মোমেনশাহী উপাখ্যান; বিহঙ্গ বীক্ষণে
::সত্যবতী গিরি
শিল্প-সাহিত্যের সার্থক সফল ও স্বাদু হয়ে ওঠার বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম হলো ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। উত্তরাধিকারী শিল্পী সাহিত্যিকরা কখনও পুরাণ-মহাকাব্য থেকে, প্রাচীন ইতিহাস থেকে, কিংবদন্তী থেকে, আবার কখনও পূর্ববর্তী সাহিত্য থেকেও উপাদান সংগ্রহ করে তাঁদের সৃষ্টির সমকালীনতার মধ্যে নতুন জীবনবোধের সঞ্চার ঘটান। এই সঞ্চার লক্ষ করা যায় ‘পতিতা’ কবিতায়, ‘কালসন্ধ্যা’, ‘অনামী অঙ্গনা’ নাটকে, ‘রাজর্ষি’র মতো উপন্যাসে। দৃষ্টান্ত অজস্র আছে, দৃষ্টান্ত না বাড়িয়ে বলা যায় আধুনিক সাহিত্যিকরাও সেই একই কাজ করে চলেছেন। তাঁদের প্রাতিস্বিক অনুভব আর উপলব্ধি পুরোনো সাহিত্যকেই সমকালীনতার প্রাণরসে সঞ্জীবিত করছে। এই ধরণেরই একটি সৃষ্টি ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’, কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের সাম্প্রতিকতম উপন্যাস।
পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়মনসিংহ গীতিকার কবিরা কাব্য ও সঙ্গীতরূপে যে অপূর্ব আখ্যান রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে চিরকালের জন্য সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন তার বিষয় আর কাহিনি অবশ্যই আধুনিক উপন্যাসের বিষয় হতে পারে। লেখক প্রথমে তাই-ই ভেবেছিলেন। ময়মনসিংহের নাম আগে ছিল মোমেনশাহী— সেই পুরনো নামে তিনি উপন্যাসের নাম রেখেছেন ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’; কিন্তু এই কাহিনিকে শেষপর্যন্ত তিনি আর নিছক গীতিকার নবরূপায়ণে আবদ্ধ রাখতে পারেননি।
পূর্ববঙ্গ ও ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগুলি সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকে তুলে ধরলেও সেগুলি বিশেষভাবে নরনারীর প্রেমের উপাখ্যান, কিন্তু এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে ঔপন্যাসিক যে উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন তা তাঁর নিজের কথাতেই বলা যাক : ‘‘ঋণগ্রস্ত কৃষকের কথা খুঁজতে গিয়ে দেখি গীতিকার বাইরে ময়মনসিংহে রয়েছে কৃষক বিদ্রোহ, হাতিখেদা বিদ্রোহ, জমির টঙ্কপ্রথার বিরোধী আন্দোলন…’’। এগুলো সবই ঘটেছিল গারো পাহাড় ঘেরা ওই ময়মনসিংহ অঞ্চলেই। তাই তাঁর এই উপন্যাসে গীতিকার আখ্যান ঘুরেফিরে এলেও সংগ্রামলিপ্ত জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত মানুষদের বেদনা আর হাহাকার, তাঁদের প্রতিবাদ কাহিনির মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ, চূড়ান্তভাবে শোষিত সাধারণ মানুষের লড়াই লেখকের নিজের কথায় ওই অঞ্চলের জীবনকে মহিমময় করে তুলেছে। ফলে তাঁর উপন্যাসের পরিসর অনেক বৃহত্তর পরিধি পেয়েছে। একটা অঞ্চলকে নিয়ে লেখা হলেও এই উপন্যাস কিন্তু কোনওমতেই আঞ্চলিক উপন্যাস নয়। যুগে যুগান্তরে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইকে ধারণ করে এটি হয়ে উঠেছে মহাকাব্যিক উপন্যাস।
এই উপন্যাসকে ঔপন্যাসিক কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করেছেন। প্রথম পর্বের নাম ‘পাতাল— আন্ধার বৃত্তান্ত’, দ্বিতীয় পর্ব ‘লীলাবতী খবরিয়া ও আয়নাবিবির বৃত্তান্ত’, তৃতীয় পর্বটি হল ‘বুনো হাঁসের উড়াল’। উপন্যাসে ময়মনসিংহ গীতিকার বিভিন্ন পালা থেকে যেমন উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তেমনই লেখক নিজেও পালার মতো করে কিছু গান নিজেই সৃষ্টি করে উপন্যোসে যুক্ত করেছেন।
কাহিনি কিন্তু শুরু হয়েছে কলকাতার কলোনি অঞ্চলে। কলকাতার উপকণ্ঠে যে অঞ্চলগুলি শিকড়বিচ্যুত পূর্ববঙ্গের মানুষদের বাসভূমি হয়ে উঠেছে সেইসব অঞ্চলের একটিতেই কাহিনি শুরু। সোমেশ্বরী সেই অঞ্চলের নাম। এই সোমেশ্বরী আসলে পূর্ববঙ্গেরই একটি নদীর নাম। মানুষ তার নিজের স্থানকে, পূর্বপুরুষের বাসভূমিকে ত্যাগ করতে বাধ্য হলেও তাকে বহন করে রক্তের গভীরে, তাই নদীর নামে নাম হয় উপনিবেশের। এই সোমেশ্বরী উপনিবেশেরই একজন সুধীন্দ্র সোম, তাঁর পুত্র আমেরিকা প্রবাসী। সে এখন সেখানকারই নাগরিক। এইভাবে মানুষ নানা কারণে বারবার ঠিকানা বদল করে; কিন্তু তবুও তার অস্তিত্বের গভীরে বয়ে যেতে থাকা সেই পুরনো স্মৃতিকে সে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাই সোমেশ্বরী কলোনির সুধীন্দ্র লিখে ফেলেন ময়মনসিংহের কাহিনি আর উপন্যাসের সূত্রধর বিপুলকে প্রকারান্তরে জানাতে চান নিজের সঙ্গে তাঁরও পিতৃকুলের দেশের কথা।
ময়মনসিংহ গীতিকার যে পালাগুলি আগের আগের শতাব্দীতে লেখা হয়েছে তার মধ্যে প্রায় সব পালাতেই সমকালীন নানা ঘটনার মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে নরনারীর প্রেম, আর একবিংশ শতাব্দীর এক কথাকার সেই অঞ্চলেরই ভিন্ন ইতিহাস নিয়ে গদ্যে রচনা করলেন উপাখ্যান। এই উপাখ্যানের মাঝে মাঝেই লেখক তুলে এনেছেন গীতিকার উল্লেখযোগ্য পঙ্ক্তি। আবার সেই সঙ্গে যুক্ত করেছেন গীতিকার পঙ্ক্তিগুলির মতো করে লেখা টুকরো কবিতা। ঔপন্যাসিকের লেখা এই টুকরো টুকরো লেখার বৈশিষ্ট্য হল তার ঐতিহাসিক পরিসর ১৯৪৬ পর্যন্ত। তিনি লেখেন— ‘‘মণি সিং ডাক দিইসে।/টঙ্ক দিতা না কইসে।।/ব্যাস্টিন এক ব্যাঘ্র হলো।/ চাষার হাতে জব্দ হলো।।’’ (পৃ. ৩১৯)। এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কিত তথ্য ঔপন্যাসিক উপন্যাসের শেষে কালানুক্রমে উল্লেখ করেছেন। তাঁর কালানুক্রমে আমরা দেখতে পাচ্ছি ময়মনসিংহ ও গারো পাহাড়ে ১২৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে এই উপাখ্যান। শুধু গীতিকার কাহিনি নয়; এতে আছে নানা কিংবদন্তি, নানা লোকবিশ্বাস আর সেই সঙ্গে জাদুবাস্তবতার অপূর্ব মিশ্রণ। এই উপন্যাসে প্রেমের কাহিনিতেও আছে অনন্যতা।
রানি কমলার পালা থেকে তৈরি হয়েছে রাজা জানকীনাথ আর কমলার প্রেমকথা। স্বামীর ও স্বামীর রাজ্যের কল্যাণের জন্য তাঁর আত্মবিসর্জনের ঘটনা একটি পৃথক উপন্যাসের কাহিনিও হতে পারত। কিন্তু ঔপন্যাসিক এই আত্মবিসর্জনের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চান ১৯৪৭-এর ৩১ জানুয়ারিতে ঘটা হাজং মাতা রাশিমণির আত্মোৎসর্গকে। ইতিহাস, কিংবদন্তি আর বাংলার এক অংশের মানুষের টঙ্কপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে এইভাবেই তিনি একসঙ্গে মিশিয়ে দেন। মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে দুই বৃত্তান্তই। রানি শুধু তাঁর দাসীদের নয়, ‘‘শুক শারি দুই পক্ষীকে বললেন, মুর বাপ ঘরৎ ছিলি তুরাও পক্ষী, মুর সাথে আইলি, মুর ছোঁয়ারে মা ডাক শিখাবি পক্ষী, মা ডাকিয়া কান্নার সময় আদর দিবি পক্ষী।’’ (পৃ. ১০৬)।
এই উপন্যাসে সুধীন্দ্রর স্ত্রীর নাম কুমুদিনী। অন্যদিকে টঙ্কপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যেও আছেন হাজং কুমুদিনী। কুমুদিনীকে বাঁচানোর জন্য, তাঁর সম্মান রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জন দিলেন হাজং নেত্রী রাশিমণি। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রানি কমলার আত্মবিসর্জন আর বিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময়ে হাজং মাতা রাশিমণির আত্মোৎসর্গ যেন এক প্রবহমান ইতিহাসকে তুলে ধরে।
টঙ্কপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি এই উপন্যাসে এসেছে হাতিখেদার আন্দোলন। দরিদ্র হাজংদের দিয়ে গারো রাজারা বনের হাতিকে বন্দি করাতেন, এর মধ্যেও রাজাদের শোষণ ও অত্যাচারের নিষ্ঠুরতা। ১৭৭০-এ রাজারা হাজং উপজাতিকে সুসঙ পরগনায় বসবাসের অনুমতি দিয়েছিলেন। বিনিময়ে বিনা পারিশ্রমিকে রাজাদের জন্য হাতি ধরে দিতেন তাঁরা আর রাজারা সেই হাতি ভেট দিয়ে বা প্রচুর টাকায় বিক্রি করে নিজেদেরকে আরও সম্পদের অধিকারী করে তুলতেন। এর বিরুদ্ধেও হাজংরা বিদ্রোহ করেন বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এর বাস্তব অর্থনৈতিক কারণ হল, হাতি ধরার কাজে নিযুক্ত হাজংরা জমি চাষ করে নিজেদের খাদ্য যোগাড় করার সময় পেতেন না; আর একটি কারণ লোকবিশ্বাস। তাঁরা মনে করতেন, ‘‘হাতি ধরে হাতির পায়ে শিকল পরালে পাহাড়ের কষ্ট হয়। গারো পাহাড়ের চোখের পানি থেকেই সিঙসাঙ নদীর জন্ম।’’ আর তাঁদের বিশ্বাসে গারো পাহাড়ও আসলে এক বুড়ো হাতি। বার্ধক্যের ভারে সে নিশ্চল হয়ে গিয়েছে। তাই হাতিখেদার বিরুদ্ধেও তাঁদের মধ্যে যে বিদ্রোহ দেখা দিল তার নেতৃত্ব দিলেন মনা সর্দার। কিন্তু পরিণামে তাঁকে হাতির পায়ের তলাতেই পিষে মারা হল। এই উপন্যাস তার কাহিনিবৃত্তে ধারণ করে আছে হাজংদের ধারাবাহিক বিদ্রোহ আর আন্দোলনকে। তাই নিঃসন্দেহে এটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মর্যাদাও পেতে পারে।
এই বিদ্রোহগুলোর সঙ্গে আবার মিশে আছে আর এক বিদ্রোহী প্রেমের কাহিনি। তার নায়িকা লীলাবতী, নায়ক অথৈচন্দ্র। বৃদ্ধ যৌনক্ষমতাহীন গণৎকার ত্রিলোচন শর্মার তৃতীয়া স্ত্রী যুবতী লীলাবতী। অথৈচন্দ্র হাজংদের আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় সমর্থক আর কর্মী। শাসকশক্তির বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গে সে তার প্রেমকে সফল করার জন্য তথাকথিত বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহী। তার এই বিদ্রোহকে সর্বাঙ্গীণভাবে সমর্থন করে লীলাবতী। সে বলে: ‘‘বনের হাতি বনে রহুক, বনের পাখি বনে রহুক, উহাদের ধরা ঠিক না পাপ হয়।’’ (পৃ. ১৪৪)। তাদের এই বিদ্রোহ সম্পর্কে বিপুলের অভিমত হল যে, সংশয়ের যুগে মানুষ অনেক বেশি পরিমাণ বিচার করছে তার সংশয় থেকেই। হাতিখেদা আন্দোলন, টঙ্কপ্রথা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে হাজংদের ক্রীতদাস করে রাখার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীন করার আন্দোলন।
উপন্যাসে অথৈচন্দ্র ও লীলাবতীর বিষামৃতময় আখ্যান যেমন নতুন মাত্রা যোজনা করে। আরও দুটি চরিত্র প্রবুদ্ধ আর সুবুদ্ধ এই কাহিনিতে নতুন মাত্রা এনে দেয়। তারা বাস্তব হয়েও যেন বাস্তবের নয়। তাদের একজন রাজার পেয়াদার অত্যাচারের কথা বলে, সে সুবুদ্ধ। কিন্তু প্রবুদ্ধ বলে পেয়াদা যেন ‘মলুয়া’ গীতিকার নায়িকা মলুয়ার ভাই, সে-ই চাঁদ বিনোদকে উদ্ধার করে এনেছিল জমিদারের লেঠেলদের হাত থেকে। সুবুদ্ধ আর প্রবুদ্ধ যেন মানুষের অন্তর্লীন সত্তার প্রতীক। এই সত্তা একটি ঘটনার বিশ্লেষণে কখনও এক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না, তাই শেষপর্যন্ত তারা বিবাদ করতে করতেই কুয়াশায় মিলিয়ে যায়।
এই উপন্যাসে খবরিয়া বা সংবাদ-সংগ্রহকারী ও সংবাদ ছড়িয়ে দেয় যে ব্যক্তি সে তার নামের সঙ্গে যুক্ত করেছে ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক চন্দ্রকুমারের নাম। এই চন্দ্রকুমার-আয়নাবিবির উপাখ্যান উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশটিকে অনেকখানি গড়ে তুলেছে। দুই বালিকার জননী আয়নাবিবি খুঁজে বেড়ায় তার নিরুদ্দিষ্ট স্বামীকে। সে আরবে অর্থসংগ্রহের জন্য গিয়ে আর আয়নাবিবির কাছে ফিরে আসেনি। আশ্রয়হীন, গৃহহীন আয়নাবিবিকে খবরিয়া চন্দ্রকুমার নিজের গৃহেই ডেকে নিয়েছে স্বপ্রেমে; দয়া বা করুণা থেকে নয়। নিজের জীবনের এই উপাখ্যানের সঙ্গে অর্থাৎ আয়নাবিবিকে গ্রহণ করার সঙ্গে সে তুলনা করেছে গীতিকার কাহিনি। চন্দ্রকুমারের মধ্যে তার মেয়েরা ফিরে পায় নিজেদের পিতাকে।
মণিসিং টঙ্কপ্রথা আন্দোলনে কৃষকদের নেতা ছিলেন। হাজং কৃষকদের আন্দোলনকে তিনি মানবমুক্তি আন্দোলনে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। জমিদারপুত্র আর রাজ পরিবারের ভাগিনেয় মণিসিং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ বিষয়ে উপন্যাসের শেষে কালানুক্রম অংশে ঔপন্যাসিক বিস্তৃত তথ্য দিয়েছেন। এই তথ্যও হয়ে উঠেছে তাঁর উপন্যাস পাঠের সহায়ক। একদিকে গীতিকার আবহ অন্যদিকে কিংবদন্তি আর লোকবিশ্বাস যেমন তাঁর উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই এক বিক্ষুব্ধ সময়ের বিশ্বস্ত ঐতিহাসিক ইতিবৃত্তও লেখক তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে।
এই উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কমিউনিস্ট লেখকরাও। উপন্যাসের অজস্র চরিত্র উপন্যাসের পাঠের সময় যেন জীবন্ত হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। বৃদ্ধ গণৎকারের তিন স্ত্রী থাকার পরেও বিবাহবাসনা, তার স্ত্রী লীলাময়ী বা লীলাবতীর বিদ্রোহ, কুমুদিনী সোম, অতীনের সঙ্গে বিপুল, সুবুদ্ধ-প্রবুদ্ধ, খবরিয়া চন্দ্রকুমার, আয়নাবিবি, দুই বোন রুমি ও ঝুমি প্রত্যেকেই নিজস্ব স্বতন্ত্র আইডেন্টিটিতে চিহ্নিত হয়ে আমাদের মনোযোগ দাবি করে। মিছিল করে নেত্রকোনায় যাওয়া, পিঠে বাচ্চা বাঁধা হাজং মা আর তির-ধনুক নিয়ে আসা হাজং পুরুষ সবাই মিলে জনসমুদ্র তৈরি করে টঙ্কপ্রথার বিরুদ্ধে নেত্রকোনার কৃষক সম্মেলনে নিজেদের দাবি নিয়ে সম্মিলিত হয়। উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের সম্পর্কে বলেন: ‘‘প্রকৃত যুদ্ধ মানুষে করে, আমি সেই সেনানিদের দেখতে এলাম।’’ (পৃ. ২৭৭)।
অন্যতম নেতা ললিত হাজং মানিককে বলেন তাঁদের এই যুদ্ধের কথাও লিখতে। এই ঘটনা দেশভাগের আগের। দেশভাগের কয়েক বছর পর মানিক লেখেন ‘হারানের নাতজামাই’, ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’-র মতো লেখা।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘জনযুদ্ধ’-এ এর প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এইভাবে দুর্গম গারো পাহাড়ের বিপুল রহস্যময়তার পাশাপাশি শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে হাজংদের প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ যুক্ত হয়ে যায় সারা পৃথিবীর শোষিত মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে, কম্যুনিজমের আদর্শবাদের সঙ্গে।
এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের সৃষ্টিক্ষমতা যেন শিল্প-সফলতার চূড়ান্ত স্তরকে স্পর্শ করেছে। তীব্র সংগ্রামী বাস্তব আর এক মায়াময় মোহময় রোমান্টিকতার স্নিগ্ধ আবেদন একসঙ্গে মিলেমিশে যেন এক আশ্চর্য রসমোক্ষণ ঘটেছে এই উপাখ্যানে। ‘মলুয়া’ গীতিকার নতুন ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। কোড়া শিকার করতে যাওয়া অভাবী চাঁদ বিনোদ গৃহত্যাগ করেছিল আসলে টঙ্কপ্রথার জন্যই। জমিতে ফসল না হলেও খাজনা দিতে হবে তাই চাঁদ বিনোদের পলায়ন। গীতিকা শুধুই প্রেমের উপাখ্যান নয়— এই সত্যই প্রমাণ করেছেন ঔপন্যাসিক। আবার চন্দ্রকুমার খবরিয়ার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ময়মনসিংহ গীতিকার গান গাওয়াতেও বাধা আসছে শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে।
এই উপন্যাস স্বাধীনতার অব্যবহিত সময়ে অত্যাচারী কালেক্টরের কথা বলে। চলে যাওয়ার আগে ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচারের প্রতিনিধি এই কালেক্টর ব্যাস্টিন। ব্যাস্টিনের অত্যাচারী পিতামহ আর তার আজ্ঞা পালনকারী ব্ল্যাকির মাধ্যমে ঔপন্যাসিক যেন বোঝাতে চান ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর থাকবে না। ব্ল্যাকি শেষপর্যন্ত তাই হয়ে যায় কালো হাঁস। লঙ্কেশ্বরের স্ত্রী কুমুদিনীকে দেখে তার মনে পড়ে যায় দিদি জুলিয়ার কথা। কুমুদিনীকে সে বাঁচাতে চায় কিন্তু পারে না। সিঙসাঙ তথা সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে আসা বুট পরা মিলিটারিরা ভেঙে দেয় কৃষক সমিতির অফিস। কুমুদিনী চলে যায় রাশিমণির কাছে। তার বৃদ্ধা শাশুড়ির সংলাপেও ব্ল্যাকি শোনে নির্ভয় বিদ্রোহের স্পর্ধিত কণ্ঠ— ‘‘ডরাব কেনে, মুর বাপে, মুর শউরে হাতিখেদা করতি গে মরিসল, কিসে ডরাই?’’ (পৃ. ৩০১)।
আমরা লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি এই মানুষদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। গারো পাহাড়ের প্রায় অজ্ঞাত রক্তস্নাত বিদ্রোহের ইতিহাস আর গীতিকার পেলবতার আড়ালে মানুষের যন্ত্রণার ইতিহাস পুনরাবিষ্কারে এই উপন্যাস আমাদেরও প্রতিবাদী হয়ে উঠতে বলে। শিল্পসৌকর্যের পাশাপাশি, কাহিনি বয়নে বহুমুখী সাফল্যের পাশাপাশি আঞ্চলিকতার নিখুঁত বয়ন আমাদের আপ্লুত করে।
শুধু একটি মৃদু অনুযোগ, কালানুক্রমের পাশাপাশি তিনি যদি বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দের অর্থ আমাদের জানিয়ে দিতেন।
মোমেনশাহী উপাখ্যান
অমর মিত্র
দে’জ পাবলিশিং
মূল্য ৩৯৯ টাকা