স্বর্ভানু সান্যাল-এর কবিতা
ভালোবাসি
আমি তোমায় ভালোবাসি।
দেবদারু গাছের নিচে বাতাস কেঁদে মরে
চাঁদ ধোয়া জল পরিত্যক্ত নোনা ধরা নৌকায় ঘাই মারে
তোমার আমার মাঝে অনন্ত জলরাশি।
একলা বন্দর। আমি বসে থাকি ঠায়
আমার আত্মা ধুয়ে যায় আকাশগঙ্গায়।
নিস্তব্ধ চারিধার
সমুদ্রের জান্তব গর্জনও প্রত্নতত্ত্বের মত নীরব।
সাদা ফ্যাটফেটে রংহীন পৃথিবী
তুমি শুধু একটু পলাশ।
আমি তোমায় ভালবাসি।
তবু দিগন্ত তোমায় চুরি করে নিয়ে যায়।
দিকভ্রান্ত মুমূর্ষু জাহাজে করে
আমার তোমাকে না-লেখা-চিঠিরা ভাসে অনির্দেশে
পরম আশ্চর্য সন্ধ্যা নামে।
তোমার আয়ত চোখ ধার নিয়ে চেয়ে থাকে সন্ধেতারা নির্নিমেষ
আমি সহবাসে তৃপ্ত নাগরের মত নিদ্রা যাই।
ভুলে যাওয়া গানের কলির মত তখন
তুমি ফিরে ফিরে আসো সহচরী।
স্বৈরিণী
সে এক নাগিনী
জীবনের অপচয়ে সব বিকিকিনি
শেষ হলে স্তিমিত চন্দ্রালোকে
অমোঘ লালসা নিয়ে আসে
বেঁধে নিয়ে শত নাগ পাশে
নির্বাসন দেয় চিরতরে
অনুজ্জ্বল ক্ষয়াটে অতীতে
সেই সে নাগিনী
বুভুক্ষু সেই স্বৈরিণী
দিনলিপি জীর্ণ হলে
বুকে হেঁটে আসে গিলে নিতে
আলোকসন্ধান
আলোকসন্ধানে বসে থাকি শমীবৃক্ষের ছায়ার গভীরে
আর শ্রান্ত মন পা বিছিয়ে বসে নদীতীরে
ক্লান্ত কোলাহল ওঠে দূরে, মানুষের ভিড়ে।
দিনভর কথকতা শেষ হলে পরে
রাত্রি নামে মন্দ্র গম্ভীরে।
অপূর্ব অন্ধকার আমি ছুঁয়ে দেখি স্বপ্নবৎ ধীরে
জোনাকি লণ্ঠন জ্বলে, নেভে, জ্বলে, আমায় বৃত্তাকারে ঘিরে
বিষণ্ণ ধ্বনি ওঠে অন্ধ শবরীর নুপুরে মঞ্জিরে
শাঁখ বাজে বারে বারে দূরে কোনো জীর্ণ মন্দিরে
আমি ভাবি এই বুঝি সঙ্গীত শ্রুতি হবে অপরূপ মীড়ে
হায়, প্রজ্ঞা ঘুমিয়ে থাকে, মূলাধারে সর্পশরীরে
আবার ভূমিষ্ঠ হয় আরো এক মৃত্যুলীন দিন
অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে
প্রেম আসে
অরণ্য বৃক্ষ জল মমতাময়ী নারী
আমায় আশ্লিষ্ট করো। পাহাড়ি
নদীর মত বয়ে যাও বুকের গভীরে
হতক্লান্ত দিশাহীন অজস্র মানুষের ভিড়ে
পথ রেখা এঁকে দিয়ো জলের আখরে।
আমি কত শত বর্ষ ধরে পথে পথে হাঁটি
ক্লিন্ন শরীর জুড়ে লেগে থাকে ধুলো কাদা মাটি
কখনো বৃষ্টি নামে আমি ভিজি একা বসে বসে
মুগ্ধ সঙ্গীত বাজে হরিণীর কণ্ঠে আবেশে
আমি শুনি। আমি খুঁজি কখনো বা প্রিয় লতা কোনো
নারীর ঠোঁটের মত শুষে নিই জীবন সফেন
রথচক্রের ঘর্ঘর ধ্বনি তুলে আসে
পুরাতন দস্যু এক। আর আমি মাঘ মাসে
পড়ন্ত রোদ্দুরে গা এলিয়ে বসি
গত জন্মের স্বাদ লেগে থাকে জিভে। রুপসী
আলোর দল বলে যায় বাউল সঙ্গীতে –
“এ জীবনে প্রেম আসে আমাদের শুদ্ধ করে নিতে।”
“এ জীবনে মৃত্যু আসে আমাদের বুদ্ধ করে নিতে।”
নিবিড় প্রহর
আমাদের আর কোনো কথা নেই…
নেই সন্ধ্যা শ্রাবণ, জ্যোৎস্না প্লাবন,
নেই কোনো বনপলাশীর চরে চপল রণন।
আছে শুধু উদাসীন ব্যথাতুর আড়াআড়ি ভেঙে যাওয়া মন।
থাকে শুধু উদাসীন ব্যথাতুর আড়াআড়ি ভেঙে যাওয়া মন…
ভীড় করে থাকে তার আশেপাশে মৃত্যু গহন।
এ প্রহর নিবিড় প্রহর
এ এক অদ্ভুত অচঞ্চল অলীক মৃত্যুলেখা ভোর
ভালবাসা, বলো সখী, কবেই বা জোর করে, জোর?
মানুষেরা সকলেই ছেড়ে যাওয়া গ্রাম-বন্দর।।