লিয়েহ ৎসে : দু’টি টুকরো
গৌতম বসু
গৌতম বসুর করা একটি অপ্রকাশিত অনুবাদ
স্বর্গ ও মর্ত্য বিষয়ে চুয়াং ৎসে ও লিয়েহ ৎসে
চী প্রদেশের এক ব্যক্তি আহারনিদ্রা ত্যাগ করলেন; তাঁর একটাই দুর্ভাবনা, যে-কোনও মুহূর্তে আকাশ ভেঙে পড়তে পারে পৃথিবীর ওপর, এবং স্বভাবতই, তখন পৃথিবীও চুরমার হয়ে আরও নিচে তলিয়ে যাবে। এই ভয়ানক অবস্থায়, ভদ্রলোকের প্রশ্ন, তাঁর শোয়াবসার জায়গার কী বন্দোবস্ত হবে? অনেকে অনেক ভাবে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কারুর যুক্তিতেই তেমন জোর না থাকায়, সকলকেই সহজে হারিয়ে, ভদ্রলোক আরও মন খারাপ ক’রে ব’সে রইলেন, তাঁকে কোনওভাবেই অবসাদমুক্ত করা গেল না। অবশেষে, এক তরুণের কথায় তিনি যেন সামান্য ন’ড়ে চ’ড়ে বসলেন, সে তাঁকে বোঝাল, ‘দেখুন, স্বর্গ জায়গাটা জমাট বায়ুস্তর বই অন্য কিছু নয়, এমন কোনও জায়গা সেখানে নেই, যেখানে বায়ু অনুপস্থিত। ভেবে দেখুন, আপনি তো সেইরকম একটা বায়ুমণ্ডলে আছেন, দিব্যি হাঁটাচলা করছেন, শরীর বেঁকাচ্ছেন এদিক থেকে ওদিক, লম্বা শ্বাস নিচ্ছেন, ছাড়ছেন। আপনি স্বর্গেই আছেন, বলা যায়! আপনার চারপাশের বায়ুমণ্ডল কি ভেঙে পড়ছে? কেন অযথা চিন্তাভাবনা করছেন?’
কিছুক্ষণ চুপ ক’রে রইলেন চী প্রদেশের সেই ভদ্রলোক, ভাবলেন, ‘সত্যিই তো, আমি এখন যেখানে আছি, কই সেটা তো ভেঙে পড়ছে না!’ পরক্ষণেই নতুন প্রশ্নের উদয় হল তাঁর মনে, যুবককে তিনি জানালেন,‘বেশ, বায়ুস্তর ভেঙে পড়ছে না, এটা না হয় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, স্বর্গ যে কেবলই জমাট বায়ুস্তর, এটা কোনওমতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। যদি তাই হতো, একা স্বর্গলোক এতগুলো তারা, এবং চন্দ্রসূর্য একসঙ্গে ধ’রে রাখতে পারত না, সেগুলো টুপ্ টুপ্ ক’রে খ’সে পড়তই।’
যুবকও কম তৎপর নয়, তৎক্ষণাৎ সে ব’লে উঠল, ‘ওগুলো তো আলো! বাতাসেরই মতো বলতে পারেন!ওরা প’ড়ে গেলেও কারুর কোনও শারীরিক ক্ষতি হবে না।’
‘আর পৃথিবীর ধ্বসে পড়ার ব্যাপারটা?’
যুবক বলল,‘পৃথিবী জমাট মাটি; উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম―চার প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছ মাটি, কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। আপনি সেই মাটির ওপর হাঁটছেন, দাঁড়িয়ে পড়ছেন, পা দিয়ে ধুপধাপ শব্দ করছেন। মাটি ধ্বসে পড়ার কথা উঠছে কোথা থেকে?’
অবশেষে ভদ্রলোক শান্ত হলেন এবং বলা বাহুল্য, তাঁর পরিবারের লোকজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যুবকের বিবেচনাবুদ্ধির সুনাম শহরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।
এক সময়ে এই বৃত্তান্ত স্বয়ং চুয়াং ৎসে-র কানে পৌঁছল। তিনি মৃদু হেসে বললেন,‘রামধনু, মেঘমালা এবং কুয়াশা, ঝড় এবং বাতাস, ঋতুচক্র ― এগুলি সবই স্বর্গলোকের পুঞ্জীভূত বায়ুর বিভিন্ন আকার। পাহাড় ও পর্বত,নদী ও সাগর, ধাতু ও পাথরখণ্ড, আগুন ও কাঠ, এগুলি সবই ভূখণ্ড থেকে উৎপন্ন। এরা প্রত্যেকে অন্তরীক্ষ ও ধরণীর বিভিন্ন অংশের খণ্ড, এই সত্য জেনেও, কীভাবে বলি যে, তা ধ্বংস হবে না? অস্তিত্বের বিচারে সর্ববৃহৎ, ওই মহাশূন্য ; স্বর্গ ও মর্ত্যলোক তার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। সন্দেহ নেই, সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পর, উভয়েরই অবসান হবে, এবং এ-ব্যাপারেও সন্দেহ নেই যে, কবে তা ঘটতে চলেছে তা এখনই নিরূপণ করা সহজ নয়। তাদের বিনাশ নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়া অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু একই সঙ্গে, কেউ যদি মনে করেন সৃষ্টি অক্ষয়,তা হলে, আমাদের আপত্তির কথা আমাদের জানিয়ে রাখতে হবেই। স্বর্গ ও মর্ত্যের বিনাশ যেহেতু সন্দেহাতীত, সেহেতু এমন একটা দিন আসবেই যেদিন তারা উভয়ই বিলুপ্ত হবে। সেই সময়ে আমরা যদি এখানে উপস্থিত থাকি, তা হলে আমাদের দুর্ভাবনা কি খুব অমূলক?’
ঘটনাচক্রে, লিয়েহ ৎসে-ও ওই একই ঘটনার বিষয়ে জানতে পারলেন, এবং তিনিও মৃদু হাসলেন, বললেন, ‘স্বর্গ ও মর্ত্য একদিন ধ্বংস হবেই, এবং অপরদিকে, তারা কোনওদিনই ধ্বংস হবে না ― উক্তি দু’টিই নির্বুদ্ধিতার ফল। তারা ধ্বংস হবে, না চিরকাল অক্ষয় থাকবে, তা আমরা সঠিক ভাবে কোনওদিনই জানতে পারব না। একদিক থেকে যদি একরকম অভিমত পাওয়া যায়, অপরদিকে পাওয়া যাবে ঠিক এর বিপরীতমুখী অভিমত। যেমন, এটা তো আর অস্বীকার করা যায় না যে, যাঁরা জীবিত তাঁরা মৃতাবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন, আবার, যাঁরা মৃত, জীবিত থাকার বিষয়ে তাঁদের কোনও ধারণাই নেই। আমরা যখন কোথাও প্রবেশ করি, তখন আমরা জানি না, পূর্বেই কারা–কারা সেখানে ঘুরে গেছেন, আবার, সেখান থেকে আমরা যখন প্রস্থান করি, তখন আগামী দিনে সেখানে কারা আসবেন, তা আমাদের অজানাই রয়ে যায় । সৃষ্টি অক্ষয়, না ভঙ্গুর, এ-নিয়ে আমরা কেন ভাবব?’
*
কাঠুরিয়ার স্বপ্নদর্শন
চেং প্রদেশের এক কাঠুরিয়া, নিজের কুটিরের জন্য জ্বালানী কাঠের সন্ধানে জঙ্গলে ঘুরছিল, হঠাৎ তার সামনে ভয়ানক ভীত এক হরিণ এসে উপস্থিত। অসহায় হরিণটিকে সে তৎক্ষণাৎ তীরবিদ্ধ ক’রে বধ করল বটে, কিন্তু মৃত জীবটিকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারল না, কারণ তার আশু প্রয়োজন খাদ্যের নয়, কাঠের। অগত্যা জঙ্গলের মধ্যেই খানাখন্দ খুঁজতে-খুঁজতে, একটা পছন্দসই জায়গা পাওয়া গেল। সেইখানে গাছের ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা দিয়ে সযত্নে হরিণটিকে ঢেকে রেখে, সংগৃহীত কাঠের গোছা মাথায় নিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল, ভাবখানা এই যে, আমার হরিণ কেউ চুরি করতে পারবে না, বাকিটা কাল দেখা যাবে। কাঠুরিয়া অন্যমনস্ক প্রকৃতির মানুষ, বাড়ি ফিরতে-ফিরতে ঘটনাটি সে সম্পূর্ণ ভুলে গেল। পরের দিন অলস মনে স্মৃতি রোমন্থন করতে-করতে হঠাৎ তার মনে প’ড়ে গেল শিকারের কথা। অল্প কথায় বৌকে গতকালের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েই সে দৌড়ল জঙ্গলের দিকে।
কাঠুরিয়া জঙ্গলের ভিতরে পায়ে-চলা পথ ধ’রে হাঁটছে আর বিড়–বিড় ক’রে নিজের মনে ব’লে চলেছে,‘তারপর ডান দিকে ঘুরে ঢালু জায়গাটায় এলাম, রাশি-রাশি শুকনো ফুল পড়েছিল, আরও এগিয়ে গেলাম, এবার বাঁদিকে বেঁকলাম, বাঁদিকে না ডানদিকে? তারপর, তারপর …’। সবকিছু আরও অস্পষ্ট, আরও ধোঁয়াটে হতে লাগল। অবশেষে, কাঠুরিয়া ক্লান্ত হয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে এল, নিজেকে বোঝাল, পুরোটাই স্বপ্ন ছিল বোধহয়, ঐ জঙ্গল, ভয়ে কাঠ হয়ে-যাওয়া ঐ হরিণ! হরিণ হারাবার কোনও দুঃখই অবশিষ্ট রইল না কাঠুরিয়ার মনে, কারণ সমস্তই তো স্বপ্ন।
ওদিকে একটা চোরও ঘুরছিল জঙ্গলে, সে লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঠুরিয়ার পিছু-পিছু যেতে- যেতে তার সব বিড়বিড়ানি শুনতে পেল। কাঠুরিয়া জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাওয়া-মাত্র সে ফিরে গেল সেখানে, কাঠুরিয়ার বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ ক’রে লুকনো হরিণের ঢিবিতে সটান পৌঁছে গেল! কাঁধের দু–দিকে হরিণটাকে ঝুলিয়ে মহানন্দে নিজের বাড়ি ফিরল সে, বৌকে বোঝাল, ‘কাঠুরিয়া স্বপ্ন দেখেছিল যে সে একটা হরিণ শিকার করেছে, কিন্তু হরিণটাকে কোথায় রেখেছে, কিছুতেই তার আর সে-কথা মনে পড়ল না। আমি খুঁজে পেলাম সেই হরিণ! এর থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে যে, কাঠুরিয়ার স্বপ্ন সত্যি।’
তার বৌ খুব বুদ্ধিমতী, সে বলল, ‘তা কেন হবে গো, স্বপ্নটা তুমিই দেখেছিলে। স্বপ্নে তুমি এক কাঠুরিয়াকে দেখেছিলে, যে একটা হরিণ শিকার করেছে। কাঠুরিয়াকে এখন দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু হরিণটা তো আছে ! তার মানে, স্বপ্নটা তোমার এবং সেটা সত্যি।’
চোর সহজসরল মানুষ, এত জটিলতা তার মোটেও পছন্দ নয়। সে জানাল, ‘একটা হরিণ পাওয়া গেছে, সেটাই বড় কথা । স্বপ্ন কাঠুরিয়ার না আমার, জেনে আমার কী লাভ?’
সেই রাতে কাঠুরিয়া একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখল। কোথায় সে শিকার লুকিয়ে রেখেছিল, তারপর কী–কী হল, কে এল, মাটি থেকে কী খুঁড়ে বার করল, কোথায় নিয়ে গেল তার শিকার, সব যেন পর-পর এক জাদুলণ্ঠনে ভেসে উঠতে লাগল! সেই অদ্ভুত স্বপ্নের পিছু-পিছু ছুটে কাঠুরিয়া পৌঁছে গেল চোরের কুটিরে। কাঠুরিয়া তার শিকার ফিরিয়ে দেবার দাবি জানাল, বিস্তর ঝগড়াঝাঁটিতে মুখর হল পাড়া, কিন্তু কোনও ফল ফলল না। অবশেষে রাগে, দুঃখে কাঠুরিয়া আদালতের দ্বারস্থ হল।
প্রধান বিচারপতি দু-পক্ষের জবানবন্দি মনোযোগ সহকারে শুনলেন, তারপর কাঠুরিয়াকে বললেন, ‘প্রথম কথা, আপনি হরিণ বধ করলেন কিন্তু ভুল ক’রে ভেবে বসলেন ওটা একটা স্বপ্ন । দ্বিতীয় কথা, স্বপ্নের মধ্যে হরিণটাকে আপনি খুঁজে পেলেন বটে কিন্তু, এবার ভুল ক’রে ভেবে বসলেন ওটা বাস্তব। অন্য ব্যক্তি আপনার হরিণ নিয়ে চম্পট দিলেন, এবং, এখন, আপনার মালিকানাই তিনি অস্বীকার করছেন। তাঁর গৃহিণী বলছেন, মানুষ এবং হরিণ, উভয়ের অস্তিত্ব কেবল স্বপ্নে, প্রকৃতপক্ষে শিকারের ঘটনাটিরই কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। একটিই বাস্তব এখন আমার সামনে, এই হরিণ। আমার মনে হয়, যিনি হরিণ শিকার করেছিলেন, এবং, জঙ্গল থেকে হরিণটাকে যিনি উদ্ধার করেছিলেন, তাঁরা হরিণটাকে সমান-সমান ভাগ ক’রে নিলে সব দিক থেকে ভাল হয়।
চেং প্রদেশের ভূস্বামীর সভায় বিচারপতির রায়ের খবর পৌঁছল।ভূস্বামী কৌতূহলভরে তাঁর
প্রিয় সভাসদের দিকে ঝুঁকে প’ড়ে, নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,‘পুরোটাই বিচারপতির স্বপ্নদর্শন নয় তো?’
ঘটনার বিবরণ এবং বিচারপতির সুচিন্তিত রায়ের সংবাদ চেং প্রদেশের বাইরে ছড়িয়ে প’ড়ে, অবশেষে দেশের রাজধানীতে প্রবেশ করল। মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে বাদী ও বিবাদী পক্ষের সমস্ত জবানবন্দি এবং বিচারপতির রায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য নিবেদন করা হল। মহামান্য প্রধানমন্ত্রী অভিমত প্রকাশ করলেন, ‘কোন্টা স্বপ্ন আর কোন্টা স্বপ্ন নয়, এ-ক্ষেত্রে তা নির্ধারণ করা আমার সাধ্যাতীত। আমি যতদূর বুঝি, ঘুম এবং জাগরণ পৃথক করতে পারতেন কেবল পীতবর্ণ সম্রাট এবং মহাজ্ঞানী কনফিউসিয়াস, কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁরা কেউই আর ইহজগতে নেই। আপাতত, আমি সম্মানীয় বিচারপতির রায়ের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলাম।’
*
[ঋণস্বীকার: ‘দ্য বুক অফ্ লিয়েহ ৎসে’, সম্পাদনা : এ. সি. গ্রেহ্যাম। লিয়েহ ৎসে সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অপ্রতুল, এমনই যে, অনেকে ধ’রে নিয়েছেন বাস্তব জগতে তাঁর কোনও অস্তিত্বই ছিল না, তিনি চুয়াং ৎসে-র সৃষ্ট এক কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। লিয়েহ ৎসে-র লেখায় কখনও বাস্তব প্রবেশ ক’রে স্বপ্নের জগতে, আবার কখনও স্বপ্ন হয়ে ওঠে কঠিন বাস্তব। তাঁর লিখনভঙ্গিমাই লেখকপরিচয়ে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে কি না, কে বলতে পারেন! একটি বিকল্প হিসেবে ভেবে নেওয়া যেতে পারে, তিনিও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে হোনান জেলার অন্তর্গত ঝেং প্রদেশে জন্মেছিলেন এবং মধ্যবয়স পর্যন্ত প্রতিবেশীদের বাইরে তাঁকে কেউই চিনতেন না, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে তাঁকে এ-জেলায় ও-জেলায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। আজ সে পরিস্থিতি নেই, তাও/ডাও ধর্মের তিন স্থপতির মধ্যে তাঁর স্থান সংশয়াতীত, অন্যরা হলেন যথাক্রমে লাও ৎসে ও চুয়াং ৎসে। মানুষের বিশ্বাস, লিয়েহ ৎসে বাতাসের পিঠে চ’ড়ে বেড়াতেন। ]
পুনর্লিখন : গৌতম বসু
অপূর্ব, অপূর্ব! বিশেষত দ্বিতীয়টি।