সেবন্তী ঘোষের গল্প
‘মেঘলা’
(১)
ওরা তখন চিন ভবনের গেটের পাশে ছড়ানো মহাকায় কৃষ্ণচূড়া গাছের শিকড়ের উপর বসে। মেয়েটিকে দেখে থমকে গেল শ্রীতমা। অবিকল গতবছরের, তারই ভঙ্গিতে, পাড়ওলা সাদা শাড়ি পরা, সমস্ত মুখে প্রথম দিন কলেজে আসার একটা উদ্বেগের, ভয়ের ছাপ। কোঁকড়া চুলে পরিচ্ছন্ন সিঁথি করা, স্পষ্ট কাটা কাটা নাক চিবুক, রঙ গাঢ় সবুজ পাতার মতো উজ্জ্বল। শ্রীতমাদের ক্লাসে বিশেষ বুদ্ধিজীবীদের একটি দল আছে। নিবিড় ও তার দলের দু তিনজন এই বারো ক্লাসেই অত্যন্ত পরিণত মনস্ক এবং গাঁজাখোর । সেই নিবিড়ের সঙ্গে মেয়েটি প্রথম দিন ক্লাস করতে এসেছে। মুহূর্তেই দেবরাজ, সন্ধি, বৈশাখরা বুঝে গেল এই ফার্স্ট ইয়ারকে প্রথম দিকটায় বাগে পাওয়া যাবে না!এর দাদাদের খুঁটি শক্তপোক্ত। সন্ধি মেয়েটিকে মেপে যাচ্ছিল এক মনে।
হাঁটিয়ে আনা সাইকেল দাঁড় করিয়ে কো-অপারেটিভের খাদির ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবি পরা নিবিড়, রচনা, শুচি, শ্রীতমাদের ডাকল।
বৈশাখ সন্ধিকে গুঁতো মেরে দেখালো ব্যাপারটা। হয়ে গেল! যাও আশা ছিল তাও জলে! শুচি, রচনা, শ্রীতমার প্রশ্রয় পেলে আওয়াজ দূরস্থান ওই মেয়ের কাছেই ঘেঁষা যাবে না!
নিবিড় বলল, এই যে,এর নাম মেঘলা, মেঘলা রায়। ইলেভেন আর্টস। তোমাদের হোস্টেলেই থাকবে।
রচনা হাত বাড়িয়ে দিল। হেসে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে এলে? মানে বাড়ি?
মেয়েটি ততক্ষণে অস্বস্তিতে, ভয়ে ঠোঁট চাটছিল। কোনমতে বলল, ব.ব.ব.বর্ধমান সে. সে.সে.সেন্ট জেভিয়ার্স। সর্বনাশ!একে সুন্দরী!তায় নিবিড়ের পরিচিত!তার উপর ইংরেজি স্কুল! এ যদি তোতলা হয় দেবরাজরা আওয়াজ মেরে শেষ করবে!
পরে অবশ্য ওরা মেঘলার এতো তোতলামি দেখেনি। টেনসনে ওরম করত। সেই দিন থেকে মেঘলা রচনা শুচিদের জিম্মায়। মোটে এক বছরের ছোট! কিন্তু শ্রীতমার মনে হত, মেঘলাকে ওর দেখে দেখে রাখা উচিত। কে জানত এই
মেঘলাকে দেখে রাখা পৃথিবীর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়! শ্রীতমা না জেনে বুঝে চিরকালের মতো এক আশ্চর্য জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল।
ইংরেজি স্কুল থেকে আসা মেঘলার ছিল বাংলা ইলেকটিভ। শ্রীতমা তখন থেকেই ঠিক করে রেখেছে বাংলা নিয়ে পড়বে। ফলে ছন্দ অলংকারের বাঁধানো খাতা নিয়ে মেঘলার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বসে পড়তে হত। শ্রীভবন হোস্টেলে নিজেদের ফ্যান ভাড়া করে আনতে হয় বা কিনতে হয়। রচনা, শ্রীতমার ডবল সিটারে একটাই টেবল ফ্যান। তার মধ্যে প্রবল পাওয়ার কাট। বীরভূমের ভ্যাপসা গরম যারা জানেন তারা জানেন! শ্রীতমা সাইকেল চালাতে পারে না। দুপুরে কিচেনের পাঁপড় আর আলুর ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ওরা চারজনে তিনটি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মেঘলার সাইকেলের ক্যারিয়ারে শ্রীতমা। গন্তব্য বল্লভপুর, হরিণ পার্ক। বিজ্ঞান ভবনের পেছনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখা যায় ডানদিকে দীর্ঘ জলাশয়ের পাড়ে ধোপারা পাটে কাপড় আছড়াচ্ছে। ওদেরই কারো কারো নানা রঙা তাঁতের শাড়ি বাঁধের গায়ে সার সার প্রেয়ার ফ্ল্যাগের মতো আধ শুকনো হয়ে উড়ছে। কাঁচা রাস্তায় উঁচু-নিচু খোয়াই পেরিয়ে ডিয়ার পার্কে ঢোকে ওরা।
এখানে এক সময় উঁচু-নিচু রুক্ষ টাঁড়ে সোনাঝুরির কৃত্রিম বন তৈরি করা হয়েছিল। পরে প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রকৃতি তা গ্রাস করে নেয়।যেদিকে তাকানো যায় ঢেউ খেলানো লালমাটিতে সোনাঝুরির ঋজু পরিচ্ছন্ন দেহ।সোনালী ফুলের রেণুতে, ঝরা পাতায়, গালচের মখমলি আরামে বসে পড়ে ওরা। খানিক দূরে দূরে উইঢিবি। সোনাঝুরির বনে অন্য কোনো গাছ নেই, এমনকি গাছের গোড়ায় লতাপাতাও নেই।
রচনা আর শুচির বাংলা নেই। একজন প্রাচীন ইতিহাসের এন.সি রায় খুলে, অন্যজন জাপানি ভাষার খাতা খুলে আধশোয়া। বাঁধানো রুলটানা খাতা থেকে শ্রীতমা সবে অনুপ্রাস সমাসোক্তি বার করেছে, দেখে, মেঘলা খাদির মোটা ওড়নাটা মুখে চেপে ধরে শুয়ে পড়েছে!
এই মেঘলা! কিরে, কি হলো? বলে রচনা।
মেঘলা মুখ থেকে ওড়নাটা সামান্য সরিয়ে বলে চুউউউপ.. কঅঅঅরওওও.. একটু পরে বলছি, এখন একদম ডাকবে না-বলেই আবার মাথা মুড়ি দিয়ে শুচির আড়ালে শুয়ে পড়ে।
একদল টুরিস্ট ঢুকেছে হরিণের খোঁজে। আলাদা আলাদা গ্রুপ একসঙ্গে হরিণ খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাসে করে তারাপীঠ বক্রেশ্বর আর শান্তিনিকেতন প্যাকেজে এরা কালীঠাকুর ও রবিঠাকুরের থান বেড়ায়।দুদিন আগে উত্তরায়ণে ছবি আঁকার ক্লাস করতে গেছিল শ্রীতমা। খাঁচায় থাকা একঠ্যাং ভাঁজ করা একটা সারস দেখিয়ে এক ট্যুরিস্ট বাবা তার শিশুপুত্রকে উত্তেজিত স্বরে বলেছিল, দেখো, দেখো, ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর!
বাচ্চা অবোধ বিস্ময়ে জানতে চাইল, এক ঠ্যাং কেন? লোকটি নির্বিকারে বলেছিল, ময়ূরের একটাই ঠ্যাং হয়!
শ্রীতমার মনে হল তেমনই কোন একটা দল ঢুকেছে বোধহয়! মেঘলা আবার হেসে-টেসে ফেলতে পারে তাই হয়তো ওড়না চাপা দিয়েছে!
দলটা চলে যেতেই শুচি বলে, মেঘা, উঠে পড় তো, কালকে তোর পরীক্ষা।
শ্রীতমাও বলল, তুই আগমনী বিজয়া কিছু পড়িসনি, বাৎসল্যের প্রশ্নটা আসবেই, আর অলংকারও তো বাকি !
মেঘলা এবারে ধড়মড় করে উঠে বসে।বলে, চলে গেল তো? নাকি আবার ফিরবে? বাপরে!
রচনা বলে, কে ফিরবে? তোর ভৌতিক সন্দেশ ছিল না ওখানে?
ভৌতিক সন্দেশ মানে শুচি, শ্রীতমার সহপাঠী সন্ধি ভৌমিক। যে কিছুদিন আগে মেঘলাকে প্রপোজ করেছে, মেঘলা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি!
মেঘলা অনিচ্ছুক ভাবে খাতাপত্র বের করে বলে রৌম্য, বলছিলাম না? বর্ধমানে? সেই যে দাদার বন্ধু? বলেই চুপ করে যায়।
শ্রীতমার আবার মায়া হয়। বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।এই তিন চার মাসে জেনে গেছে মেঘলার জীবন ওদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাবা ছিলেন
নামকরা শল্য চিকিৎসক। মা পুরনো শান্তিনিকেতনি, পান্নালাল দাশগুপ্তর শিষ্যা। খাদি ছাড়া পরেন না, খালি পায়ে হাঁটেন। নীতি একটি অনাথ আশ্রমও চালান। সেটিই তাঁর ধ্যান জ্ঞান। সংসার বলতে যা বোঝায় তা তিনি কখনোই করেননি। মেঘলার যখন সাত বছর বয়স তার বাবা ইংল্যান্ডে মারা গেলেন।নীতির বাপের বাড়ি সম্পন্ন। স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিও খারাপ নয়।সংসার চালানোর কোন অসুবিধে হল না কিন্তু গোল বাঁধলো মেঘলার দাদা মনসিজকে নিয়ে। ছোট থেকেই সে দুর্দান্ত প্রকৃতির। বাপের রূপ পেলেও স্বভাব পায়নি। তথাকথিত আলগা সংসারের পরিপূর্ণ সুযোগ নিল সে। কো-এড ইংরেজি স্কুলের ক্লাস নাইনের এক সহপাঠিনী ব্রা পরে আসে কিনা বোঝার জন্য ছেলেদের মধ্যে বাজি ধরা হয়। স্পর্শ না করে করে প্রমাণ করতে হবে যে সে ব্রেসিয়ার পরেনি!। মনসিজ তার টিফিন বক্সে জল নিয়ে অসতর্কতার ছলে মেয়েটির পিঠে ছুঁড়ে দেয়।
প্রথমে তিরস্কার, পরে সাসপেন্ড, আরো পরে ড্রপ আউট হতে অসুবিধে হয়না মনসিজের। এর মধ্যে একাধিক প্রেম পর্বও চলেছে। অল্প বয়সে এমন ধরনের ছেলেদের প্রতি মেয়েদের একটা আকর্ষণ থাকে। মনসিজকে আয়ত্তে রাখতে না পেরে নীতি সংসার থেকে নিজেকে আরো সরিয়ে নেন। বাড়িতে কখনো আসেন কোন সেবাশ্রমের মহারাজ, পশু ক্লেশ নিবারণী সভার উদ্যোক্তা, কখনো নারী সেবা কেন্দ্রের লোকজন। মেঘলা ক্রমশ পরিবারের মধ্যে একলা হয়ে এক কোণে সরে যায়।
মেঘলা ছবি আঁকে আর গান গায়। অবিশ্বাস্য তার গলার কাজ। শুচি আর শ্রীতমা জিজ্ঞেস করেছিলো, তুই সঙ্গীত ভবনে ভর্তি হবি না কেন?
মেঘলা বলেছিল, এখনো কিছু ঠিক করিনি। পরে ভাবব।
শ্রীতমা জিজ্ঞেস করেছিল, দাদাকে মিস করিস না তুই?
উত্তরে মেঘলা বলেছিল, ছোটবেলায় একদিন বাড়িতে মা নেই, মনসিজ ছোট বোনকে একটা মজা দেখাতে নিয়ে যায়। ফাঁকা একটা চৌবাচ্চায় উঠিয়ে জল ছেড়ে দেয়। তারপর মাথা ঠেসে ধরে জলের মধ্যে যতক্ষণ না কাজের মহিলা ওদের খুঁজতে আসেন! দশ বছরের মেঘলার দম ফুরিয়ে যেতে থাকে। দাদাকে কিছুদিনের জন্য হোস্টেলে দেওয়া হয়। মেঘলা ভয় পেতে থাকে। তোতলাতে থাকে। ছুটিতে দাদা এলে দূরে থাকতে বলে মা । একদিন দুপুরে আগুন ধরে যায় মেঘলার পুতুলের ঘরে। মনসিজ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, ফলে তাকে ধরার উপায় নেই! কাঁপতে থাকা মেঘলার চোখের সামনে ওর পুতুল ছেলেমেয়ে বউ সহ পরিবার পুড়ে কুঁকড়ে যায়। আর পুতুল খেলেনি সে। তোতলামি বেড়েছে।
রচনা বলে, হ্যাঁ সে তো বুঝেছি। কিন্তু এখন ওর কথা বলছিস কেন?
শ্রীতমা খানিক আশঙ্কার স্বরে জিজ্ঞেস করে, ওই দলটার মধ্যে ছিল নাকি?
মেঘলা সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে।
শুচি বলে, তোর ভয়ের কি? লুকিয়ে পড়বি কেন? ফেস কর।
মেঘলা বলে, ও একটা মাস্তান। সবাই জানে।
শুচি স্থির ভাবে বলে, তবে তার সঙ্গে তোর কি?ওর সঙ্গেও তোর প্রেম ছিল?
মেঘলা চুপ করে থাকে।
শ্রীতমা বেশ সম্ভ্রমের চোখে মেঘলার দিকে তাকায়। মাস্তান! ডাক্তার ও বিশিষ্ট সমাজসেবীর মেয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত সমাজবিরোধীর সঙ্গে প্রেম করতে পেরেছে! তার মানে করা যায়! গুন্ডা তো দূরস্থান, কোন ভদ্র সন্তানের সঙ্গেও প্রেমে শ্রীতমার মায়ের আপত্তি প্রবল। প্রেমের অপর নাম লাম্পট্য বা ব্যভিচার, এই হচ্ছে তার মায়ের মত! গোপনে দুঃখ চাপে সে।
রচনা বলে, তোর কাছে ওর একটা ছবি ছিল না ? হোস্টেলে গিয়ে দেখাস তো। এই দলে ছিল নাকি?
মেঘলা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।
আবার পড়ার নাটক শুরু হয়। রচনা ওর প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে আবার মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।
আবহাওয়া থমথমে দেখে মেঘলা তুতলে বলে, কালই এসেছে। বলতে ভুলে গেছি। যদি আবার চলে আসে?
শ্রীতমা বলে, সবাই দেখলাম গেটের দিকে গেল। মানে আগেই ঢুকেছে। বেরিয়ে যাবে।
রচনা কনুইয়ে ভর রেখে হেসে বলে, আর আসলে দেখা যাবে। আমরা কম নাকি? দেখিস না তোর সন্ধিদা, বৈশাখদা আমাদের কেমন ডরিয়ে চলে?
মেঘলা বলে, মনে নেই আবার? তুমি আর রচনাদি ডাবলসে ওদের কেমন হারিয়ে দিলে? সন্ধিদা বলছিল, হবে না কেন? রচনাদি টি.টিতে ডিস্ট্রিক্ট রানার্স। যেকোনো দিন স্টেট খেলবে।
রচনা, শুচি আর শ্রীতমার দৃষ্টি বিনিময় হয়। সন্ধি ভৌমিক কবে থেকে এর এতো কাছের হল?
শরীরের তলায় গুঁড়ো গুঁড়ো লাল শুকনো মাটি ,ঝির ঝিরে সোনাঝুরির হাওয়া উষ্ণ আরামে সারা শরীরে ঘুম নামিয়ে আনে।
শ্রীতমা বোঝায়, খেয়াল কর অ্যালিটারেশন হলো অনুপ্রাস। ওই যে তুই গানটা গাস না? ‘
নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর/ হে গম্ভীর/ হে গম্ভীর- অঞ্জন, পুঞ্জ- ফিরে ফিরে আসছে। কানে শোন। যে গাইতে পারে সে আরও সহজে ধরতে পারে।
মেঘলা শুনতে থাকে। মাথার ওপর গাছের পাতার ফাঁকে ঝকঝকে আকাশ।
মেঘলা হঠাৎ গেয়ে ওঠে, ‘নীল দিগন্তে, ওই সুরের আগুন লাগল, লাগলোওও..’
পা ছড়িয়ে গাইতে থাকে মেঘলা। খাতা বই একধারে সরিয়ে কাপড়ের ওপর ওড়না পেতে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে শ্রীতমা। সূর্য ম্লান হয়ে আসছে । আকাশ রিন সাবানের মতো গাঢ় নীল। গান শেষ করে মেঘলাও ভূমিশয্যা নেয়। আরামে চোখ বুজে আসে। ঘুম ভেঙে যা হালকা অথচ তীক্ষ্ণ একটা শব্দে।
মেঘলা চোখ খুলেই ভয়ে শুচির হাত চেপে ধরে। পূর্ণবয়স্ক একটি চিতল হরিণের পরিবার ওদের একেবারে সামনে। বয়স্ক দীর্ঘকায় পুরুষটি ঠিক ওদের মাথার কাছে। এত কাছে যে নাকের পাটা কোঁচকানো, শ্বাস ফেলা শোনা যাচ্ছে। বাতাসে নাক টানে পুরুষ চিতল। তারপর মানবীদের বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে দলবলকে অভয় দিয়ে মাথা নামিয়ে খাবার খুঁজতে থাকে। নির্ভীক হরিণের দলটার পায়ের কাছে সন্ত্রস্ত হয়ে শুয়ে থাকে তিনটি কিশোরী শরীর। তিন জোড়া চোখ কেবল চিতলদের গতিবিধি নিরীক্ষণ করতে থাকে।
২
জার্মান ধাবার ভিতর প্রচন্ড ভিড়। বাইরে বাঁধানো চত্বরে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীতমা। বলা যায় দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ঢুলছে। দু পেগ রাম ওর পক্ষে দশের সমান। আজ বোধহয় আরও এক পেগ বেশি নিয়েছে। নিয়েছে বেশ করেছে। দীপ্তমান নিজের কাজে সিঙ্গাপুরে গেছে। শাশুড়ি আলাদা থাকেন। ছেলেপুলে কিচ্ছু নেই, চাকরি নেই, টাকা ও তেমন নেই, ফলে তার জীবনে আছেটা কী? এত সব ‘না’ – এর মাঝে আছে মেঘলা। ওর কাছে এসে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। দোলের সময় মেঘার বাড়িতে নানা ধরনের বন্ধুরা আসে। কলকাতা থেকে দু চারজন লেখক গায়ক-বন্ধুরাও আছে সে দলে। গানের পর গান, মদ ও গাঁজা। চিন ভবনের পিছনে কারো একটা খালি কোয়ার্টার কদিনের জন্য ধার নিয়েছে সুজন, মেঘলার বর। শ্রীতমার দুই বন্ধু, যারা আসলে ওর বর দীপ্তমানের বন্ধু , তারা তো মেঘলাকে দেখে বিস্মিত! এমন নিরাভরণ সাজ, এমন খোলা গলা,তার সঙ্গে অফুরান বিড়ির সুখটান! শ্রীতমার ও মাঝে মাঝে চমক লাগে। কোথায় সেই দুই বিনুনী করা তোতলাতে থাকা ভীতু মেয়েটি আর কোথায় এই ডাকাবুকো বেপরোয়া নারী!
নাজিমুল মুগ্ধ স্বরে বলে, মেঘা তুমি পানটা না খাইলেই পারতা! দাঁতগুলো গেসে একেবারে!
মেঘলা হাসে। বলে ও ওটা একটা ঢাল! ও.ওটা দেখলে আর কেউ এগোয় না!
আরেক বন্ধু অনির্বাণ হেসে বলে-ও স্কেলিং করা যায়! কুছ পরোয়া নেই!
মেঘলার বর সুজন স্বভাব সঙ্গত ভাবে হেসে বলে, হা হা হা! স্কেলিং করে বেরিয়ে
দারোয়ানের কাছে পান চাইবে! ক’বার নিয়ে যাবে? আর নেবে, নিয়ে যাও প্লিজ! ফেরত দিও না মাইরি !আমি ছাড়া ওকে নিয়ে কে ঘর করবে?
মেঘলা অমনি গান ধরে,’ ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে..’
শ্রীতমা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে একদৃষ্টে মেঘলার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোঁকড়া চুল গুলো টেনে নিয়ে খোঁপা করা, কন্ঠার হাড় স্পষ্ট, চোখের কোণে কালি। শির ফুলিয়ে গাইছে মেয়েটা।
সুজনের ব্যবসা ভুবনেশ্বরে। খুব একটা জমেনি এখনো। দু-মাসে তিন মাসে আসে। মেঘলা এমএ তে ফার্স্ট ক্লাস কিন্তু ওর যা ইমেজ তাতে এখানে চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে গ্রামের মেয়েদের নিয়ে কাঁথাস্টিচের ব্যবসা শুরু করেছে। ওর বিভাগের এক শিক্ষক মধুমন্ত আচার্য এক রবীন্দ্র পরিকরের নাতি । শ্রীতমা শুনেছে গ্রাজুয়েশন থেকেই ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় মেঘলার। ভদ্রলোক বিবাহিত ও যথেষ্ট বয়সের ফারাক ছিল উভয়ের। খুব তীব্র আবেগ না থাকলে এগুলো সচরাচর অতিক্রম করা যায় না।
মেঘলার সঙ্গে তখন ওর সহপাঠী আকাশের সম্পর্ক। স্বভাবতই আকাশ বেশিদিন ব্যাপারটা সহ্য করল না। মেঘলা ও সম্ভবত ভালো রেজাল্টের আশা ছাড়তে পারেনি। ওর স্বভাবে ওর দাদার ছায়া ছিল প্রথম থেকেই। পরবর্তীকালে মধুমন্ত আচার্য ই ওর চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে জোরালো ভাবে আপত্তি করে। অবশ্য এসবই শোনা কথা। শ্রীতমা কোনদিন মেঘলাকে ওর জীবন যাপন বিষয়ে জ্ঞান দেয়নি। শুচি , রচনাদের ছক বাঁধা জীবনের বাইরে এই মেয়েটির বেপরোয়া অথচ মাটির কাছাকাছি জীবন আকৃষ্ট করে রেখেছে চিরকাল।
শুচির অধ্যাপক বর বলেছিল, ও ছেলে হলে এত কথাই শুনতে পেতে না ! ওকে বেশি বেশি নম্বর দিয়ে রেখেছ কিন্তু তোমরা! মেয়ে বলেই আলাদা মনে হয়।
শ্রীতমা বলেছে, মেঘলা তুই গানের অনুষ্ঠান করিস না কেন? এত বছর শিখলি?
মেঘলা হাসতে হাসতে বলেছে, এই যে তোমাকে শোনাই! একি বড় অনুষ্ঠানের চেয়ে কিছু কম? কত লোক আসে আমার বাড়িতে। গানই তো গাই!
নাজিমুল ,অনির্বাণ, সুজনের সঙ্গে বোলপুরের দিকে গেল। আরো মদ আনবে। কলকাতার এক নামকরা গায়ক মেঘলার সঙ্গে গলা মেলায়। এত অত্যাচারেও মেঘলার গলার দানা নষ্ট হয়নি। শ্রীতমা উঠে গিয়ে কোয়ার্টারের বাইরে শাল ও জারুল গাছের মাঝে সেপটিক ট্যাংকের উপর গিয়ে বসে। জার্মান ধাবা থেকে ফেরার পর টালমাটাল অবস্থা। মস্ত থালার মতো চাঁদ যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাচ্ছে। খসখসে শালপাতা খসে পড়ছে,ঘষটে উড়ে যাচ্ছে খানিক দূরে, সেই পাতার সরে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। হঠাৎ করে দমকা বাতাস উঠলো, দুলে উঠল দীর্ঘকায় বৃক্ষ গুলি। দোলের আগের রাতে আলোয় ভেসে যাওয়া পথ ঘাটে আবিরের হালকা গন্ধ, বুনো ফুলের সুবাস। কলকাতার কোন অতি উৎসাহী দল হয়তো বিকেলেই দোল খেলে গেছে। এদিকটায় লোকজনের হল্লা নেই, যেন বহু দূরে সরে গেছে জনপ্লাবনের শেষ কোলাহল। খুব একটা আনন্দ হয়, খুব কান্না পায় শ্রীতমার। জীবনের প্রতিটি বাধ্য বন্ধনের বাইরে এই মুক্ত প্রকৃতিকে ঈর্ষা হয়। কেন একজন মানুষকে প্রতি পদে লোকাচার সমাজের খুঁটিনাটি মান্য করতে হবে? কেন স্বাধীনচেতা মেয়ের পরিবার ঘর সংসারের সাধ মিটবৈ না? আমার বাঁচা কেন নিয়ন্ত্রণ করবে অন্য মানুষ? এই মুহূর্তটি যদি অনন্ত হত, এই চুপচাপ একা, প্রকৃতির মধ্যে, পাতার মধ্যে খসা ফুল আর বৃন্ত কামড়ে থাকা ফুলের গন্ধে ডুবে থাকা যেত যদি ইচ্ছে মতো- ভাবতে ভাবতে দেখি মেঘলা এসে পাশে বসেছে। খেসের হলুদ শাড়ি আর কমলা বাটিকের ব্লাউজ পরা রোগা দুটি হাতে ঢলঢলে একটা ডোকরার বালা।
ওই ক্ষীণ হাতে কি এমন শক্তি যে এতদিন ঠিক নিজের মতো করে বাঁচতে পারছে মেয়েটা? যেমনটা নিজে চাইছে, ভুলভাল হলেও ঠিক তেমনটা? আর ভুল কাকে বলে এখন আর জানে না শ্রীতমা।
শ্রীতমা বলে, মেঘা অতটা খাওয়া ঠিক হয়নি রে, সহ্য করতে পারছিনা, অব্যেস নেই তো
মেঘলা বলে, ছাড়ো তো! এই তো একদিন! আবার কবে দেখা হবে কে জানে-
শ্রীতমা বলে, মেঘা কেমন একটা লাগছে জানিস? মনে আছে ঋতার এক্সকারশনে গিয়ে জলে ডুবে যাওয়া দিনটা? আমার জন্মদিন ছিল। আমরা সবাই বিকেলে ভালো মন্দে গিয়ে খাবো বলে অপেক্ষা করছিলাম?
মেঘলা ওর হাত চেপে ধরে বলে, বোলো না প্লিজ, আমি ওকে স্বপ্ন দেখি এখনো। তুমি তোমরা কিন্তু ওর পক্ষ নিয়েছিলে।আমার সঙ্গে থাকোনি।
শ্রীতমা বলে, ওর পক্ষ নয় এস.এফআইয়ের পক্ষ নিয়েছিলাম। ও দাঁড়িয়ে ছিল। তাই ওকে ভোট দিয়েছিলাম। তুই কি করে ঐসব ফালতু পার্টির দাদাদের খপ্পরে পড়লি? ওই সচিত্রর জন্য তো? তোর পাশে ওকে দেখলে আমার গা জ্বলে যেত।
মেঘলা একইরকম আবেগে বলে, কি করতাম? ঋতার দাদারা এস.এফ.আইয়ের নেতা। ওর বাবা-মা ও বামপন্থী। দাদার বন্ধুরা সব ওর বন্ধু। ওকেই পছন্দ করল সবাই। আমি কি ভিক্ষা চাইতে যাবো?ওরা কেউ ডাকেনি আমাকে।
নেশার মধ্যেও শ্রীতমা বুঝল, কোনো নীতির পরোয়া না করে ইলেকশনে দাঁড়ানোর কি দরকার এটা মেঘলাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না।
রাজীব গান্ধী ছিলেন পদাধিকারবলে ওদের চ্যান্সেলর। রাজীবের এক সভায় পায়ের কাছে মেঘলাকে বসে থাকতে দেখেছিল শ্রীতমা। তখন ওদের দলবলের সঙ্গে মেঘলার সম্পর্কটা ঘেঁটে গেছে। কেবলমাত্র শ্রীতমাই যোগাযোগ রাখতো। মেঘলা তখন জঙ্গী নেত্রী। স্পিক ম্যাকের স্থানীয় কর্ত্রী হয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নানা অনুষ্ঠান সামলাচ্ছে। সবাই সমালোচনা করছে মেঘলার কিন্তু অস্বীকার করতে পারছে না।
শ্রীতমা নিরাপদ দূরত্ব থেকে জীবন দেখা এক ভীতু মধ্যবিত্ত। এতগুলো বছর দূরে দূরে থাকলেও মেঘার প্রতি নজর রেখে গেছে ও। স্বাভাবিকভাবেই সচিত্র আর মেঘার সম্পর্ক ভাঙল তুমুল ঝঞ্ঝাটে। ততদিনে মেঘা পায়ের তলায় জমি পেয়েছে।
এখন এই সেপটিক ট্যাংকের উপর মেঘলার পাশে শরীরে শরীর ঠেকিয়ে বসে আছে শ্রীতমা । তরঙ্গের মত অনুভব করছে সমস্ত ঘৃণা পছন্দ-অপছন্দ বিরুদ্ধ মত, পচা পাক থেকে হাঁসের দুধ বেছে নেওয়ার মতো একটা অনুভব উঠে আসছে। ছড়িয়ে পড়ছে শ্রীতমার শরীরে। সে বুঝতে পারছে তা ছড়িয়ে পড়ছে মেঘার শরীরেও। একে কি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে? তবে যে অন্য ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় থাকা মানুষদেরই তা জাগ্রত হয় বলে জানে সে? তবে কি শ্রীতমা আসলে ভালবাসার অন্ধ আবেগে মেঘলার মতই দু-চার জনের বিষয়ে অন্ধ ,বধির?
মেঘলা বলে, শ্রী দি, অ্যাই শ্রীদি? কালা হলে নাকি? কখন থেকে বলছি চলো হেঁটে আসি! দেখছো না চাঁদটা কেমন রাস্তায় নেমে এসেছে? ছোটবেলার গুলি খেলার মত ড্রপ খাচ্ছে? গুলি খেলোনি তুমি? আমি দাদার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম। চল না শ্রীদি, একটা লাথি মেরে আসি-
কতবার বলেছি মদের সঙ্গে গাঁজা মেশাস না, মনে নেই,ডেডলি কম্বিনেশন? বলে শ্রীতমা।
দুজনের একসঙ্গে মনে পড়ে যায়। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসে।
বছর চারেক হতে পারে বা ছয় সাতও হতে পারে। এক শীতের ভোরে মেঘলা প্রস্তাব দিলো, গোয়ালপাড়ায় একটা তাড়ির ঠেক আছে যেখানে মেয়েরা খেতে যেতে পারে। পেঁচি মাতালদের হুজ্জোত নেই। সে সময় ক্যানাল পেরিয়েই ডান দিকে দুটি ভাতের হোটেল, ইরিগেশনের বাংলো ও দু’চারটে বিক্ষিপ্ত মাটির বাড়ি ছাড়া প্রান্তিক অবধি ধু ধু মাঠ। গোয়ালপাড়ার রাস্তায় একটাও পাকা বাড়ি নেই। মেঘলার সাইকেলে দুজনে পৌঁছলো। শ্রীতমা একটু শঙ্কিত। দলবেঁধে আসা একটা ব্যাপার, অত কেউ খেয়াল করেনা। আজ ওরা মাত্র দুজন। কাঁচা রাস্তার ডানদিকে একটা কালভার্ট পেরিয়ে ফাঁকা মাঠে দুটো পরিবার আস্তানা গেড়েছে। সম্বল চার-পাঁচটা পুষ্ট খেজুর গাছ। তকতকে নিকোনো উঠোনে ছানাপোনাওয়ালা মুরগি পেরিয়ে কোন এক পরানদার উদ্দেশ্যে হাঁকাহাঁকি করতে করতে ওরা বাড়ির পিছনে গড়াগড়ি খাওয়া মাটির কলসি পেরিয়ে, বসার জন্য ছেঁড়া চাটাই পেল। পরিবারের কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। পরানদার বউ বা মা এলেন। ভাবলেশহীন মুখে ঠকাস করে একটা মাটির কলসি আর দুটো মাজা কাঁসার গ্লাস রেখে গেলেন। মেঘাও অভ্যর্থনার বহরে চুপসে গেছে। শ্রীতমার কাছে প্রে.ডা মানে প্রেস্টিজ ডাউন! সে উঠে গিয়ে মহিলাকে কিছু বলে এল। কিছুক্ষণের মধ্যে বহু আকাঙ্ক্ষিত পরানদার আবির্ভাব ঘটল। ও হরি! এ তো ওদের স্ট্যান্ডের রিক্সাওয়ালা! বেশিরভাগ সময় মন দিয়ে বাঁশি বাজাত।
মেঘা জানাল উনি নাকি কবিগানও করেন! এটা সেই পরাণদারই বাড়ি। একটু পরেই বাড়ির ভিতর থেকে সদ্য ধরা লাল কুচো চিংড়ি আর আলু লঙ্কার ঝাল ঝাল তরকারি এল। মাজা, আঁশটে গন্ধওলা কাঁসার গ্লাসে , ঠান্ডা তাড়িতে এমন কিছু হওয়ার নয় কিন্তু শ্রীতমার তো বটেই, মেঘলার অবস্থাও খারাপ হয়ে গেল। দ্বিতীয় গ্লাসের পর দুজনে চিৎপাত হয়ে মাটির রসে ভেজা ছেঁড়া চাটাই-এ শুয়ে পড়ল। তাড়ির উত্তেজনা হঠাৎ যেন থম মেরে গেল। দুরন্ত ঘোড়ায় লাগাম পরালো যেন কেউ। উপরে দূষণ হীন নীলিমা, দিগন্তে মিশেছে ধান কাটা মাঠের খরখরে রঙ। তাড়ির উত্তেজনা হঠাৎ যেন থম মেরে গেল। ছটফটে ঘোড়ায় লাগাম পরালো যেন কেউ। কী যেন কথা বলছিল দুজনে, কীভাবে যে চড়াই ভেঙে সাইকেলের ক্যারিয়ারে ফিরেছিল শ্রীতমার এখন আর মনে নেই কিন্তু পরদিন থমথমে গলায় মেঘা বলেছিলো, ও দশ বার টয়লেটে গেছে এবং খবর নিয়ে শুনেছে ওখানে তাড়িতে ট্যাবলেট মেশানো হয়!
অনেকদিন পর মেঘা বলেছিলো, শ্রী দি তুমি কিন্তু ট্যাবলেট অবধি হজম করেছিলে! আমি তো খোসা ছাড়ানো কুচো চিংড়িটা অবধি নিতে পারিনি, পরদিন বমির মধ্যে দেখেছিলাম! মাইরি বলছি! কুচোকুচো লাল লঙ্কার দানা অব্দি মনে আছে! এখন ওদিকটায় না, একটুও মাঠ নেই। ঘিঞ্জি বাড়ি, গেস্টহাউস, কি যে কষ্ট হয়!
শ্রীতমা বলে, সবই বদলায় রে, আমরাও কতো বদলে গেছি। তবে মজাও করেছি, বল? সেই, সেই বর্ধমানের গুন্ডা, ফর্সা মতো, সুন্দর দেখতে কি যেন নাম ছেলেটার?
মেঘলা হাসতে হাসতে বলে, রৌম্য, যা! গুণ্ডা হবে কেন? উফ! তোমার মনে আছে?
থাকবে না? বাব্বা! যে বিপদে ফেলে ছিলি? সবে টুয়েলভে পড়ি। ঢপ মারতে গলা মুখ শুকিয়ে যায়। হোস্টেল থেকে ঠেলে পাঠালি ওর সঙ্গে কথা বলতে! তুই না, শালা ওই রচনা পাঠাল আমাকে। দেখি শ্রীভবনের গেটের একেবারে মুখে দাঁড়িয়ে! তখন বেশ লোক লোক মনে হচ্ছিল। স্থির চোখ। খুনির দৃষ্টি।
কোনমতে বললাম, মেঘার জ্বর হয়েছে। বেরোতে পারবে না। তোর ওই রৌম্য স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জ্বরটা কবে ছাড়বে মনে হয়?
আমি তো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা খুঁজে পাচ্ছি না। ততোধিক শুকনো গলায় বললাম, জ্বর খুব। কবে সারবে কি করে বলব?
কি বলল মনে আছে তোর? বলেছিলো, বিকেলে জ্বর সারলে বলবে, রৌম্য এসেছে। বলেই সোজা পিছন ফিরে হন্টন। আমার অবস্থাটা ভাব!
মেঘলা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
শ্রীতমা সেই হাসি দেখলে অনেকক্ষণ ধরে। এরপরের ঘটনা সে জানে। এবং সে যে জানে সেটা বোধহয় মেঘা জানে না। তার পরদিনই হবে বোধহয়। ছাতিমতলার অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ফিরছিল রচনা আর শ্রীতমা। নাট্য ঘরে কোন এক অনুষ্ঠান অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় ছেড়ে আসছিল ওরা। দূরে দূরে টিমটিমে আলো। এত গাছপালার মাঝে আলো বড়ো ম্লান।ওদের ঠিক সামনে সাইকেল হাটিয়ে একটা ছেলে ও মেয়ে যাচ্ছে। ওরা দেখল সিকিউরিটি অফিস মানে ‘ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড’-র পিছনে অন্ধকার ঠেলে একটা লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ তরুণছেলে মেয়ে দুটির মুখোমুখি হল । উল্টোদিক থেকে সাইকেলে একজন-দুজন আসছে, যাচ্ছে। প্রায় নটা বাজতে চলেছে, হোস্টেল বন্ধ হবে। পথে লোকজন কম। তরুণটি হঠাৎ ঠাস করে একটা চড় মারল মেয়েটিকে এবং পরপর তিন চারটে।
এক সাইকেল-আরোহী বয়স্ক ভদ্রলোক সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভদ্রলোকের গলার স্পন্ডিলোসিস -এর কলার দেখেই রচনা বলল, পালা! রনি হানি! বাঁ দিকে ঢুকে যা। ‘রনি হানি’ মানে ওদের প্রিন্সিপাল রণেন্দ্র নাথ রঞ্জন। মৌমাছি পোষেন শখ করে, তার মধ্যে অত্যন্ত মধুর মিষ্টি সুরে কঠিন কথা বলেন, তাই হানি আর কি! সে আমলে প্রিন্সিপালের মুখোমুখি হলে অকারণেই মনে অপরাধ বোধ জেগে উঠত।
ওরা দ্রুত আম্রকুঞ্জে ঢুকে যায়। শালবীথি ঘুরে সিংহ সদনের সামনে দিয়ে হোস্টেলের রাস্তায় ওঠে। পরদিন চালতা তলায় বাথরুমে স্নান করতে যাওয়ার সময় মেঘার মুখোমুখি। মেঘা কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিল, শ্রীতমা দেখে ওর দু-গাল লাল, প্রায় হাতের পাঞ্জা ফুটে আছে। সংক্ষেপে জানায় ও আজ বাড়ি যাচ্ছে, শরীর ভালো নেই। শ্রীতমা ওকে বলেনি যে ছেলেটিকে ও চিনতে পেরেছিল।
মেঘার হাসি শেষ হয়। দুজনে পথে বেরোয়। রাস্তায় জড়ো হওয়া সেগুনের বড়ো, কোঁকড়ানো শুকনো পাতায় উপশিরা অব্দি স্পষ্ট। হঠাৎ হঠাৎ হাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে মনে হয় বৃন্ত থেকে পাতা খষার মুহূর্তটি র শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাসি খুশি চাঁদ যেন নেশার চুম্বকের টানছে ওদের। মনোরঞ্জনদার ভূগোল বিভাগের পাশের রাস্তা দিয়ে গিয়ে কালভার্টে বসে। কদিন পর এর তল দিয়ে ঘন লাল জলের স্রোত ছুটবে।বসন্ত কি এই জায়গা ছাড়া বাংলার আর কোথাও বোঝা যায় এমন ভাবে?
মেঘলা মাথা নাড়িয়ে বলে, এখানেই রবি ঠাকুর আছেন, এখানেই। দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে নাটুকে সুরে গভীর আবেগে বলে, এইইই চারপাশে- শ্মশানে কেন যাবেন? সে তো তুমি আমি যাব। ওই গুঁড়ো গুঁড়ো পাতায়, শাল ফুলে, পারুলে, মালতীলতায় সবেতে উনি। তুমি শুনতে পাচ্ছ না? মেঘা গাইতে শুরু করে, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণেএএ-‘
চিত্রার্পিতের মতো বসে থাকে শ্রীতমা।
হাসি খুশি চাঁদ এখন বেয়াড়া। মাথার উপর উঠেছে। উঁকি মারছে দুজনের ভিতর। চাঁদের দিকে কড়া চোখে তাকায় শ্রী।
মেঘা গান গাইতে গাইতে ওর হাত ধরে। বলে, থাকুক। দেখুক, ওই তো সাক্ষী।
শ্রীতমা হতাশ গলায় বলে, এতো আলোয় ঘুমানো যাবে না মেঘা। দীপ্ত রোজ আলো জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ওর মধ্যেই ঘুমোতে হবে। দরজা জানলা বন্ধ, তারমধ্যে সিগারেট খাবে, আমাকে ঘুমোতে হবে। মশারি টানালে সিগারেটের আগুন লেগে যাবে, তাই মশার কামড় খেতে হবে সারারাত। সব বিছানাপত্র, তোষক বালিশ পোড়ায় ওই সিগারেটে।ওর মধ্যেই থাকতে হবে। মদের গন্ধে গা গুলোয়।রোজ রোজ মদের গন্ধের মধ্যে ঘুমোতে হবে। পারছি না মেঘা। আর পারছি না রে। কান্নায় ভেঙে পড়ে শ্রীতমা।
মেঘা এই প্রথমবার যেন শ্রীতমা হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে শ্রীকে। শ্রী কাঁদে।মেঘলা চুপ করে থাকে।উতল হাওয়ায় সেগুনের পাতা পিচ ওঠা রাস্তায় নিশাচরের মতো বুকে হেঁটে সরে সরে যায়।
৩
ভোর চারটে হবে বোধহয়। জল খেতে উঠেছে শ্রীতমা। অভ্যাস মতো চোখ যায় ফোনের দিকে। সাইলেন্টে রাখা। চার-পাঁচটা মিসড কল। এতো রাতে? মাতাল দু-চারটি বন্ধু বা পরিচিত অবশ্য কখনও ওরকম করে। শ্রীতমা এখন বোঝে ওরা ঠিক জ্বালাবার জন্য করে না। সময়ের হিসেব ভালোভাবে কাজ করে না। কখনো কখনো আবেগ উথলে ওঠে, ফলে তখনই ফোন করে ফেলে। ঘুমচোখে নম্বর গুলো দেখে। রচনা ,দেবরাজ , সন্ধি?
হঠাৎ এরা সব একসঙ্গে?
রচনাকে ফোন করে। মুহূর্তে ফোন তোলে রচনা। দেবরাজ রচনা যা বলে তা যেন মাথায় ঢোকে না। দু’বার তিনবার জিজ্ঞাসা করে। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। বাউল মেলা থেকে ফেরার পথে বিশিষ্ট বাউল শিল্পী সুধন্য দাসের সঙ্গে মেঘার গাড়ি ইলামবাজারের জঙ্গলে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ড্রাইভার সহ তিনজনই স্পট ডেড।হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ পাওয়া যায় নি। মেঘা নাকি মদ্যপ ছিল সে সময়। কিছুক্ষণ রচনার সঙ্গে কথা হয়। তারপর ফোন ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে বসে শ্রী। ফাঁকা ফ্ল্যাটে দীর্ঘ দিন বাদে ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। কাকেই বা ডাকব, কেইবা আসবে? বারান্দায় বসে ও শান্তি নেই ! আজকাল পথবাতি এত জোরালো যে অমাবস্যা পূর্ণিমা কিছুই টের পাওয়া যায় না। মাথা ঘুরতে থাকে শ্রীতমার।
রুদ্র পলাশ গাছের কমলা লাল ফুলের ছায়া উজ্জ্বল আলোয় এখন রক্তের মতো কালচে লাগে। মনে পড়ে,এম এ পড়ার সময় ওরা অন্য হোস্টেলে চলে গেছে। মেঘা অন্য আরেকে। দেখা-সাক্ষাৎ কম হয়। পার্টি নিয়ে জোরদার ব্যস্ত মেঘা সারা বিশ্ববিদ্যালয় চষে বেরোয়। ওর
চারপাশে তখন পার্টি করা স্থানীয় ছেলেরাই বেশি। বাইরে থেকে পড়তে আসা হোস্টেলের ছেলেরা কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। খুব একটা পার্টিতে মন ছিল না তাদের।
এর মাঝে মেঘার সন্ধি ভৌমিকের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী প্রেমের পর, কুখ্যাত সচিত্র গুঁই হয়ে তুলনায় ভদ্র সভ্য আকাশের সঙ্গে প্রেম চলছে। শুচি, রচনা বদলে যাওয়া মেঘলাকে নিয়ে বিরক্ত। একমাত্র শ্রীতমা মনে মনে পছন্দ করে ওকে। ওদের হোস্টেলের ঘর প্রায় রাস্তার ওপর। খাটও জানলা ঘেঁষে পাতা। কোন কোন দিন ভোর বেলা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পাতার মধ্যে একমুঠো বকুল বা মালতি বা টগর দিয়ে যেতো মেঘা।
সব দেশি ফুল চেনে সে। প্রসাধনহীন শরীরে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ী জড়ানো, পায়ে হাওয়াই চটি।
একদিন একগাদা ওই স্প্যাথোডিয়া বা রুদ্র পলাশ ফুল দেওয়ার সময় শ্রীতমা বলেছিলো, লালফুল আনলি কেন রে? আমার কেমন গা শিরশির করে, কালীপুজোর বলির কথা মনে পড়ে।
মেঘা হেসে বলেছিলো, রক্ত দিয়ে চিঠি লেখে না লোকে? রক্তওও দিয়ে? সেরকম করেই ভালোবাসা জানালাম, যেভাবে বড়দের মতো আগলে আগলে রাখলে-
শ্রীতমার বলতে ইচ্ছে করলো, কই আর পারলাম? চিরকাল আগুন নিয়ে খেলা মানুষদের নিয়ে কারবার। কেউ খাঁচায় ঢুকলো না।
বাকি রাত বারান্দায় বসে কেটে গেলো। ছটা নাগাদ মাকে ডাকলো শ্রীতমা। মার যেমন স্বভাব, শুনেই হাঁউমাউ করে উঠলেন। মেঘলার ছেলে এবারে মাধ্যমিক দেবে। কি হবে ছেলেটার! এইটুকু বয়স-
এসব আলোচনা চলতে লাগলো সারাদিন। শ্রীতমা একবার স্থির, একবার অস্থির হয়ে এঘর ওঘর করলো। বিকেলে ফোনে ধরলো সুজনকে। গলার আওয়াজ অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। প্রায় বছর তিনেক বাদে কথা হলো শ্রীতমার সঙ্গে। তাও এমন বিষয় নিয়ে, যা নিয়ে, যাতে কিছু বলারই নেই। এর মধ্যে কত ভিন্নধর্মী মানুষের সঙ্গে মেঘার বিষয়ে কথা হয়েছে। গতবছর পৌষ মেলা ফেরত দেবরাজ রচনা বলছিল মেঘা ইদানীং খুব নেশা করে।
শুচি বললো, মেঘা ওর পছন্দের ক্লাসিক্যাল গান ছেড়ে কোন বাউলের আখড়ায়
নাড়া বেঁধেছিল। গাইতেও যাচ্ছিল বিভিন্ন মেলায়। মাস ছয়েক আগে শ্রীতমাকে একবার ফোন করেছিল মেঘা। পথ কুকুরদের নিয়ে কাজ করা কলকাতার বিখ্যাত এনজিও কর্ত্রীর ফোন নাম্বার চেয়েছিলো।গত ছয় সাত বছর পথের কুকুরদের নির্বীজকরণ করা থেকে টিকাকরণ ও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খুলেছিল মেঘা। ফোর লেনের জন্য বড়ো বড়ো গাছ কেটে খেলার পর প্রচুর পাখি ঘর হয়ে যায়।উপমাদি এই পাখিদের বাঁচাতে সারা বীরভূম জুড়ে বিকল্প বাসস্থানের ও স্থানীয় জনগণের সচেতনতার ওপর কাজ করছেন। উপমাদি মেঘাকে সাহায্য করছিলেন।
মেঘা চলে যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই উপমাদি মেঘার নামে একটি পুরস্কার চালু করে দিয়েছেন। অসহায় পশুপাখিদে রক্ষা, তাদের বাঁচার বিকল্প ব্যবস্থা যারা করবে এমন কাউকে বছরে বেশ খানিকটা অর্থমূল্যের পুরস্কার দেওয়া হবে। পশুপ্রেমী বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুরশ্রী রায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
৪
ঠিক তিন মাস বাদে শ্রীতমা সুজনের মুখোমুখি হল। ততদিনে ওদের ছেলে বুবানের মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। গিয়ে শুনলো কলকাতায় সুজনের দিদির বাড়িতে রয়েছে তখন।মেঘার কুকুর বেড়ালগুলো চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উঠোনে বেড়ালদের মাছ সেদ্ধ করছে সন্ধ্যাদি। কুকুরের রান্না এর পর।
সুজন আগে এগুলোকে দেখলেই রেগে যেত। প্রথমবার যখন ওদের ছেলেকে দেখতে এসেছিল শ্রী তখন বুবানের দেড় বছর বয়স। শ্রী দেখল ঘরে একটা অ্যালসেশিয়ানের ছানা দৌড়াদৌড়ি করছে। এক রকম দেখতে দুটি পাত্রে মেঘা উভয়কে রুটি দুধ খেতে দিল । হেসে বলেছিল, একসঙ্গে বড়ো হবে বলে এক রকম অভ্যাস। না হলে পরস্পরের খাবারের প্রতি লোভ করবে। আরেকটু থেমে বলেছিল, সুজন এখানে থাকেনা বলে এসব করতে পারছি। কুকুর বেড়াল দেখলে এতো রেগে যায়।
এখন সুজনের দিকে তাকিয়ে শ্রী বলে, এগুলোকে নিয়ে কি করবে?
সুজন বলে, কেন ? যেমন আছে থাকবে। এখন আরো তাগড়াই হয়েছে শয়তান গুলো।
শ্রী দেখে সুজনের মুখে অপার স্নেহ।
সুজন বলে, কিছুতেই বাধা দিইনি। জানতাম শুনবে না।
শ্রীতমা সায় দেয়, বলে, ওদের সঙ্গে থাকতে হলে ওদের শর্তেই থাকতে হবে। আমি জানি। যেমন দীপ্ত।
সুজন বলে,প্রেমের পর্বটা বাদ দিয়ে পনেরো বছর সাঁইত্রিশ দিন চোদ্দঘন্টা একসঙ্গে থেকেছি।এই কয়দিনে হিসেব করলাম।
শ্রীতমা এখন কিছুতেই অবাক হচ্ছে না।নাহলে সুজনের এই সময়ের হিসেবে হতভম্ব হয়ে যেত। সে জানে শেষের দিকে সুজনের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল না মেঘলার। দুজনের মদ্যপ স্বভাব প্রায়শই দুজনকে প্রতিপক্ষে দাঁড় করাত।
সুজন আবার বলে,প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এই বুঝি ঝগড়া করে আমাকে বাড়ির বাইরে বার করে দেবে।মাথাই কাজ করছে না। আলটিমেটলি কি হল? যারা ওকে তোল্লাই দিল এক্সট্রাঅর্ডিনারি বলে , তারা বেঁচে বর্তে সংসার করল।
না,সুজন, এরা মানে দীপ্ত ,মেঘা এদের উসকানি দিতে হয় না। এরা আত্মঘাতী, লুনাটিক-দিগভ্রান্ত। তবে জীবন এতো দয়াময় নয়,আমারো মনে হয়, দীপ্তর এতো ক্ষ্যাপামি আমাদের সংসার নষ্ট করলো, কারো তো লাভ হল না।
আমি চিরকাল চোখের সামনে পাঁঠা কেটে এনেছি,সেই আমি এতো রক্ত সহ্য করতে পারছিলাম না। তুমি তো পারতেই না। সুজন বলে।
শ্রীতমা বলে, একসময় মেঘাও পারত না। শ্রীতমার মনে পড়ে,মেঘার ভর্তির পর মাস ছয়েক গেছে,ওর আর শুচির ডবল সিটারে সে রাতে ঘুমিয়েছিলো মেঘা। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে দুজনের। তাড়াহুড়োয় কুর্তা পরার সময় হুক আটকাতে গিয়ে তার ভিতর নখ ঢুকে পুরোটাই প্রায় উল্টে গেছে। ব্যথার চেয়েও অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেছে মেঘা। ভীত শ্রীতমাও। রক্ত দেখলে খুব ভয় পায় সে। স্কুলে ফার্স্ট এড শেখানোর ক্লাসে রক্ত শব্দটা বারবার এলে পেন নামিয়ে রাখতো। হাত অবশ হয়ে যেতো। বিয়ের পর দীপ্তর মা বলেছিলেন শ্রীর নার্ভের সমস্যা আছে।
স্বভাবতই এতো রক্ত দেখলে প্রথমেই প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড় শ্রীর। পরমুহূর্তে উপায়ন্তরহীন শ্রী হাতের কাছে থাকা সুতির নাইটি ছিঁড়ে, বোরোলিন
মাখিয়ে কোনমতে সেই স্কুলের ফার্স্ট এড ক্লাসের শিক্ষা দিয়ে টেনেটুনে বেঁধে ফেলল আঙ্গুল। তারপর কুর্তা পরিয়ে বাইরে গিয়ে রিকশা নিয়ে সোজা হাসপাতাল। রাস্তায় কেউ দেখে ফেলায় সন্ধির কাছে খবর গিয়েছিল বোধহয়। নিমেষে দেবরাজ আর সন্ধি হাজির। ইনজেকশন নিতে হবে বলে ভয়ে থর থর করে কাঁপছে মেঘা। একটা হাতে শ্রীতমার কুর্তা মুঠো করে ধরে আছে আর শ্রীর মুখ স্বভাবতই নার্সের উল্টোদিকে!
সেই ভীতু, তোতলা মেঘা কিভাবে এতটা সাহসী হয়ে উঠলো? কিভাবে মেঘা ওদের চেনা আর নিরাপদ নিয়মকানুন ভেঙে পছন্দের জীবন বেছে নিল, নিতে পারল?
শ্রীতমার মনে পড়ল ওই ক্লাস টুয়েলভ- এর বা ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকের একটা ঘটনা। রচনা, শ্রীতমা, শুচি আর মেঘলা এক তুমুল বৃষ্টির দিন শ্যামবাটি পেরিয়ে ক্যানেলের দিকে গেছে। ছাতা- টাতার বালাই নেই। তিনজনে ক্যানেলে ছুটে যাওয়া তীব্র জলধারা দেখতে দেখতে ইরিগেশনের বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়েছে। এতো বৃষ্টির দিনে চৌকিদারও বেপাত্তা। ওরা একটা বন্ধ ঘরের বারান্দায় বসে পড়ল। গা দিয়ে, শাড়ি দিয়ে, চুড়িদার দিয়ে উপচে জল নেমে যাচ্ছে।মেঘা ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে কাপড়ের ব্যাগ থেকে নুনের পুঁটুলি সহ চারটে আমড়া আর দুটো চালতা বার করল। রচনা মাটিতে নেমে বৃষ্টিধোয়া একটা তীক্ষ্ণধার পাথর খুঁজে নিয়ে এল। ওই কাদা মাখা মেঝেতেই আমড়া আর চালতা গুলোকে থেঁতলে মাখা বানিয়েছিল ওরা। এসব কান্ড কারখানায় নিজেরাই প্রবল হাসছে তখন।আরাম করে খাওয়া, বেশ খানিক হাসি আড্ডা শেষ। পর ওঠার সময় শ্রী দেখলো ওর একপাটি চটির স্ট্র্যাপ ছেঁড়া।
রচনা বললো, ক্যারিয়ারে ঢোকা। কাল সেলাই করে নেবো।
জল ধরে এসেছে ততক্ষণে। শুচি বলল, দুপাটিই ক্যারিয়ারে নিয়ে নে। বসবি তো সাইকেলের পিছনে। খালি পায়ে থাক।
শ্রী বলল, এখানেই থাক। বলে দুপাটিই টান মেরে রাস্তায় ছুঁড়ে দিল।
মেঘা এক মুহূর্ত দেখে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে আস্ত চটিটা কুড়িয়ে ছেঁড়া চটিটার পাশে
রেখে বলল, যে পাবে সেলাই করে নেবে, খামোখা ওদের দূরে দূরে রেখে কি হবে?
শুচি রেগে গেছে, বলছে, অ্যাই শ্রী, মেঘা! একদম পাগলামী করবি না! নিয়ে আয়, নিয়ে আয় বলছি, চটি ফেলছিস কেন?একটু ছিঁড়েছে। কাল কি পরবি? যা নিয়ে আয়-
কেউ শুচির নির্দেশ শুনছে না। শুচি ওদের মধ্যে সবচেয়ে উদার। সাইকেল থেকে কেরোসিন ধার, সবেতেই সে সবার আগে। সে কিনা ছেঁড়া চটির জন্য এমন করছে,!
রচনা হাসতে হাসতে বলে, একেবারে রাস্তার মাঝে রাখ। মাঝে-
শুচি ততোধিক রেগে বলে, একদম ওসকাবি না ওদের, রচনা- শ্রী জুতোটা তুলে আন।
এবারে তিনজনে মিলে শুচির রকমসকমে হাসতে শুরু করে। চারজনের শরীরে এতোটুকু জায়গা শুকনো নেই। কৈশোরের ভেজা শরীর নিয়ে বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই।কারণ এখানে বৃষ্টি হলে অনেকেই এমন খালি পায়ে ভিজতে ভিজতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মেঘার গোলাপি খাদির কুর্তা ও সাদা পাজামায় লাল মাটির রঙ গুলে গাঢ় লাল।
শ্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেছে, সুজনই বলেছে, বাউল মেলা থেকে ফেরার সময় আলমবাজারের জঙ্গলে দিশা হারিয়ে ধাক্কা খাওয়া দোমড়ানো গাড়ির ভিতরে লাল হয়ে যাওয়া দেহ থেকে তখনো বৃষ্টি কাদার রুক্ষ লাল মাটির মতো রঙ ঝরছিল। ঘটনাস্থলে সুজন পৌঁছেছিল ঘন্টা দুয়েক পর, তখনো।
শ্রীর ঘোর কেটে গেলো সুজনের কথায়, আরে, তখন থেকে কথা বলে চলেছি, কি ভাবছো? শোনো তোমরা আমার পাশে থেকো। পশু হাসপাতাল শুরু করতে চেয়েছিল এবারে আমি করব কথা হয়ে গেছে সিউড়ি থেকে ডাক্তারবাবু সকালে দু’ঘণ্টা করে আসবেন সপ্তাহে তিন দিন। টাকা পয়সার জোগাড় হয়ে যাবে। তোমরা শুধু পাশে থেকো।
শ্রীর চোখে হঠাৎ জল আসে। হুড়মুড়িয়ে। সে জল সে থামাবার চেষ্টাও করে না। সুজন বলে, দুঃখ কোরোনা। ওর মতো করে ওর জীবন ও বেঁচেছে। এখন আমার কাজ ওর ইচ্ছেটুকু বাঁচিয়ে রাখা।
শ্রীর মনে হয়, মেঘা মদ্যপ ছিল কিনা তাতে যায় আসে না কারণ মেঘা গাড়ি চালাতে জানত না। ফলে ওই দুর্ঘটনায় ওর হাত ছিল না।শ্রীর আবার হঠাৎ মনে হয়, মেঘার মনের ভিতর তখন হয়তো ওই গানটাই ছিল, ‘ এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ মেঘার মতো বন্য মেয়েদের, যারা এই পোষ্য সমাজে মানিয়ে নিতে পারে না কিছুতেই, তারা হয়তো শেষ অবধি মুক্তিই চায়। স্রেফ নিজের শর্তে জীবন,নিজের ইচ্ছায় বাঁচা। শ্রীতমার মনে হয় মুক্তির কড়া দাম চোকাতে হলেও এই স্বাধীনতার স্বীকৃতি খানিক হলেও এই লাল মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে এক কবি। সে বোধ রক্তের গভীরে যার একবার ঢুকেছে তার আর পরিত্রাণ নেই।