বেবী সাউ-এর কবিতাগুচ্ছ
অঙ্গে রাধা
১.
তোমাকে দেখিনি আমি, কত রাত ঝড়-জলে গেল
এদিকে বৃষ্টির দিনে বাঁশি বাজে দিগন্তরেখায়
ডাকে ? ভাবি কতদিন কেন সে ডাকে না…
আমার অসুখ সেই
যে জীবন যায় খড়কুটোটির মতো…
লুকিয়ে থেকেছি তার পাশে গান, আত্মহত্যা হয়ে…
২.
তাহাকে দেখিনি আমি, হয়তো দেখেছি আজ যাকে
এখন বৃষ্টির দিনে, তার পাশে শুয়ে থাকি…
যে তুমি আমার গান, যে তুমি আমার প্রার্থনাটুকু
তোমাকে নিবিড় ভেবে বহুজন্ম কবিতার মায়া
আমি তার ভেঙে ফেলা কাটাছেঁড়া শব্দ,
পদাবলী ভেবে বিরহী কবি সে যতনে সাজায়
৩.
আমি যে কীর্তন বলি, আমি যে ইমন বলি রাত…
যে আমার পাশে শোয় অর্ধদগ্ধ বৃন্দাবনী সুরে
যে আমার লুপ্তসুর, যে আমার ভোরের শিশির
যে আমার স্নানজল, যে আমার ঠোঁটে মাধুকরী
যে আলাপ গেয়ে ওঠে সঞ্চারীতে রুদ্রবীণা তালে…
আমি যে লালনগান, আমি যে সুমনকাব্য হই
আমি যে রবীন্দ্রতীর্থে ছিন্নপত্রে একাকী বিষাদ আঁকি…
আমি যে ভাসানজল, আমি যে কৃষ্ণচূড়াগান
আমি যে আমার অঙ্গ, প্রতি অঙ্গে সন্ধিপূজা পাতি…
আমি যে ভীষণ কান্না, ধুলোমাখা পাগল ভজন
তোমাকে দিলাম সবই
অভিসার, আপনি বৈষ্ণব হোন…
৪.
আসে, নিয়তির মতো। সে আসবেই, জানি…
মুখে অন্ধকার লেগে, চোখে প্রেম, প্রেমে নাশকতা…
তোমাকে কি চিনি আমি? আমরা তো সকলে অচেনা…
প্রতিটি প্রেমের গল্প কখনও কি এক হতে পারে?
সে যদি বিধির বিধি,
আমি তার বিরহবেদনা…
রাধা এক চৈতন্য, অন্ধকারে একাকী চেতনা…
৫.
অথচ তাহার পথে মেঘ পেতে রাখি…
শস্য কণাটির মতো শুয়ে থাকি রোজ…
বুঝি বা রোদের আলো আমার নির্ঘুম চোখে সবুজের ছোঁয়া দিয়ে যাবে!
অথচ খাদক সেই ছিনিয়ে নিতে পারে জীবনের সুপ্ত মোহটুকু…
শুকিয়ে পুড়িয়ে মারে
যাতনার পথ বেয়ে উঠে বসি তাও
ধুলো মুছি…
সেবাটুকু নিও শুধু গোঁসাই ঠাকুর!
৬.
অক্ষরের খেলা সেরে নবীন বাউল সেই
মায়াময় চোখে
প্রেম পেতে ধরে
বহু বহু জন্মধরে আমার প্রার্থনা, উপাসনা
নিজেকে আহত করে
যে পথিক পথটুকু বুঝে নেয় শুধু
তার কাছে পেতে দিই শীতল বাতাস,
করুণ ঘুঙুর
তোমার কঠোর চোখ এখানেও কলঙ্ক বোঝাবে!
৭. আমি আছি… আমি আছি… সত্য এই প্রিয়
আমার সমস্ত প্রাণ বৃথা বয়ে যায়
আমার সমস্ত জ্ঞান মিথ্যা মনে হয়
নিজেকে আহত করে ভ্রম গুণি চোখে
কেউ কী নিজের নয়? এই ছায়াঘেরা পথ, রোদ?
দু’দণ্ড কথার মায়া দেবে নাকি কেউ?
বুকের প্যাঁচালো পাখি শীতল মালসা যেন…
ধীরে ধীরে পিঁপড়েরা আসে
চেটেপুটে খায়…যায়…
রাধিকা নামের মেয়ে যাতনায় সাজে…
৮.
তাহাকেই মুক্তি মেনে মনে মনে রোজ মরে যাই
কোলাহল হয়
শহরের বাঁকগুলি ভরে যায় কলঙ্ক রোপণে
শাখা-প্রশাখায় খাঁজে ঝুলানো দড়ির মায়া;
কদমের কাল এলো ভেবে শ্রাবণও নামে
বস্ত্র ভিজে যায়
অঙ্গ ভিজে যায়
পাগলিনী বেশ এই মৃতের অধিক
দয়াপরবশ, মৃতদেহটিকে দেবে শ্যামের বাঁশুরি
৯
.ঘুম ভেঙে যায়
চারপাশে মায়ার সংসার
তার মাঝে রাধা আমি পাশা-কড়ি পাতি
তোমাকে দেখিনি শ্যাম, তুমিও দেখোনি
অবেলার খেলা শুরু হতে হতে বেলা চলে যায়
এঁটো বাসনের ঝুড়ি থেকে বেরোয় কালনাগ…
এ ভূমি,শেখায় যে ভূমিকা তারকাছে চুপ করে থাকি…
চিরবাউলিনী মন, তোমাকে পাওয়ার লোভে বৃথা কেটে যায়…
১০.
গতমভিসারে চলি
বাঁশি বেজে যায় দূরে
নাওয়া খাওয়া ভুলে এই যোগিনী যাপন
কেউ কি কাঁদবে তাকে দু’বেলার ডাকে?
অভিমান নেই
অভিযোগও গড়ে নি তেমন
নিজের শোকের কাছে চুপচাপ বসি,
ভাত বাড়ি, ফ্যান দিই…
কাক-শালিকেরা আসে, ছড়ায় প্রত্যহ
নিজের খেলার সাথে দু’বেলার সেই ডাক
তোমাকেই ভুলে যায় বাঁশরিবাদক