
শুভদীপ নায়ক-এর ছোটগল্প ‘ দূর আকাশের তারা’
" একদিন আমরা বেড়াতে বেরিয়েছিলাম গঙ্গার ধারে । নদীর পারে নিয়নের আলোয় সন্ধেবেলাটা আরো যেন ফুটে উঠেছে । অদূরে হাওড়া স্টেশন, দুই পারের মাঝখানে জলের ওপর টানা অন্ধকার, মাঝখানে ঝুলছে রঙিন রবীন্দ্রসেতু, আমাদের পরিচিত হাওড়ার ব্রিজ । ব্রিজটাকে ডানদিকে রেখে আমরা একটা লোহার বেঞ্চে বসলাম, যার ভরাট অন্ধকারে তীর্যকভাবে পড়েছে কমলা আলো । শ্রী আমার বাঁ-হাতটা জড়িয়ে ধরে আমার বুকে এলিয়ে দিল নিজেকে । আমি শ্রীকে মন থেকে ফেলে দিয়ে ডুব দিলাম আমার ব্যক্তিগত সত্যে ।"
দূর আকাশের তারা
‘কী হয়েছে ? আজ এমন বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন তোমায় ?’
— ক্লান্ত লাগছে অপর্ণা, খুব ক্লান্ত । কত কিছু হারিয়ে আমি আজ এইখানে ! জীবনের অনেকটা তলিয়ে গিয়েছে অতীতের গর্ভে, পড়ে আছি শুধু তোমাদের মুখ চেয়ে ।
‘আমাদের মুখ চেয়ে ?—কথাটা তুমি বলতে পারলে নিখিল ? ওঠো দেখি, ছাড়ো !’
— কোনওকিছুই তো তোমার অজানা নয় অপর্ণা, আমাদের ভাঙনের তুমিও তো একটা অংশীদার ।
‘শুধু তোমাদের ভাঙন ? আমি ভাঙিনি নিখিল ? আমাকে হারাতে হয়নি ? তিথিকে হারাতে হয়নি এইটুকু বয়সে ?’
—এ কথা যদি জানতে যে হারাতেই হবে, কেন তবে আমাকে ঠেলে দিয়েছিলে অনিশ্চিত পথে ? ডুবিয়ে দিয়েছিলে অন্ধকার ঝিলে, বলো কেন দিয়ে দিয়েছিলে ?
‘ছাড়ো আমায় ! মেয়েটা উঠে পড়বে ঘুম থেকে । এসব কথা পরে কখনও হবে ।’— অপর্ণা চুল গুছিয়ে শাড়ি ঠিক করে উঠে গেল বিছানা থেকে, পড়ে রইলাম আমি । বিছানার এলোমেলো চাদরের ওপর সিগারেটের বাক্সটা পড়েছিল । সেটা থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালাম । পাশে টেবিলের ওপর পড়েছিল অনুবাদের একটা বই, লরেন্সের লেখা ‘লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক’ । তারই পাতা উল্টাতে গিয়ে দেখলাম, বইয়ের ভিতরে অপর্ণা এখনও রেখে দিয়েছে আমাদের কলেজ জীবনের ছবি । তখন ওর খুব একটা চুল ছিল না, বাঁ-হাতে সরু ডায়ালের ঘড়ি পরত ।
‘চা খাবে ?’—আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা পুনরায় ঠিক করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল অপর্ণা । বুক থেকে একবার আঁচলটা নামিয়ে ভদ্রস্থ করে গায়ে জড়িয়ে নিল । বিছানার পাশে তিথি ঘুমচ্ছে পুতুল হাতে নিয়ে । মেয়ের হাত থেকে পুতুলটা সরিয়ে রেখে মাথার চুলে একটু হাত বুলিয়ে দিল সে । আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত পুরনো একটা ছবি এখনও সযত্নে রেখে দিয়েছ ?’
বিছানার পাশে একপায়ে ভর দিয়ে অন্য পা-টা ঈষৎ হেলিয়ে দাঁড়াল অপর্ণা । তাঁর বয়স চল্লিশ ছুঁয়েছে । কালো একটা হাতকাটা ব্লাউজে ঢাকা তার মধ্যবয়সের বুক, গা থেকে যেন গলে পড়ছে সরু শ্যাওলা পাড়ের মলিন সাদা শাড়ি । তার ঠোঁটের কোণে একটা চাপা হাসি চলকে উঠল মনের ভিতর থেকে । বলল, ‘খুব পুরনো স্মৃতি ওটা । তোমাকে হারাব না বলে এতকাল বয়ে বেড়াচ্ছিলাম ।’
আমার সিগারেট ফুরিয়ে এল । অপর্ণার বাড়িতে অ্যাশট্রে নেই, বাধ্য হয়ে জানলার একটা পাল্লা খুলে বাইরে ছুড়ে ফেললাম পোড়া ফিল্টারটাকে । অপর্ণা এই ফাঁকে চা বসাতে গেল ।
অামি যখন চাকরি নিয়ে দিল্লিতে, অপর্ণা তখন অনেক বাধ্যবাধকতা নিয়ে সংসার করতে গেল অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে । সেই সংসার থেকে সে কিছুই পেল না শুধু তিথিকে ছাড়া । ডিভোর্সের পরে এই স্কুল শিক্ষিকার চাকরিটা বেছে নিয়ে সে উঠে এল তার বাবার কাছে । বাবা তাকে এ বাড়িটা লিখে দিয়ে চিরবিদায় নিল বছর কয়েকের মধ্যে । আমি শহরে ফিরতেই আমার সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হল অপর্ণার, কিন্তু আমরা আর আগের মতো নেই, আমাদের মাঝখানে যোগ হয়েছে দীর্ঘ এক জীবনের কাহিনি । হারিয়েও আমরা মিলতে পারিনি পরস্পরের সঙ্গে ।
। ২ ।
অপর্ণার সঙ্গে যখন আমার নতুন করে দেখা হল, সেই সময় শ্রীলেখার সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে । আমি অপর্ণাকে ভুলতে পেরেছিলাম হয়তো শ্রীলেখার জন্যেই । শ্রী জানত আমার জীবন থেকে অপর্ণা তার রোদটুকু সরিয়ে নিয়েছে । এখন আমার মন জুড়ে যে ছায়া নেমেছিল, শ্রী সেটাকেই নিজের করে নিয়েছিল । একরকম দোটানায় পড়ে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠছিল শ্রী’র হাতে । সে আমার অনিচ্ছাকে বহুদিনের চেষ্টায় পরিণত করেছিল ইচ্ছেতে । প্রাণোচ্ছ্বল সেই যুবতী নিজেই গড়ে তুলল দুটো বাড়ির মধ্যে একটা বৈবাহিক সম্পর্ক । শ্রীলেখাকে সকলেই শ্রী বলে ডাকত । সে ছিল আমার বাবার ছোটবেলার বন্ধু অরুণকাকুর একমাত্র মেয়ে । আমি অবশ্য তার চেয়ে বছর ছ’য়েকের বড় ছিলাম । আমাদের বাড়িতে সে যখন ছোটবেলায় আসত, একটা রঙিন ফ্রক পরে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াত । একবার বারন্দায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল । চোখের ওপরে দেখা একটা একরত্তি মেয়ের অঙ্গসজ্জা কীভাবে বদলে গেল যুবতী বেলায় এসে, সেটা ভেবেই মাঝেমধ্যে আশ্চর্য হতাম ।
শ্রীলেখার বাবা-মা একরকমভাবে তাঁদের মেয়েকে আমাদের বাড়ির বৌ হিসাবে উৎসর্গ করে রেখেছিল । শ্রীলেখাও তাই-ই জানত, তার প্রণয়ের যাত্রাপথ যে আমার বাড়ির চৌকাঠে এসে শেষ হবে, এমন ধারণাতেই গড়ে উঠেছিল তার মন । তেমনভাবেই সে তার যুবতীবেলার শরীরকে সাজাত যাতে তার সৌন্দর্য আমার চোখে পড়ে । যাতে আমি ভুলতে পারি সে আমার পরিচিতা, যাতে আমাদের দু’জনের মধ্যে জন্ম নেয় রহস্য, সেই রহস্য—যা মেয়েপুরুষকে চিরকাল এক সুতোয় বেঁধে রাখে । শ্রীলেখার মা তাঁর মেয়ের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আমিই তার জীবনের একমাত্র ভবিতব্য । সুতরাং, আমার পছন্দ অপছন্দ সবকিছুকেই সে টুকে রাখত নিজের মধ্যে । আমার জন্মদিনে সে নিজে হাতেই গুড়ের পায়েস রান্না করে আনত । আমি পাঞ্জাবি পরতে ভালবাসি বলে, আমার আলমারিকে সে ভরিয়ে তুলেছিল নানারঙের পাঞ্জাবিতে । কার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল আমি ক্লাসিক পড়তে ভালবাসি, তাই দুনিয়ার সব ক্লাসিক বই বেছে বেছে এনে আমার মন রাখার সাধ্য মতো চেষ্টা করত । ভিতর থেকে এমন সম্পর্কে যতই দুর্গন্ধ থাক, বাইরে থেকে তা সবার নজর কেড়েছিল । শ্রী আমার বিধবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল । বিয়ের পথে কোনও বাধা নেই দেখে একদিন অরুণকাকু সস্ত্রীক এসে আমার মা’কে প্রস্তাব দিলেন শ্রীকে এবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা পাঠাতে চাইছেন আমার কাছে । আমার নীরবতা সীলমোহর দিল সেই প্রস্তাবকে । দেখলাম, শ্রী আমার মায়ের পাশে পুত্রবধুর জায়গা নিয়ে আগে থাকতেই দাঁড়িয়ে আছে । বাঙালি পরিবারে বিয়ের ব্যাপারে ছেলেদের কোনও সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না । শুধু দেখে নেওয়া হয় সে উপার্জন করে কি না ! সেই থেকে শ্রী আর আমার মধ্যে একটা নিরুপায়ের সম্পর্ক গড়ে উঠল, আমাকে স্পর্শ করার এক অলিখিত নির্দেশ পেল শ্রী ।
একদিন আমরা বেড়াতে বেরিয়েছিলাম গঙ্গার ধারে । নদীর পারে নিয়নের আলোয় সন্ধেবেলাটা আরো যেন ফুটে উঠেছে । অদূরে হাওড়া স্টেশন, দুই পারের মাঝখানে জলের ওপর টানা অন্ধকার, মাঝখানে ঝুলছে রঙিন রবীন্দ্রসেতু, আমাদের পরিচিত হাওড়ার ব্রিজ ।
ব্রিজটাকে ডানদিকে রেখে আমরা একটা লোহার বেঞ্চে বসলাম, যার ভরাট অন্ধকারে তীর্যকভাবে পড়েছে কমলা আলো । শ্রী আমার বাঁ-হাতটা জড়িয়ে ধরে আমার বুকে এলিয়ে দিল নিজেকে । আমি শ্রীকে মন থেকে ফেলে দিয়ে ডুব দিলাম আমার ব্যক্তিগত সত্যে । অনেকক্ষণ পর শ্রী আমার নীরবতা ভেঙে আমাকে ঠেলা দিল তার কনুই দিয়ে ।
— কী ভাবছ ?
‘কিছু না, এমনিই—’
—কিছু না বললে আমি শুনব ? তোমাকে চিনি আমি । নিশ্চয়ই কিছু ভাবছ ।
আমি চুপ করেই রইলাম । আধিপত্যে অন্ধ মানুষ অন্যের উদ্বেগের খোঁজ রাখে না ।
শ্রী পুনরায় ঠেলা দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমাদের বিয়ের কথা হচ্ছিল যখন, তুমি চুপ করে ছিলে কেন ?’
—আমি কী বলতাম !
‘বাহ্ রে, তুমি তোমার কথা বলতে । তোমার একটা মতামত তো নিশ্চয়ই আছে আমাকে নিয়ে । নেই ?’
—তোমাকে নিয়ে আমার যদি মতামত থেকেও থাকে, তবে সেটা সকলের সামনে বলাটা কি ঠিক হত শ্রী ?
কথাটা বলে আমি বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালাম, পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালাম । শ্রী পায়ের ওপর পা তুলে সামনের দিকে ঝুঁকে বেঞ্চেই বসে রইল । গ্যাস লাইটারটা হাতে নিয়ে এক-দু’বার জ্বালানোর বৃথা চেষ্টা করল সে ।
আমি তাকে লক্ষ করছিলাম । আমাকে সম্পূর্ণভাবে কাছে পেয়েও যেন তার আত্মা বঞ্চিত হয়ে রইল ।
এরপর থেকে শ্রী ক’দিন আমার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল । সেই দূরত্বে আমিও কিছুটা পরিত্রাণ পেয়েছিলাম । বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়তাম শ্যামবাজারে বন্ধুদের আড্ডায়, কিংবা রবীন্দ্রসদনে দু’একটি নাটক দেখতে । বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে শুনতাম শ্রী এসেছিল আমার স্যুট প্যান্টের মাপ জানতে । বিয়ে সংক্রান্ত ছোট বড় প্রায় সব কাজই আমাকে করতে হত । বিয়ের কার্ড ছাপাতে দেওয়া, ডেকরেটরকে আগাম টাকা দেওয়া, ক্যাটারিং থেকে ইলেকট্রিকের খরচ বাবাদ ব্যাঙ্ক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তোলা, সবটাই সেরে ফেললাম কয়েকদিনে । দূরের যেসব ঘনিষ্ট আত্মীয়, তাঁরা একে একে বাড়িতে এসে উঠলেন । বাড়ি ভরে গেল অপ্রয়োজনীয় মানুষে, সরঞ্জামে ।
তখন হেমন্তকাল চলছে, বিয়ের তারিখ পড়েছে আঘ্রাণে । বাড়িতে যেসব আত্মীয়েরা এসেছে, তাঁদের কেউ কেউ মেয়েকে আংটি, গলার চেন, হাতের বালা দিয়ে আশীর্বাদ করবেন বলে শোনা যাচ্ছে । বাবার রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে আমার মা ইতিমধ্যেই পুত্রবধুর জন্য গড়িয়ে ফেললেন নতুন গয়না । টেলিফোনে সে খবর পৌঁছাল মেয়ের মায়ের কানে । এরই মধ্যে একদিন বিয়ের কেনাকাটা সেরে আমি আর শ্রী একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে বেরচ্ছি, হঠাৎ অপর্ণার সঙ্গে দেখা । আমাদের সম্মুখেই ফুটপাতের ধারে দেখি ট্যাক্সি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করছে । শ্রীলেখার সামনেই তাকে ডাকলাম—
‘কী আশ্চর্য, তুমি এখানে !’
অপর্ণা প্রথমে শ্রী-র উপস্থিতি টের পায়নি । সে আমাকে দেখতে পেয়ে অবাক হল না, বরং তার কবরে চাপা দেওয়া একটা স্বপ্ন মাটি ফুঁড়ে উঠল ।
বলল, ‘আমি তো এখন এখানেই থাকি । বছর দু’য়েক হল বাবা মারা গেছে ।’
আমি অপ্রস্তুতের মতো বললাম, ‘আমি তো জানতাম তোমার—’
মুখের কথাটা শেষ হতে দিল না অপর্ণা । বলল, ‘তুমি জানতে তো কী ! তা আর আগের মতো নেই ।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার তা হলে চলছে কীভাবে ?’
—কেন ? আমি কি খোঁড়া না অন্ধ, যে নিজেকে চালাতে পারব না ! এমএ পাশটা কাজে লেগে গেছে । একটা স্কুলে পড়াচ্ছি ।
শ্রী এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল । কাছে আসতেই, অপর্ণার সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিতে হল । দু’জনের পরিচয় যেন পরস্পরের কাছে চেনা । অালাপের সবটুকু কাউকে মুখে বলতে হল না । অপর্ণা আলাপটা ধরে নিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি, তুমি নিখিলের বৌ । তাই তো ?’
শ্রী হাসল । মজার ছলে বলল, ‘বিয়ে করলে তবে তো, বাবুর যা মতিগতি ।’
অপর্ণা হেসেই সে জবাব ফিরিয়ে দিল ।
‘ও মা ! কেন করবে না ?’
তারপর আমার দিকে ফিরে সে বলল, ‘এইবার তা হলে তোমার ব্রহ্মচর্যের পায়ে সংসারের বেড়ি পড়ল ।’
আমরা তিনজনেই হেসে উঠলাম ।
শ্রীয়ের থুঁতনিটা তিন আঙুলে ধরে অপর্ণা বলল, ‘ভারি মিষ্টি মেয়ে ।’
অপর্ণার হাতের তালুতে হাত রেখে শ্রী বলল, ‘তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি, তুমিই অপর্ণাদি । ওর মুখে তোমার কথা খুব শুনেছি ।’
—খুব বলে বুঝি ?
‘হ্যাঁ, বলেই তো । শোনো, আমি কিন্তু কোনও বারণ শুনব না, তোমাকে আসতেই হবে আমাদের বিয়েতে ।’—এ কথা শুনেই অপর্ণার মুখে একটা ছায়া পড়ল । সে আমার দিকে একবার দৃষ্টি দিয়েই ফিরে তাকাল শ্রী-র দিকে । বলল, ‘আচ্ছা, আসব ভাই ।’
শ্রী অবশ্য এরপরেও ছুটি দেয়নি অপর্ণাকে । অপর্ণার কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর নিয়ে তার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল । তাকে পাঠিয়েছিল বিয়ের কার্ড ।
অপর্ণা কিন্তু বৌভাতের দিন সত্যিই এসেছিল, শ্রীলেখাকে দেওয়া কথা সে ফেরায়নি । হাতে একটা ফুলের বোকে নিয়ে সে হাজির হয়েছিল সন্ধেবেলায় । অনেক অতিথিদের মাঝে নিজেকে সে যথাসম্ভব একা করে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু শ্রী তা হতে দেয়নি । সে নিজে গিয়েই টেনে আনছিল অপর্ণাকে । পরিচিতদের আলাপের ভিড়ে সেদিন বারবার আমার চোখ পড়ছিল অপর্ণার ওপর । কী নিষ্ঠুর ভাবেই সে আমার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিল সেদিন, অথচ সদ্য পরিচিতা শ্রী-র সঙ্গে এমনভাবে মিশছিল, যেন শ্রী তার কতকালের চেনা । মেয়েদের স্বভাবে বিধাতা যে মমত্ববোধটা লুকিয়ে রেখেছেন, তার বাইরে তিনি চিরকাল একটা নিষ্ঠুরতার পাহারা বসিয়েছেন । আমি ভেবেছিলাম অপর্ণা হয়তো আসবে না । সে না এলে আমি অন্তত এই ধারণা নিয়ে বাঁচতে পারতাম, তার মনের কোনও একটা গোপন অংশে আমি আজও আছি । কিন্তু অপর্ণা সেদিন এসে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সে তার জীবনকে খুব স্বচ্ছলভাবেই যাপন করে চলেছে, তার কোনও অংশে আমি বা আমার অতীত বেঁচে নেই ।
সেদিনের আলাপটুকুর কথা আজও মনে পড়ে । বৌভাতের দিন শ্রী সেজেছিল নীল বেনারসিতে । তার চুলের খোঁপায় পরানো ছিল বেলফুলের গজরা মালা, গলায় বিছে হার, হাতে সোনার বালা, চুড়ির গাছি, তালুভরা মেহেন্দি ও দু’চোখে জমানো ছিল রাত্রির অপেক্ষমান বিভীষিকা । অপর্ণা এসে উপস্থিত হতেই তাকে সে নিয়ে এল আমার কাছে ।
‘দ্যাখো কে এসেছে । কী বলেছিলাম তোমাকে, অপর্ণাদিকে আমি আনবই । আমরা হলাম আজকালকার মেয়ে, আমরা আমাদের বিয়েতে সতীনকেও নেমতন্ন করি ।’
অপর্ণা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায় ও-কথাটা শুনে । ফুলের বোকে আর গিফ্ট আইটেমটা শ্রীয়ের হাতে তুলে দিয়ে শান্তস্বরে জানিয়েছিল, ‘কনগ্রাচুলেশন !’
শ্রী-র সঙ্গে একাধিকবার ছবি তুলেছিল অপর্ণা, ইচ্ছের বিরুদ্ধে, নিজেকে অনেক সংযত রেখে । সেই রাত্রে অপর্ণাকে আমি ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছিলাম । ফিরে এসে দেখি নিজেরই ঘরের ছবি বদলে গিয়েছে । আমার সাধারণ ঘরটিকে সেদিন সাজানো হয়েছিল ফুলে, বিছানায় পাতা হয়েছিল ফুলশয্যার চাদর । চেয়ে দেখি রজনীগন্ধার জালের ভিতর দিয়ে বহুদিনের প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে শ্রীলেখা ।
ফুলশয্যার দিন দীর্ঘরাত অবধি জেগেছিলাম আমি । শ্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল । কিন্তু অনেকদিন পর একটা পুরনো ধোঁয়া আমার মনের মধ্যে পাক দিয়ে উঠছিল । আমি বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম । শ্রী গা থেকে খুলে ফেলেছিল তার ভারি গয়নাগুলো, শখের সাজানো চুল খুলে এলোমেলো করেছিল । তার শোবার ধরন ভাল নয় দেখে, আমি তাকে মাঝেমধ্যে গুছিয়ে দিচ্ছিলাম । সে আরও তীব্র করে আমায় জড়িয়ে ধরছিল । মনে হচ্ছিল বহুদিনের চেষ্টায় সে কোনও সম্পত্তির মালিকানা হাতে পেয়েছে, অথচ তাকে ঘিরে আমার ভিতরে কী বাসনা জাগছে, তা সে জানতে চায় না । যে স্ত্রী কখনও জানতে পারে না তার স্বামীর জেগে থাকার কারণ, সে কীভাবে দাবি করে তার স্বামীকে সে চেনে !
। ৩ ।
‘তোমার চা ।’— অপর্ণা আমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে বসল নিজের চা নিয়ে ।
আমি তার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখছিলাম । তার বিয়ের ছবি, মেয়ে তিথিকে কোলে নিয়ে তোলা ছবি, অপর্ণার নিজের ছোটবেলার ছবি, তার বাবা-মায়ের ছবি । জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার স্বামীর ছবি দেখছি না । নেই তোমার কাছে ?’
অপর্ণা চায়ে চুমুক দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বলল, ‘আছে, দেওয়ালে টাঙানো নেই ।’
একটু থেমে বলল, ‘যে মানুষটার সঙ্গে আমার যোগ নেই, তার ছবি চোখের সামনে রাখার কোনও দরকারও নেই বলে আমি মনে করি ।’
চা খেলাম এক চুমুক । বললাম, ‘যোগ তো আমার সঙ্গেও ছিল না এতকাল । তবে আমাদের ছবিটা বইয়ের মধ্যে স্মৃতি হয়ে ঘুরছে কেন অপর্ণা ?’
—কোন্ মানুষের সঙ্গে যোগটা কেমন, স্মৃতিটা তার ওপর নির্ভর করে নিখিল ।
‘শ্রী-র সঙ্গে তো তোমার যোগটা মন্দ ছিল না । তাকে কেন বাদ দিলে ?’
—সম্পর্কটা তো তোমার বৌ নিজে থেকেই রাখল না । মরে গিয়ে সে আমাদের মাঝে পাঁচিল তুলে দিয়ে গেল ।
অপর্ণা একটা বিরক্তিকর মন নিয়ে বসে রইল বিছানায় । মাঝেমধ্যে গালে ঝুঁকে পড়া অলকটা ঠেলে কানের ওপাশে পাঠাতে লাগল ।
বিছানার অন্যপ্রান্তে গিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসলাম । বললাম, ‘শ্রী অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছিল অপর্ণা, তার কাছে এছাড়া হয়তো আর কোনও পথ খোলা ছিল না ।’
কথাটা শোনামাত্র যেন বাজ পড়ল অপর্ণার মনে । সে একটুও নড়ল না, শুধু তার অক্ষিগোলক দুটি আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ । কৌতূহল চেপে না রেখে খানিকবাদে সে নিজেই জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে তোমার বৌ তো আগে থাকতেই জানত, তা হলে কী এমন ঘটল তোমাদের মধ্যে ?’
অপর্ণা আমার বিবাহিত জীবনের এই অংশটুকু জানে না । যতটা সে জানে, ঘটনাটা তাকে সেখান থেকেই বলতে শুরু করলাম ।
বিয়ের পরের দিনগুলোতে আমার জীবন স্বাভাবিকই কাটছিল । যে মানুষকে আগে থাকতে নিজের বাড়ির সর্বত্র দেখেছি, সে মানুষ স্ত্রী হয়ে আসাতে আমার কখনও মনে হয়নি পরিবারে একজন নতুন সদস্য যোগ হয়েছে । নতুন বৌয়ের মধ্যে যে লজ্জা যে দ্বিধা বিয়ের পর কিছুদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে, শ্রীলেখার মধ্যে তার কিছুমাত্র ছিল না । তার কখনও মনে হয়নি আগে থাকতে পরিচিত বাড়ির দেওয়ালগুলো তাকে নতুন গৃহিনী রূপে মেনে নেবে কি না ! আমার পছন্দকে সে নিজের পছন্দ বলে ধরে নিয়েছিল । আমার প্রতি তার কোনও জীবনজিজ্ঞাসা ছিল না, আর সেইটাই সবচেয়ে হতাশ করেছিল আমাকে । প্রশ্নবিমুখ, সরেখ, একটানা একটা মেয়ে যে আমার সংসারে স্ত্রী হয়ে আসতে পেরে সুখী, যার মধ্যে আমাকে খুঁজে বেড়ানোর কোনও স্পৃহা নেই, আমাকে জানার কোনও সদিচ্ছা নেই, অথচ আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম তার প্রতিদিনের আচরণ দেখে, আমাকে তার স্বভাবের সঙ্গে এক করে মিলিয়ে নিতে তার কোথাও একটুও বাধল না । সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম, অপর্ণা জানত আমি শ্রীলেখার সঙ্গে এ জীবন খুব বেশিদিন কাটাতে পারব না । কেননা অপর্ণা, তুমি হলে সেই মেয়ে যার মন ভাবনার বাধা রচনা করে । কিন্তু শ্রী, সে ছিল এর ঠিক উল্টো । সুখী হওয়া ছিল তার জন্মগত নিয়তি । অর্থবিত্ত পিতার সংসারে সে কখনও অভাবের মুখ দ্যাখেনি । এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেও সে ছিল সুখী, কারণ সে নিজেকে তৈরি করেছিল আমার স্ত্রী হয়ে বাঁচার লক্ষ্যে । আমাদের বিয়েটা যখন কাগজ-কলমে ভেঙে যায়, তারপরেও তার মনে হয়নি জীবনে অন্তত বিরাট ভুল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে সে নিষ্কৃতি পেয়েছে ।
মা মারা গেল আমার বিয়ের তিনবছর পর । বাড়িটা আমাদের স্বামী-স্ত্রী’র পরিচয় নিয়ে টিকে রইল । শ্রীলেখা নিজে হাতে সাজাতে লাগল তার সংসার । মাঝেমধ্যে আমি তাতে নতুন কিছু যোগ করতাম । হয়তো বইয়ের আলমারি কিনলাম একটা কিংবা একটা সোফাসেট । শ্রী তার সঙ্গে জুড়ে দিল নতুন একটা কাচের টেবিল । এইভাবে আমাদের দু’জনের সংসার একদিন ভরে উঠল অজস্র আসবাবের স্তূপে । আমাদের মাঝখানে যেন কোনও সুখ নেই, কোনও গল্প নেই, কোনও ছবি নেই । অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমি ডুব দিতাম আমার বইপত্রের গভীরে, সংসারে পড়ে থাকত শ্রী । এইভাবে বহুদিন বহুরাত পার হয়ে গেছে, তবু শ্রী আর আমার মধ্যে গড়ে ওঠেনি কোনও জীবনের সমীকরণ ।
এক রাত্রে জেগে রয়েছি, বারন্দা থেকে চেয়ে আছি দূরের রাস্তার মোড়ের দিকে । পাশের বাড়িতে রেডিয়োতে বেজে চলেছে মৃদু রবীন্দ্রসঙ্গীত । শ্রী এসে দাঁড়াল আমার পাশে ।
‘কী গো, শোবে না ?’
—ঘুম আসছে না ।
‘মাঝেমধ্যে ওরকম হয়, শরীর ঠিকাছে তো ?’
—হ্যাঁ, তুমি শুয়ে পড় ।
‘তা হয় না কি ! আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব ?’
আমি শ্রীলেখার দিকে বিস্ময়ে ফিরে তাকালাম । যে মেয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন করে না, তার মনে যদি জিজ্ঞাসা আসে, তা হলে হয়তো নতুন করে ফিরে আসবে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে ।
কিন্তু আমাকে নিরাশ করে শ্রী বলল, ‘অপর্ণাদিকে দেখে মনে হয়, ও বোধহয় তোমাকে ভুলতে পেরেছে । নইলে আমার সঙ্গে যার এত কথা হয়, সে কখনও তোমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে না কেন ? তুমি কি ওঁকে আজও ভুলতে পারনি ?’
—আমি কোনওকিছুই ভুলি না শ্রী ।
‘কোনওকিছু ভুলতে পারা, আর একটা মেয়েকে ভুলতে পারা,—দুটো এক ব্যাপার নয় নিখিল ।’
—মানে ? কী বলতে চাইছ তুমি ?
‘বলতে কিছুই চাইছি না । আমার মনে হচ্ছে অপর্ণাদি সম্পর্কে তোমার মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে ।’
—সব মানু্ষেরই অন্য মানুষকে নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা থাকে মনে । ভুল ধারণা থেকেই জন্ম নেয় জীবনে অন্যভাবে বেঁচে থাকার মানে ।
শ্রীলেখা হাতে করে একটা চিরুনি নিয়ে এসেছিল । সেটা দিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকল । খানিকক্ষণ আমাদের মাঝে থেমে থাকল কথা ।
শ্রীয়ের চিরুনিতে কিছুটা চুল উঠে এল । আঙুলের ডগায় সেই টুকরো চুলগুলোকে গিঁট পাকিয়ে সে বাইরে ফেলল । তারপর বলল, ‘ভুল ধারণা থেকে উঠে না আসলে আমাদের জীবনটা কখনও সুখী হবে না নিখিল । তোমাদের মধ্যে যদি ভালবাসাটা থাকত, তা হলে আমার জায়গায় আজ অপর্ণাদি তোমার স্ত্রী হত ।’
—এসব কী বলছ তুমি ? কী হয়েছে তোমার এই রাত্রিবেলায় ?
শ্রী বলতে থাকল,—’কী হয়েছে জানি না, শুধু এইটুকু জানি আমি তোমার স্ত্রী হয়েও তোমাকে সম্পূর্ণরূপে ছুঁতে পারি না । বুদ্ধি বলে, অপর্ণাদি তোমাকে চায় না । তবু, মন দিয়ে যখন তোমাকে ঘিরতে যাই, অপর্ণাদিরই ছায়া এসে দাঁড়ায় আমাদের মধ্যিখানে । আমি তোমাকে কখনওই পরিপূর্ণভাবে পেতে পারি না, অথচ যেন অপর্ণাদি তোমাকে চিরদিনের জন্য পেয়ে গিয়েছে ।’
—অপর্ণাকে নিয়ে কেন এত ভাবছ তুমি শ্রী ? সে তো আমাদের দাম্পত্যের বাইরে ।
‘ভাবছি, কারণ সে আমাদের সম্পর্কের ভিতরে ।’
কথাটা বলে চুপ করে রইল শ্রী । আমি তাকে অনেকদিন পর বুকে জড়ালাম । নিজের জন্য কোনও সান্ত্বনা খুঁজে না পেলেও তখনও পর্যন্ত সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী, তার চোখের দিকে চেয়ে দেখলাম অন্ধকারে চোখের মণিতে একফোঁটা তরলে তার বিশ্বাস জেগেছে । বিশ্বাস এই, আমাকে সে ফেরাতে পারবে নিজের কাছে ।
দিন পেরিয়ে যেতে থাকে আমার আর শ্রীলেখার মধ্যে ফুটে ওঠে এক অদৃশ্য দূরত্ব । যেন আমরা একটা ভুল করে ফেলেছি, ভুল করেছি জীবনের দিকে না তাকিয়ে, জিজ্ঞেস করিনি কী চাইছিল আমাদের জীবন । সেদিন ছিল এক ঝড়ের বিকেল । মেঘ ঘনিয়েছে দিগন্তে, শ্রীলেখা ছাদে গিয়েছে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলে আনতে, এখুনি হয়তো বৃষ্টি নামবে । টেলিফোনটা অনবরত বেজে চলেছে নিচের ঘরে ।
শ্রী ফোন তুলছে না দেখে বাধ্য হয়ে ফোনটা আমিই তুললাম । মনে আছে অপর্ণা ফোনটা তুমিই করেছিলে ?
‘হ্যালো, হ্যালো নিখিল !’
—কে ? অপর্ণা ? হ্যাঁ বলো, কী হয়েছে ?
‘সর্বনাশ হয়ে গেছে নিখিল, আমার মেয়ে পড়ে গেছে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে ।’
—কী বলছ কী তুমি ?
‘হ্যাঁ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না নিখিল, তুমি একবার আসবে ? দ্যাখো না, মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে, কথা বলছে না ।’
—আমি এখুনি আসছি অপর্ণা ।
ফোনের রিসিভার রেখে শ্রীলেখাকে আমি বলে আসলাম, ‘অপর্ণার মেয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে, আমি ওর কাছে যাচ্ছি, তুমি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ো ভিতর থেকে, ঝড় আসছে ।’
সেদিন সমস্ত রাত আমার কেটেছিল হাসপাতালে,—অপর্ণা, তোমার সঙ্গে । তোমার মেয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছিল । কিন্তু সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন ঝড় এসেছিল আমার আর শ্রীয়ের দাম্পত্যে ।
পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে শ্রীয়ের মুখে অদ্ভুত বিতৃষ্ণার ছবি দেখলাম । সারাদিন সে কাটিয়ে দিল সংসারের কাজ করে । শুধু একবার আমাকে চা দিতে এসে বলল, ‘অপর্ণাদির মেয়ে এখন কেমন আছে ?’
বললাম, ‘জ্ঞান ফিরেছে ।’
সে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘কাল যে ফিরবে না, একবার জানাতে পারতে ।’
‘খবর দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না আমরা শ্রী । নইলে তো—’
—থাক । অত কিছু শুনতে চাই না । বাচ্চাটা ভাল হয়ে গেলেই ভাল ।
সেদিনকার মতো আলোচনায় বিরতি পড়ল, কিন্তু আশঙ্কার মেঘ ছড়াতে লাগল সংসারের ভিতরে । যাবতীয় কাজে শ্রী নিজেকে তুলনা করতে লাগল, অপর্ণা তোমার সঙ্গে । কোনওদিন সকালে স্নান সেরে একখানা শান্তিপুরী শাড়ি পরে এসে সে বলত, ‘এই শাড়িটা তোমার খুড়ি পিসি দিয়েছিল, রঙটা ভীষণ সুন্দর । ভাল লাগছে আমায় ?’
আমি বলতাম, ‘শাড়ির বিষয়ে আমি কী বুঝি ! তবে, শাড়িটা পরেছ জানতে পারলে খুড়ি পিসি খুশি হতেন ।’
কথার দিক বদলে দিয়ে সে বলত, ‘বললে না, আমাকে কেমন লাগছে ? অপর্ণাদির মতো নিশ্চয়ই সুন্দর নয় ?’
কিংবা একদিন পোস্ত-চিংড়ি রেঁধে কৌটোতে করে এনে বলল, ‘শোনো, তুমি যদি অপর্ণাদির বাড়িতে যাও, তবে এটা একটু দিয়ে এসো তো । আমার সতীনকে টেলিফোন করে জানাতে বলবে, তার মতো করে রাঁধতে পেরেছি কি না !’
অপর্ণা, তোমার মেয়ে তিথির সেদিন জ্ঞান ফিরেছিল ঠিকই, কিন্তু সে হারিয়ে ফেলেছিল বাকশক্তি । দু’জনে মিলে কত ডাক্তার দেখালাম, তবু তার কণ্ঠ বিদীর্ণ করে উঠে এল না কথা । হয়তো আমাদেরই পাপের শাস্তি পাচ্ছে বাচ্চাটা ।
একদিন শীতের সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি শ্রী ঘর অন্ধকার করে বসে আছে । হাঁটুতে মাথা রেখে বিছানার এককোণে গুটিয়ে রয়েছে । আলো জ্বেলে তার কাছে গিয়ে বসলাম । বললাম, ‘কী হয়েছে শ্রী, শরীর খারাপ ?’
মাথা তুলতেই দেখি তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর একটা ক্ষীণ ধারা ।
—এ কী ! কাঁদছ কেন তুমি ?
সে কোনও উত্তর না দিয়ে অন্যত্র দৃষ্টি মেলে রইল ।
চোখের জল মুছিয়ে দিতে গেলে সে আমায় বাধা দিল । বলল, ‘তোমার লজ্জা করে না, স্ত্রী থাকতেও অন্য মেয়েমানুষের কাছে যেতে ?’
কথাটা শুনেই আমার ভিতরে আগুন জ্বলে উঠল । তবু তাকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম, ‘মুখ সামলে কথা বলো শ্রী । অপর্ণার সঙ্গে তুমি নিজেই পাতিয়েছ সম্পর্কটা । যা মুছে গিয়েছিল, তাই আবার নতুন করে টেনেছ ।’
—হ্যাঁ, টেনেছি । কারণ, আমার ভিতরে একটা জোর কাজ করেছিল যে তুমি আমার । আমি তাকে দেখাতে চেয়েছিলাম, যা সে পারেনি, তা আমি পেরেছি খুব সহজেই ।
দ্বিগুণ জ্বলে উঠলাম কথাটা শুনে । বললাম, ‘অপর্ণা আর যাই হোক আমাকে নিয়ে হারজিতের খেলায় নামেনি । যেমনটা তুমি নেমেছ ।’
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই শ্রী আমার আমার হাতটা ধরে টানল । বলল, ‘আমি তোমাদের কাছে বিরাট একটা বাধা, তাই না ? আমি সরে গেলে তোমরা দু’জনে খুব সুখে থাকবে, বলো ?’
আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘এত ঘৃণা তোমার মধ্যে অপর্ণার প্রতি ?’
শ্রী কোনও জবাব দিল না, রাঁগে ফুসতে লাগল তার গোটা শরীর । আমি চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখতে যাব, এমন সময় শ্রী আমায় টেনে ধরল তার শরীরের ওপর । আমরা দু’জনে লুটিয়ে পড়লাম বিছানায় । শ্রী আমাকে জড়িয়ে ধরল, এক হাতে সে খুলে দিল তার রাতপোশাকের কোমরবন্ধনীর ফাঁস । আমার অস্বস্তিকে সে কোনও মূল্যই দিল না । আমি তাকে বললাম, ‘ছেলেমানুষী কোরো না শ্রী, ছাড়ো আমায় ।’ তবু সে অনবরত চুম্বনে ভরিয়ে দিতে থাকল আমার নির্বিকার মুখমণ্ডলীকে ।
‘তুমি আমায় ভালোবাসো না বলো ? আমি তোমার স্ত্রী নিখিল । তবু কেন আমাকে এতবছর কাটিয়ে দিতে হচ্ছে এক শরীর বসন্ত নিয়ে, মনভরা অপেক্ষা নিয়ে ?’
আমি তাকে বোঝালাম, ‘ভালোবাসা ব্যাপারটা বিয়ের ওপর নির্ভর করে না শ্রী । ভালোবাসার দায় অনেক, ভালোবাসার দুঃখ বিচিত্র ।’
কিন্তু এসব কথার মানে বোঝার মতো পরিস্থিতিতে সে ছিল না । যে ক্ষুধা তার ভিতরে বহুবছর ধরে সঞ্চিত আছে, সেই ক্ষুধা সেদিন প্রাণপণ উঠে আসতে চাইছিল । কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর আমাকে সে হার মানাতে না পেরে ছেড়ে দিল । আমি উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে । সে শুয়ে রইল ওভাবেই, অর্ধনগ্ন, গ্লানির চিত্র যেভাবে আঁকা থাকত টিৎসিয়ানের ক্যানভাসে । তিরস্কৃত আমি পা বাড়ালাম বাড়ির বাইরে । নিজেকে পাথরের মতো ভারি মনে হচ্ছিল অপর্ণা, এমনকী তোমার কাছেও সেদিন ফিরতে মন চাইছিল না ।
তবু, আমি ফিরেছিলাম শ্রী-র কাছে । একটা উজ্জ্বল মেয়ে, তার জীবন এভাবে অন্ধকারে ধূপের ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাক, এ আমি কিছুতেই চাইনি । কিন্তু ফিরে গিয়ে সেদিন শ্রীকে বাড়ির কোথাও খুঁজে পেলাম না । দেখি, বিছানার ওপরে পেপারওয়েট চাপা একটা চিরকুট পড়ে । তাতে লেখা ছিল, ‘অপর্ণাদিকে বোলো, আমার স্বামীকে আমি তার হাতে দিয়ে গেলাম । সুখী থেকো দু’জনে ।’
ভয়ে আমার সর্বশরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল । আমি টেলিফোন করলাম শ্রী-র বাপের বাড়িতে । জানতে পারলাম সেখানেও সে যায়নি । সারারাত ছোটাছুটি করলাম, উতলা হল প্রতিবেশীদের কেউ কেউ, ফোন করল অনেক অাত্মীয়েরা । শ্রী-র বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম থানায় । সমস্ত রাত উদ্বেগ নিয়ে কেটে গেল আমার, তবু শ্রী বাড়ি ফিরে এল না ।
পরদিন সকালে জল-পুলিশের একটা লঞ্চ ডুবুরি নামিয়ে শ্রীলেখার দেহটা গঙ্গার গভীর থেকে উদ্ধার করেছিল । কাদা আর জলে ভিজে তার সুন্দর শরীরটা সাদা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছিল । নদীর নির্মম স্রোতে ভেসে গিয়ে সে নিজের শরীরমনে জমতে থাকা জ্বলন্ত অঙ্গারকে চিরকালের জন্য নিভিয়ে ফেলেছিল । এর জন্য আমি তাকে দোষ দিই না । সে ছিল জীবনের মধ্যে বেঁচে থাকার আয়ু, জলের মধ্যে অদৃশ্য ফেনার তরঙ্গ, সম্পর্কের মধ্যে এক চিলতে জমি, যাকে আমরা মেরে ফেলেছি দু’জন মিলে, হ্যাঁ— আমরা, আমি আর তুমি, অপর্ণা ।
। ৪ ।
অপর্ণা এতক্ষণে জানলার একটা পাল্লা খুলে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমার কথা শুনছিল । আমি উঠে গেলাম তার কাছে । আজকাল নিজের বাড়িতে আমার থাকাই হয় না । রাতদিন পড়ে থাকি এই মেয়েটার বাড়িতে । অনেকে বদনাম রটায়, ছোটবড় কথা বলে, কিন্তু নিজের বাড়ির ঐ অন্ধকার কূপের চেয়ে অপর্ণার বাড়ির এই অনিশ্চিত জীবনের ছায়া আমার পক্ষে ঢের ভাল । অপর্ণার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম । তার ঘাড়ের ওপর আমার নিঃশ্বাস পড়তে থাকল, তবু সে ফিরে তাকাল না । সাদা মলিন শাড়ির অন্তরাল সরিয়ে হাত দিলাম তার নরম উদরে । চল্লিশে পা দিয়েও তার শরীর এখনও হারায়নি তার আগের নমনীয়তা । আমারও গালে এসে গিয়েছে বয়সকে স্পর্শ করা নুনমরিচের দাড়ি, সেই দাড়ি আমি ঘষতে লাগলাম অপর্ণার শরীরের অনাবৃত অঞ্চলে । শিউরে উঠছিল সে । এক বিশাল জলস্রোত বাঁধের বিপদসীমা ডিঙিয়ে উপচে পড়তে চাইছে । অনেকক্ষণ পর সে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল । কান্না ও আদরের মধ্যে বহুক্ষণ চলল আমাদের প্রাণের যাতায়াত । একসময় সে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও নিখিল । আমি অনেক দেরিতে বুঝেছিলাম তোমাকে আমি ভালোবাসি ।’
আমি অপর্ণার ঠোঁটে আঙুল ঘষে তাকে থামালাম । শিরায় শিরায় এতদিন যে তরল লাভা চাপা ছিল, দেখলাম তার সর্বত্র আজ সেই লাল আভায় ভরে গেছে । আমরা মেতে উঠলাম সেই লোভে, যা আমাদের আরও দুর্নামের দিকে নিয়ে যাবে ভবিষ্যতে । রাতের আকাশে মাঝেমধ্যে এমন এক একটা দুঃখী তারার জন্ম হয়, যারা অনেক বাড়িতে আগুন লাগায়, অনেক সম্পর্কে বিষ ঢালে, তবু তারা তাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বটা ভুলতে পারে না । যেমন পারেনি অপর্ণা । সেদিন সমস্ত সন্ধে পাশের ঘরে আমরা এক বিছানায় দু’জনে নীল শিখায় জ্বলে উঠলাম । তিথি অন্য ঘরে ঘুমচ্ছিল, সে কিছুই জানতে পারেনি ।
চমৎকার দ্বন্দ্ব, প্রেম, উপেক্ষা, একতরফা ভালোবাসা- সব মিলিয়ে অসাধারণ। এই লেখার বাস্তব আবেদন আছে বলে আমি মনে করি। শুভেচ্ছা রইলো আরো অনাবিল লেখা পড়বার আশায়।