
স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাগুচ্ছ
বনবিবি
দম রাখো আরও ডুব সামনে আসছে
সুতলির ধারণ ভেঙে ভেঙে নতুন চর
এ ডিঙি জীবন এ জল বাউলের মতো বেখেয়াল
পিতলের ঘটি রেখে কাদাখোঁচা পাখি ধরে তাদের
পায়ের আঁকশি মেপে ঠোঁটে ঠোঁট ঠেলে রূপো ধরা শেখায়
স্রোতের ব্যথার কাছে নতুনের শাড়ি ভেসে থাকে
শরবন হোগলাপাতার সারি এসব ডিঙিয়ে শীত শীত
প্রেম আসে চুল খোলা কোমর ছাপানো পানের খয়েরি
শিলমোহর হাঁটুর ওপরে পোড়াদাগ হি হি প্রেতিনীর
হাসি হাসে জিভের ডগায় তার বিষাদের তূণ
দাঁতের ধার আর এবড়োখেবড়ো মাড়ির আড়াল
যেন বেত সটান আছড়ে পড়েছে ওই জলাটির পাশে
লন্ঠন জ্বলে ভোর অবধি জ্বলে থাকে আলেয়ার চোখ
ঘোর অথচ ঘোড়েল এই পট দুয়ারে দুয়ারে পুজো হয়
আতর বিলোয় প্রসাদী চিবুক পৌঁছে যায় ঈশ্বরের থানে
প্রতারক
১।
একটা অন্ধকার হাঁ করে গিলে খাচ্ছে
একটা শূন্যতা টুকুস করে গলায় ফেলে দিলো বীজ
যার ভেতরে অংকুরিত জন্মাচ্ছি হাতের আঙুল
মুখের আলায় পুরে ও জান ওহো জান বলে কাতরাচ্ছি
এবার শিরা ফুঁড়ে উঠবো শূন্যতার নাভিতে নাভিতে
তরঙ্গ খেলাতে খেলাতে ছিটকে যাবো হুই হুই হুল্লোড়
ইঁদারার গম্ভীর থেকে হাঁক পাড়ছো ছলকে ছলকে
উঠে আসছো বালতি বালতি চাংভাঙা পাথরের গতরে
২।
শরীর বাজে না আর মন ঘরে ফেরার আগে
ক্ষেত আলপথ ঘুরে নিজের ছায়া হারিয়েছে
ছায়া হারালে কী আর থাকে ! চামড়া খাঁচা?
নিজের ভেতর থেকে চারাগাছ তুলে ফেলে মন
মাটি নেই ঘর নেই সূর্যের পাখনা কবে কেটে গেছে
দলা দলা জল ছাঁট ফেলছে কেবল
ঘোষিত অস্ত্বিত্বের আহ্লাদ চেঁছেপুঁছে শ্যাওলা জমেছে
৩।
আগুনের নৌকো ছেড়ে দিলো পাড়ের ধমনী দাউদাউ
ও হৃদয় স্থিতি হও তরল হও শান্ত দিঘির ঠান্ডা হও
আগুনের নৌকো শ্বাস ফেললো গাছপালা যাবতীয়
অতীতের কাছে স্মৃতি রেখে হুসহুস বর্তমান এলো
শিখা এসো গ্রাসের পরিধি শেখাও ব্যকরণ মাপো
এখন কাছের কাছে ডুব দিয়ে দূর শিখে আসি
গল্পগাছাগুলি
শিকড় পড়ে আছে
একা থাকা সাধের পেটে কতো গাছ গুল্ম
উঠোনে চাতালে তার দ্রুত পরিক্রমা
ঘুনপোকা কেটে খাচ্ছে সময়ের দড়ি
তাকে বেঁধে রাখার চেষ্টায় ওলোট পালোট
সুর তুলছো ধুন ছড়াচ্ছো এদিক ওদিক বাহার বুনছো
ওই তো ওই ছেলে ঘর ছেড়ে নামহারা স্টেশনে নামলো
আদিবাড়ি বদরীহাটা রেশমপুর গাঁ
পোস্ট অফিস বদলে বদলে সাকিনও বদলেছে
ছেলের পায়ে পথ চলে আলপথ সূর্যের দিকবদল
একে একে মেলাও এবার একা একা দোকা হোক
ফাঁকা পথে ঝড় উঠুক ডানা সামলাতে উড়ে এসে
পড়ুক মা বাপ খাকী পাড়াবেড়ানি গেছো ধুমসি মেয়ে
২।
প্রশ্রয় তার নাম প্রেম বলে ডাকতেও পারো
সকালে উঠে গোবিন্দ গোবিন্দ বলে হাটে বেরিও
কানাসাধু অজুফকির হরিবাজাড়েদের পেরোতে পেরোতে
দেখা পাবে সেই দিঘির যাকে তুমি নিঝুম নামে চেনো
পরণের ছলাৎ এ সে ঘুরে যাবে তোমার কঠিনে
তোমারই অজান্তে নলকূপের মতো সিঁধোবে আর
নিজের সমতলে তুমি লাগামছাড়া ঝর্ণা হয়ে যাবে
জলপাই বনের ভেতরে
দূরের ভেতর ভেঙে আরও দূর আসে
আরোগ্য যেমন বৃত্তের বৃত্তান্ত খুলে
নিজেই নিজেকে বোঝে ও বোঝায়
অসুখকে আমি ইশারা করে পাশে বসতে বলি
পারদে পারদে তার বুকের উঁচুতে নারী খেলে যায়
না না সমর্পণ দাগি না কিছুতে শুধু শহর ছাড়ানো
টিলা মনে জমা রেখে তিন চার পাঁচ সাজাই
তার মেঘমুখ ঠোঁটচাপা কান্নারা গুম হাঁটুতে থুতনি রেখে উদাস
আঘাত ঈর্ষা আর ক্ষত তিন মোড়ল সভা বসায়
এক এক করে পার করি দৃষ্টির চোয়ারে ছয়কোণ
তারপর মাঠ বেয়ে ছোট্ট বন গেরুয়া মাটির চাক
ঢুকি উফফ কী অবাক একঝাঁক জলপাই সবুজে সবুজ
লাল টিপে আহ গৃহিণীর ঘরোয়া চোখে চেয়ে থাকে
খিদে
১।
চর শুকনো ও ধোঁয়া স্রোত এসে থেমে আছে দূরে
হাঁটুর মালা খুলে হাঁটুরই কোন আত্মীয় হেঁটে যাচ্ছে
ঠিক হাঁটা নয় শ্বাপদীয় টেনে টেনে নিজেকে
বয়ে নিয়ে তরলের ডানায় উড়িয়ে নেওয়া বলা যায়
আজ পূর্ণিমা চাঁদ তাই আলুথালু ছুটিয়েছে মহল্লার বুক
দানা কুড়িয়ে আয়ুর ঝিনুকে ঘাম ভরে মাংসল নরম
শহরের দ্রাঘিয়ান শুধু এই চরে জেগে আছে
বাকি সব ঘুমের লবনছড়া ঘুমের শিসে সোনালি মথ
২।
কলঙ্ক মানো? পাপ? জন্ম জন্ম ধরে সেই বুড়ি
চরকা কাটে তার তুলো বলের আকারে মেঘ হয়ে ভাসে
এসব বিশ্বাস? উপকথা? কল্পশুঁড় ?
শৈশব পার করে মধ্যযৌবনের দুপুররাতে
কোন এক জাদুকর আসে তার আলখাল্লার সুরঙ্গ পকেটে
খেলা থাকে বালি থাকে আর হাঁস ও তিমির দঙ্গল
জাদুছড়ির ভ্রূটোনে পাপ কলঙ্ক মিথের খিদেতে জেগে থাকে
জাদুবাক্স
রোদ্দুর ফুটে আছে গাছের পাতাতে
তুমি যদি ইচ্ছে করো তুলে নিতে পারো
আগুন ভেবে আমি ওই ছাঁদ স্তনে চেপে ধরি
অলিন্দে অলিন্দে রোদ্দুরের গায়ে পাতা ফুটে থাকে
অভিজ্ঞ নাবিক নৌকো নামায় ওড়ে শরীর ঘুরিয়ে
বায়ুস্থলি হাড়ের ঘরেতে আনাগোনা
আয়নায় নিজেকে পাখি দেখি ও সুমোচন
ডুমো ডুমো খুশির ইঙ্গিতে ঘর ভরে যায়
খুশির প্রতি খোপে খরগোশ জিরাফ সিংহ ভোঁদড়ের জাগলিং
সে আসলে আট কুটুরির কুটুম নয় দরজার আকাশ
ভিতর এবং বাহির মেলালে এক একটা জাদুবাক্স
ম্যাজিশিয়ান ইন্টারভ্যালে তাঁবু আনতে গেছে
দিঘিপাড়
অধোমুখ বসে আছে নক্ষত্রফেনা
সেই ঝোঁকা গালের চিবুকের ফোঁটা
টুপ ঝরে ছিটকে উঠছে
কোন ঢেউ নেই কোন আলোড়নতল
নাভির বিন্দু থেকে মাছের বুড়বুড়ি
সেও কী নীরব! ঝাঁঝিপানার ঘ্রাণ চত্ত্বরে
আঁশের রূপওয়ালি চিকমিক অভ্র ঠোনা খায়
সন্ন্যাসীর জটা ও যষ্ঠিকা কুশ ও কৌপিন
শিয়াল ও শবের বাহানা ভারখন্ড ও নরমাংসসাধ
জলের আধারে এসে মেশে
সেও কী নীরব! কবে কোন মেয়েমানুষ শরীর রহস্যের
চর্চা হতে হতে আশিরনখ পাথরের যবনিকা হয়ে
এই জলে এই নক্ষত্রফেনার টুপঘরে গলাচাপা
টং- এর ধ্বনির কোলে নিজের মৃত্যু ফেলে গেছে
ক্ষীয়মানা
প্রেমকে ঘেন্নার পাশে বসতে দাও
প্রেম পাশে ঘেন্না বসে আছে আদুর গা
বুকের মধ্যে কাশ্মিরী কার্পেট লাল কলকায়
সোনালি রূপোলি বুটি ঝাড়দানি
মন পড়ে নিচ্ছে সব দেওয়াল বসতভিটে
মাঝরাত গ্রাম পেরোতে গিয়ে লন্ঠন জ্বলে গেলো খড়ে
গোলাঘর ভীষণ একলা ডুকরে ওঠে লক্ষ্মীবার এলে
দিঘিমুখে যায় বসে পেট থেকে ধান বের করে
জলের আলপনা বরাবর ছুঁড়ে দেয় উজ্জ্বল আঁকে
প্রেমকে ছিঁড়ে ফেলা অবয়বের পাশে রাখো
যে গরু বাঁটফোলা স্নেহের ক্ষরণে নিত্য দুধেল
তার পাশে বিচালি বাছুর কাঠের পা
জীবন ভেবে সে মৃত্যুকে ভালোবেসে যাবে
সন্ধের শাঁখ তিনবার বেজে থামুক ঘন্টাধ্বনি হোক
উলু হোক আরতির বাসনে সেজে উঠুক দালানবাড়ি
ঈশ্বর ঘুমোলেও প্রসাদ বাঁটবে ভক্তজন
বাক্স
খারাপ লাগার কিনারা ভেসে ভেসে জাগছো
মনখারাপের আধুলি সিক্কা বছর বছর ধুলো জমে
মোটা পরত পড়েছে শিকলের পাঁজরে দেওদার রঙ
টিনের চাদর সেও পুরোনো হয়েছে রাশ ঝরে গেছে
বোবামুখ শ্রমিক মেয়ে যেন বুকের মাঠ থেকে ঘাস
তুলে তুলে পিঠের ধারণে সইয়ে নিয়েছে
আরও নখ আরও দাঁত ছিড়কুটে বেরোয় জন্তু
বন ও নদীর সীমানায় নগরও আছে গ্রাম ছড়টানা
শুধু সোনালি আংটা অথবা কিছু আংশিক
জাহাজের মতো দরজা আগলায়
একলা ছায়া
শোয়ার ধরণ উল্টে গেলে রাতের বদলে দুপুর এসে বসে
জ্যোৎস্না ঢালা আকাশ থমকে গিয়ে রোদ্দুর বিয়োয়
দু’টো শালিখ তুরুকতুর ঘুরছে হলুদ পায়ে প্রণাম
কখন যে দুই থেকে এক হয়ে যাবে অমনি একা পায়ের
কাছে ফুটে উঠবে একলা এক ছায়া…
ফ্যান ঘুরছে সিলিংটাকে এক মনে ফিল করছি
ঘোরা শব্দের ওপর জোর দিচ্ছি মনে মনে আরও জোর
গতি বাড়ছে বেড়েই যাচ্ছে এবার হয়তো খুলে যাবে পাখা
তিনটে ধারের ব্লেড নিজেদের ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে
হাওয়াদের কাটতে কাটতে ঝম ঝমাৎ স্বাধীন হবে
এরপর ফুসফুসের কাছে যাই শ্বাস ধরে রাখি কিছুক্ষণ
আবার অল্প অল্প এক্সেল করি মধুগন্ধ গাছে গাছে
ব্যথা চামড়ায় ফুটে ওঠে সুখচিহ্নের পাপড়ি
খুব ভাল লেখা
ভালো লাগলো