
ভিসওয়াভা সিম্বোর্সকার কবিতা
অনুবাদ ও ভূমিকা– বেবী সাউ
ভিসওয়াভা সিম্বোর্সকা । পোলিশ কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। ১৯৯৬ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। প্রোভেন্টে জন্মগ্রহণ করেন, যেটি কর্নিকের অংশ। তিনি পরে তার জীবনের শেষ অবধি ক্রাকোতে বসবাস করেন। তাকে কবিতার মোজার্ট হিসাবে বর্ণনা করা হয়। পোল্যান্ডে, সিম্বোর্স্কার বইগুলো বিক্রি প্রচুর। এর ফলে বিশিষ্ট গদ্য লেখকদের তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। যদিও তিনি একবার একটি কবিতা, Some Like Poetry (Niektórzy lubia poezje)-তে মন্তব্য করেছিলেন যে হাজারের মধ্যে দু'জনের বেশি লোক শিল্পের প্রতি যত্নশীল নন। ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে, তিনি দৈনিক সংবাদপত্র, ডিজিয়েনিক পোলস্কিতে তার প্রথম কবিতা সুজুকাম স্লোয়া (শব্দের সন্ধানে) প্রকাশ করেন।।তাঁর কবিতা বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। দার্শনিক চিন্তাভাবনা এবং তার আবেশগুলিকে আলোকিত করার জন্য সিম্বোর্স্কা প্রায়ই সাহিত্যিক যন্ত্র ব্যবহার করতেন যেমন-- বিদ্রূপাত্মক নির্ভুলতা, প্যারাডক্স, দ্বন্দ্ব এবং আন্ডারস্টেটমেন্ট। তাঁর অনেক কবিতায় যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদের চিত্র রয়েছে। তবে তাঁর কবিতার অস্পষ্টতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তাঁর কবিতা তাঁর অভিজ্ঞতা, সময় এবং সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। তিনি তাঁর অস্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে পেরেছেন এমন অনেক দৃশ্য যা আমাদের চমকে দেয়। যেমন-- তাঁর মৃত মালিকের সদ্য খালি অ্যাপার্টমেন্টে একটি বিড়াল। তাঁর খ্যাতি একটি অপেক্ষাকৃত ছোট কাজের উপর নির্ভর করে, ৩৫০ টিরও কম কবিতা। এত কম কবিতা কেন প্রকাশ করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন: আমার বাড়িতে বহু আবর্জনা আছে। সিম্বোর্স্কা কবিতার জন্য ১৯৯৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন কেননা তাঁর কবিতা বিদ্রূপাত্মক নির্ভুলতার সঙ্গে ঐতিহাসিক এবং জৈবিক প্রেক্ষাপটকে মানব বাস্তবতায় টুকরো টুকরো ভাবে প্রকাশিত হয়। এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন। তাঁর কাজ ইংরেজি এবং অনেক ইউরোপীয় ভাষায়, সেইসাথে আরবি, হিব্রু, জাপানি এবং চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। সিম্বোর্স্কার কবিতা Nothing Twice, ১৯৬৫ সালে লুজা প্রুস দ্বারা পরিবেশিত সুরকার আন্দ্রেজ মুনকোভস্কির একটি গান রূপে প্রকাশিত হয়। তাঁর কবিতা পোল্যান্ডে পরিচিত করে তোলে, ১৯৯৪ সালে নাথিং টুইসের রক গায়ক কোরা কভার হিট হয়েছিল। টার্ন ছবিতে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট ব্যবহার করা হয়েছিল। বাম, ডানদিকে ঘুরুন -এ অভিনয় করেছেন তাকেশি কানেশিরো এবং গিগি লেউং৷ থ্রি কালার: রেড, ক্রিস্তফ কিসলোস্কি পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র, সিম্বর্সকার কবিতা, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট থেকে অনুপ্রাণিত। তার শেষ বছরগুলিতে সিম্বোর্স্কা পোলিশ জ্যাজ ট্রম্পেটার টোমাসজ স্ট্যানকোর সাথে সহযোগিতা করেছিলেন যিনি তাঁর রেকর্ড উইসলাওয়া (ECM, 2013) তাঁর স্মৃতিতে উৎসর্গ করেছিলেন - তাদের সহযোগিতা এবং তার কবিতা থেকে রচনাগুলির জন্য অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। সিম্বোর্স্কা ফ্রেব্রুয়ারী ২০১২ সালে ৮৮ বছর বয়সে ক্রাকোতে বাড়িতে মারা যান।
তিনটি বেমানান শব্দ
আমি যখন উচ্চারণ করি ‘ ভবিষ্যৎ ‘… ‘ফিউচার’
তার প্রথম সিলেবলটাই হয়ে যায় অতীতের অন্তর্গত
যখন আমি বলি ‘চুপ’ ‘নীরব’
সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করি তাকেও…
‘কিছুই না’ যখন উচ্চারণ করি আমি
তখন এমন কিছু তৈরি করি যা আমার সত্তাকে প্রকটিত করে তোলে…
প্রকৃত প্রেম
সত্যিকারের ভালোবাসা–এটা কি স্বাভাবিক, এটা কি ঐকান্তিক, এটা কি অভ্যেস!দু’জন লোক, যারা তাদের নিজস্ব দুনিয়ায় বিরাজ করে, কী পায় পৃথিবী তাদের কাছ থেকে!
লাখ লাখ মানুষ জানে, এলোমেলো ভাবেই হোক, একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই এটি এভাবেই ঘটে যাবে— মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবে একটি প্রাপ্তি,সামান্য পাওয়া
আর নেমে আসবে আলো। কোনোদিক থেকে…কোথাও থেকে…
শুধু এই দু’জনের ওপর…
অন্যদের ওপর কেন নয়?
কোনও উত্তর নেই। বিচার করাও অসম্ভব!
এটা কি আমাদের এতদিনের শ্রমসাধ্যভাবে তৈরি করা নীতিগুলিকে ব্যাহত করে না? এবং উভয় ক্ষেত্রেই নৈতিকতাকে শিখর থেকে নিক্ষেপ করে না?
সেইসব সুখী কপোত-কপোতীর দিকে তাকান, তারা কি সামান্য হলেও অন্তত আড়াল করার চেষ্টা করতে পারে না, তাদের বন্ধুদের জন্য একটু বিষণ্ণতা! সামান্য আড়াল!
তাদের হাসির শব্দ, তাদের স্পষ্ট বাকচাতুরী আমাদের কুপিত করে!
এবং তাদের সামান্য উদযাপন, আচার-অনুষ্ঠান, বিস্তৃত পারস্পরিক রুটিন – স্পষ্টতই মানব জাতির পিছনে একটি চক্রান্ত, মনেহয়!
আর জনগণ যদি তাদের দেখে শুরু করে অনুসরণ, ভাবুন বিষয়গুলো গড়াতে পারে কতদূর!
ধর্ম এবং কবিতা কিসের উপর নির্ভর করবে? ভাবতে পারেন? মনে করতে পারেন? ধরে রাখতে পারেন সীমার মাঝে অসীম প্রেমকে?
সত্যিকারের প্রেম– এটি কি সত্যিই জরুরি?
চতুর কৌশল এবং বাস্তব বুদ্ধি আমাদের বলে এক্ষেত্রে নিশ্চুপ হও…ঠিক যেন জীবনের বিরাট ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া একটা দুর্ভাগ্যের কলঙ্ক! এর সাহায্য ছাড়াই নিখুঁত এবং নিপুণ শিশু জন্মগ্রহণ করছে, করেছে…
হাজার হাজার বছর ধরে চলছে গ্রহ, নক্ষত্র…
কিন্তু সত্যিকারের প্রেম আসে বিরলে,একান্তে
যে যা ভাবে ভাবুক, যারা পায়নি খুঁজে এই সত্য প্রেম, ভালোবাসা
তারাই মরতে পারে সহজে
বাঁচতে পারে সহজভাবেই…
দ্বৈত নয় কিছুই
কোনো কিছুই কখনও দুবার ঘটতে পারে না। ফলশ্রুতিতে, দুঃখের বিষয় হল আমরা এখানে নিজেকে গড়ে নেওয়ার জন্য আসি এবং অনুশীলনের সুযোগ ছাড়াই চলে যাই। এমনকি যদি কেউ না থাকে, আপনি যদি গ্রহের সবচেয়ে বড় বোকা,লেট লার্নারও হন, আপনি গ্রীষ্মের ক্লাসগুলি পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন না যেহেতু এই কোর্সটি শুধুমাত্র একবার অফার করা হয়।
গতকাল, অথবা কোনো দু’টো রাত অবিকল একই ভাবে, অবিকল আসে কি! একই চুম্বনের পুনরাবৃত্তি কি সুখ শেখাবে তোমাকে!
একদিন, সম্ভবত একটি অলস জিভ দুর্ঘটনাক্রমে আপনার নামটি উল্লেখ করেছে আর আমার মনে হলো যেন সমস্ত ঘরে গোলাপ ছড়িয়ে পড়লো তার সঙ্গে যুক্ত হলো রঙ এবং ঘ্রাণ…
পরের দিন, যদিও তুমি আমি একসঙ্গে আছি, তাও আমি সময়ের দিকে তাকাতে পারি না…
এইযে গোলাপ
এই গোলাপ
এটি কী আসলে!
একটি ফুল না একটি পাথর?
কেন যে আমরা এই ক্ষণিকের দিনটিকে এত অপ্রয়োজনীয় ভয়ের সাথে আচরণ করি এবং দুঃখ করি! এটা কি প্রকৃতজ!
বর্তমান চলে যায়, চলে যায় অতীতও! হাসি এবং চুম্বনের সঙ্গে, আমরা মিলিয়ে নিই, খুঁজি তারার নীচে করে ফেলা প্রেমের ইস্তেহারগুলি।
আর আমরা দু’জনেই জানি সবকিছু দুই ফোঁটা জলের মতো আলাদা…সবকিছু আলাদা…
প্রথম দেখাতেই প্রেম
দু’জনেই বুঝেছিল,
একটি অনুভূতি হঠাৎ তাদের একত্রিত করছে
যেটি নিশ্চয়তার মতো সুন্দর,
অনিশ্চয়তার চেয়ে সুন্দরতম…
ভেবেছিল তারা,
চেনে না তো একে অপরকে,
কিছুই তো ঘটেনি তাদের মধ্যে
এই রাস্তা, সিঁড়ি…
এই করিডোর
কোথায় সেই স্মৃতিচিহ্নমণ্ডিত পথ
বহু যুগ আগে দেখা করতে পারে তারা?
আমি জিজ্ঞাসা করি তাদের,
জাগাও স্মৃতির সরণী –
মনে করো, মনে করো—
একটি ঘূর্ণায়মান দরজার মুখোমুখি তোমরা
একদিন ভিড়ের মধ্য থেকে ভেসে আসা “দুঃখিত”
অথবা ফোনে “ভুল নম্বর”?
কিন্তু উত্তর ছিল জানা
উঁহু, তাও মনে নেই তাদের…
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তারা
ভাগ্য তাদের খেলাচ্ছে অবিরত
ভাগ্য যখন অপ্রস্তুতের ফাঁদে
নিত্য জড়ায় মায়ার মোহপাশ
কাছের মানুষ আপন হলো বুঝি
এগিয়ে আসে ভালোবাসার হাত
পথের পাশে পথ কাটারই খেলা
হাসি তখন পালিয়ে যায় দূরে
গানের সাথে মৃদু ইশারায়
ব্যাখাতীত ব্যাপার হলো বুঝি!
বছর তিনেক অথবা মঙ্গলবার
কাঁধের পাতা অন্য কাঁধে পড়ে
হারিয়ে গেছে অথবা আশ্রয়ে
ঝোপের মাঝে যেমন লুকায় বল
শৈশবেরই হাতে?
হাতল দেওয়া কলিং বেলের মতো
হাতের পরে অন্য হাতের মায়া
স্যুটকেসের সেই লাগেজ ভরা মন…
হয়তো ছিল স্বপ্ন ভুলে হাঁটতে চাওয়া একটি ছোট্ট রাত
শুরুর আগে শুরুর শেষে
কিন্তু ঠিক খোলাই থাকে
ভাগ্য আঁকা বই…
নিজের খারাপ অনুভূতির প্রশংসা
বাজপাখি কখনও বলে না এটি কোনও খারাপ কাজ
প্যান্থার জানেই না ছলচাতুরীর মানে…
পিরানহা যখন আঘাত করে, তার তো তখন লজ্জা করে না!
যদি সাপের হাত থাকত সেও বলতো
তার হাত পরিষ্কার…
শেয়াল বোঝে না ‘অনুশোচনার’ মানে!
সিংহ এবং উকুন কখনই সরে আসে না তাদের চলার পথ থেকে…
তারা কেনই বা এমন করে, তারা কি জানে তারা সঠিক?
যদিও ঘাতক তিমিদের হৃদয়ের ওজন এক টন
তাও সে হালকা অন্য যে কোনও উপায়ে…
সূর্যের এই তৃতীয় গ্রহে
পশুত্বের লক্ষণগুলির মধ্যে এক নম্বর হলো তাদের ‘পরিষ্কার বিবেক’…
বেবী, কবিতাগুলো ভালো লাগল, অনুবাদ।
অনুবাদ বেশ ভালো লাগল। আবহমানের এই অনুবাদ প্রকাশ খুব প্রশংসনীয়। অনেক কিছু শিখছি।
এত আপন করে নেওয়া কবিতার অনুবাদ
দ্বৈত সঙ্গীতের মতন