
মহিলা কামরা
পর্ব ৩ এবং ৪
রূপশ্রী ঘোষ
৩
বহুদিন পরে সেদিন ময়ূরীকে দেখলাম। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে অন্য এক দিদিমণিকে খুব উপদেশ দিচ্ছিল। পাশে আরও কয়েকজন দিদিমণি তাঁদের স্কুলেও “ওই একই সমস্যা” সেটা বোঝাতে চাইছিল। আমি একটু দূরে ছিলাম, তবুও বারবার ময়ূরীর কথাই কানে আসছিল। সে বলছিল — “আরে তুমি এই বিষয়ে কম্পিটেন্ট। বলছি না তুমি খুবই কম্পিটেন্ট তাই HOD তোমাকে এটা নিয়ে কিছু বলবেন না। আরে আমি বলছি তো, তুমি দেখো।” ওই একই কথা ঘুরে ফিরে নানান টোনে বলছিল আর হেডফোন ঠিক করছিল। তার হেডফোন এখন লাল থেকে সাদা হয়েছে। অন্য এক দিদিমণির মুখনাড়াটুকুই দেখতে পাচ্ছিলাম, কথা কিছু বুঝতে পারিনি। ট্রেন এসে গেল।
ময়ূরী ট্রেনে উঠে সিট পেয়েই আবার হেডফোন গুছিয়ে বসল। এর মধ্যেই স্বপনদা সুর করে — “বাসন মাজা স্কচ ব্রাইটটা পাবেন, চুলের ক্লিপ” — বলতে বলতে একটু দূরে চলে গেছে। ময়ূরী হঠাৎ চেঁচাতে শুরু করল — “কাপড় কাচা ক্লিপ আছে? কাপড় কাচা?” সবাই হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে। স্বপনদাও তাই। তখন ময়ূরী চকিতে সম্বিত ফিরে বলল — “আরে ধুর্-র কি যে সব বলছি না.. ওই কাপড় মেলা, কাপড় আটকানোর ক্লিপের কথা বলছি।” স্বপনদা – “আছে”, বলে তার সামনে এসে হাজির হল।
ময়ূরী জানতে চাইল — “এক প্যাকেটে কটা থাকে?”
স্বপনদা — “বারোটা।”
— “কত দাম?”
— “পঁচিশ টাকা।”
ময়ূরী — “আচ্ছা এক প্যাকেট দিন, না না ঠিক আছে দু প্যাকেটই দিয়ে দিন” বলে পঞ্চাশ টাকা বের করে তার হাতে দিল।
স্বপনদা একটা কালো ক্লিপের প্যাকেট তার হাতে দিতেই সে বলে উঠল — “কালারফুল নেই? মানে বিভিন্ন রঙের ক্লিপ নেই?” স্বপনদা বলল, “না বিভিন্ন রঙ হবে না, শেষ হয়ে গেছে। এটা আছে।” বলে হালকা সবুজ রঙের একটা ক্লিপের প্যাকেট বের করে দিল। বলতে বলতেই চারদিক থেকে আরও অনেকে ওই ক্লিপের প্যাকেট নিয়ে দেখতে লাগল। প্রায় চার-পাঁচটা প্যাকেট বিক্রি হয়ে গেল। এর আগে কখনও স্বপনদার এতগুলো প্যাকেট বিক্রি হতে দেখিনি।
এর মধ্যেই দেখি একজন দিদি একটা প্যাকেট নিয়ে ময়ূরীর কোলে ফেলে দিল। ময়ূরী তা থেকে বের করল একটা লাইট ওরেঞ্জ কালারের সালোয়ার কামিজের পিস। তাতে অনেক সুতোর কাজ করা। ময়ূরী সেটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল, “না গো এমনটা তোমাকে বলিনি। সেটার হাতে আর কামিজের নিচটায় পাড়ের মতো কাজ থাকবে।” বলে সেই দিদিকে ফেরৎ দিয়ে দিল। সেই দিদিও সেটা নিয়ে বলল, “হ্যাঁ পরে এনে দেব।”
এই দিদিকে আমি আগে অনেকবার দেখেছি। প্রথম দিকে ভাবতাম ডেলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যেই একজন। একদিন দেখেছিলাম সে ট্রেন থেকে নেমে, ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কয়েকটা ক্যাটালগ একজন দিদিমণিকে দিল, এবং বলে দিল পরেরদিন ফেরৎ নেবে, তারমধ্যে সে যেন ঠিক করে রাখে কোনটা কোনটা পছন্দ। ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিলাম ওটা ওরিফ্লেমের নেলপালিশ আর লিপস্টিকের ক্যাটালগ। এখন দেখছি সে চুড়িদার, সালোয়ার কামিজ পিসও বিক্রি করে।
কথায় বলে খদ্দের লক্ষ্মী। দোকানদার বা হকার যদি নারায়ণ হয় তাহলে জমে ভালো। আমাদের এই ট্রেনে সত্যিই একজন নারায়ণ আছে। এই নারায়ণ খুব ফেমাস একজন পেয়ারাওলা। এ এসেই দিদিমণি দিদিমণি করে না। প্রথমেই কয়েকটা প্লাসটিক প্যাকেট বের করে। কোনোটায় চারটে, কোনোটায় পাঁচটা, কোনোটায় ছ’টা পটাপট ভরে যে দিদিমণিরা যেমন নেন, তাঁদের কাছে পৌঁছে দেয়। দিদিমণিরাও দেখেছি কোনো উচ্চবাচ্চ না করে যে যাঁর ব্যাগে ভরে নেন। কেউ কখনও বলেন না – নারায়ণ এটা এমন দিলে কেন, ওটা অমন দিলে কেন, বা এটা পাল্টে দাও, ওটা কেন পাকা? নারায়ণের ওপর সবার অন্ধবিশ্বাস। নারায়ণ আবার শীতকালে জয়নগরের মোয়া বেচে। অনেক দিদিমণির কাছে নারায়ণের ফোন নম্বর আছে। তাঁরা ফোন করে বলে দেন — “অমুক ট্রেনে কাল ওটা নিয়ে এসো, আমি ওই ট্রেনে থাকব।”
আর একদিন এক মহিলাকে দেখেই চমকে গেলাম। হঠাৎ মনে হল আমার সেজো পিসি। খুব লম্বা, ধবধবে ফর্সা, চোখা নাক, বড় লাল টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর পরে, অবিকল আমার ওই পিসির মতো দেখতে। দেখতে দেখতেই ট্রেন এসে গেল। আমি অন্যদিকে উঠলাম। উঠে সিট খুঁজতে খুঁজতে সেই মহিলার উল্টোদিকের সিটটাই পেলাম। বৃষ্টির জন্য সব সিটের জানলার দিক ফাঁকা থাকলেও শুকনো সিট খুঁজেই বসতে হচ্ছিল। ওনার ঠিক মুখোমুখি আমি বসলাম। দু-মিনিট পরেই দাদু “চিঁড়ে ভাজা, বাদাম ভাজা” হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছিল। ওই মহিলা দাদুকে ডাকলেন।
— “একটা চিঁড়ে ভাজা দিন তো।”
— “কোনটা? সাদা না মশলা?”
— “না না সাদাই দিন।”
দাদু সাদা প্যাকেট দিতেই মহিলা বললেন — “কেটে দিন।”
উনি সব গুছিয়ে টাকার ব্যাগ মেন ব্যাগে ভরে চিঁড়েভাজা খেতে থাকলেন। চশমার ভিতর দিয়ে চোখটা একবার ছোটো ছোটো একবার বড়ো বড়ো করে বারবার এমন করছিলেন মনে হচ্ছিল তাকাতে যেন অসুবিধা হচ্ছে।
এরপরে এক খুব বয়স্ক মহিলা এলেন ভিক্ষে করতে। তাঁর বয়স পঁচাত্তর তো হবেই। সবার কাছে হাত বাড়িয়ে পয়সা চাইছিলেন। আমার ডান পাশের মহিলা দু- টাকা দিলেন। পিসির মতো মহিলাও দু-টাকার একটা কয়েন দিয়ে বললেন — “আপনি এই বয়সে ভিক্ষে করছেন কেন? বাড়িতে থাকতে পারেন না?”
বয়স্ক মহিলা বললেন — “আমার দুই ছেলে-মেয়ে পাগল। আমি মরে গেলে তাদের কি হবে?”
— “তাদের হোমে দিয়ে আপনি কারও বাড়িতে থাকতে পারেন তো?”
তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে কাঁদো কাঁদো চোখে অন্যদের দিকে পয়সা চাইতে গেলেন।
তখন ওই মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন — “এখন তো কত পাগলখানা আছে, তাই না? কোনও একটায় দিয়ে উনি তো কারও বাড়িতে থাকলেই পারেন। এই বয়সে উনি তাদের কথা ভেবে কি করবেন? কোনও সমাধান তো নেই। আমার বাড়িতেই তো এমন একজন থাকলে ভালো হয়, এদিক ওদিক বেরোতে পারি। একটা দায়িত্ব। আসলে ওরা অনেক মিথ্যে কথাও বলে গো। ভিক্ষে করলে তো প্রচুর ইনকাম। পার ডে প্রায় পাঁচশো-ছশো টাকা। কারও বাড়িতে থাকলেও তো – থাকা, খাওয়া, টাকা-পয়সা সবই পাবে।”
এইসব কথা চলতে চলতে চলে এল মোসাম্বিওলা।
“এই মোসাম্বি… মিষ্টি মোসাম্বিটা পাবেন।” এই ছেলেটা সত্যিই খুব হাসিখুশি। আমি একে সারাক্ষণ হাসতে দেখি। বিক্রি হোক বা না হোক। তবে বেশিরভাগ সময় ঝুড়ি খালি করেই নামে। মাঝে মাঝে আঙুরও বেচে। আজ একজন দিদিমণিকে লেবু দিতে দিতে হঠাৎ একগাল হেসে আমাকে বলল — “দিদিমণি ভালো আছেন?” ঘাড় নেড়ে বললাম “হ্যাঁ।”
ওই দিদিমণিকে কুড়ি টাকায় চারটে লেবু দেওয়ায় তিনি বললেন — “পাঁচটা হবে না?” সে বলল — “না দিদিমণি, পাঁচটা তিরিশ টাকা হয়ে যায়। আপনাকে বলেই কুড়িতে চারটে দিয়েছি।” দিদিমণি বললেন “মিষ্টি হবে তো?” সে- “হ্যাঁ” বলে হাসতে হাসতে চলে গেল।
এর পরেই সেই বয়স্ক মহিলা হাত বাড়িয়ে পয়সা চাইতে চাইতে আবার হাজির। আমার ডানদিকের মহিলা বললেন — “এই তো আপনাকে পয়সা দিলাম।” মহিলা তখন একটু ক্ষুব্ধ হয়েই বললেন — “যারা দিয়েছে তারা আর দেবে না। আমি তো এই একটা কামরাতেই থাকি। আর কোথাও উঠিও না নামিও না। তাই যারা নতুন ওঠে তাদের কাছে আবার চাই।” বলতে বলতে চলে যাচ্ছেন তখন তাঁর বাঁ হাতে বাঁধা বিপত্তারিনীর ডুরিটা দেখে আমার সেজোপিসির মতো দেখতে মহিলা ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে টিপ্পুনি কাটলেন — “আবার বিপত্তারিনীর বার করেছে।”
একজন মহিলা তাঁর পাশে জানলার ধারে সিটটায় বসতে চাইলেন। তিনি বললেন — “ভেজা তো বসবে কি করে?”
— “ভেজা তো আর কি করা যাবে, কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকব?”
— “তাহলে ছাতাটা দিয়ে মুছে বসুন।” বলে নিজের ছাতাটা নিয়ে আমার বাঁদিকের ফাঁকা সিটে রাখলেন। তারপর আমাকে বললেন — “এখানে রাখছি তো, আবার ভুলে না যাই।” বলেই তাঁর পুরনো একটা গল্প বললেন — “একবার সব বন্ধুরা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়েছিলাম। আমি সিটের পিছনে ছাতা আর ব্যাগটা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। নামার সময় দুটোই ভুলে গেছি। সে গাড়িও হাওয়া। বন্ধুরা কত বকেছিল, বলেছিল, তুই গাধা আছিস।” মনে পড়ল আমি আর আমার বর একবার এমন গাধা হয়েছিলাম। একবার দাদা বৌদিকে দেবার জন্যে পুজোর জামাকাপড় কিনে ফেরার সময় ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটা সামনে বসে থাকা মহিলার হাতে ধরতে দিয়েছিলাম। কী একটা বিষয়ে দুজনের মধ্যে রাগারাগি হয়ে যাওয়ায় অন্যমনস্ক হয়ে প্যাকেটটা ভুলেই নেমে গিয়েছিলাম।
ট্রেনটা হঠাৎ দুটো স্টেশন গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ততক্ষণে ভিড় অনেকটা বেড়ে গেছে। মাইকে কিছু একটা বলল কেউ শুনতে পেলাম না। এ ওকে জিজ্ঞেস করছে, সে তাকে, কিন্তু কেউই বলতে পারল না কি অ্যানাউন্স করা হয়েছিল। সবাই বিরক্ত। উফ! আফ! করছে। তার মধ্যেই হঠাৎ দূর থেকে একটা পুরনোদিনের গান কানে এল। কথা বুঝতে পারছিলাম না। পিসির মতো দেখতে মহিলা দেখলাম দিব্যি তাল দিয়ে আপন মনে ঘাড় নেড়ে যাচ্ছেন। এরপর কানে এল “চুড়ি খনকে গি, বিন্দিয়া চমকেগি”। এটুকু হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল “আআই না কুচ খবর, মেরে ইয়ার কি…”। বুঝলাম কেউ তার মোবাইল থেকে গান চেঞ্জ করে করে পছন্দের গান বাছার চেষ্টা করছে। তখন আমার পছন্দের একটা গান চলে এল। “এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়, মজোঁ কি রবানি হ্যায় … ”। কিন্তু সে থামল না, বাছতেই থাকল। আমার কানে বাজতে থাকল .. “জিন্দেগি অর কুচভি নেহি, তেরি মেরি কাহানি হ্যায়….”। ট্রেন চলতে থাকল।
আমার স্টেশন এল। নামার আগে মহিলাকে ইশারা করে তাঁর ছাতাটা মনে করিয়ে দিলাম। তিনি হাসিমুখে আমাকে অনেক “ধন্যবাদ”, বলেই তাঁর হাতে থাকা চিঁড়ের আর একটা বিস্কুটের খালি প্যাকেট দেখিয়ে বললেন — “এগুলো স্বচ্ছ ভারতের জন্য রেখে দিয়েছি। ডাস্টবিন দেখতে পেলেই তাতে ভরে দেব।” আমি হাসতে হাসতে নেমে গেলাম।
নেমে লাইন পেরোনোর সময় ওই মহিলার কথা আর আমার সেজো পিসির কথাই ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি তীব্র হর্ন দিয়ে উল্টো দিকের ট্রেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সম্বিত ফিরে পেলাম। তাকিয়ে মাপজোক করে দেখলাম আমি ট্রেনের আগেই দৌড়ে লাইন পেরিয়ে প্লাটফর্মে উঠে যেতে পারব। দৌড়ে উঠেও গেলাম। একটা চৌকিতে বসে চারজন তাস খেলছিল। আমি উঠতেই জোরে চেঁচিয়ে বলল — “যেদিন ট্রেনের তলায় যাবেন বুঝবেন।” অন্য একজন বিড়বিড় করে বলল — “সাহস আছে বলতে হবে।”
আরও পরে আমার কলিগ বলল — “আমি তো নিজে দাঁড়িয়ে তোর নাম ধরে চিৎকার করছিলাম। তুই শুনতে পেলি না। দেখলাম দৌড়চ্ছিস…।”
৪
ফেরার সময় দেখি মহিলা কামরার ছবিটা বেশ অন্যরকম থাকে। এমনকি দুপুরের ট্রেন একরকম হয়, বিকেলের ট্রেন আর একরকম।
দুপুরের ট্রেন সাধারণত খুব ফাঁকা হয়। সবাই মোটামুটি হাত পা ছড়িয়ে, অন্য সিটে দু-পা তুলে যায়, কেউবা শুয়েও। বিশেষ করে যারা ঠিকে কাজ করে বা বাজার থেকে ফেরে তারা। কোনো কোনো মাসি তো বাজার ফেরত বাকি সবজিগুলো গেটের ধারে ছড়িয়ে বিক্রি করতে বসে যায়। শুকনো করলা, পটল, বীনস, কাঁচালঙ্কা, শাকও থাকে। তখন তারা পারলে মোটামুটি সবগুলোই দশ টাকাতে দিয়ে দেয়।
মোসাম্বিওলা পিন্টু তখন গেটের মুখে ফাঁকা জায়গায় বসে তার লেবুর বস্তা থেকে লেবুগুলো একটা একটা করে নিয়ে গামছা দিয়ে মুছে মুছে ঝুড়িতে রাখে।
এইসময় বাদামচাক, ওয়াফেল, টক-ঝাল, লেবু, আদা, আনারস লজেন্সওলা সবাইকেই ট্রেনে দেখি। কিন্তু এরা সবাই অন্য, দু – চারজন বাদ দিলে আর কাউকে সকালে যাবার ট্রেনে দেখা যায় না।
একজন ফেরিওলা আছে উঠেই প্রচন্ড নাকি সুরে শুরু করে দেয় — “এই কাজু না, কিসমি না, আমসত্ব”। তার ঝুড়িতে থাকে ছোটো ছোটো কাজু, কিসমিস, আর আমসত্বের প্যাকেট। পাঁচ আর দশ টাকার। আর একদম ছোটো ছোটো আমসত্বের পুরিয়া এক টাকা করে। কিন্তু সে কেন যে — “কাজু না, কিসমি না” বলে আশ্বস্ত করতে চায় সেটা বুঝতে পারি না।
ফেরিওয়ালাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো। শুধু হাসি বিনিময় নয়। একে অন্যকে নিজেদের জিনিস দিয়েও এরা বন্ধুত্ব বজায় রাখে। বিশেষ করে লজেন্সওলা সবাইকে লজেন্স দেয়। তারা নিজেদের মধ্যে সুখ দুঃখের গল্প, কাজের কথা সবই আলোচনা করে। একদিন লজেন্সওলা বলল, কোন দুই ভাই নতুন এসেছে এই লাইনে, তাদের থেকে এদের পাণ্ডা হাজার টাকা নিয়েছে মদ খেতে। তারা খুব মনমরা হয়ে আছে। এদের নিজেদের “মিটিং”ও হয়। একদিন তপনদা এক ক্লিপওলাকে জিজ্ঞেস করল — “কাল মিটিংটা হয়নি তো?” সে উত্তর দিল — “না হয়নি।” তপনদা বলল — “ভালো হয়েছে, আমি আসতে পারতাম না।”
দুপুরের ফাঁকা ট্রেন এতোই ফাঁকা হয় যে কখনো কখনো ছেলেদেরও উঠতে দেখা যায়। একদিন আমি দুজন ষণ্ডামার্কা লোককে দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম। তাদের মধ্যে একজন আবার জামার ওপরের দিকের বোতামগুলো খুলে রেখেছিল। তার বুকের কাছ থেকে পেট অব্দি আমি কাটা দাগ দেখেছিলাম। সেদিন মোটামুটি প্রাণ হাতে করে বসেছিলাম। তার কদিন আগেই ওই ট্রেনে ছিনতাই হয়েছে। এমনকি পেয়ারাওলা রাজকুমারকেও ছুরি দেখিয়ে সব কেড়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছে।
অন্য আর একদিন মাঝ বয়সী দুটো লোক দেখলাম। তপনদা এসে ফিসফিস করে বলল, এখন খুব ছিনতাই হচ্ছে, তাই সিভিল ড্রেসে পুলিশ থাকছে। যেন প্রাণ আসল ধড়ে। আমার ফোনটা হারিয়ে যাওয়ার দিন আমি বালিগঞ্জ রেল থানায় বলেছিলাম, “এত ছিনতাই হচ্ছে, কোনও নিরাপত্তা নেই, খুব মুশকিল তো।” ওঁরা আমাকে পুলিশের সংখ্যার হিসেব দিয়ে বলেছিলেন — “অর্ধেকের বেশি পুলিশ মন্ত্রীদের গার্ড দিতেই চলে যায়। আমরা যদি একদিন স্ট্রাইক করি কতজন মন্ত্রীর মাথা পড়ে যাবে জানেন? জানেন না। জনতা এতটাই ক্ষেপে আছে যে ওদের সিকিওরিটি দিতেই আমাদের লোক শেষ হয়ে যায়। তাহলে কতগুলো ট্রেনে আমরা লোক দেব?”
কি আর করা। এমন অকাট্য যুক্তি শুনে চুপচাপ “হুম” বলে ঘাড় নেড়েছিলাম।
দুপুরের ফাঁকা ট্রেনে মাঝে মাঝে প্রেমিক প্রেমিকাদেরও দেখা যায়। একবার দেখেছিলাম — মেয়েটা যতটা উৎকট সেজেছিল ছেলেটাও ঠিক ততটাই। সোনালি চুলের স্পাইক কাট, তার ওপরে জেল-ফেল লাগিয়ে বেশ দেখার মতো। চুলটা ঠিক সোনালি নয়, সবুজ ঘাসকে ঢেকে রাখলে তার ক্লোরোফিল চলে গিয়ে যেমন জ্বলে যায় ঠিক তেমন। মেয়েটাও পাল্লা দিয়ে ঝিকঝাক ড্রেসের সঙ্গে চড়া মেকাপ আর লিপস্টিকে নিজেকে এমন সাজিয়ে ছিল বেশিক্ষণ তার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। তারা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তাতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভবও ছিল না।
——
দুপুর আর বিকেলের ফেরার ট্রেনের আকাশ-পাতাল তফাৎ। তার ওপর যদি জেনারেল বগি হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। তবে মহিলা কামরায় ভিড় একটু কম থাকে।
ফেরার সময় ক্লান্ত দিদিমণিরা আর তখন চেঁচামেচি করেন না। নিজেদের গ্রুপ উঠলে আলাদা কথা। না হলে সবাই ঝিমুনিকে আঁকড়ে চুপ থাকতেই ভালোবাসেন। আবার কেউবা হাই তুলে তুলেই কাটিয়ে দেন।
তবে ওই সময় চেঁচামেচি করে গল্প করে স্কুল ফেরত নাইন থেকে টুয়েলভের মেয়েরা। তাদের ফিজিক্স ভালো লাগে, না কেমিস্ট্রি, ম্যাথ নাকি বায়োলজি — এইসব চলে। একদিন দুটো মেয়ের গল্প শুনলাম — “জানিস তো নতুন একজন বায়োলজি টিচার এসেছেন? দারুণ দেখতে কিন্তু।”
— “হ্যাঁ হেব্বি হ্যান্ডসাম!”
— “দেখেছিস?”
— “হ্যাঁ।”
— “আরে আমাদের সঞ্চারী তো পুরো ফি–দা। তার কোনো দরকার থাক বা না থাক, সে পারলেই স্যারের কাছে চলে যায়।”
— “সে কি রে? স্যার কিছু বলেন না?”
— “না। ইনি মানুষটাও খুব ভালো। যতবার যায় ততবারই হেল্প করেন।”
— “তাহলে ভালো। আরে আমাদের স্কুলে সবাই প্রায় ভালো। শুধু ঐ শিঁটকে মার্কা ম্যাথের টিচারটাকে আমার একদম সহ্য হয় না। ওই আগে ভূগোলেরটা যেমন ছিল, ঠিক তেমন। বাব্বা! তিনি বিদেয় হয়েছেন বেঁচেছি।”
দিদিমণিদের মধ্যে যাঁরা ক্লান্ত হন না তাঁরা শুরু করেন তাঁদের শাশুড়িমা নিয়ে। বেশ জোর গলাতেই। অথবা হয়তো বাড়ি ফেরার সময় বাড়ির লোকের কথাই মনে পড়ে। একদিন এক দিদিমণি স্কুল সেরে বিয়েবাড়ি যাচ্ছিলেন। হাতে ছিল গিফটের প্যাকেট আর বিশাল বড় একটা ফুলের বোকে। তিনি বলতে শুরু করলেন — “আমার আবার বিশাল জ্বালা। সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে হবে। না হলেই তো শাশুড়ি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। তাই একেবারেই স্কুল থেকে চলে যাচ্ছি। গিয়ে একবার দেখা করে গিফটটা দিয়ে চলে আসব।” শাশুড়ি সম্পর্কে আরও বললেন — “মহিলা এই গিফট কেনা নিয়েও অনেক ঝামেলা করেছে। মহিলার গুণের শেষ নেই। এত ছুঁচিবাই কি আর বলব। সারাদিন শুধু এঁটো-সকরি জিনিসের বিচার করে যায়। আর এদিকে তার বাথরুমে ঢুকলে দেখা যায় কাঁড়ি কাঁড়ি বাসি, পরা জামা-কাপড় ঝুলছে। সেদিকে ছুঁই ছুঁই নেই। এদিকে ভাত ফ্রিজে রাখতে দেয় না। যত্তসব। আনহাইজেনিক জিনিসে নজর নেই। শুধু ভাত, সকরি এইসব নিয়ে বাতিকগ্রস্ত। আর কী করে বৌয়ের পেছনে লাগা যায়।”
অন্য দিদিমণি শুরু করলেন — “আরে আমারটা তো আর এক। বাড়ি ফিরে শান্তিতে একটু টিভি দেখতে পাব? এসে অমনি জুড়ে দেবে, এটা হয়নি, ওটা হয়নি।” বলেই একটা গল্প বললেন — “কাল কী হয়েছে জানিস – বাবু টিউশন থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে একবার টিভি দেখতে বসেছে। ব্যাস! তাকে তো পুরো পাগল করে দিচ্ছিল – ‘তোর বাবা এলে এই বলব, সেই বলব’। আর বাবু ঘুরে খুব দিয়েছে। আমার ভীষণ আনন্দ হয়েছে। তুই ভাবত ক্লাস এইটের একটা ছেলে তার পিছনে যদি অমন অকারণ খ্যাচ খ্যাচ করে তাহলে সে রেগে যাবে না? কাল বাবু ঠিক করেছে। খুব ভালো হয়েছে। মাঝে মাঝে অমন বলা দরকার। নিজে গাদা গুচ্ছের সিরিয়াল দেখবে তাতে দোষ নেই, আর আমি বা বাবু একবার টিভি দেখতে বসলেই তার মাথায় বাজ পড়ে যায়। কাল বর ফিরতেই আমি বলেছি – ‘আমাদের শোওয়ার ঘরের জন্যে এবার একটা কেনা দরকার’।”
— “শুনে কী বলল?”
— “কী আর বলবে? চুপ করে ছিল। জানে তো মা কেমন।”
অন্য দুই দিদিমণি শুরু করলেন — “কাল ফিরে আমি বধূ বরণটা দেখতে পাইনি জানিস।”
— “ও। আমি জাস্ট ঢুকেছি আর শুরু হল। ফ্রেশ না হয়েই আগে বসে গেছিলাম।”
— “কাল কী দেখাল?”
— “সেই একই জিনিস। ঝিলমিল আর তার মা শয়তানি করে যাচ্ছে। কনক মুখ বুজে সহ্য করছে।”
— “শেষ অব্দি কি হবে কে জানে? ওটা তো হিন্দি সিরিয়াল থেকে নেওয়া।”
— “হ্যাঁ, তবে হিন্দিটায় শুনেছি কনক আর ঝিলমিলের বাচ্চা হবে। ঝিলমিলের মেয়েরা ভালো, আর কনকের ছেলে খুব দুষ্টু হবে। ঠিক এটার উল্টো। আর দেখা যাবে কনকের মা ফিরে আসবে। বাংলাটায় শেষমেস কী হবে কে জানে! সিরিয়ালগুলো এত অনন্তকাল ধরে চলে যে তার আর মান থাকে না। টেনে টেনে এটা-সেটা ঢোকায় তখন আর দেখতে ভালো লাগে না। ওরা শুরুটা ভালো করে। কিছুদিন অব্দি ঠিক থাকে তারপর গাঁজাখুরি শুরু করে দেয়।”
তারপর তাঁরা অন্যান্য সিরিয়ালের কোনটার কত পর্ব চলছে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন।
বৌমাদের যেমন শাশুড়িমা নিয়ে অভিযোগ থাকে, শাশুড়িমাদেরও তেমনি বৌমা নিয়ে। অন্য এক মাঝবয়সী দিদিমণি শুরু করলেন তাঁর বৌমা নিয়ে। এই দিদিমণি তাঁর বৌমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন কিন্তু বৌমা তেমন সুবিধের না। তিনি বললেন — “আমি কখনও তাকে দুইদুই করি না। আমি তাকে বলেছি আমার মেয়ে যেমন তুইও তেমন। আমি আজ অব্দি কিছু কিনলে দুজনের জন্যেই সমান জিনিস কিনি। তবুও তার মনে হয় আমি মেয়েরটাই ভালো কিনি। আমি তাকে আগে বেছে নিতে বলি তবুও। আর সে নিজে যা কেনে বা ছেলে যেগুলো কিনে দেয় সেগুলো সব আগেই আলমারিতে ভরে দেয়, দেখায় না অব্দি।”
— “বৌমা রান্না করে?”
— “রান্না? এই যে ফিরব একগ্লাস জল অব্দি মুখের কাছে ধরে না। আমি বলে দিয়েছি। আমি যতদিন শক্ত-সামর্থ্য থাকব ততদিন আমি কারও আশা করি না। তারপর তো আমার পেনশন থাকবেই।”
শুরুতে কাউকেই আমি চিনতাম না। আজ অনেককে চিনেছি। তাদের নাম জেনেছি। সবাই আমারও মুখ চিনেছে। হয়তো বা কেউ কেউ নামও জেনে গেছে এতদিনে। অনেকের হাঁড়ির খবরও আমি জেনেছি। যে সমস্ত দিদিমণিরা ফেরিওলাদের বলেন আমরা ষাট বছর বয়েস অবধি এই ট্রেনেই যাব, কোনও চিন্তা নেই, ট্রেনের গতির সঙ্গে সমান তালে এমনি ভাবেই ছুটবে তাদের জীবন। আরও নতুন মুখ জুটবে। যাঁরা রিটায়ার করবেন তাঁদের জন্যে এপথ বন্ধ হবে। আমার জীবনও যদি মোড় নেয় অন্য পথের বাঁকে, তখনও লিখব। অন্য কথা। অন্যদের কথা। শুধু পাল্টে যাবে গল্প।