ে রাখলে কেন

লক্ষ লক্ষ মানুষ ও প্রাণের ভিতর?

কোথায় রাখবে তুমি প্রভু? অন্য কোনো দেশে,

প্রথমে আমরা ছিলাম যেখানে?

মৃতদের পাতায় পাতায় আর জীবনের ঘূর্ণিঝড়ে?

প্রভু ওগো, আমাদের শিরায় শিরায়, আমাদের গভীরে

সূর্যের দারুণ এক ভীতি গেড়ে আছে,

আলো যেন আশাহীন কী হবে তা দেখে,

আগামীও আশাহীন কী হবে তা পেয়ে

যখন আবার নতুন জীবন হবে শুরু।

.

যদি বীজ নাই হতাম আমরা

সৃষ্টির, পৃথিবীর ও তার বংশরক্ষার,

যদি এখনো কাদামাটি কিংবা হতাম কয়লা

কিংবা এ’দুইয়ের মাঝখানে কোনো কিছু,

যাতে পৃথিবীকে আর দেখতে হত না কখনোই,

কিংবা তার নরক, অথবা ঈশ্বর — একটি দিনের জন্যও নয়।”

.

.

যদি সময়কে নতুনভাবে শুরু করা যেত

আর আছড়ে পড়ত জল জীবনের মুখ মুছে দিয়ে,

আর কেঁপে উঠত পৃথিবী, এবং ভগবান তড়িঘড়ি

বলতেন আমায়, “নূহ, আমাদের জন্য সব প্রাণীকে বাঁচাও,”

আমি শুনতাম না তার কোনো কথা,

আমি নৌকোটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম,

মৃতদের খোঁদল থেকে কাদা আর নুড়ি যত ছেঁচড়ে

নিতাম তুলে,

বন্যাকে দেখাতাম আমি তাদের অতল,

তাদের শিরায় আমি ফিসফিস করে উঠতাম, আমি বলতাম

মরুভূমি থেকে ফিরেছি আমরা, গুহা থেকে

উঠে এসেছি,

কত যুগের আকাশ আমরা বদলে দিয়েছি,

আমি বলতাম যাত্রা করি চলো হে ভয়ের কাছে মাথা না ঝুঁকিয়ে,

ভগবানের কোনো কথা কানে না তুলে।

মৃত্যু আমাদের অপেক্ষায়,

আমাদের সৈকত হল ঘনিষ্ঠ নিরাশা, আর তাকে আমরা

গ্রহণ করেছি

একটা সমুদ্রের মতো, শীতল ইস্পাতের মতো সেই জল

যত পেরোই,

বাইরের সীমা ছুঁয়ে দিতে লড়াই করি হরদম,

আমরা চলে যাব সেই ভগবানের কথা না শুনেই,

আমরা চাই এক ভিন্ন ঈশ্বর, এক নতুন ঈশ্বর।

টীকা: পৃথিবীর প্রান্ত

.

o এই পর্বের কবিতাগুলির মধ্যে পনেরোটি যেমন পরবর্তী সংস্করণে বাদ দেওয়া হয়েছে, তেমনই অন্য কবিতাগুলিতে কিছু কিছু জায়গায় শব্দের পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, কিংবা পঙ্‌ক্তি বাদ দেওয়া হয়েছে। যে কবিতাগুলো পরবর্তী সংস্করণে একেবারেই নেই, সেগুলো হল : “জোব্বাটা”, “আমার দিগন্ত এক অঙ্গীকার”, “পুবের সৌন্দর্য”, “আমার অস্থিরতা”, “বস্তুর অন্ধকারে”, “সেই নক্ষত্রেরা”, “প্রসববেদনা”, “এক”, “মৃত্যুর দুটি গান”, “আমি খুঁজি অর্থ”, “সেই জাদুবুড়ি”, “ইচ্ছা”, “পথগুলো”, “আমি আলো নিয়ে বাঁচি” এবং “সীমানা”।

o আলাপ পর্বের, ‘প্রত্যাখানের এক মুখ গড়ি আমি’ পঙ্‌ক্তি থেকে পরবর্তী সংস্করণে ‘প্রত্যাখ্যানের’ শব্দটির বদলে ‘দিগন্তের’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

o ‘কাকের পালক’ কবিতার প্রথম পর্বে ‘আমি আসি ঋতুহীন একা’ অংশটি পরবর্তী সংস্করণে রাখা হয়নি।

o ‘সেই দরজা’ কবিতাটির নীচের পঙক্তিগুলোর উর্ধ্বকমা পরবর্তী সংস্করণে তুলে দেওয়া হয়।

“কী মহৎ, কী অমূল্য এই অশ্রুবিন্দু

যার নদী আমার প্রিয়জনেদের তাদের জাহাজে তুলে দেয়।”

o কবিতা : নতুন নূহ

নূহ বা নোয়াকে সুবিশাল এক নৌকো তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঈশ্বর, যাতে জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে নূহ এবং তার পরিবারসহ পৃথিবীর অন্য প্রাণীদের রক্ষা করা যায় ( জেনেসিস অধ্যায় ৬ – ৯)। প্রভুর নির্দেশে নূহ ৪৫০ ফুট লম্বা, ৭৫ ফুট চওড়া এবং ৪৫ ফুট উঁচু একটি নৌকো তৈরি করেন।

বাইবেলে এই নৌকোটিকে নূহ বা নোয়ার ‘আর্ক’ বলা হয়েছে, যা থেকে মনে হয় সুবিশাল এক সিন্দুকের মতো এর চেহারা। বলা হয়, এই নৌকোয় সওয়ার হয়ে ঈশ্বরবিশ্বাসীরা মহাপ্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পান।

o ভগবান

এখানে এক পতিত ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে, যার জন্য বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধার অবকাশ নেই কবির মনে। ইংরেজি ভাষান্তরে ‘god’ এবং ‘his’ — এই দুটি সম্বোধন ছোটো হরফে লেখা হয়েছে।

o সিরিয়া : এক স্বপ্নের আহুতি

.

আজ আমরা সিরিয়া বলতে যে দেশের সীমানা বুঝি, খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতেই নব্য অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে সেটি এই আকার পায়। এই সাম্রাজ্যটির রাজধানী ছিল আশুর। সম্ভবত ‘আশুর’ শব্দটি থেকেই সিরিয়া-র উৎপত্তি হয়েছে।

সিরিয়া বা সুরিয়া, সরকারিভাবে সিরীয় আরব প্রজাতন্ত্র, পশ্চিম এশিয়ার একটি সার্বভৌম দেশ যার পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উত্তরে তুরস্ক, পূর্বে ইরাক, দক্ষিণে জর্ডন এবং দক্ষিণ পশ্চিমে লেবানন এবং ইজরায়েল। উঁচু পাহাড় যেমন আছে এই দেশে, সবুজ উর্বর সমতলভূমিরও অভাব নেই, আবার আছে মরুভূমি আর মালভূমিও।

সবচেয়ে প্রাচীন যে ধ্বংসাবশেষ সিরিয়াতে পাওয়া যায় তা প্রত্নপ্রস্তর যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৮০০,০০০ অব্দ)। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন যে সিরীয় সভ্যতা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতাগুলির একটি। প্রাচীন সভ্যতা বিকাশের কেন্দ্রগুলিকে একসঙ্গে ‘উর্বর চন্দ্রকলা’ অভিধা দেওয়া হয়, যার অন্যতম কেন্দ্র ছিল সিরিয়া। খ্রিস্টজন্মের ১০ হাজার বছর আগেই সিরিয়া ছিল নব্য-প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। চাষবাস এবং পশুপালন এখানেই প্রথম শুরু হয়। তাছাড়া অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যেও যে তারা পিছিয়ে ছিল না, তারও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। মেসোপোটেমিয়ার পরেই পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল এখানেই।

খ্রিস্টজন্মের ৩,৫০০ বছর আগেই উত্তর সিরিয়ার ইদলিবের কাছে এবলায় (Ebla) দেশীয় সভ্যতার বিকাশ হয়। মেসোপোটেমিয়ার সুমের, অ্যাসিরিয়া এবং আক্কাদের মতো সভ্যতার সঙ্গে এই সভ্যতার যোগাযোগ ছিল, এমনকী ফারাওদের উপহার অবধি ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া গেছে। এর থেকে বোঝা যায় মিশরের সঙ্গেও সিরিয়ার যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে এবলার সঙ্গে একটি লিখিত বাণিজ্য চুক্তিও ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া যায়। মেসোপোটেমিয়ায় যে আক্কাদীয় ( akkadian) লিপি লেখার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত, প্রাচীনতায় তার পরেই ছিল এবলায় ব্যবহৃত প্রাচীন আফ্রো-এশীয় লিপিটি।

যা কিছু এই দেশের আশীর্বাদের মতো ছিল, যেমন এর সম্পদ, অথবা ভূমধ্যসাগর দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সহজ এক যোগাযোগব্যবস্থা — তাই একদিন এর অভিশাপ হয়ে দাঁড়াল। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আজ অবধি ক্রমাগত যুদ্ধ আর রক্তক্ষয়ী লড়াই, এই দেশের নিয়তি। প্রাচীন সভ্যতার আলো ফুটেছিল যেখানে, সেই এবলা জনপদই মারি-র সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধে দুর্বল হয়ে শেষে ধ্বংস হয়ে যায় এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৩ শতকে আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় সিরিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ২১ শতকে সিরিয়ার আধিপত্য ভাগ হয়ে যায় উত্তরভাগে হুরীয় ( Hurrians) এবং অন্য অংশে আমোরীয়দের ( Amorites) মধ্যে। এই যুদ্ধ আর এই দখল-পুনর্দখলের ইতিহাস চলতেই থাকে — শুধু বদলে যায় নয়া আক্রমণকারীর নাম, বদলে যেতে থাকে বিজীত শক্তিদের পরিচয়।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে সুমেরীয়, এবলীয়, আক্কাদীয়, অ্যাসিরিয়, মিশরীয়, হিট্টি, হুরীয়, মিতান্নি, অ্যামোরীয় ও ব্যবিলনীয়রা সিরিয়াকে পর্যায়ক্রমে দখল করার জন্য একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। প্রভাবশালী ইয়ামহাদ ( Yamhad) রাজবংশের রাজধানী ছিল আলেপ্পোতে (Aleppo)। আলেপ্পো এবং দামেস্ক (Damascus) হল পৃথিবীর প্রাচীনতম দুই বসতি। পরে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের কাছে এই দুই জনপদের পতন হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালে। সেই থেকেই সিরিয়া তার মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয় এবং অন্য শত্রুদের সঙ্গে এক যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নেয়। কত কত গোষ্ঠী যে এই দেশের নানান অংশে নানান সময়ে প্রভুত্ব কায়েম করেছে, তা বোধহয় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না!

অ্যাসিরীয়রা সিরিয়া এবং লেবাননে তাদের উপনিবেশকে ‘এবের-নারি’ ( নদীর অন্য প্রান্ত) বলে অভিহিত করত। কিন্তু তাদের আধিপত্যও খর্ব করতে মিডাস ( Medas), ব্যাবিলনীয় ( Babylonians), কালদীয় ( Chaldeans), পার্সি ( Persians), সিদীয় ( Scythians), সিমেরীয়রা ( Cimmerians) একে একে সিরিয়া আক্রমণ ও ধ্বংস করে চলে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০৫ অব্দে শেষবারের জন্য অ্যাসিরীয়রা কারচেমিশে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারপর এল নব্য ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ( ৬০৫ – ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে)। এইসময় সিরিয়া হয়ে দাঁড়ায় ব্যাবিলনীয় এবং মিশরে অবস্থিত অ্যাসিরীয়দের মধ্যে এক যুদ্ধক্ষেত্র। শেষ অবধি ব্যাবিলনীয়রা জয়লাভ করে। ১৯৪৬ অবধি সিরিয়া ছিল ফরাসিদের একটি উপনিবেশ। পরাধীন থাকাই যেন এই দেশের ভবিতব্য।

সিরিয়ার সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাস তার প্রাচীন ইতিহাসের থেকে কম রক্তাক্ত নয়। নামেই এটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র, প্রকৃতপক্ষে একনায়কতন্ত্র। ১৯৬৩ সাল থেকেই এখানে জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে। রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক বাহিনীর লোকেরাই এখানে সমস্ত অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের হর্তাকর্তা। রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে চলা যুদ্ধে পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ মানুষ এখানে মারা গেছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৪৫% সিরীয়, আহত হয়েছে ১৯ লাখ। “আরব বসন্ত” নামের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের ঢেউ সিরিয়াতে আছড়ে পড়ে ২০১১ সালে। ২০১০ থেকে২০১৫, মাত্র এই পাঁচ বছরের মধ্যেই সিরিয়ার মানুষের গড় আয়ু ৭০ থেকে কমে ৫৫ বছরে দাঁড়ায়। ২০১৬ সালের বিশ্ব শান্তি সূচক অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে অশান্ত দেশের নাম সিরিয়া। হালে এখানে আই এস জঙ্গিদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। এক কথায় নিজের প্রাচীন গৌরবের কবরের ওপর সিরিয়ার বর্তমানের বিবর্ণ ধ্বংসস্তূপ যেন সভ্যতার এক কলঙ্ক।

যুগ যুগ ধরে কত জাতি কত সভ্যতা এই দেশ জয় করে নিতে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই সিরিয়ায় আজ বিভিন্ন জাতিগত এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন — তারা হলেন সিরীয়,আরব, গ্রীক, আর্মেনীয়, অশূরীয়, কুর্দি, কার্কাসীয়, মানডীয় এবং তুর্কি। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো হল সুন্নি, শিয়া, খ্রিস্টান, আলবীয়, দ্রুজ, ইসমাইলি, মেন্ডীয়বাদী, সালাফি, ইয়াসীদ ও ইহুদি। আরবরা এখানকার বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, এবং সুন্নীরা (৭৪%) হল বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী। প্রতি পাঁচ জনের চারজনই এখানে আরবি ভাষায় কথা বলেন। তাছাড়াও আরামীয়, আর্মেনিয়, আদিজে, আজারবাইজানী, দোমারি, কুর্দি, সিরীয় ভাষাতেও কেউ কেও কথা বলেন।

.

সিরিয়ায় জন্মে যিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, নিশ্চিতভাবে তাঁকে স্বপ্নের আহুতি দিয়েই যাত্রা শুরু করতে হবে এবং সেই লেখার খাতার পাতায় পাতায় প্রতিধ্বনি তুলবে ভেঙে পড়ার শব্দ। আদুনিস তার ব্যতিক্রম নন। আদুনিসের কবিতাও তাই রুক্ষ আর ব্যথিত এক মানুষের বয়ান।

.

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes