‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ও কবির জাগরণ ধর্ম
পার্থজিৎ চন্দ
"চৈতন্যের সঙ্গে ‘মগ্ন’ শব্দটিকে যোগ না-করলে কিছুতেই তাঁর জগৎ ছোঁয়া যাবে না। এই মগ্নতাই তাঁর কবিতাকে সার্থক ভাবে চিহ্নিত করে, তাঁর কবিতায় বারবার যে ‘জেগে থাকা’র কথা পাওয়া যায় তাকে আসলে নিছক ‘কনসাসনেস’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। একটি দুর্গম পাহাড়ি পথের শেষে জেগে থাকা প্যাগোডা, প্যাগোডায় বুদ্ধমূর্তির সামনে জ্বলে থাকা আলো যেমন নিছক দর্শকের জন্য জ্বলে থাকে না, সে আলোর প্রকৃত রূপ আবিষ্কার করতে গেলে যেমন মগ্নতার ভিতর ডুব দিয়ে বারংবার প্রক্ষালন করতে হয় সত্তার, ক্রমশ যোগ্য হয়ে উঠতে হয়, শঙ্খ ঘোষ-এর কবিতার ভেতর ডুব দিতে গেলে সেই মগ্নতার যোগ্য হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি ভীষণ জরুরি। "
আত্মবীক্ষণের কাছেই তিনি যে বারবার ফিরে এসেছেন সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। গূঢ় এষণার প্রবাহ, সত্তা ও সত্তার সংকট তাঁর লেখার সব থেকে বড় উপজীব্য, আমাদের চিন্তন-প্রবাহের বাইপোলারিটিকে অতিক্রম করে যাওয়ার পরেই সন্ধান পাওয়া যেতে পারে তাঁর সত্তার ‘একত্বের’।
চৈতন্যের সঙ্গে ‘মগ্ন’ শব্দটিকে যোগ না-করলে কিছুতেই তাঁর জগৎ ছোঁয়া যাবে না। এই মগ্নতাই তাঁর কবিতাকে সার্থক ভাবে চিহ্নিত করে, তাঁর কবিতায় বারবার যে ‘জেগে থাকা’র কথা পাওয়া যায় তাকে আসলে নিছক ‘কনসাসনেস’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। একটি দুর্গম পাহাড়ি পথের শেষে জেগে থাকা প্যাগোডা, প্যাগোডায় বুদ্ধমূর্তির সামনে জ্বলে থাকা আলো যেমন নিছক দর্শকের জন্য জ্বলে থাকে না, সে আলোর প্রকৃত রূপ আবিষ্কার করতে গেলে যেমন মগ্নতার ভিতর ডুব দিয়ে বারংবার প্রক্ষালন করতে হয় সত্তার, ক্রমশ যোগ্য হয়ে উঠতে হয়, শঙ্খ ঘোষ-এর কবিতার ভেতর ডুব দিতে গেলে সেই মগ্নতার যোগ্য হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি ভীষণ জরুরি।
শঙ্খ ঘোষ’এর কবিতায় ‘জেগে থাকা’র যে কথা বারবার ফিরে ফিরে আসে সে জাগরণের চরিত্রটিকে এক ছাঁচে ঢেলে তাকে অনুধাবন করতে অনেক সময়ে ভুল হয়ে যায় আমাদের। আমাদের ‘রাজনৈতিক’ ‘সামাজিক’ প্রজ্ঞার ধারা বেয়ে সে জেগে থাকাকে ‘অ্যলার্টনেস’ হিসাবে গণ্য করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি আমরা। অস্বীকার করা যায় না ‘যমুনাবতী’ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শঙ্খ ঘোষ-এর বহু বহু লেখায় এই ‘সামাজিক’ ও ‘রাজনৈতিক’ জেগে থাকার কথা আছে। এই জেগে থাকার মধ্যে এক সচেতন অথচ নীরব ক্ষিপ্রতার ধারা লক্ষ করা যায়।
কিন্তু শঙ্খ’র জেগে থাকার আরেকটি রূপ’ও আছে; তিনি জেগে থাকেন এক মগ্নচৈতন্যের মহাদেশে…সেখানে তিনি একজন আর্দ্র মানুষ। সেখানে অনুচ্চ বাইপোলার অবস্থা, ডুয়ালিটি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। দ্বান্দ্বিকতাকে অতিক্রম করে সেখানে তিনি মাঝে মাঝে গাঙ্গেয় ডলফিনের মতো ভেসে উঠেছেন; আবার নিজেকে অতি-দৃশ্যমানতার থেকে আড়ালে রেখেছেন – দুটিই সমান সত্যি।
এখানে, এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে নেওয়া জরুরি; প্রকরণের দিক থেকে তিনি বাংলা কবিতার ‘সুবিখ্যাত’ সহজিয়া ধারাকে নির্বিচারে গ্রহণ করে দায় সারেননি। তাঁর কবিতার ভিতর প্রবেশ করলে, সচেতন ভাবে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ভারতবর্ষ-সহ সারা পৃথিবীর দর্শনের ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি আলোচিত যে বিষয় – কনসাসনেস – তিনি গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে উপনিষদ, লালন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ – বারবার সেই রহস্যময় দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। Allusion-রূপে সেগুলি যত না তাঁর লেখায় এসেছে তার থেকে অনেক বেশি এসেছে দর্শনগত মূল প্রশ্ন রূপে।
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ এমনই এক সন্ধানের ধারাপাত, কনসাসনেস মগ্ন-চৈতন্য ইত্যাদিকে আশ্রয় করে সে হয়ে উঠেছে এমনই এক আশ্চর্য সৃষ্টি যার প্রতিটি পঙতির ভিতর লুকিয়ে রয়েছে আবিষ্কারের আনন্দ।
২
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে শুয়ে থাকে ‘সহজ পাঠ’ –এর দ্বিতীয় ভাগ, ‘বাদল করেছে। মেঘের রঙ ঘন নীল। ঢং ঢং করে নটা বাজল। বংশু ছাতা মাথায় কোথায় যাবে? ও যাবে সংসার-বাবুর বাসায়…।’
বংশুর সংসার-বাবুর বাসায় যাবার আগেই ‘সহজ পাঠ’ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে, সেখানে ফুটে ওঠে ঘণ্টার ধ্বনি ও একজন শ্রোতার ভূমিকা।
বেশ কয়েক দশক আগে উইলিয়াম জয়েস এই ঘণ্টাধ্বনি ও শ্রোতার ভূমিকা নিয়ে যে সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন তা আসলে আমাদের সচেতনতা চৈতন্য সত্তা ও সত্তার সংকট নিয়ে এক বিরাট কুহক, দর্শনের মূল রহস্যের বিষয়।
শঙ্খ ঘোষ-এর ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ও ‘সহজ পাঠ’এর একটি আপাত নিরীহ টেক্সট যখন কাছাকাছি এসেই গেছে তখন আরেকটি বিষয় ধরে নেওয়া যাক। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ সকাল থেকে প্রথমবারের জন্য ওই সকাল ন’টায় সচকিত হয়েছিলেন ঘণ্টাধ্বনির দ্বারা। এবার কনসাসনেসের প্রশ্নে বিষয়টি জটিল হয়ে পড়বে একটু একটু করে।
নিশ্চয় সকাল থেকে একই রকম ভাবে ঘণ্টাধ্বনি হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রথম শুনেছেন সকাল ন’টায়। তা বলে তো আগের ঘণ্টাধ্বনিগুলি মিথ্যা হয়ে যায় না; অর্থাৎ এখান থেকে এমন একটি সিদ্ধান্তে কি পৌঁছানো সম্ভব যে ‘আগের ঘণ্টাধ্বনির স্মৃতি’ রয়ে গেল কোনও ‘আনকনসাস’ স্টেটের ভিতর; এবং প্রথমবার ঘণ্টাধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্মৃতি মনোযোগের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে কনসাসনেসে রূপান্তরিত হয়ে গেল শুধু?
এবার এখান থেকে আরকটি সিদ্ধান্তেও কি পৌঁছানো সম্ভব, ‘জেগে থাকা’র যে কথা শঙ্খ ঘোষের কবিতার ক্ষেত্রে বারবার ফিরে আসে তাও আসলে এক প্রবহমান ধারার অংশ? যে মুহূর্তে কবি নিজে ‘জেগে ওঠবার’ ক্ষণটিকে অনুভব করছেন সে মুহূর্তটি মনোযোগের রূপান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়।
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ মনোযোগের হঠাৎ রূপান্তরের’ও বিপরীত এক প্রক্রিয়া, এটি মগ্ন-চৈতন্যের প্রবহমানতার প্রলম্বিত রূপ।
বাহ্যিক দৃশ্যমান জাগরণের ভূমিকায় ফুরিয়ে এসেছে এখানে।
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ‘যুক্তির ঘেরাটোপ’কে অতিক্রম করে যাওয়া এক মহাদেশ, এটি অনেকটা হুয়াং-লাং’এর তিনটি প্রশ্নের মতো, যেখানে এসে প্রশ্নগুলি উত্তর ও উত্তরগুলি প্রশ্ন হয়ে ওঠে। প্রশ্ন তিনটির দিকে একবার তাকানো যাক,
প্রশ্ন- প্রত্যকেরই জন্মের নির্দিষ্ট স্থান আছে। তোমার জন্মস্থান কোথায়?
উত্তর – সকালে আমি এক দলা ভাত খেয়েছি, কিন্তু এখন আমার আবার খিদে পাচ্ছে।
প্রশ্ন- আমার হাত ক্রমশ বুদ্ধের হাতের মতো কোমল ও সুন্দর হয়ে উঠবে কী করে?
উত্তর- চাঁদের আলোয় বাঁশি বাজানো একমাত্র উপায়।
প্রশ্ন- আমার পা একটা গাধার পায়ের মতো লাগছে কেন?
উত্তর- একটি সাদা সারস যখন বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে তখন তার গায়ের রঙ আলাদা মনে হয়।
-এগুলি প্রত্যেকটিই এক একটি ‘কূট প্রশ্ন’। প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ও উত্তরের অভিন্নতা শুরু হয়ে যায়। ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’র মধ্যে এই চূড়ান্ত অভিন্নতা আছে, আছে প্রতারক ‘চিহ্ন’কে মুছে দিয়ে তার ভিতর লুকিয়ে থাকা রূপটিকে, সত্যকে সন্ধান করবার প্রক্রিয়া। যে জলজ উপাদান এই লেখাগুলিতে রয়েছে তা বাহ্যিক আলোড়নকে সূচিত করে না। জলের ভিতর থেকে উঠে আসা আলো ফিরে যাচ্ছে জলে, ঠিক যেমন উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে, আগুনের স্ফূলিঙ্গগুলি ফিরে যায় আগুনে। ধাতব মেধার হাত থেকে মুক্তি পেলেই একমাত্র শুনতে পাওয়া সম্ভব সেই জলের শব্দ।
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’-এ তাই কোনও রকম সচেতন আলেপন’ও লক্ষ করা যায় না, শুধু বোঝা যায় কোথাও বৃষ্টি হয়ে চলেছে, শান্ত বৃষ্টি; আর সেখানে নিজেকে একটু একটু করে মুছে ফেলার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে এক সত্তা। সে সত্তার কাছে জলাভাস, সেখানে আবার তপশ্চারণের কোনও বাহ্য লক্ষণ নেই। সে সত্তা সেই অর্থে নির্মায়িক’ও নয়, তারও আসঞ্জন আছে। সে আসঞ্জন আব্রহ্ম আসঞ্জন, যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে নির্লিপ্তি ও উদাসীনতা। এই আশ্চর্য রসায়নের ধারা বেয়েই তৈরি হচ্ছে ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’।
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ তার পরাপাঠে আরেকটি প্রশ্নেরও সূচনা করে দেয়, মৃদুভাবে হলেও এই প্রশ্নটিকে অস্বীকার করা যায় না। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন,
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
নৌকার গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে’।
-এই তীব্র assertion মুহূর্ত হয়তো কনসাসনেস দাবি করে, যার মধ্য দিয়ে সচেতন ভাবে মুছে দেওয়া যায় অতীত ও ভবিষ্যৎ’কে। কিন্তু কালের তিনটি অবস্থার মধ্যে দুটিকে মুছে কবি কি বর্তমানের অনিবার্যতাকে দেখাতে চাইলেন? না কি এই দুটির বিলোপের মধ্য দিয়ে তিনি তৃতীয়টির নশ্বরতাকেই চিহ্নিত করলেন আরও বেশি করে?
দ্বিতীয় সম্ভাবনাকেই বেশি সত্য বলে মনে হয়। এই কবিতাটিতে ‘ছলছল’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ করার মতো, শব্দটির মধ্যে যুগপৎ দূরতিক্রম্য মায়া, অনতিক্রম্য আসঞ্জন ও উদাসীনতা রয়েছে। এই সবগুলিই ‘বর্তমান’ নামক কালের অবস্থাকে ছারখার করে দেয়, পড়ে থাকে শুধু এক ‘শূন্যতা’র অসম্ভব আদিকল্প। জলজ গুল্মের ভারে ভরে থাকা শরীরের কথা বলে কবি আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন প্রত্ন আদিম অবস্থার কাছে। দাঁড় করিয়ে ছিলেন এমন এক সাঁকোর মাঝখানে যার দু’দিক পুড়ে যাচ্ছে। আসলে শূন্যতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে ‘বর্তমান’ নামক অবস্থাটিও। অথবা যে শূন্য নিজে কানায় কানায় পূর্ণ তাকে শূন্যের পূর্ণতা নামেও অভিহিত করা যেতে পারে। মাইক্রো হয়তো এভাবেই ম্যাক্রো’কে অনুধাবন করে এং এক সময়ে এসে মাইক্রো ও ম্যাক্রো’র মধ্যে সীমারেখা বিলুপ্ত হয়ে যায়,
‘ঝড়ে-ভাঙা লাইটপোস্ট একা পড়ে আছে ধানক্ষেতে
শিয়রে জোনাকি, শূন্যে কালপুরুষের তরবারি
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে শেষ, নিঃশব্দে প্রহর দশ দিকে
যেদিকে তাকাও রাত্রি প্রকাণ্ড নিকষ সরোবর’।
৩
একবার সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে গেলে স্রষ্টার ভূমিকা ধীরে ধীরে অপসৃত হতে থাকে, অপসৃয়মান স্রষ্টার ছায়ার নীচে ধকধক করে জ্বলতে থাকে সৃষ্টি। ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ধরে রেখেছে এই মহাসত্য’কেও। জেন-এ বর্ণিত ‘sitting quietly, doing nothing’ যতটা না শারীরিক বিষয় সমূহের ব্যবকলন প্রক্রিয়া, তার থেকে অনেক বেশি এই স্থিরতার মধ্যে দিয়ে এক উপলব্ধিতে পৌঁছান, যেখানে গিয়ে আবিষ্কৃত হতে পারে ‘fatal confusion of fact with symbol’। শুধু মাত্র ফ্যাক্ট’কে খুঁজে পাওয়া কবির লক্ষ্য হতে পারে না, শঙ্খ’ও এখানে বস্তু শিলা-পাথর ও পারিপার্শ্বিকের উপর পড়ে থাকা প্রতারক আচ্ছাদন খুলে নগ্ন করে দিয়েছেন, দেখেছেন তার ভেতর ফুটে থাকা লাভার সত্য’কে,
‘ঘিরে ধরে পাকে পাকে, মুহূর্তে মুহূর্তে ছেড়ে যাই
জলপাতালের চিহ্ন চরের উপরে মুখে ভাসে
তাঁবু হয়ে নেমে আসে সূর্যপ্রতিভার রেখাগুলি
স্তব্ধ প্রসারিতমূল এ আমার আলস্যপুরাণ’।
-এই আলস্যপুরাণের মধ্যে নিশ্চেতনা খুঁজতে যাওয়া বৃথা ও ঘাতক, কারণ এখানেও শঙ্খ ‘জেগে’ রয়েছেন। অনাসক্তির ভিতর এই জাগরণ এক অপাকৃতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা। সামাজিকতার ফাঁস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা, নিজের চারদিকে এক বর্ম গড়ে তোলার সন্ধানে সারাজীবন নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন শঙ্খ,
‘খুব অল্প ভাল লাগে এইসব বহু বিচ্ছুরণ
খান খান হতে থাকা রংকরা সামাজিকতায়।
মাটির ভিতরে শস্য নিভৃত আশ্বাস নিয়ে বাড়ে
বুকে ইথারের ভারে নিশ্চল হয়েছি একেবারে’!
-শস্যের নিভৃত আশ্বাসের প্রতীতি তাঁর কবচকুণ্ডল। এই বিরল অপাকৃতির কারণে শঙ্খ’র মৃত্যুবোধকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না, সেও যেন এক জীবনের প্রবাহ – ধান ও গান–মাখা,
‘চোখের পাতায় এসে হাত রাখে শ্লথ বেলপাতা
পাকা ধান নুয়ে প’ড়ে আদরে ঘিরেছে শরীরীকে
বালির গভীরে তলে ঘন হয়ে বসে আছে জল
এখানে ঘুমানো এত সনাতন, জেগে ওঠা তাও’।
-‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’-এ শঙ্খ একজন মাধুকরী করা মানুষ, দিনের শেষে তিনি মাটির হাঁড়ি ভেঙে ফেলে চলে যাচ্ছেন দূর থেকে দূরে। কিন্তু কিছু মুহূর্ত আগে তিনি মাধুকরী করে পাওয়া অন্ন গ্রহণ করেছেন পরম মমতায়, অন্নের সামনে বসে তাকে প্রণাম’ও করেছেন হয়তো। অথচ এ মুহূর্তে আসঞ্জন’কে অতিক্রম করে যাবার ক্ষেত্রে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই,
‘দাও ডুবে যেতে দাও ঐ পদ্মে, কোরকে, কোমলে
দাও চোখ ধুয়ে দাও ভোরের আভার, জন্মভোর
শিরায় শিরায় বাঁধো, পাপড়িগুলি ঢেকে বলে দাও
ফিরে যাওয়া যাওয়া নয়, সেই আরো কাছাকাছি আসা’।
-কিন্তু শিল্প ও স্রষ্টার মধ্যে যে সন্ত্রাসের সম্পর্ক – সেখানে স্রষ্টা সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই শিল্পের ভিতরমহলে পৌঁছান, জয়ী হবার পরের মুহূর্তেই নিজেকে সমর্পণ করেন শিল্পের কাছে। কারণ জয়ের সেই মুহূর্ত পর্যন্ত’ই তার প্রাণশক্তি, তারপর তাঁকে ‘মৃত্যু’র কোলে ঢলে পড়তে হয়। এই সন্ত্রাসের সম্পর্ক ছাড়া সমস্ত শিল্প আসলে ব্যর্থ শিল্প,
‘মাটি খুব শান্ত, শুধু খনির ভিতরে দাবদাহ
হঠাৎ বিস্ফার তার ফেটে গেছে পাথরের চাড়।
নিঃসাড় ধুলায় দাও উরিয়ে সে লেখার অক্ষর
যে লেখায় জ্বর নেই, লাভা নেই, অভিশাপও নেই’।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও দর্শনের ‘কিছুই না-হওয়ার’ প্রক্রিয়ার সঙ্গে, লক্ষণের সঙ্গে একজন কবির কিছুই না-হয়ে ওঠার পার্থক্য যে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এবং সে কারণে didactic হবার কোনও দায় নেই একজন কবির, নিজের শরীরে যে কোনও গান নেই তিনি তা উপলব্ধি করেন। দেখেন ‘দূরের লোকের এসে ধুলোপায়ে কেনাবেচা করে’। এই দেখাটুকু লিখে তিনি নিজেকে মুছে দেন, তারপর একটি সম্ভাবনা আমাদের মাথার ভেতর পাক খেতে থাকে – গানের এই না-থাকাই কি সেই গাছটির মৃত্যুর কারণ? গান কি তাকে কাঠুরের হাত থেকে বাঁচাতে পারত? তা হলে গান’ই কি সেই প্রতিরোধ যা মৃত্যুকে প্রতিহত করে রাখে কিছুদিন?
এমনকি একজন কবি এই ‘কিছুই না-হয়ে ওঠার’ দিকেও তাকিয়ে দেখবেন, দেখবেন তাঁর নিয়তির কাছে ঘুরে বেড়ানো আলো-অন্ধকার’কেও,
‘প্রগাঢ় অন্যায় কোনো ঘটে গেছে মনে হয় যেন
কিছু কি দেবার কথা কিছু কি করার কথা ছিল?
থেমে থাকা বৃষ্টিবিন্দু হাড় থেকে টলে পড়ে ঘাসে
ভেজা বিকেলের পাশে ডানা মুড়ে বসে আছে আলো’।
-কিছু যে ‘দেবার কথা’ ছিল না, কিছুই যে করার কথা ছিল না তা কবির থেকে বেশি কেউ জানেন না। তা হলে দ্বিতীয় পঙতির শেষে প্রশ্নচিহ্ন কেন? এই প্রশ্নচিহ্ন কবির আত্মপ্রশ্নকে সূচিত করেছে। ‘প্রগাঢ় অন্যায়’ শব্দদুটির মধ্যে খুব মৃদু শ্লেষ লুকিয়ে রয়েছে।
যে বৃষ্টিবিন্দু থেমে ছিল তা হাড় থেকে টলে পড়ে যাচ্ছে ঘাসে। যেন শেষ সংশয়টুকু ঝরে পড়ল ঘাসে, হাড়মজ্জার ভেতর লুকিয়ে থাকা শেষ সংশয়। এর পরের দেখাটুকুই পাঁজরে দাঁড়ের নেমে আসা শব্দ, ‘ভেজা বিকেলের পাশে ডানা মুড়ে বসে আছে আলো’।
শ্রোতা-নিরপেক্ষ এই শব্দ, জল ও পাঁজরের মধ্য থেকে উঠে আসা শব্দ যদি কেউ শুনে ফেলেন তবে সেটি তার বহুজন্মের পুণ্যের ফল, জল ও পাঁজরের কোনও সচেতন ভূমিকা নেই নিজেকে প্রকট করে তুলে শ্রুতিগ্রাহ্য হয়ে ওঠার। জেগে থাকার এও এক বিশেষ অবস্থা ও পরিণতি।
সুগভীর আলোচনা। ভাল লাগল।
অনেক দিন আগে বুদ্ধদেব গুহর একটা লেখায় পড়েছিলাম, ঠিকমতো অনুবাদ হলে ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ নোবেল পুরস্কার পেতে পারত। আজ তোর লেখা পড়ে বুঝতে পারলাম কথাটা কতটা সত্য।