রামজি’র হার ও একটি হাহাকার <br /> পার্থজিৎ চন্দ

রামজি’র হার ও একটি হাহাকার
পার্থজিৎ চন্দ

জীবনে নদীর থেকে দূরে গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারিনি। যে নদীর পাশে জন্মেছিলাম সেখানে ছিল বহু ভাষাভাষী, বহু-ধর্মের (মূলত) শ্রমিকদের বসবাস। তাই গঙ্গা-স্নান করে উঠে ‘রামচরিতমানস’ পাঠের সুর অথবা দু’জন মানুষের দেখা হলে রামের নামে একে অপরকে সম্বোধন করা ইত্যাদির উদাহরণ দিয়ে অনেককে বেশ চমকে দেওয়া গেলেও অনেকে যে ‘চমকে’ উঠে এ-বিষয়টিকে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পক্ষে অকাট্য যুক্তি বলে মানবেন না সেটিও স্বাভাবিক। এসব নিচু-যুক্তিবাদিতার কাছে আমরা বারবার পরাজিত হচ্ছি। নিচু মুখে মেনে নিচ্ছি নিচু-স্তরের যুক্তিকে। এমনকি ‘অন্য ধর্মের’ উদাহরণ দিয়ে যখন যুক্তি পেশ করা হচ্ছে, তলে-তলে রামমন্দিরকে জাতীয় আবেগের প্রকাশ বলে অভিহিত করা হচ্ছে তখনও আমরা ভুল যুক্তির ফাঁদে পড়ে ছটফট করছি।
আমি বিশ্বাস করি না রামমন্দির প্রতিষ্ঠার নামে এই উদযাপন বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা; এ আসলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ইউজেনেস্ক-নামক গোপন দানবের বহিঃপ্রকাশ। একই ঘটনা ঘটে চলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে, মধ্যপ্রাচ্যে। আফ্রিকায়। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে। রেস-থিয়োরিস্টস্-দের পক্ষে এমন সুসময় ইতিহাসে আর আসেনি। এবং সব থেকে বেশি চিন্তার, ইনফরমেশন বিস্ফোরণের ফলে একদিকে যেমন তথ্য আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসছে মুহূর্তে; ঠিক তেমনই অদৃশ্য, প্রায় উন্মোচন করা যায় না এমন এক ধাতব পর্দাও ঢেকে রেখেছে সত্য ও তথ্যের মুখ। তলে-তলে কী যে ঘটে যাচ্ছে তার হদিশ ও পরিচয় পেতে আমাদের হয়তো আরও কয়েক দশক সময় লেগে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানুষকে মানুষের ঘৃণা করার, মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য বিস্তার করার একটা অজুহাত চাই-ই চাই। সে মন্দিরের নামে হোক বা মসজিদের নামে।
আপাতভাবে মনে হতে পারে একটি মন্দির, যাকে কেন্দ্র করে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে যুদ্ধ, দাঙ্গা, হত্যা ইত্যাদি ঘটেছে সেটি নির্মিত হলে কী আর এমন ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে সেটি ঘটছে এমন এক ভূখণ্ডে যেখানে সংখ্যাগুরুর ধর্ম ‘মন্দিরের’ ধর্ম। আপাতভাবে এটিও মনে হওয়া স্বাভাবিক এবং তলে-তলে অনেকে এটি বিশ্বাস করে ফেলেছেনও যে রাম আসমুদ্রহিমাচলের আবেগকে ধারণ করে রয়েছেন। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হিসাবে একে গণ্য করার মানুষও কম নেই।
অনেকে আবার স্বয়ং গান্ধীজির উদ্ধৃতি ও উচ্চারণ তুলে ধরে প্রমাণ করতে চাইছেন, জাতির জনক যখন্ রামের নামে এতগুলি কথা বলেছেন, রাম’কে স্বীকার করে নিয়েছেন তখন রামমন্দির প্রতিষ্ঠায় সমস্যা কোথায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ‘প্রদত্ত তথ্য’ ও বিশ্লেষণ। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট। ফলে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা যে এক ধরণের সিদ্ধ কাজ সে নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকছে না কোথাও।
কিন্তু সব থেকে বড় সন্দেহ ও হাহাকারের অবকাশ থেকে যাচ্ছে মানবতা নামক এক ‘কল্পিত’ বিষয়ের ভেতর। এ-পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মানবতা ও মুক্তিচিন্তাকে কল্পিত হিসাবে গণ্য করা ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশ নেই।
কেন হাহাকার?
কারণ, এখানে থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ডিজাইন; এই মন্দির আসলে রাম’কে কেন্দ্র করে নির্মিত হচ্ছে না। এমনকি এই যুদ্ধ যদি পাঁচশো বছর ধরে চলে এসে আজ এই ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ সমাপ্ত হয় তা হলেও এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মানুষের আধিপত্যবাদের প্রকাশ। এখানে আসলে জয়ী হচ্ছে দাঁত-নখ-সংখ্যা-অপযুক্তি ও ঘৃণার দানব।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও দিন কোনও আধিপত্যবাদীর উগ্র প্রচারক ও সংস্থাপক ‘মানুষের সমর্থন’ ছাড়া ক্ষমতায় আসেনি। দিন যত বদলেছে, যত ‘অগ্রসর’ হয়েছে মানুষ তত তার সমর্থনকে ‘কনসলিডেট’ করার পদ্ধতি বদলেছে। আধিপত্য বিস্তার করার পদ্ধতি হিসাবে সব থেকে সুলভ ও সহজ হাতিয়ার যে ‘ধর্ম’ তা নিয়ে কোনও দ্বিধা থাকেনি শাসকের মনে। এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পাবলিক-ডোমেনের বাইরে থেকে বিকল্প তথ্য ও প্রণোদনা আমদানি করা জরুরি। তারপর তাকে পাবলিক- ডোমেনে নিয়ে এসে ‘চ্যাম্পিয়ন’ করার কাজটি চলতে পারে প্রকাশ্যে। রামমন্দির প্রতিষ্ঠার আড়ালে বা প্রকাশ্যে যে ‘রাম’এর নির্মাণ তা এ-পথেই ঘটেছে।
এ-পথে ঘটা রামমন্দিরের নির্মাণ যদি সঙ্গত হয়ে থাকে তা হলে ভারতের কোণে-কোণে অন্তত কয়েক লক্ষ রামমন্দিরের নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ত। তা হয়নি। হবেও না। কারণ রাম-কে ভারতীয় হিন্দু আবেগের সঙ্গে যুক্ত করা এই পদক্ষেপের কেন্দ্রে ছিল না; আজও নেই। এখানে রাম, বারবার বলার, এক উপলক্ষ্য মাত্র। আসল উদ্দেশ্য- সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ সুনিশ্চিত করা ও তার সাপেক্ষে একটি নিদর্শন স্থাপন করা।
আর তার পরেও যা ভয়ংকর তা হল, ইতিহাসের গর্ভ থেকে দাঁত-নখ-রক্তের নিদর্শন তুলে এনে এই পদক্ষেপকে ‘জাস্টিফাই’ করা। ১৫২৮ সালে বাবরের সেনাপতি মির বাঁকি’র ‘মন্দির’ ধ্বংস করা, ১৬২৭ সালে ব্রিটিশের চোখে অযোধ্যায় হিন্দুদের পূজা-ইত্যাদি, ১৮৫৫ সালে হনুমানগড়ি-তে দাঙ্গা মানুষের মুখে-মুখে ঘুরছে। অদ্ভুত ডিসকোর্স নির্মাণ করা হচ্ছে; একদিন যদি এই মন্দির ভেঙে মসজিদ স্থাপিত হতে পারে তো আজ সেই স্থানে ‘বিতর্কিত’ কাঠামো ভাঙার পর মন্দির নির্মাণ হওয়া ‘জায়েজ’। শুধু তাই নয়, ভাটিক্যান সিটি যদি ক্রিশ্চানদের প্রাণকেন্দ্র হতে পারে, আল-মসজিদ আল-আসকা যদি এক ধর্মের হাত থেকে মুসলিমদের দখলে চলে গিয়ে তাদের তৃতীয় পবিত্র ধর্মস্থান হিসাবে গণ্য হতে পারে তা হলে বিতর্কিত কাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়ে রামচন্দ্রের নামে মন্দির পুনরুদ্ধার করার মধ্যে অন্যায় কোথায়?
অন্যায় আসলে কোথাও নেই; রয়েছে সভ্যতার ধারণার মধ্যে।
যদি ধরে নেওয়াও যায় যে রামচন্দ্র ঠিক ওই স্থলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মির বাঁকি তাঁর ‘গৃহ’ কেড়ে নিয়েছিলেন, গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন রামচন্দ্রের বাসস্থান, প্রায় অনাথ করে ছেড়েছিলেন তাঁকে তবু স্বীকার করতেই হবে কোটি-কোটি ভারতবাসীর মন থেকে তাঁকে উপড়ে ফেলতে পারেননি মির। তিনি তুলসীদাস থেকে কৃত্তিবাস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছেন হাজার-হাজার বছর ধরে তাঁর সব দোষ-গুণ নিয়েই। বিতর্কিত কাঠামো ধ্বংসের পর এক আন্তর্জাতিক টিভি-সংস্থার তরফে নেওয়া সেই বৃদ্ধার সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ছে এ-মুহূর্তে, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এই কাঠামো ভেঙে ফেলার অনুভূতি ঠিক কী তাঁর কাছে।
ভারতবর্ষের ‘মা’ উত্তর দিয়েছিলেন, সারা পৃথিবীই যাঁর বাসস্থান, তাঁর ‘বাসস্থান’ নির্মাণ করতে গিয়ে একটা কাঠামো ভেঙে ফেলতে হল!
হাজার-হাজার বছর ধরে রামচন্দ্র ঠিক এখানেই জিতে গিয়েছিলেন, তাঁর হাজার বাজার বছরের আয়ুতে এই প্রথম তিনি পরাজিত হচ্ছেন। পরাজিত হচ্ছেন কোনও বিধর্মীর হাতে নয়; ‘নিজের’ ধর্মের মানুষের হাত ধরে। কোনও পার্থিব উদাহরণ দিয়েই এই পরাজয়কে বোঝানো যাবে না; হৃদয়ের প্রেম ও আলো ছাড়া যেমন রবীন্দ্রনাথের গানকে আত্মস্থ করা যায় না, ঠিক তেমনই হৃদয়ের উদারতা ও সংকীর্ণতাকে বিসর্জন না-দিলে আপাত-জয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এ-পরাজয়কেও অনুধাবন করা যাবে না।
আজ আমাদের অভিশাপ তাড়া করে বেড়াচ্ছে; উদাহরণের অভিশাপ। কাশী-মথুরা-বৃন্দাবন থেকে শুরু করে আরও হাজার-হাজার স্থানে এ-অভিশাপ একদিন না-একদিন আরও তীব্র হবে। সে অভিশাপ অনবরত বলে যাবে- যারা তোমার ধর্মস্থান গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ‘করে’ নিয়েছে এবার তাদের বিরুদ্ধে পালটা আক্রমণ শানাও। ভুলে যাও যে সময়ের নিজস্ব একটি ধারা আছে; সে প্রথমেই মুছে দেয় অসহিষ্ণুতাকে। দেয় বলেই মাত্র পাঁচশো বছর আগে ভেঙে দেওয়া তাঁর ‘জন্মস্থানে’ তিনি আটকে থাকেন না। তিনি ভারতের ধূলিকণায় মিশে রয়েছেন। মিশে রয়েছেন আরও অনেক ধর্মের পাশাপাশি’ই। কোথাও তিনি সুপারলেটিভ ডিগ্রি আকাঙ্ক্ষা করেননি। ঠিক কতটা মিশে রয়েছেন তিনি?
এই দুঃসময়ে মনে পড়ে, বহুবছর আগের ঘটনা। ছোটনাগপুরের একটি ছোট্ট জায়গায় গেছি। গ্রীষ্মের বিকেল; খর রোদ। ঘুরতে-ঘুরতে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম একটি টিলার কাছে তিরতির করে জল বইছে একটি নালা দিয়ে; স্থানীয় বাচ্চারা, ল্যাংটো-বাচ্চারা আমাদের দেখিয়েছিল ‘সীতা-ঝর্না’।
এখানেই সীতা-মা রামচন্দ্রের সঙ্গে বনবাস-কালে রান্নাবান্না করে খেয়েছিলেন। লক্ষ্মণ ‘ওই ওখানে’ ঘুরে বেড়াতেন।
এখানেই ‘তাঁর’ জিতে যাওয়া ‘ছিল’। অস্বীকার করার উপায় নেই, অস্বীকার করছিও না যে বহু ধর্মের ক্ষেত্রেই ধর্মাচারণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের বেশি প্রয়োজন। এই বিষয়টি সে ধর্মগুলির অন্তর্গত বিষয়। রামচন্দ্র, হিন্দু-দেবতা হিসাবেও যদি তাকে সংকীর্ণ করে তুলি তা হলেও বলতে হয়- তাঁর ক্ষেত্রে এমন কোনও ‘প্রতিষ্ঠান’ বা স্ট্রাকচারের প্রয়োজন হয়নি কোনও দিন। এটি’ই তাঁর ‘অন্তর্গত প্রতিরোধ’; পবিত্র অর্থে জয়ের জায়গা।
যারা আজকে নিজেদের জয়ী বলে মনে করছেন তারা মনে রাখুন, রাষ্ট্র তো অনেক সীমাবদ্ধ বিষয়; পৃথিবীর সমস্ত বিচার ব্যবস্থার থেকেও অধিকতর ক্ষমতাশালী ও পবিত্র এক বিচার সময়ের হাতে রয়েছে। কালের হাতে রয়েছে। সেখানে সমস্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেগে রয়েছে মহাকাল। হাজার, দু’হাজার বছরের ইতিহাস সেখানে ছোট ঢেউ মাত্র। ধর্মান্ধ স্বৈরাচারী শক্তি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেয়। লক্ষ-লক্ষ মানুষের রক্ত ঝরে। সেই ‘কাল’ নীরবে নজর রাখে; মুছে দেয় অত্যাচারীকে।
শুধু এই ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছি, পোস্ট-কলোনিয়াল ভারতের এক বিরাট অংশের মানুষ নিশ্চয় তলে-তলে এর প্রতি সমর্থক ছিল। তাই সে-শক্তি আজ ‘জিতে’ গেল। হয়তো সারা পৃথিবী জুড়েই দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্তের নির্ভুল প্রকাশ এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মান্ধতার বাড়বাড়ন্ত। অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়ার সংস্কৃতি। আপাতত প্রস্তুত থাকুন, এ-পথ ধরে জীবনের মহত্তর গান শোনার অবকাশ কমে গিয়ে ক্রুদ্ধ, পাশবিক উল্লাস শোনার। শুনতে-শুনতে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ার। চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়ার দ্বিমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
সত্যিই তো, এক-পক্ষ পড়ে পড়ে মার খাবে কেন? এবার থেকে সে রামের নামে মারবে, রহিমের নামেও মারবে। শুধু রামচন্দ্র-নামে ভারতের পথেপ্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা যে ভালমন্দ-মেশা ‘বোধ’ তা গুমরে কাঁদবে।
হয়তো রামজি একদিন সে মন্দির থেকে বেরিয়েও আসতে পারেন, রাত্রে। চিৎকার করে বলতে পারেন, আমাকে বিজেতার ‘আইকন’ বানিয়ে, ক্ষমতার আইকন বানিয়ে এত ছোট একটা ঘরে বন্দি করল কে? আমি জীবনে বহুবার পরাজিত হয়েছি; প্রেমের কাছে পরাজিত হয়েছি, নৈতিকতার কাছে পরাজিত হয়েছি, নিয়তির কাছেও পরাজিত হয়েছি। কিন্তু সে সব মহা-পরাজয়; সে সব পরাজয় ‘জয়ের’ থেকেও অনেক বড়।
আমাকে এতটা নিচু-স্তরে নামিয়ে এনে সমবেতভাবে পরাজিত করল কারা?
যে রামচন্দ্র আমার মাতামহীর কণ্ঠে ছিলেন, তিনি নিশ্চয় অভিশাপ দেবেন।
হয়তো আজ থেকেই এক অভিশপ্ত জাতির উপর ঝরে পড়া সে অভিশাপ শ্রুত হতে শুরু করবে।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Sangita Dutta 12 months

    যথার্থ লেখা। আজ ভোর থেকে ভীষণভাবে উপলব্ধি করছি।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes