মেরু-নিশীথের নাবিকেরা – পঞ্চম পর্ব <br /> পার্থজিৎ চন্দ

মেরু-নিশীথের নাবিকেরা – পঞ্চম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ

কিন্তু কেন দৃশ্যের ভেতর ‘জটিলতা’ চাই? কেন মানুষের মেধা ও বোধ এ বিচিত্রপথে ঘুরে বেড়ায়? কেন সে ডেকে আনে এ সন্ত্রাসের পথটিকে? অতিরিক্ত দুষ্প্রবেশ্যতার বিষয়টিকে একপাশে সরিয়ে রেখে বলা যায়, দৃশ্যের মধ্যে মিশে থাকা রহস্য আমাদের খোঁজার প্রক্রিয়াটিকে প্ররোচনা দেয়, যা কিছু রহস্যময় তাকে খুঁজে পাবার, আবিষ্কারের শক্তি জোগায়। এ যেন এক নিজস্ব সমুদ্র নির্মাণ ও কলম্বাস-ভূমিকা পালন। কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে কি আমাদের ইন্সটিংক্টের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা রয়েছে? এ রহস্যবোধ আমাদের জিনের মধ্যে মিশে থাকা? না কি জন্মের পর থেকে তাকে ধীরে ধীরে একটু একটু করা অর্জন করি আমরা? এই যে দৃশ্য নির্মাণ করবার ক্ষমতা ও প্রবল ইচ্ছা মানুষের তা কি জন্মসূত্রে পাওয়া? না কি মানুষের দ্বিপদী হয়ে ওঠবার সঙ্গেও এর সংযোগ রয়ে গেছে?

শিকার’ ও ‘সুন্দরবনের গল্প’

‘দৃশ্য’ এক আশ্চর্য শব্দ, মানুষ দৃশ্য ‘তৈরি’ করে এবং একটা সময়ের পর মানুষ নিজেই সে দৃশ্যের ভেতর আশ্রয় নেয়। ক্রমশ নির্মিত-দৃশ্য ‘নির্মাণ’ করতে শুরু করে ব্যক্তি-মানুষ’কে। কিন্তু মানুষের হাতে নির্মিত হয়ে ওঠা এসব দৃশ্যের ভেতর কতটা কাজ করে তার অধীত অভিজ্ঞতা? না কি আমরা যাকে ‘অধীত’ বলে গণ্য করছি তার ভেতর রয়েছে আরও জটিল কোনও খেলা। অথবা সে অধীত অভিজ্ঞতা এক-জন্মে অধীত নয়।
তাদের কেউ-ই সাভানা-জঙ্গলে যায়নি; যাবার কথাও ছিল না। তাদের একে একে দেখানো হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের জঙ্গলের ছবি, ল্যান্ডস্কেপের ছবি। আট-বছর বয়সি শিশুদের অধিকাংশ পছন্দ করেছে সাভানার ছবি; পনেরো বছর বয়সের শিশুদের যে শ্রেণী তারা সাভানার পাশাপাশি পছন্দ করছে পর্ণমোচী-অরণ্য। এভাবে সত্তর বছর বয়সিদের মধ্যে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে সাভানা রয়েছে একদম প্রথম দিকে, অথচ তাদের কেউ-ই সাভানায় যায়নি কোনও দিন।
নিউরোএস্থেটিক্স নিয়ে গবেষণা করেন যাঁরা তাঁদের হাতে নির্মিত হয়েছে একটি হাইপোথিসিসি, নাম ‘সাভানা সাইপোথিসিস’। বিখ্যাত গবেষক অঞ্জন চ্যাটার্জি তাঁর গ্রন্থগুলিতে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। কিন্তু কেন সাভানা? কেন সেই সামান্য উচ্চতাযুক্ত তৃণভূমি?
সাভানা হাইপোথিসিস বলে, সামান্য উচ্চতা আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের দিয়েছিল দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া দৃষ্টি। বন্য পশুদের উপর নজর রাখা সহজতর হয়ে উঠছিল তাদের। শুধু তাই নয়, তৃণভূমির কারণে ঘুরে বেড়ানো পশু তাদের যোগান দিত জীবন ধারণের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় প্রোটিন।
তাই কি মানুষ-শিশুর হাতে পেন্সিলে তুলে দিলে তারা দূরে অনুচ্চ পাহাড় আঁকে? এবং তার নীচে সমতলে আঁকে মানুষের ছোট ছোট ঘরবাড়ি?
প্রায় একই কথা বলছেন Heerwagen ও Orions তাঁদের বিখ্যাত ‘দ্য বায়োফিলিয়া হাইপোথিসিস’-এ।
যে দৃশ্যের কথা প্রসঙ্গে এ লেখা শুরু হয়েছিল আবার সে দৃশ্যের কাছে ফিরে যাওয়া যাক; গভীর ছাপ রেখে যাওয়া দৃশ্যের প্রাথমিক শর্ত – তাকে coherent হয়ে উঠতে হবে। কারণ সেটির অনুপস্থিতি’তে দৃশ্য মানুষের কাছে হয়ে উঠবে অতিরিক্ত কঠিন ও দুষ্প্রবেশ্য।
আবার একই সঙ্গে সে দৃশ্যের মধ্যে থাকতে হবে পরিমিত জটিলতা, এ জটিলতা ব্যাতিত মানুষ দৃশ্যটির দিকে তাকাবার কোনও আগ্রহ অনুভব করবে না।
কিন্তু কেন দৃশ্যের ভেতর ‘জটিলতা’ চাই? কেন মানুষের মেধা ও বোধ এ বিচিত্রপথে ঘুরে বেড়ায়? কেন সে ডেকে আনে এ সন্ত্রাসের পথটিকে?
অতিরিক্ত দুষ্প্রবেশ্যতার বিষয়টিকে একপাশে সরিয়ে রেখে বলা যায়, দৃশ্যের মধ্যে মিশে থাকা রহস্য আমাদের খোঁজার প্রক্রিয়াটিকে প্ররোচনা দেয়, যা কিছু রহস্যময় তাকে খুঁজে পাবার, আবিষ্কারের শক্তি জোগায়।
এ যেন এক নিজস্ব সমুদ্র নির্মাণ ও কলম্বাস-ভূমিকা পালন।
কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে কি আমাদের ইন্সটিংক্টের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা রয়েছে? এ রহস্যবোধ আমাদের জিনের মধ্যে মিশে থাকা? না কি জন্মের পর থেকে তাকে ধীরে ধীরে একটু একটু করা অর্জন করি আমরা?
এই যে দৃশ্য নির্মাণ করবার ক্ষমতা ও প্রবল ইচ্ছা মানুষের তা কি জন্মসূত্রে পাওয়া? না কি মানুষের দ্বিপদী হয়ে ওঠবার সঙ্গেও এর সংযোগ রয়ে গেছে?
নবজাতক মানবশিশু অসহায়। দিনের পর দিন তাকে লালন করে জন্মদাত্রী, বাইপেডাল হয়ে ওঠার ফলে তার গর্ভকাল সংক্ষিপ্ত হয়েছে। সে লালনপর্বে মা ও শিশুর মধ্যে ঘটে চলে বহু গল্প ও দৃশ্যের simplification, ratification, elaboration ও exaggeration।
গভীরভাবে ভাবলে অনুভব করা যাবে এই চারটি বিষয়ই জন্মদাত্রী ও শিশুর মধ্যে ঘটে যেতে যেতে ক্রমশ দৃশ্য রচনা করবার ক্ষমতাটিকে পরিস্ফুট করতে সাহায্য করে। এ পরিবর্ধন ও বিস্তার প্রক্রিয়াও কি ইন্সটিংক্ট বাহিত হয়ে আসে আমাদের কাছে? এমন এক একটি দৃশ্যের কাছে আমরা ঘুরে বেড়াই যার হাত থেকে আমাদের মুক্তি নাই; হয়তো বা তার হাত থেকে মুক্তি নেই বলেই আমাদের সমস্ত শিল্প ‘সত্য’ হয়ে রয়েছে পৃথিবীতে। শিল্পীর অবচেতনে থাকা সে দৃশ্য বারবার ছায়া ফেলে যায় তাঁর লেখায়; যেমন ফেলেছিল জীবনানন্দের লেখাতেও।
ভারবি-সংস্করণের বাইরে জীবনানন্দের যে বিপুল পরিমান কবিতা ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলিকে পাঠ করতে করতে কয়েকটি বিষয় সচেতন পাঠকের চোখ এড়াতে পারে না; যেমন তাঁর কবিতায় নক্ষত্রের ও রাতাভরা আকাশের কথা প্রায় নিয়ম করে ফিরে ফিরে আসছে। লুপ্ত প্রাচীন জনপদ ও শহরের প্রতি তাঁর তীব্র আগ্রহের রূপ ধরা পড়ছে। এবং তাঁর কবিতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একটি দৃশ্যের থেকে কিছুতেই মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না – হরিণের পিছনে তাড়া করে ফিরছে চিতাবাঘ। অতিপ্রকাশ্যভাবে তার শুরু ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘শিকার’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে।
কবিতাটির ভেতর প্রবেশ করলে দেখা যাবে প্রথমেই জীবনানন্দ একটি ফ্রেম নির্মাণ করে নিচ্ছেন। সে ফ্রেমের নাম ‘ভোর’। কবিতাতে ‘গল্পের উপাদান’ থাকবে-কী, থাকবে-না তা নিয়ে যারা বিশেষ ভাবিত তাদের উদ্দেশে এখানে বলে রাখা যাক জীবনানন্দের মতো কবির ক্ষেত্রে এ বিতর্ক ক্লিশে হয়ে আসতে বাধ্য। এখানে জীবনানন্দ একটি বা কয়েকটি দৃশ্যের বর্ণনা করছেন; কিন্তু সংগোপনে তিনি আমাদের প্রস্তুত করছেন এক মহা-গল্পের সামনে দাঁড়াতে –
‘ভোর;
আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল;’
-এ বর্ণনার মধ্য দিয়ে যে কবিতার শুরু তার চতুর্থ ও পঞ্চম পঙক্তি’তে তিনি লিখছেন, ‘একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে;
পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো;’
-এরপরের পঙক্তি’তে এসে তিনি নিকট বর্তমান’কে সূদূর অতীতে রূপান্তরিত করছেন, ‘কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তা
আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল’
-এখান থেকে শুরু হচ্ছে জীবনানন্দের আরেক ‘খেলা’; নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সাসপেন্স বুনে দেবার অলৌকিক প্রক্রিয়া। তলে তলে ঘটনাগুলি ঘটে যাচ্ছে; অথচ পৃষ্ঠদেশে তার হদিশ মিলছে না কিছুতেই। দেশোয়ালীরা আগুন্ জ্বালছে এবং সে আগুন মোরগফুলের মতো লাল। তীব্র কনট্রাস্ট তৈরি হচ্ছে যখন তিনি লিখছেন, ‘সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ
ময়ূরের সবুজ নীলা ডানার মতো ঝিলমিল করছে’।
-এই আপাত-সুন্দর, শান্ত বাস্তবতা আসলে নির্মিত; সেটি একটি ক্ষেত্র। এবার সন্ত্রাস নামিয়ে আনবেন জীবনানন্দ।এরপরই তিনি লিখবেন,
‘ভোর;
সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে
নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে
অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে
সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল’।
-হরিণটির এই অবিরাম ছুট শুধু একটি দিনের নয়, যেন আদি-অনাদিকাল থেকে চিতার হাঁ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সে ছুটে চলেছে। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন থেকে বনে; মৃত্যুকে পরাজিত করছে ছুটের মধ্য দিয়ে।
এরপরের কয়েকটি পঙক্তি’কে সৌরঝড় বলাই সঙ্গত, একটি ভাষাকাঠামোর মধ্যে যতটা স্বাধীনতা পাওয়া যায়, যতটা উল্লম্ফন দেওয়া যায় ততটাই ব্যবহার করলেন জীবনানন্দ। বারংবার ‘মতো’ শব্দটি ব্যবহৃত হল অথচ সেটি কবিতাটির বহমানতাকে আঘাত করল না,
‘ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য
অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো
একটা বিস্তির্ণ উল্লাস পাবার জন্য;
এই নীল আকাশের নীচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে উঠে
সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য’।
-‘সাহসে’ ‘সাধে’ ‘সৌন্দর্যে’ শব্দ তিনটির প্রথমেই ‘স’ ধ্বনিটি উচ্চারিত হচ্ছে; যে কোনও মুহূর্তে এই তিনটি শব্দ কবিতাটির ঘাতক হয়ে উঠতে পারত; হল না। কারণ তারা সেখান থেকে উড়ে গিয়ে চিতার মুখ থেকে পালিয়ে বেড়ানো হরিণের বিশাল সাধ’টিকে সূচিত করল। এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ করার, সে হরিণ শুধু একটি হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার বিষয়ে ভাবিত নয়; সে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দিতে চায়। যৌনতার ভেতর লুকিয়ে থাকা এই ইন্সটিংক্ট’টির আবরণ’কে দাঁতে ছিঁড়ে ফেললেন জীবনানন্দ। ঠিক যেমন হরিণটি সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল, সে সাবলীলতায়।
কিন্তু এরপর নদীর জল মচকাফুলের মতো লাল হয়ে উঠল; এখানেও দেখার – আগুনের রঙ বোঝতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন মোরগফুল। রক্তের রঙ বোঝাতে তিনি ব্যবহার করলেন মচকাফুল।
হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হয়েছে অথচ যেন তা হয়নি। কবিতাটি ভয়াবহ হয়ে ওঠে এখানেই।
‘মাংস’ শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে – ‘গতজন্মে তুমি আমাকে ভক্ষণ করেছো, এ জন্মে আমি তোমাকে ভক্ষণ করব।’ এখানেও যেন সেই শান্ত… চরম শান্ত যুক্তি মেনে, ‘কিছুই ঘটেনি’র পথ ধরে হরিণের মৃত্যু উদযাপিত হয়েছে।
এখানে এসে আরেকবার কবিতাটির দিকে তাকালে মনে হতে বাধ্য, তা হলে কি ‘হরিণের’ মুক্তি নেই কিছুতেই?
চিতার হাত থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে সক্ষম হলেও অমোঘ নিয়তি কি তাকে টেনে নিয়ে আসবেই মৃত্যুর কাছে?
হঠাৎ মাথার ভেতর ঝনঝন করে ওঠে, এ কবিতা কি হরিণের ছদ্মবেশে জীবনানন্দেরই আত্মকথন? এক ভয়ংকর জীবন তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সুস্থির নারীর ইশারামাত্র নেই জীবনে। ক্ষতবিক্ষত হতে হতে সে শুধু পালিয়ে বেড়ায়, এক মৃত্যুর কোল থেকে আরেক মৃত্যুর হাঁ-মুখের দিকে। হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার মতো অনন্ত আকাঙ্ক্ষা রয়ে গেছে তার; অতৃপ্ত অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা সব।
এবং এই শিকারির দল কি তার ব্যক্তিজীবন’কে বারবার ছারখার করে দেওয়া মানুষজন? যারা নিঃশব্দ ‘প্রায় হত্যাকাণ্ড’ সম্পন্ন করে চুরুট খেতে খেতে টেরিকাটা মাথায় সফেদ বিছানার দিকে চলে গেছে?
কী আশ্চর্য, একদম শেষ লাইনে এসে জীবনানন্দ যে ‘নিষ্পন্দ নিরপরাধ ঘুম’-এর কথা বলছেন তাকে কতবার সূক্ষ ব্যঙ্গ হিসাবে গণ্য করতে চেয়েছি, পারিনি। শিল্পে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা আছে; কিছুতেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তার সীমা অতিক্রম করতে পারে না। ‘নিষ্পন্দ নিরপরাধ ঘুম’-এর ভেতর তাই ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে ট্র্যাজেডির ঘন ইশারা, পারাপারহীন নিয়তির ছোবল।

কিন্তু শুধু যদি তিনি এ কবিতাটিই লিখতেই তা হলে হাভানা-হাইপোথিসিসের উল্লেখ প্রয়োজন হত না লেখাটির শুরুতে। তাঁর আরও একটি অগ্রন্থিত কবিতা পাওয়া যাচ্ছে যেটিকে অনায়াসে এ কবিতাটির ‘যমজ’ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। কবিতাটির নাম ‘সুন্দরবনের গল্প’। ‘শিকার’ কবিতাটির ভেতর প্রবেশ করে সেখানে গল্পের ফ্রেম নির্মাণ করার প্রক্রিয়াটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলবার সময় সামান্য যে দ্বিধা কাজ করছিল এখানে এসে কবি স্বয়ং সেটি মুছে দিলেন। কারণ কবিতাটির নামের মধ্যেই তিনি উল্লেখ করলেন ‘গল্প’ শব্দটি।
‘সুন্দরবনের গল্প’ কবিতাটি শুরু হয়েছে ভোরের নদীতে হরিণের নামার মধ্যে দিয়ে,
‘ভোরের নদীর জলে হরিণ নামলো
কাল সারারাত বাঘিনী ছিল তার পিছু পিছু
কাল সমস্ত জ্যোৎস্নার রাত সুন্দরী চিতাবাঘিনী
এই হরিণের ছায়ার পিছনে ছুটেছে।’
-কবিতাটির শুরুতে সামান্য জটিলতা রয়েছে, কারণ এক্ষেত্রে চিতাবাঘিনী ও হরিণী সমলিঙ্গের মনে হতে পারে, যদিও পরের দিকে বিষয়টি স্বচ্ছ হয়েছে,
জীবনানন্দ লিখছেন,
‘বাতাসের পায়ের মতো এর ছায়ার পিছনে
ছুটেছে কামনার মতো
গহন রূপের আঘাতে যে রক্তিম কামনার জন্ম হয়
হিংসা নয় –
কাল রাতে চিতাবাঘিনী হরিণীর মুখের রূপে
ফেনিল হয়ে উঠেছিল’
-এখানে জীবনানন্দ যৌনতার থেকে হিংসাকে পৃথক করলেন সচেতনভাবে। এবং তারপর আছড়ে পড়তে শুরু করল একের পর এক চিত্রকল্প, পাওয়া গেল, ‘এরা দু’জনে অরণ্যের স্বপ্ন তৈরি করেছিল কাল
এই হরিণ – এই চিতা – ’
অর্থাৎ এখানে এসে অরণ্যের ‘বাস্তব’ উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশটিকে মুছে দিলেন কবি, কারণ যে অরণ্যে হরিণ ও চিতার ‘খেলা’ সম্পন্ন হচ্ছে তা তাদের স্বপ্ননির্মিত – এমন একটি ইশারা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন কবি নিজেই।
কিন্তু কবিতাটির ভেতর কিছুটা প্রবেশের পর কবি আরেকটু জটিল করে তুললেন এ লিঙ্গ পরিচয়, ‘এই হরিণ – এই চিতা
জ্যোৎস্নার কোমল স্নায়ু এদের শরীরকে বানিয়েছিল ছবি
অপরূপ নারীর ছবি এঁকেছিল এই বাঘিনীর দেহ দিয়ে
ছুটেছে হাওয়ার মতো তার (ঈপ্সিত) তরুণের পিছে’
-‘ইপ্সিত’ শব্দটিকে বন্ধনির মধ্যে রেখে তিনি পাঠক’কে অসীম রহস্যের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন; পাঠকের মনে অবিরাম প্রশ্ন জাগতে শুরু করল – বাঘিনীর দেহ দিয়ে যে নারীর ছবি আঁকা হয়েছে সে কি ছুটেছে কোনও এক ‘নির্দিষ্ট’ তরুণের দিকে, না কি সে ‘তরুণ’ ইপ্সিত অথচ অনির্দিষ্ট!
এ ঘন যৌনতার উপর বারবার জাফরির রহস্যময় ছায়া পড়ছে। ‘জানলার মতো ফাঁক হয়ে যাচ্ছে’, ‘অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো নীল হয়ে যাচ্ছে আবার’, ‘পাহাড়ের গুহায় গুহায় আবেগে স্ফিত হয়ে উঠছে’ ইত্যাদি চিত্রকল্প অবধারিতভাবে যৌনচেতনার প্রকাশ।
শেষ স্তবকে এসে আমরা আবিষ্কার করব, ‘রাশি রাশি কাঞ্চন ফুলের মতো ফুটে উঠছে এদের দেহ আরেকবার’। আবিষ্কার করব পরপর তিনটি লাইনে ‘মতো’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তারা সূচিত করছে অবরুদ্ধ, তীব্র কামের বিস্ফোরণ,
‘ছায়ার ভিতর থেকে হীরের মতো জ্যোৎস্নাকে খুঁড়ে বার করে
অন্ধকারকে তম্বুরার মত বাজিয়ে বাজিয়ে
বাতাসকে তরমুজের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে’
-এ কবিতাটিতে, লক্ষণীয়, নারী অধীকতর সক্রিয় যৌনভূমিকা পালন করছে। জীবনানন্দ তাকে নির্ধারণ করছেন ‘নীল দারুময়ী বাঘিনী’ হিসাবে। সমস্ত কবিতাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে তীব্র কামাতুর এক নারীর ছুটে চলা। অবশেষে সে ‘নারী’ (বাঘিনী) তার পুরুষকে খুঁজে পেয়েছিল নিশ্চিত, মিলনও হয়েছিল; কিন্তু অনিবার্য ট্র্যাজেডি হিসাবে তারা চাঁদকে একবার খুঁজে পেয়ছিল ও ‘একবার হারিয়ে ফেলেছিল’।
সৃষ্টির মূলে কি তবে রয়ে গেছে নারীর এ তীব্র যৌনবোধ? সেই কি পুরুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে বন থেকে বনান্তরালে? এমনকি এটাও বলা সম্ভব যে পুরুষ মাঝেমাঝে সে তীব্র কামের সামনে দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল ও কিছুটা ভয়ার্ত হয়ে পড়েছে?
অন্তত এই কবিতাটিতে তো একবার চিতার রূপের সামনে দাঁড়িয়ে হরিণ’কে সেভাবেও আবিষ্কার করা যায়, দেখা যায় মেহগিনির ছায়ায় হরিণ ‘হয়ে যাচ্ছে মেহগিনি কাঠের হরিণ’।
এখানে ‘কাঠ’ শব্দটি সবিশেষ উল্লেখ্য। কামার্ত চিতাবাঘিনীর থেকে কি হরিণ নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইছে?
জীবনানন্দের এ কবিতায়, অন্তত একবার, সফল সংগমের ইশারা রয়েছে; কিন্তু তার থেকেও বেশি রয়েছে কামার্ত বাঘিনীর হাঁ-য়ের থেকে এক হরিণের অবিরাম ছুটে চলা। তার কারণ রহস্যময় এবং অনির্ণীত।
তার থেকেও বেশি অনির্ণীত কেন বারবার জীবনানন্দের কবিতায় ফুটে উঠেছে এই ত্রস্ত হরিণ ও চিতাবাঘের ছবি। আমাদের স্নায়ুর ভেতর প্রবেশ করে থাকা আদিম, ত্রস্ত ছুটেরই কি সার্থক রূপকার জীবনানন্দ? সেই স্মরণাতীত কাল থেকে কি ব্যক্তি-মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করছে চিতার হাঁ-মুখ থেকে পালিয়ে বেড়ানো হরিণ হিসাবে?
সমস্ত ভালোবাসা, কাম, আলিঙ্গন, শরীরের পরেও কি ওই আদিম ছুট, যে ছুট এক হরিণের… যে ছুট চিতাবাঘের হাঁ-এর থেকে পালাবার, তাই কি ফুটে থেকেছে জীবনানন্দের কবিতায়?
এও কি এক পৃথক ধরণের সাভান-হাইপোথিসিস?

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80