‘সে-লেখা তুলবে বলে…’ :
বেবী সাউ
হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে
অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো
করেছো, অতল; করেছিলে; পড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
–’পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকত–সে-লেখা তুলবে বলে
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।
চারপাশের এই আনন্দ হাওয়া, এইযে একলা হয়ে ওঠা একটা অভিমানী মন কিংবা বলা যেতে পারে রোজ রোজ নিজেকে আবিষ্কার করতে করতে হেঁটে যাওয়া একটা পথ, যে পথে জমে উঠেছে বহু বহুকাল ধরে অসংখ্য পা-ছাপ এবং একটা ছন্দ, নিজস্ব, ব্যক্তিগত অথচ আন্তরিকতায়, ভালোবাসায় মোড়া– তার দিকে, সেই পথটির দিকে আমরা যখন তাকাই, ভাবি, লিখে দিতে চাই কিংবা লিখে ফেলার পরেও মননের অক্ষর দিয়ে তাকে বুঝতে চাই, সে কী আসলে একটা জন্মদিন নয়? হ্যাঁ, জন্মই তো। হাজার হাজার জন্মের ভেতর থেকে অতীত থেকে খুঁড়ে আনা আরেকটি জন্ম। নিজেকে দেখা। নিজের সঙ্গে হাটিমাটিম খেলা অথবা দু’টো হাত জড়ো করে সেই অদ্ভুত দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা— আনন্দ এবং আশ্চর্যের চোখ নিয়ে! এই যে প্রত্যহের খেলা আমাদের, এই যে রোজকারের আবিষ্কার আমাদের, উজ্জ্বল কিংবা বিমর্ষতার উপলব্ধি এই তো জন্ম। এই তো নিজেকে আরেকবার জন্ম দেওয়া নিজের শরীর থেকে। সেই নতুন ধারণের শরীরই আসলে জন্মের ইঙ্গিত। ভালোলাগার, মন্দলাগার উৎসব।
আসলে আমরা নিজেকে মুড়ে ফেলা, ফ্যানেন বন্দি করা অথবা রঙ্গিন ব্র্যান্ড-এ ঢেকে রাখতে রাখতে, রাখতে রাখতে একসময় ঘড়ির কাঁটা হয়ে যাই। চক্র বূহ্য ভেদ করার আকাঙখা এতো প্রবল হয়ে ওঠে তখন চারপাশের ঘূর্ণমান দৃশ্য রঙহীন, ফ্যাকাশে সাদা হয়ে পড়ে। তাই ভাবি কিছু না হোক, সেই আলোটিকে আজ খুঁজে দেখি, যিনি নতুন ফোন কেনার বাহানায় হারিয়ে ফেলেছেন আমার শুভেচ্ছাবার্তা, আমার প্রণামের আনুষঙ্গিক…পূজার ফুলের স্রোত হয়তো ততক্ষণে ভেসে ভেসে তৈরি করেছে এক স্বর্গীয় অলকানন্দা। আর সেই রামধনুর রঙে একের পর এক আশ্চর্য দিগবলয় তৈরি হয়েছে — প্রেম, আকাঙ্ক্ষার হাড়গোড় পেরিয়ে জন্ম নিয়েছে এক অতল আলোক। আলোর জন্ম! হ্যাঁ, জন্মই তো! বিপুল এবং বিশাল এই জন্ম। এই জন্ম আসলে অক্ষরের,, শব্দের, উপলব্ধি এবং বোধের। এ জন্ম হয়তো আরও গভীর বিষাদের রাতে আরও নিকষ তার রং। এজন্ম হয়তো তীব্র আলোকের চেয়েও আরও তীক্ষ্ণ অথবা শান্ত, নিমোর্হ, সমাধিস্থ! কিন্তু জন্মই… সেই জন্ম যার কোনও দিন নেই, ক্ষণ নেই, রাশি-লগ্নও নেই! আর বিপুলভাবে সত্য …
জন্ম ভেদ করে এইযে জন্ম নেওয়া, জন্মকে ভেঙে এইযে জন্মকে গড়ে তোলা— চিরপ্রেমিক সেই, এসো হাত ধরো। নাহলে ‘পড়ে রইলো যে!’ একা একা এই পথটুকু যে অভিমানে ভরা! হাঁটতে গেলে হোঁচট লাগে! ছিলে যায় মন, চোখ। বন্ধ চোখ নিয়ে, অন্ধ মন নিয়ে কী আর অভিমান সাজে!
আর এ কেমন অভিমান! এ কেমন রাধাসাজ! কেমনই বা বোকা বোকা অভিযোগ! আর কচি খুকিটিও নয় তুমি, বয়েস তো হলো ঢের, আর কেন! আর কেন এভাবে খোঁজের জন্য হন্যে হয়ে মোবাইলের নং হারিয়ে ফেলা! হয়তো এরও দরকার আছে! হয়তো একেও নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া জন্মদিন বলে! নিজেকে চিনে নিতে নিতে, নিজেকে পরিচয় করাতে করাতে ক্লান্ত আমি, অধিক ক্লান্ত এক সাধকের কাছে বসি। অপেক্ষা করি জন্ম-জন্মান্তরের…
থাক আজ! অভিমানের কথা, অভিযোগের কথা থাক! বরং রোজ রোজের এই জন্মদিন আরও দীর্ঘকালীন হোক, এটাই একান্তের চাহিদা! সাধক সেই হাজার হাজার মৃতের কোষ জমাতে জমাতে জন্ম আঁকতে পারেন! হাঁটতে পারেন! সে পথটিতে এসে জোটে একলা সেইসব পাঠক, পথিক। কবিকে চেনে না তারা। ব্যক্তিমানুষটির সুখ-দুখে দাঁড়ায় না কেউ তারা। কিন্তু ভেসে যাওয়া সেই দুঃখ-সুখের স্রোতে মহাষৌধির মতো তুলে রাখে ‘লিপি চিত্রিত লিপি’… যেন এইটুকুই নেওয়ার ছিল তাদের। এই মহামন্ত্রটুকু তাদের পার করে দিতে পারে কয়েকশো মৃত্যুর জন্ম। কবি এসব কী জানেন! বোঝেন! হয়তো… তাতে তাঁরও কিছু আসে না। তিনি তো আলো-আঁধারির, অলকানন্দার ভেসে যাওয়া স্রোত দেখতে দেখতে মৃত্যু থেকে ছেঁকে তোলেন জন্ম! লিপি! অক্ষর! না-বলা কথা! আর তখনই চারপাশে জেগে ওঠে অক্ষরের সংসার।
এই পাঠ প্রতিক্রিয়া মনে রাখার মতো। বেবীর গদ্যের বহমানতাও নদীর মতো। কোথাও কোথাও শাখায় ভেঙে বয়ে যায়।