বিপুল তরঙ্গরে <br /> শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

বিপুল তরঙ্গরে
শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

পুরুলিয়া

মোবাইল-ভাইরাস-ব্যস্ততা-অসুখ সমাচার..
এসব কিছু মিলে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বেঁচে থাকা। সবেই রাতপাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেদ করে রাস্তা চিরে সাঁই সাঁই ছুটে যাওয়া এম্বুলেন্সের শব্দ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে, কিন্তু জীবনের অনিশ্চয়তা কোথাও কি ঝাঁপ ফেলছে না ! মায়াময় আনন্দ গান থামিয়ে দিচ্ছে না বাদামি ঠোঁটের পাখি?
দাপাচ্ছে মেঘ চোখের ভেতর, অনুশাসন চলছে আর্শিনগরের চৌহদ্দিতে, কমে আসছে মনের সাথে মনের মিশেল..এত সমস্ত দশ দুগুণে আশির অসঙ্গতি এড়িয়ে আমরা সাহিত্য চর্চা করছি। বন্ধ্যা হতে দেবো না সাহিত্যের ভুমিকে তাই এই প্রচেষ্টা। সফল হই বা না হই চেষ্টা যখন একমাত্র অবলম্বন তখন সামনে তাকিয়ে শুধু হেঁটে যাবো এইটুকু জোর। এবং তখন দেখি আমাদের সৃষ্ট প্রচেষ্টা গুলি তারা হয়ে জ্বলছে নিভছে আমাদের নিজস্ব আকাশে। শিল্প সাহিত্য চর্চা সে এক ঘোড়ারোগ বলতে পারেন,বিশেষত এই রকম দিনে ,যখন মনে হয় সময়ের বৃত্ত টাকে যদি অনেকটা চওড়া করে নেওয়া যেতে পারতো! ছুটছি ছুটছি আর ছুটছি ..তার মধ্যে
পড়ন্ত বিকেল, ঘুঘু ডাকা নির্জন দুপুর, চিলেকোঠার ফিসফাস..বেনে বউ মাছরাঙা শঙ্খচিলের উল্লাস-এক্কা-দোক্কা,তিলফুল,সরষে খেত…মাঠ ,নদী দিনান্তের উদাস বাউল…এইসব চালচিত্র নিয়ে বুকের মধ্যে অনুরণন ! সময় কোথা ,সময় নষ্ট করার!!
কিন্তু আমরা করছি..অন্তত প্রয়াসটা ধরে রাখছি..আপনজনের মতো বাংলা সাহিত্যকে আগলে রাখার একটা চেষ্টা করছি ,সে কতখানি সফল আমরা তার হিসেব ভবিষ্যৎ দেবে,কিন্তু একেবারেই গোড়ার মাটিতে জল না দিলে তো ফুলটুকুর প্রত্যাশা করাই অনুচিত।
কেন এত গৌরচন্দ্রিকা! কারণ আমি শিবরঞ্জনী গাইতে বসেছি তাই আলাপ একটু প্রলম্বিত হলো।
কারণ আমি তরঙ্গ নামক একটি শিল্প নিয়ে কথা বলতে বসেছি। যার উৎস একটি উন্নত মানের সাহিত্য এবং সাহিত্যিক। সাহিত্য চর্চার অপ্রতুলতা নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা আমাদের ঘিরে ধরেছে বলেই এতসব কথার আলাপ জোড়া।
পলাশ দে র তরঙ্গ নিয়ে বহুজন বহু কথা বলেছেন। বলেছেন পলাশ একজন কবি তাঁর সৃষ্ট তরঙ্গ একটি কবিতার ছবিকারী …
কথাটা সর্বাংশে সত্যি।আমার মন আরো একটু এগিয়ে ভেবেছে পলাশ একজন সাহিত্যিক এবং তরঙ্গ সিনেমার শরীরে একটি কাব্যিক মুক্তগদ্য , বলা যাক ছান্দিক গদ্য। সিনেমার খুঁটিনাটি বুঝিনা আমি ,বুঝি ভালো অথবা কম ভালো ,বেশি ভালো লাগার ব্যাপার। বুঝি প্রেক্ষাগৃহ পেরিয়ে দর্শক পেরিয়ে কতখানি থাকছে তার রেশটা…
তরঙ্গ নিয়েই কেন এত কথা বলছি ,কিছু বিষয় থাকে যেগুলি বারবার বলতে ইচ্ছে হয়..এই জাদু বাস্তবতা তরঙ্গ তৈরি করতে পেরেছে আমার ভেতর তাই এতদিন পরেও তার রেশ থেকে যাচ্ছে।
“তেলেনাপোতা আবিষ্কার” গল্পটা পড়ে মনে খালি প্রশ্ন জাগতো তেলেনাপোতা আবিষ্কার কেন হবে? এমন একটা মৃত্যুপুরীর মত যে গ্রাম তাকে আবার আবিষ্কার করতে হয় নাকি!
পরে উত্তরটা পেয়েছি ঠিক যেমনভাবে,
তেমনভাবে তরঙ্গ সিনেমা নিয়ে প্রশ্ন ছিল তরঙ্গ কেন?কিসের তরঙ্গ হবে?
বুঝতে পারলাম তরঙ্গ আসলে জীবনের সঙ্গেই জুড়ে থাকে, তরঙ্গ আসলে এক জীবন থেকে অন্য জীবনে ছড়িয়ে যাওয়ার গল্প বলে। এক পরিসর থেকে অন্য প্রেক্ষিতে সরে যাওয়ার গল্প বলে।যে জীবন দেখতে খুব সাদামাটা তার ভেতরেও জমতে থাকে অভিযোগ অভিমান ক্ষোভ অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা সেগুলি পুঞ্জীভূত হয় নিশ্চুপে তা বহন করে চলেন মানুষ তার জীবনযাপনে সেই তরঙ্গ নিস্তরঙ্গ জীবনের ভেতরে প্রবহমান। এই দহন ও সহনই হয়তো জীবনের পূর্ণতা।যেমন করে আগর গাছের ক্ষতস্থান থেকে জন্ম নেয় সুগন্ধ আতর। সিনেমাতে সেই তরঙ্গের বিনির্মাণ দেখলাম।
দেখেছি তরঙ্গ ,
যার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।রিভিউ লেখার মত বিদ্যে নেই আমার। সে ক্ষমতা বিশেষদের থাকে কিন্তু কিছু কথা যেগুলি আমাদের মতো সাধারণ মানুষদেরই বোধহয় বলা উচিত ,তাই কিছু না পারি এটুকু পারবো যে তরঙ্গ কী আর কতটা বলে আমার মনে হয়েছে সেটুকু বোঝাতে।
সিনেমা তো প্রচুর দেখি।বলতে গেলে আমাদের এই ছোট্ট শহরটিতে ওটাই একমাত্র বিনোদন।অনেক সিনেমা দেখতে যাই সবাই মিলে একটু হৈ চৈ করে আনন্দ করার জন্য। কিন্তু কিছু সিনেমা আমি হলে বসে দেখতে যাই কারণ একটা দায় থেকে।শিল্পের যেমন সমাজের মানুষের প্রতি দায় আছে। সমাজের মানুষেরও শিল্পের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। তবেই শিল্প বাঁচে, শিল্পী বাঁচেন।
তরঙ্গ নিয়ে আমার উচ্ছ্বাস ছিল শুরু থেকেই।
তার কারণ এটি পলাশ দে (যিনি অত্যন্ত উচ্চ মেধার একজন কবি)-র বিনির্মাণ। কবিতাকে যেমন একটা ভিড় থেকে টেনে এনে পলাশ আলাদা করে নিজের নামে চিহ্নিত করতে পেরেছেন তেমনই তাঁর নির্মিত সিনেমাও যে স্বতন্ত্র পথে হাঁটবে এবং কেমন সেই পথ সেটা জানার কৌতূহল। বাদশা মৈত্র আর সোহিনী আমার ভীষণ প্রিয় একজন অভিনেতা / অভিনেত্রী এত দক্ষ শিল্পী তাঁরা দুজনই, ভীষণ সম্মান করি তাঁদের ,তাঁদের দক্ষতাকে। এটা ছাড়াও আর একটা বড় কারণ এর সেই মন খারাপিয়া ভালো না লাগার কথা বলা গান ও তার সুরটা (দেবজ্যোতি মিশ্র)।
সব চাহিদাগুলো পূরণ করে দিয়েছে তরঙ্গ।
যাঁরা উচ্চকিত শব্দ, গান, নাচ ঝলমলে দৃশ্যের টানে দেখবেন তাঁরা খুশি হবেন না। কিন্তু যাঁরা গল্পলোভী শিশুর মত মন নিয়ে দেখবেন তাঁরা গল্প পাবেন। মহৎ অভিনয় দেখার লোভে দেখবেন তাঁরা সেই সুযোগ পাবেন একশ ভাগ। মানুষকে ছুঁয়ে যায় মানুষের দুঃখ বেদনা। এখানে অভিনয়ের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে বাদশাকে অতিক্রম করে অভিজিৎ মনে এসে বসত করতে শুরু করে। মনখারাপ হয়ে যায়। চোখ ভিজে যায় রোগাক্রান্ত, স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া অসহায় মানুষটির জন্য। হাহাকার করে ওঠে মন।
যখন তাঁকে দেখি স্ত্রীর কাছে এসে শেষ চেষ্টা করেন আবার যদি ফেরা যায়! কিন্তু পিছিয়ে পড়লে বোধহয় আর ট্র্যাকে ফেরা যায় না। হতাশ একটা মানুষ, সব হারানো একটা মানুষের অসহায় অভিব্যক্তি এই সিনেমার সম্পদ যা বর্ষার মেঘময়, বৃষ্টিময় প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সোহাগের চরিত্রে সোহিনী এতটাই স্বাভাবিক, বিস্মিত হতে হয়, কতটা দক্ষতা থাকলে এত স্বাভাবিক অভিনয় করা যায়। এক একটা রাগ যেমন ধীর লয়ে সুরের বিস্তার করে এই গল্পের চলন তেমন। ধীর লয়ের ..
প্রকৃতি এই সিনেমার সম্পদ। পলাশ জানেন নিঃসঙ্গতার রঙ ধূসর, তাই বর্ষাকাল এই গল্পের সময়। স্বপ্ন আর গন্ধ সন্ধান এই গল্পের লক্ষ। একটা জায়গাতে গানের কথার সঙ্গে কালো মেঘেদের ভেসে যাওয়া অদ্ভুত প্রতীকী সৃষ্টি করেছে।
একটা দৃশ্য যেখানে সোহাগ দোলাচলতা কাটিয়ে রাজীবের প্রেমকে বাদ দিয়ে বন্ধুত্বকেই স্বীকার করে নেয়, সেখানে রাজীবের অস্থিরতা মনকে নাড়া দেয় স্বপ্ন তো তারও ভাঙে। স্বপ্ন ভাঙার তো শব্দ হয়না, তাই সেই গল্পতো বিলম্বিত লয়েই এগোবে। কী নিয়ন্ত্রণ গল্পকারের!এই গল্প মূল্যবোধের, এই গল্প সততার পাঠ দেয়, এই গল্প সব শেষ হয়েও অনেক কিছু থেকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়।
যখন শূন্য ঘরে অভিজিৎ এর সুগন্ধির বোতল বাইরে পড়ে, সোহাগ সেটা আবিষ্কার করে এবং গন্ধ ঘষে নেয় হাতের উপর
ওই দৃশ্যে আমি শুধু একাকী নিঃসঙ্গ, স্বপ্ন বুকে নিয়ে সরে যাওয়া অভিজিৎকেই দেখতে পাই। মনে হয় সোহাগের জীবনের সুগন্ধ ফিরিয়ে দিতেই হয়তো…
রাজীব (রনজয় বিষ্ণু) বিপ্লব (অমিত সাহা) এত মানানসই চোখ থেকে সরে গেলেও মন থেকে সরেন না।
আগর গাছের সন্ধান আসলে একটি লক্ষের সন্ধান- অপূর্ণ স্বপ্নের সন্ধান…
গল্পটি একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য। যে কারণে আমার মনে হয়েছে তরঙ্গ বিনির্মাণ সেটা এই গল্পের চরিত্রদেরকে গল্পের বাইরে বের করে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করাতে পারার কৌশলের কারণে।
তাঁরা যে একটি বার্তা দিচ্ছেন পরিচালক সেটা বুঝতেই দেননি। গল্পটা দেখতে সরল গতির কিন্তু তা যে নয় সেটা পরে বুঝলাম, দূরে এসে… দেখলাম দূর থেকে আগর গাছের ঘন জঙ্গলে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা ভেঙে যাওয়া মানুষের স্বপ্নগুলোর বিগত-গন্ধ, শিমুল তুলোর মতো ভাসছে অনেক মানুষের অসহায়তা, ভাসতে ভাসতে স্থায়িত্ব হারিয়ে বিলীন হবে বলে।
যেমন ভীষণ মধ্যবিত্ত দুটো মানুষ তাদের মধ্যেকার সংঘাত গুলি ভীষণ স্বাভাবিক গতিতে ঢুকেছে গল্পে, নিরুচ্চার অথচ কী অসম্ভব বাঙময়! শিল্পী বিপ্লবরা তো আমাদের চারপাশেই আছে, অভাবের তাড়নায় পেশা বদলে ফেলছে,বাপ ঠাকুরদার শিল্পকে ব্যবসাতে রূপান্তরিত করতে বাধ্য হচ্ছে। হয়ে উঠেছে মজুর, শ্রমিক শিল্প হারিয়ে ফেলছে তার আভিজাত্য। যেটা পুরুলিয়ার ছৌ এর মুখোশের কারিগর হউন বা ছৌ নৃত্য শিল্পীই হউন অথবা এমন কত হারিয়ে যাওয়া শিল্প ও শিল্পীদের ক্রাইসিস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর “শিল্পী” গল্পের মদনের যা লড়াই ছিল বিপ্লবদের লড়াইও তো একই প্রেক্ষিতে। শিল্প ও শিল্পীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করে মুনাভা লোভী স্বার্থপর ব্যবসায়ী শোষক শ্রেণি সবসময় তাদের দাবিয়ে রাখে। এই সমস্যা সর্বকালের। কিন্তু গল্পকার তথা পরিচালক সমস্যা দেখিয়েই থেমে যাননি , সমাধানের পথ দেখিয়েছেন।
সোহাগ ও বিপ্লবের কথোপকথন অংশে সোহাগ দিশা দেখাচ্ছে বিপ্লবের মত আরো শত সহস্রকে।
হবে না মানে! হতেই হবে
সকলের মধ্যে মত আদান প্রদান হবে, একদিন করে সকলে মিলে বসে আলোচনা হোক..পারবো না বিপ্লব দা! নিজেদের একটা স্বপ্ন পূরণের ঘাঁটি হবে!
মনে হলো এ তো সেই বিশ্বাস
“আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি…”
কেমন যেন ঘোর লাগে সোহাগের মুখের সরল হাসি দেখে,প্রত্যয় দেখে ,চিহ্নিত করতে পারি এই প্রত্যয়কে
আমরা যারা হাজারটা টিলা টপকে টপকে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ি আবার চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়াই।
জেদকে আলিঙ্গন করে ভাবি হতেই হবে…
পলাশের লেখার মধ্যেও এই প্রত্যয় থাকে। তারই তরঙ্গ তিনি বইয়ে দিতে চেয়েছেন।
আবার দুটি সম্পর্কের মধ্যে যে নৈঃশব্দ, অভিজিতের অপরাধবোধ আর সোহাগের অভিযোগ এর মধ্যে পড়ে সম্পর্ক যখন গতি হারায় মানুষ শার্সিতে আটকানো মাছির মত ছটফট করে। মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের মারাত্মক নিয়তি এটাই যে সম্পর্কের ভেতর টান নামক সুতোটি ছিন্ন হলেও তাকে বয়ে চলতে হয়।তার মাঝেই বাস করতে হয়…পলাশ দে এর সমাধানও অদ্ভুত কৌশলে দিয়েছেন..
অভিজিৎ অভ্যাসের বন্ধন থেকে সোহাগকে মুক্ত করে অন্য একটা ছায়ার সন্ধানে যাত্রা করে।যেখানে নিভৃতে তাঁর স্বপ্নরা বাসা গড়েছে, যেখানে রোগ জর্জরিত জীবনকে কৃত্রিম জীবনীশক্তি (কেমো) দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে অসুন্দর করে তোলার বাধ্যবাধকতা নেই। বরং যেটুকু আছে মুঠোর ভেতর তাই দিয়েই আট দুগুণে আটশো করে নেওয়ার অদম্য প্রাণময় প্রচেষ্টা আছে।
আসলে সমাধান চারপাশেই ছড়িয়ে থাকে। সহৃদয় ইচ্ছের অভাব শুধু তাকে আঁধার করে রাখে।

প্রত্যেকটি চরিত্র যথাযথ অভিনয় করেছেন। এই গল্পের যেটা দাবি ছিল ঠিক তেমনটি।
পুরুলিয়ার দৃশ্যপট আমার চেনা, কাছের, বলেই হয়তো এত বেশি ভালো লাগলো। কিন্তু এটা বারবার মনে হয়েছে
চাইলে পলাশ ঝাঁ চকচকে করে সাজাতে পারতেন এর দৃশ্যপট, সুদৃশ্য পোশাকে তুমুল নাটকীয় সংলাপে বিনোদনের চূড়ান্ত প্রোডাক্ট তৈরি করতেই পারতেন। করেননি কারণ পলাশের মধ্যে থাকা একরোখা শিল্পনিষ্ঠতা কাজ করেছে । তাই ধূসর বিষন্নতার রঙ আঁকতে হয়নি তাঁকে। বর্ষার প্রকৃতিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিয়েছে।বর্ষার প্রকৃতি, রুক্ষ প্রান্তর না হলে
“ভালো লাইগছ্যা নাই “শব্দসুর এত সুদূর প্রসারিত হতো কি?
যে সুর হাওয়ার সাথে ঘর করতে শুরু করে।
সোহাগের দোলাচলতা, অভিমান,কষ্ট
অভিজিতের যন্ত্রণা পুরুলিয়ার এই প্রকৃতি যা বাইরের মানুষের কাছে পিছিয়ে পড়া জেলা বলে উপেক্ষিত সেই প্রকৃতিই ফোটাতে পেরেছে।কারণ এর মাটিতেই ছড়িয়ে আছে সেই অভিমান, অভিযোগ আর রুক্ষ প্রচ্ছন্ন প্রত্যাখ্যান।
মুখোশ শিল্পীদের গ্রাম বলেই সেটা পুরুলিয়ার দৃশ্যপটে নির্মিত হতে হবে এমনটাই নয় শুধু। অনাড়ম্বর জীবনের ভেতর যে গল্পের বীজ উপ্ত,যার মূল ক্যানভাসটাই সাদা-কালো অথচ যার যাত্রা লাল মাটির পথের মতো স্বপ্নময়তার দিকে সেটির জন্য পুরুলিয়ার তুলনায় কম ব্যবহৃত জায়গাগুলির উঠে আসা অনেক হিসেবের ফল। হিসেব আরো আছে..সিনেমায় ব্যবহৃত গানটির ক্ষেত্রে। দেবজ্যোতি মিশ্র এর সুর এবং তাঁর কন্ঠকে দুর্দান্ত সফল ব্যবহারের মধ্যে। গায়ক দেবজ্যোতি মিশ্রকে আমি অন্তত প্রথম শুনলাম। আনকোরা এমন কন্ঠ গানটিকে চূড়ান্ত সফল সৃষ্টি করে তুলতে পেরেছে। গানের কথাগুলো উতলা করে দেয়…হল ছেড়ে বেরিয়ে এসে বহুদিন পরেও মন কী এক অব্যক্ত বিষণ্নতায় হু হু করে উঠলে এখনো কানে বাজছে-
“ভালো লায়গছ্যা নাই, এটা বইলতেও আর ভাল লায়গছ্যা নাই”
শুধু লালন আর তার মাসির চরিত্রে যিনি, তাঁদের উচ্চারণে মানভূমের ভাষা একটু শ্রুতিকে পীড়া দিয়েছে। এর জন্য ওয়ার্কশপ দরকার ছিল। অথবা স্থানীয় অনেক শিল্পী আছেন যাঁরা এই অংশটি উৎরে দিতে পারতেন সুন্দরভাবে। আবহসংগীতের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বাজনাই ব্যবহৃত হয়েছে। দু একটা জায়গায় আমার মনে হয়েছে একটু উচ্চকিত। আরো পরিমিত হলে গল্পের নৈঃশব্দ অধিক অনুভূত হতো। তবে পরে জেনেছি এই বাদ্য যন্ত্রটিও বিরল এবং যিনি বাজিয়েছেন তিনিও বিরলদের মধ্যে পড়েন। একটা লোকবাদ্যর আবহ নির্মিত হয়েছে।
পুরুলিয়ার বাঁধনা পরবে যেমন
অহীরা গীতি … গেয়ে ওঠে ধাঁগড় (গায়করা) আর বেজে ওঠে বাদ্যযন্ত্র সমেত শিঙ্গা-সানাই তার মধ্যে থাকে জাগরণ এর কথা ।তরঙ্গ তো জাগরণের গল্পই।তাই এই আবহ সঙ্গীত সুপ্রযুক্ত।

এই সিনেমায় একটি কথা বারবার মনে হয়েছে
কতটা সংযত থাকলে একজন বড় মাপের শিল্পী হওয়া যায়!
সোহিনী বাদশা, রনজয়, অমিত,ক্যামেরার পেছনে যিনি (অমর) দেবজ্যোতি মিশ্র যিনি সামা বেঁধেছেন এই গল্পের। একটি মাত্র গান দিয়েই কেল্লাফতে এবং সর্বোপরি পলাশ দে যিনি গল্পকার, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালনার কাজটি করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। গানের কথা লিখেছেন যিনি তিনিই সেই মেধাবী কবি
ভালো লাগছে না,ভালো লাগছে না প্রায়ই বলি, ভাবি নি কোনদিন, সত্যিতো এটা বলতেও ভালো লাগে না আর। গানটা শোনার পরই মনে হলো কথাটা কী ভীষণ সত্যি।
অসাধারণ নয় বরং সাধারণ সব কিছু বলেই জটিল মনস্তত্বও দুর্বোধ্য লাগে নি। এই সাধারণ ব্যাপারটাই সর লাগা জলের তরঙ্গ যার গায়ে চাঁদও ভাসে জলেরই মাপে।
কিন্তু সিনেমাটা তো শেষ হয়েও শেষ হয় নি। যেমন জীবন শেষ হয়েও অনেক কিছুর ভেতর থেকে যায়। তাই অনেকের সৎ একটি প্রচেষ্টার গল্প হয়ে থেকে যাবে তরঙ্গ। অনেকদিন পর ভালো একটা গল্প উপভোগ করলাম।যে দর্শককে বাধ্য করে ভাবতে। আমাদের চিন্তার অনুশীলন নেই আজকাল। তাই যা দেখি পড়ি সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাই। ভুলে যেতে পারি অনায়াসে।তরঙ্গ ভুলি নি, কারণ চিন্তা করার অনুশীলন ফিরিয়ে দিয়েছে তরঙ্গ।
শেষ দৃশ্যকে আরো একটু জমাট করা যেতো হয়তো…যেখানে শিল্পীদের তৈরি মুখোশের প্রদর্শনী হচ্ছে সেখানে।তবে খামতি পূরণ করে দিয়েছে দুর্দান্ত সুন্দর বর্ণময় একটা মধুরতা।
সোহাগের অপেক্ষায় দূরে এসে দাঁড়ায় রাজীব। বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো।
রোমান্টিক দৃষ্টি, রঙিন পাঞ্জাবি পরিহিত সুদর্শন নায়ককে ভারী ভালো লাগে। মুহূর্তটি অনেক কথা গেল বলে,কিছু না বলেও।এই সিনেমাকে একটি কবিতা বলেছেন অনেকেই।
বেশ কিছু দৃশ্য কবিতার মতোই ব্যঞ্জনাময়। অনেকভাবেই এই দৃশ্যগুলি দর্শকের মস্তিষ্কে বোধে অনুরণন তুলতে পারে।
অভিজিৎ স্ত্রীর জন্য ডিমের ডালনা রান্না করে। সোহাগ তা ছুঁয়েও দেখলো না… বললো খেয়ে ফিরেছে। অভিজিৎ কোন অভিযোগ না করে ডিমের ডালনা খুব ঝাল দিদিমণি খেতে পারেনি তাই রামুদাকে নিয়ে যেতে বলেন…
ঠান্ডা হয়ে আসা জুড়িয়ে আসা সম্পর্ক যে কত প্রদাহ দিতে পারে এই দৃশ্যটি তার প্রমাণ। কষ্ট হয় অভিজিতের জন্য। রাগ হয় সোহাগের উপরে।
আবার নদীর তীরে বসে সোহাগ যখন বলেন
কতবার বললাম IVFটা করিয়ে নাও, পেট ব্যথা পেট ব্যথা কিন্তু ডাক্তারের কাছে গেলেই না।
তখন দর্শকের সমস্ত সহানুভূতি সোহাগের দিকে। এই পরিমাপে প্রত্যেকটি চরিত্রের দিকে তাঁদের স্রষ্টা সমান নজর দিয়েছেন। সমান যত্ন নিয়েছেন, কোথাও কোথাও এসে স্বাধীনতা দিয়েছেন দর্শককে তার নিজের মতো করে ইন্টারপ্রেট করে নিতে। অনেকদিন পর একটা গ্রাম দেখলাম যে ছবির মত সুন্দর নয়,বাস্তবের মতো খাঁটি,যেখানে রাস্তায় কাদা, পুকুরে বৃষ্টিপতন তরঙ্গ তোলে… উদাসীন নির্বিকার প্রকৃতির মতো ইতিউতি বসে থাকে মানুষ। যেন মনে হয় কোথায় আঘাত রাখা আছে,কষ্ট গচ্ছিত আছে তা তো মানুষের জানা..তাকে তুলে নিয়ে মাখিয়ে নাও তোমারই প্রতিবিম্বদের মধ্যে।যেন বুঝিনি কোথায় কেন বিষণ্নতা থাকে ঘাপটি মেরে, যা ভালো লাগছে না র অসুখ ছড়িয়ে দেয় মনের ভেতর…বুঝে নেওয়ার জন্য পলাশ দে র তরঙ্গ আমার ছবি হয়ে উঠেছে,আমাদের হয়ে উঠেছে। যেন সুতীক্ষ্ণ শেলের মতন বুকে বিঁধে থাকে স্বপ্ন এর সন্ধানে পুনরায় যাত্রার অভিলাষ…কিন্তু ফিরে যাওয়া যেন শেষ কথা নয়।
ফিরে আসাই চরম সত্য হয়ে থাকে শেষ দৃশ্যে।
তখন ধূসর বিষাদ ঢেকে যায় বৃষ্টির রঙে।

আমরা বাংলা ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে গেল গেল রব তুলি, মূল্যবোধ হারিয়ে গেল বলে কপাল চাপড়াই আর একজন দর্শকটুকু হয়ে সাহায্য করতেও এগিয়ে আসবো না তাহলে কোন ভরসায় বাঙলা সিনেমার প্রযোজক, পরিচালকরা রিস্ক নেবেন?
তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ুক।
ও বলাই হয়নি, যেটা পুরুলিয়ায় আগে কখনো হয়নি
স্বয়ং সিনেমার পরিচালক , প্রধান অভিনেতা এসে দর্শকদের মতামত শুনলেন। খারাপ বা ভালো সে যাই হোক সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন হাসিমুখে। ভালো কথা যে অনেক বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক এবং বিশিষ্ট মানুষজন এসেছিলেন। পাশে বসে সিনেমা দেখার উত্তেজনাই আলাদা। ভবিষ্যতে আরো অনেক ভালো কাজের প্রত্যাশা রইল। বহুদিন যাবৎ অযৌক্তিক দৃশ্য, ঘটনা, উচ্চকিত শব্দ, অতিরঞ্জন সমন্বিত “মুভি” দেখে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা চোখ তরঙ্গের মতো অঙ্গুলিমেয় দু একটি সিনেমাই দেখতে সুযোগ পায়। আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর এমন কিছু সৃষ্টি যা অন্তর্দৃষ্টিকে শুদ্ধতা দান করে, তৃপ্ত করে মননকে। মানুষকে ভাবায়, সিনেমার গল্পকে নিজের জীবনের সঙ্গে জুড়ে সমাধানের পথ সন্ধানে প্রেষণা হয়ে ওঠে তরঙ্গ। তাই তরঙ্গ থাকবে মানুষের মনে। বাংলা সিনেমার সুসময় ফিরে আসবে পলাশ দের মতো চিন্তায় ভাবনায় আধুনিক ,বুদ্ধিমান সাহিত্যিক সিনেমাওয়ালাদের হাত ধরে। মানুষ হল মুখী হবে এই স্বপ্ন সাধ জাগিয়ে গেল তরঙ্গ।
ভালোর জয় হোক।

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (3)
  • comment-avatar
    Prakalpa Bhattacharya 2 years

    খুব সুন্দর ঝরঝরে রিভিউ। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। লেখিকাকে কুর্নিশ!

  • comment-avatar

    Review deoao ekta shilpo. Ekta osadharon review pelam.

  • comment-avatar

    Osadharon review.

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes