
৮ই মার্চ– প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ পর্যন্ত প্রতিটি বাঁকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব সুনিশ্চিত করুন
সোমা দত্ত
প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ পর্যন্ত যেখানে যেখানে মেয়েরা এগিয়ে এসেছে, সেখানেই একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে, –এখনো কেন? ৮-ই মার্চকে কেন্দ্র করে এখনো অধিকার, সমতা, সংগ্রামের মতো গতানুগতিক টেবিল চাপড়ানো প্রসঙ্গ কেন? মেয়েরা এখন সীমিত নয়, ভিতরঘরে চিকের আড়ালে তাদের আটকে রাখার দিন এখন ইতিহাসের দলিলমাত্র। এখন উন্নয়ন একটা সার্বিক প্রসঙ্গ। এবং অবশ্যই কিছুটা ব্যক্তিগত তাগিদ। একটা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সেই দেশের সামাজিক অবস্থা অনেকখানি জড়িয়ে থাকে। আবার একটা দেশের সামাজিক আধুনিকতার যে রূপরেখা তা নির্দিষ্ট করে সেই দেশের মানুষের চিন্তা এবং বোধ। বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতি এতটাই মাইক্রো লেভেলে পৌঁছে গেছে, যে সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে বিশ্বের যে কোনো তথ্য এবং ইতিহাস। শিক্ষা যখন সর্বসাধারণের কাছে উপলভ্য, তখন কোনো বিশেষ অন্ধত্ব বা পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ থাকে না। অথচ পরিসংখ্যানগতভাবে মেয়েরা এখনো প্রবল দুর্নীতি ও অত্যাচারের শিকার।
২০২১ সালের বিবিসির একটি রিপোর্টে , নারী পুরুষ বৈষম্যে যে পাঁচটি দেশের নাম সর্বাগ্রে তার মধ্যে চতুর্থ স্থানে ভারত।সমীক্ষায় রয়েছে, বাল্য বিবাহ, নারী ভ্রূন হত্যা ও পাচারে ভারতের অবস্থান চার নম্বরে।
কয়েকদিন আগেই একজন সদ্য বিবাহিতা পঁচিশ বছর বয়সী গৃহবধূর, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে নিগৃহীত হয়ে আত্মহত্যার খবর পড়লাম, ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে অজস্র মোমবাতি জ্বালিয়ে গলিয়েও কি বা ব্যতিক্রম ঘটে? এই যে সন্দেশখালি নিয়ে এত শব্দরোষ ঘনীভূত হয়েছে সেকী নারী নিগ্রহের জন্য? রাজনৈতিক ফরম্যাট একটি ঘটনাকে দাবদাহে পরিণত করে এখন, প্রয়োজনে সে আগুন নেভাতেও জানে। আমরা রাজনীতির ক্রীড়নক হয়ে অপেক্ষা করি খবরের কাগজের।
তাছাড়া ধর্ষণ, মেয়ে পাচার ইত্যাদি ঘটনার কীয়দাংশই জানতে পারি আমরা। কীয়দাংশ চর্চায় ওঠে। খবর সংগ্রহ এবং সরবরাহ এর মাঝখানে এখন রাজনীতির ভূমিকাও প্রবল। সেই প্রভাবটুকুই আমাদের আলোচনায় ওঠে, কলমে আসে।
১৭-ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩-এ, ছত্রিশ বছরের লেখক চামেলি যাদবের মৃতদেহ গুজরাটের ভদোদরা জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে পুলিশ খুঁজে পায়। জানা যায় তার জীবনসঙ্গী অজয় যাদব তার গলা টিপে তাকে খুন করে। দিল্লির শ্রদ্ধা ওয়াকারকে খুন করে তার দেহ টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল আফতাব পুনাওয়ালা।
সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হওয়া থেকে শুরু করে খুন, ধর্ষণ, অত্যাচারের একটি সমীক্ষার গ্রাফ অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭৭৪৯ জন মহিলা এই ধরনের ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছেন। ২৮৪টি গণধর্ষণের, ৬৭৫৩ টি পণ দিতে না পারার কারণ ঘটিত মৃত্যুর, স্বামী ও তার পরিবারের দ্বারা নিপীড়িনের কারণে ১৩৬২৩৪ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এই নিপীড়িন মানবাধিকার সুরক্ষার দিকে আঙুল তোলে। এই নিপীড়িন যেকোনো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের শিক্ষা, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে থাকার একটি সূচক। মেয়েদের ঘরে আটকে রেখে বা রাত ন’টার পর বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে এই নিপীড়ন আটকানো সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস 2024-এর থিম হলো- “Invest in Women: Accelerate Progress”
এই লগ্নিকরণ সার্বিক হোক বা না হোক ব্যক্তিগতভাবেও তো কিছু উদাহরণ রাখতে পারে। প্রতিটি মেয়ে একটি মেয়ের উন্নতির জন্য দায়ী হোক। প্রত্যেক মা সন্তানের আধুনিকমনস্ক বোধ ও বিচারভাবনার জন্য দায়ী থাকুন। ধর্ম এবং নিয়মের তুচ্ছ অনুশাসন থেকে মেয়েদের বার করে আনুন। উপোস, ব্রত এবং গোবর লেপা ঠাকুরঘরের বাইরে নিয়ে আসুন। বয়স্কদের শিক্ষিত করুন। ঘরের মা বাবা ঠাকুমা পিসীমাদের কাছ থেকেই সংস্কারের শোধন হয়। সংস্কার নির্মাণ করুন পুনরাধুনিক চর্চায়।
এবং সাহসী বেঁচে থাকার আনন্দ উপহার দিন। মনে রাখবেন প্রতিটি বধুহত্যার ঘটনার জন্য প্রাথমিক দায় তার পরিবারের। প্রতিটি বধুহত্যার খবর কোর্ট পর্যন্ত না পৌঁছনোর দায় নিগৃহীত কন্যার পিতামাতার। প্রতিটি ধর্ষণের জন্য দায়ী দেশের প্রশাসন। সুতরাং শুধুমাত্র ক্রিকেট, কুস্তি বা ব্যাডমিন্টন খেলার সিরিজে এগিয়ে যাওয়া নির্দিষ্ট কয়েকটি উদাহরণ মেয়েদের জন্য পৃথক একটি জায়গা তৈরি করে না। একটি রাজমিস্ত্রীর ঘরের মেয়ে, একটি গৃহকর্মচারীর মেয়ে, একটি রিকশাওয়ালার মেয়ের জীবন প্রত্যক্ষ করুন এবং তাদের আধুনিক শিক্ষার মান সুনিশ্চিত করুন।
১৯১০ সালে ডেনমার্ক এর কোপেনহেগেন শহরে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের আহবান জানানো হয় এবং ১৯১১ সাল থেকে তা পালিত হয়, এবং এর প্রত্যক্ষ আহবায়ক ছিলেন, ক্লারা জেটকিন নামের এক মার্কসিস্ট জার্মানি তনয়া যিনি নারীদের শ্রমের জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন ১৮৫৭ সালে। সেই থেকে ৮ই মার্চ নারীদিবস।
কিন্তু যে শ্রমিক আন্দোলন এই নারীদিবসের ভিত্তিপ্রস্তর সেই শ্রমের প্রসঙ্গটি এলে আমাদের দেশে নারীকে মা দুর্গা নামক কাল্পনিক চরিত্রের সাথে তুলনা করা হয়, মা দুর্গা রান্না করতেন কিনা, বা এখন করেন কিনা আমি জানি না।
এছাড়া বেশ কিছু ভারবাহী বিশেষণ ও উদাহরণ বহু ব্যবহারেও ক্লিশে হয় না। যেমন,
* রূপে লক্ষী ও গুণে সরস্বতী,
* একই অঙ্গে বহু রূপ,
* কার্যেষূ দাসী, করনেষু মন্ত্রী, ভোজ্যেষু মাতা, শয়নেষু রম্ভা….
এইসব মাইথলজিক্যাল চরিত্র, পুরোনো শ্লোকের থেকে নেওয়া বিশেষণে বিশিষ্ট করে, গুণাবলীর ধারক ও বাহক হিসেবে মেয়েদের মহিমান্বিত করতে গিয়ে দায়িত্বক্লিষ্ট করার কেন যে দরকার হয় কে জানে? আসলে মেয়েদের অতিরিক্ত সম্মানের দরকার নেই, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য সমানাধিকার ও মানবিক সম্মানটুকুই শুধু দরকার।
মেয়েদের ঘাড়…দোষের ভার….এমন নাহলেই যথেষ্ট ছিল।
মেয়ে মানেই তাকে সর্বংসহা হতে হবে, গৃহকার্যনিপুণা হতে হবে, বা দশ হাতে দশ অস্ত্র ধরে
রণং দেহি হতে হবে তার কি মানে?
মেয়ে মানে একজন স্বাভাবিক মানুষ, একজন পুরুষ যে যে জৈবিক ভারসাম্যের মধ্যে দিয়ে একটি জীবনচক্র সমাধা করতে নানারকম বোধ এবং বাঁধন এর মধ্যে দিয়ে যান, একজন মেয়ের জীবনখানিও তাই, অতিপ্রাকৃতিক কোনো ক্ষমতা তাদের মধ্যে নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে গড়ে প্রতি তিন জন নারীর মধ্যে এক জন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার কিন্তু তারপরেও দেশের অধিকাংশ মেয়েরা মনে করেন গার্হস্থ্য হিংসা স্বাভাবিক। তবে, এসব তালিকার বাইরেও অহংকার করে বলবার মত বহু উদাহরণ আছে। সকলেই গন্ডির ভিতরে আটকে রাখেননি নিজেকে।
কিন্তু কোনো একটি গর্বিত উদাহরণে পৌঁছানোর জন্য যে মানসিক স্বাধীনতার দরকার হয়, চেতনায় যে সংস্কারমুক্তির দরকার হয় সেটিকে ছুঁয়ে নিতে পারলেই সর্বভারতীয় পরিসংখ্যানগুলিকে বদলে দেওয়া যায়। সেখানেই নারীদিবসের সার্থক জন্ম। ২০২১ সালের নারীদিবসের থিমের হ্যাশট্যাগ ছিল,
choosetochallenge . যার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, a challenged world is an alert world and from challenge comes change.
আগ্রহের বিষয় হয় যদি প্রতিটি মেয়ে স্ব-ইচ্ছায় প্রগতিশীল, যুক্তিনির্ভর ও বিজ্ঞানমনস্ক ভাবসমৃদ্ধ সামাজিক জীবন উদযাপনে বাঁচবার চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে। ২০২৪ সালেও ওই একই প্রেক্ষিত পর্যালোচনায় প্রাসঙ্গিক হোক।