মন্দির যত বড়ই হোক, তাতে দেশ আঁটে না <br /> সরোজ দরবার

মন্দির যত বড়ই হোক, তাতে দেশ আঁটে না
সরোজ দরবার

অবশেষে রামলালা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হইয়া প্রমাণ করিলেন যে, তিনি এযাবৎ ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না। বেচারা বাল্মীকি! একজন কিংবা বহুজনে মিলে লিখে তো ছিলেন মহাকাব্য। তার প্রসারিত অর্থকে দুমড়ে-মুচড়ে মূর্তি করে একটা মন্দিরের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হল। রামের যে এমন আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হতে পারে কে জানত! এখন এই অপূর্ব আয়রনিতে মহাকবি লজ্জায় জিভ কাটবেন নাকি স্বনামে বিমানবন্দরের সান্ত্বনা পুরস্কার নিয়ে শান্ত থাকবেন, তা তিনিই জানেন। তবে, ভারতবর্ষের মানুষ হিসাবে এই ঘটনায় লজ্জা না পেয়ে উপায় থাকে না। হয়তো ক্রুদ্ধ হতে পারলেই সমীচিন হত। তবে কিনা উত্তর-বিশ্বায়ন পৃথিবীতে ক্রোধ-ও মাহাত্ম্য হারিয়েছে। তা আর জমাট বাঁধে না, ফুঁসে ওঠে না, জগদ্দল নড়াতে জাড্য সরবরাহ করে না। ফলত আন্দোলন এবং আলোড়ন নেই। কেবল নির্বিকার দেখে যাওয়া এমন কোনও সমাচার বয়ে আনে না, যা একটা একাধিপত্যকামী দলকে তার কাজ থেকে দূরে রাখতে পারে। লজ্জা সেখানেই। যে, এই সবকিছু চোখের সামনেই ঘটল। ভারতবর্ষের মানুষ, দেশের এই আমূল বদলকে স্বীকার করল কি-না বলা যায় না, তবে, বাধাও সেভাবে দেয়নি। যে-বাধা এলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ একটি মন্দিরকে সামনে রেখে দেশের খোলনলচে বদলে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারত। ঠিক এইখানেই খানিক খানিক করে দায় আমাদের প্রত্যেকের উপরই বর্তায়। একটা দল, একটা আদর্শ – যারা এই কাজকে তরান্বিত করেছে তাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া যায়, তাদের দোষ নেই এমন কথা তো নয় – তা সত্ত্বেও একটা কথা মানতে হয় যে, রাষ্ট্র তো কেবল একটা দল নয়, ফলত রাষ্ট্রের উদ্যোগ যখন সর্বোতভাবে মন্দিরগামী হয়ে ওঠে, তখন আদতে তা আমাদের অন্তর্গত মন্দিরকামিতার অনুমোদনকেই স্বীকৃতি দেয়। ভারতবর্ষ হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র ছিল গোপনে, এখন আর চোখে লজ্জা নেই।

মন্দির-রাজনীতি এ-দেশে নতুন কিছু নয়। যদি ড্যামকে আধুনিক মন্দির হিসাবে তুলে ধরে উন্নয়নের যজ্ঞ চলে, তবে তার মধ্যে যতই উদার আকাশ খোঁজা যাক না কেন, আসলে তা মন্দিরই নির্মাণ করেছে। তবে কিনা সেই বয়ান অনেকটাই নরম, লুকনো, অনুচ্চকিত। আমাদের গায়ে লাগেনি সেভাবে। তবে, বদ-হাওয়া স্বাধীন ভারতবর্ষের গায়ে যে তখনই লেগে গিয়েছে তা পরবর্তী কয়েক দশকেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। সত্যি বলতে, সে-হাওয়া আরও পূর্ববর্তী। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দরুন যখন দেশের অর্থনীতি এবং সমাজ-কাঠামো একেবারে বদলে গিয়ে ভিতর-ভিতর নতুন দেশ তৈরি হয়েই গেল, তখন থেকে যে মোটা দাগের দুই থাকের জন্ম, তাকেই উত্তরকালে পুষ্টি দিয়েছে দেশের রাজনীতি। তুঙ্গ মুহূর্তের খিলাফত আন্দোলন যেদিন থেমে গেল কিংবা থামিয়ে দেওয়া হল, দেশের সর্বজনীন নেতা হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার পর যিনি আচমকা গীতা আউড়ে নিজের অবস্থান চিনিয়ে দিতে শুরু করলেন, সেদিন ভারতবর্ষ যা ছিল, তা হিন্দু-প্রথম রাষ্ট্র ছাড়া তেমন আলাদা কিছু নয়। তবে তার পরেও বিষয়টি যে সার্বিক প্রতিষ্ঠা পায়নি, কিংবা বলা যেতে পারে, ভারতবর্ষের ঔদার্যের অনুশীলন চলেছে, তার কারণ এ-দেশের বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা বিভিন্ন সময়ের সংস্কার আন্দোলন। যা সবার উপরে মানুষকে স্বীকার করেছে, বর্ণবাদী থাককে অস্বীকার করে প্রেমকে তার মূল্য দিয়েছে। ভারতবর্ষের একটা বড় অংশের মনে ফল্গুর মত বয়ে গিয়েছে এই মানবতাবাদী নৈতিকতার স্রোত। ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যত মানুষকে অবমাননা করেছে, তত প্রতিষ্ঠান অস্বীকার করে উদার মানবিকতার আন্দোলন নানা সময়ে দানা বেঁধেছে। সুতরাং বুদ্ধের প্রায় বৈপ্লবিক ভাবনা যে ভারতবর্ষীয় চেতনার জন্ম দিয়েছে, ক্রমে তাই-ই পেয়ে গিয়েছে চৈতন্য, কবীর, দাদূ-কে, এবং সেই দেশ অবধারিত ভাবেই একদিন পৌঁছেছিল আম্বেদকরে। আর্যশ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সমান্তরালে তাই আর-একটা দেশ আছে, যা মানুষ এবং মানুষের অধিকারকেই সর্বোত স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে এবং সেই দেশটার নাম ভারতবর্ষই। ফলত এই দেশ যে যুক্তিকে মান্য করবে, বাম আদর্শকে গ্রহণ করবে এ সম্ভাবনা নিহিত ছিল কার্যকারণ সূত্রেই।

চলেওছিল সেইভাবে বেশ কিছুদিন, বেশ কয়েক দশক। এরপর একদিন বৃহৎ বাজারে এসে পড়ল কোকাকোলার বোতল। মানুষ ভাগ হয়ে গেল অসংগঠিত ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে। মন বদলাল, শ্রম বদলাল, বদলাল শ্রমের ধরন। বিশ্বায়ন নামক একটা সর্বব্যাপী আগ্রাসনের ধারণা এসে ক্রমে ক্রমে গড়ে তুলল নতুন উপনিবেশ। দেশের ভিতরকার সংগঠনকে তা যত বদলাতে শুরু করল মানুষ তত পড়ল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সমষ্টির ধারণা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এল এই আধুনিক কানেক্টেড পৃথিবীতে। এত প্রাগ্রসর পৃথিবীতে তার ভাতের ঠিক নেই, পিছনের কাপড়েরও ঠিক নেই। অথচ সে বেঁচে আছে, বেঁচে তো থাকতেই হচ্ছে। এই যে অসহায়তা, এই দীর্ঘশ্বাস ক্রমশ তাকে আবার ফিরিয়ে দিল রিলিজিয়ন অর্থে ধর্মের কাছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন আলোচনা করেছেন যে কী এক আশ্চর্য মনস্তত্ত্বে চিনা আগ্রাসনে কাজ হারনো মানুষ দক্ষিণপন্থাকেই আঁকড়ে ধরেছে আপ্রাণ। কেননা এই পন্থীর নেতারা তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন যে খাওয়া-পরার ‘গ্যারান্টি’ তাঁদের হাতে তো আছেই, সর্বোপরি আছে আপন ধর্ম রক্ষার অধিকার। তা কি আগে ছিল না? সে প্রশ্নও আপাতত আর করছে না মানুষ। কেননা এই দক্ষিণপন্থী নেতারাই একদিন তাঁদের শুনিয়েছিল এবং বারবার বলে এই কথা বিশ্বাস করিয়েছিল যে তাঁদের ধর্ম, এথনিসিটি চুরি যেতে বসেছে। এ-গল্প প্রায় গোটা বিশ্বেরই। কখনও রোহিঙ্গা, কখনও উদ্বাস্তু, কখনও আবার নিজ ভূখণ্ডের সংখ্যালঘুদের থেকেই যে এই উচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় আছে, তা দক্ষিণপন্থী নেতারা বিশ্বাস করতে পেরেছেন। ফলত আমাদের দেশে, সুপ্রিম কোর্ট যতই বলুক না কেন যে ‘৪৮ এবং ‘৯২-অন্যায় হয়েছিল, মানুষ মন্দিরে বাধা দেয়নি। বরং আজকের মিডিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে, মানুষ এই পদক্ষেপকে অভিনন্দিত করছে। এত মানুষকে অস্বীকার করলে ভুল হবে, আসলে তারা সকলে মিলে একটা গড়িয়ে যাওয়া বাস্তবতা যা আটকানোর ক্ষমতা গণের হাতে থাকলেও, জনগণ সে দায়িত্ব সময়ে পালন করেনি। ফলত, মন্দির হচ্ছেই। ভারতবর্ষ আবার হিন্দু-প্রধান রাষ্ট্র হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করছে, এবার আর গোপনে নয়, প্রকাশ্যেই।

এই মন্দিরের সবথেকে বড় সাফল্য হল, এ আর শুধু মন্দির নেই, যেমনটা রামচন্দ্র গুহ বলছেন যে, এই মন্দির গোটা ভারতবর্ষীয় রাজনীতির বয়ানকে হিন্দুত্বে টেনে আনতে পেরেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি হিন্দুত্বের ধারনা উপ্ত করে তাকে মহীরূহ করে তুলতে চেয়েছিল। এ নিয়ে তাঁদের সদস্যদের মধ্যে কস্মিনকালেও কোনও ভণিতা ছিল না। সেই রাজনীতির যাঁরা বিরোধিতা করছেন, এখন, অন্তত আপাত ভাবে দেখে যাকে বিরোধিতা বলেই মনে হয়, তাঁদের বয়ানও হিন্দুত্বের পথেই চালিত হচ্ছে। বিরোধী রাজনীতি হিন্দুত্বের নামাবলি গায়ে চাপিয়ে হিন্দুত্বেরই বিরোধিতা করছে। ফলত পুরো ব্যাপারটা যে হাস্যকর হয়ে উঠেছে কেবল তাই-ই নয়, হিন্দুত্বই যে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির কেন্দ্র ও পরিধি, তাই-ই জোরাল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সন্দেহ নেই বিজেপির নিরন্তর চেষ্টা এই বয়ানটিকে পাকা করে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে সরোজ আচার্য যাকে ‘ধনতন্ত্রের ফ্যাসিস্ট মূর্তি’ বলে থাকেন, তা আমাদের দেশে বেশ পাকাপাকি ভাবেই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে প্রথমত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা এবং পরে ‘নির্মম জুলুমতন্ত্র’ প্রয়োগে তেমন বাধা আর থাকবে। সে-পথে অনেকটা এগিয়েও গেছে এই দেশ। তাতে অনেকের আশু ক্ষতি হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে এই পথেই উন্নতির স্বর্গ রাখা আছে। আর যাদের ক্ষতি হচ্ছে, তারা এতই অসহায় এবং অসংগঠিত, এতটাই ভীত এবং বিচ্ছিন্ন যে কিছু বলে ওঠা সাধ্যের অতীত। অথচ ইতিহাস নির্মম বলেই সে সবকিছুর সাক্ষী থাকে। বুদ্ধদেব বসুকে জনৈক ছাত্র যখন হিটলারের আমলে দেশের উন্নতির খতিয়ান শোনাচ্ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ওরা তো আইনস্টানকে তাড়িয়েছে। ছাত্রের যুক্তি, ভয়ানক খারাপ লোকেদের তাড়ানোই উচিত। তাহলে রবীন্দ্রনাথ? যদি কোনও স্বদেশি হিটলার একদিন এসে রবীন্দ্রনাথকে তাড়িয়ে দিতে চায়? প্রশ্ন ছিল বুদ্ধদেবের। ছাত্র সপাট জানিয়েছিলেন, দেশের উন্নতির জন্য যদি তাড়াতে হয় তো হবে। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘যে উন্নতির জন্য রবীন্দ্রনাথকে তাড়াতে হয় সে-উন্নতি আমি চাই না কারণ মনে-মনে আমি নিশ্চয়ই জানি যে সেটা উন্নতি নয়, ঘোর অবনতি।’ ঠিক এই কথাটাই আমরা বলে উঠতে পারছি না যে, যে-উন্নতির জন্য দেশের গণতন্ত্র, বহুত্ব, এবং মানবিকতা বিসর্জন দিতে হয়, সে উন্নতি আমরা চাই না কেননা আমরা জানি যে তা উন্নতি নয়, ঘোর অবনতি।

ধনতন্ত্রের এই ফ্যাসিস্ট মূর্তি যে চিরকাল পুজো পাবে এমনটা নয়। এ-দেশের অতীত ধর্মযুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামের তাৎপর্যই নিহিত আছে। সে সিন্ধু সভ্যতা হোক বা আজকের ভারতবর্ষ- এই সত্যের হেরফের হয় না। অতএব অধিকার কেড়ে নিয়ে জুলুমের শাসন প্রতিষ্ঠা হতে পারে। ধর্মীয় আগ্রাসনের চিহ্ন মুছে দিয়ে পালটা ধর্মীয় আগ্রাসনের ইমারতও তৈরি করা যেতে পারে। তবে সেই চিহ্ন নির্মাণকারী শাসকরা যা মনে রাখেন না তা হল, ধর্মস্থান যত বড়ই হোক না কেন, সেখানে আস্ত একটা দেশ আঁটে না।

আগেও কখনও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Arna Seal 12 months

    অসাধারণ লেখা, অসাধারণ বিশ্লেষণ!

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes