ধারাবাহিক উপন্যাস
যে আমারে চায়
তৃতীয় অংশ
ঈশা দেব পাল
রুদ্রর দিল্লি যাপন আর তারপর দিল্লির চাকরি হঠাত চলে গেলে চেন্নাইতে যায় সে নতুন চাকরি নিয়ে। স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে কি ক্রমশ দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে তার ? সে কি কাজ আর কাজের স্বপ্নের মধ্যে থাকতে থাকতে দূরে সরে গেল পরিবারের বন্ধন থেকে ? এই যন্ত্রণা, অসহায়তা আর সাফল্য মিলেমিশে যেতে থাকে তার জীবনে। কর্পোরেট জগতের অন্ধকারের পাশে আলোটুকুও অবশ্য ধরা দেয় তার কাছে। আর ক্রমশ সে বুঝতে পারে লড়াই করবার জেদ থাকলেই জীবন হতে থাকে সহজ। সে চাকরি ছেড়ে তার স্বপ্নের জায়গা নিউ দিল্লির নেহেরু প্লেসে খুলতে পারে তার নিজস্ব প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। কিন্তু এরমধ্যেই অকস্মাত আসে লকডাউনের বিপদ। আসে আরেক নতুন চ্যালেঞ্জ। তবু কাজ, কাজের স্বপ্নই পথ দেখায় তাকে। ‘ পথ আমারে সে দেখাবে যে আমারে চায়’ এই রবীন্দ্র পংক্তিই যেন তার জীবনের নির্ধারক। এক সহায় সম্পদহীন বাঙালি যুবকের বাংলার বাইরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠার অদম্য লড়াইয়ের কাহিনিই ‘ যে আমারে চায়’।
পূর্বের পর্বগুলি— প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
দশ
রুদ্র অফিসে ঢুকেই বালন আর প্রসেনকে বলল— আজ আমরা চল অফিসের পরে একটু নেহেরু প্লেসে যাই। কিছু খাওয়া দাওয়া করি।
রুদ্র সাধারণত এরকম বলেনা। বালন আর প্রসেনজিত দুজনেই খুব অবাক হল। রুদ্র খুব হিসেব করে চলে আর কাজ ছাড়া তো কিছুই বোঝেনা। ওকে দেখলে ওদের সবসময়ই মনে হয় কী এক ব্রত নিয়ে এসেছে বুঝি সে।
ঘুরে বেড়ানো আর খাওয়াদাওয়ার জন্য যদিও কর্ণট প্লেস খুব ভালো জায়গা, কিন্তু নেহেরু প্লেস হলে তিনজনেরই ঘরে ফেরার সুবিধে হয় তাই নেহেরু প্লেসের কথাই বলল। তাছাড়া ওই বৃহত্তম মার্কেট আর চারিপাশের উঁচু উঁচু অফিস রুদ্রকে খুব টানে। সে একধরণের স্বপ্নের মুখোমুখি হয় ওই মার্কেটটার সামনে এসে দাঁড়ালে।
বালন নিজের জগতে থাকে। সে খেতে যাবার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল। প্রসেন চোখ মটকে জানতে চাইল—ব্যাপার কী ?
এখানে তারা দুজনে মাঝে মাঝেই বাংলা বলে । রুদ্রর আগে ধারণা ছিল বাংলা কেউ বোঝেনা, তাই ঠাট্টা ইয়ার্কি বা বসকে নিয়ে দু একটা মজা বাংলায় করাই যায়। কিন্তু প্রসেন বলে দিয়েছে, একেবারেই না। দিল্লির এড এজেন্সিগুলোয় এত বাঙালি , আর বেশিরভাগ জনই দু তিন জায়গায় কাজ করে এখানে এসেছে। তাই সবাইই ভালো বাংলা বোঝে। সেইজন্য বাংলায় কোনো সিক্রেট বলা যাবেনা।
রুদ্র চাপা হেসে বলল— আনন্দী আসছে কাল । অবশ্য দিন দুই এর জন্য। তাই আজকে আমাদের ব্যাচেলারস পার্টি।
হাহা করে হাসছিল প্রসেন। বালনকে ডেকে বলল—দেখো, বিবাহিতদের সুখ। বউ আসছে বলে কী খুশ !
তিনজনে তারা অফিস ছুটির পর নেহেরু প্লেসে যখন এল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজছে। আসলে তো তাদের ছুটির কোনো টাইম নেই। তাদের কাজ চলে দিনে রাতে সারাদিন। তবু নিজেকে তারা বার করে নিয়ে আসে কম্পিউটারের সামনে থেকে। কম্পিউটার সারানোর দোকানগুলো বন্ধ হবার মুখে। কিন্তু খাবার নানা জায়গা খোলা। বালন বলে—চল একটা খুব সস্তা চাইনিজে নিয়ে যাই।
দিল্লির পরিবেশের মধ্যে একটা ফুরফুরে ভাব আছে বেশ। জীবন যেন অনেক সহজ। রুদ্র দিল্লির রাস্তাঘাটে যেটা খেয়াল করে শুধুই সেটা হচ্ছে বড় বড় অফিস বিল্ডিং। আকাশ ছোঁয়া বাড়ি এক একেকটা। রুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাসে আসে, বাস থেকে নামে আবার অফিস ফেরত আকাশের দিকে তাকিয়েই বাসে ওঠে। অথচ দিল্লির নাগরিক জীবন বেশ আকর্ষণীয়, চমৎকার। ছেলেমেয়েরা সুন্দর সেজে থাকে। কলকাতার গরীব ভাবটা একেবারেই নেই। রাজপথ ঝকঝকে। আনন্দীকে নিয়ে যেবার এসেছিল সেবার তারা পয়সার অভাবে খুব পথে হেঁটেছিল। হেঁটে হেঁটে একটা ধাবায় খেতে যেত, যেটা বাসে গেলে তিন চারটে স্টপ। আবার হেঁটে দেখেছে অনেক কিছুই ।
বালন যে চাইনিজ দোকানে নিয়ে এল সেটা একটা খোলা গাড়ি আসলে। একটা পার্কের একপাশে দাঁড়ানো। এই গাড়িটা নাকি রোজই সন্ধে থেকে রাত অব্দি এখানেই থাকে। বেশিরভাগ লোক গাড়ি দাঁড় করিয়ে খাবার কিনে গাড়িতে বসেই খাচ্ছে। তারা গ্রেভি মিক্সড চাউমিন আর চিলি পর্ক চাইল। লোকটা ওদের জন্য একটা ফোল্ডিং টেবিল আর চেয়ার এনে দিল।
রুদ্র খাবার নিতে গিয়েই বুঝল লোকটা বাঙালি আর তার বউ , যে রান্না করছে সে নেপালী। এখনো প্রবাসে বাঙালি দেখলে একটা বাড়তি উচ্ছ্বাস হয় বইকি। সে কিছুক্ষণ আলাপ করে জানালো সে আসলে উত্তরবঙ্গের ছেলে। রুদ্রর জাড়তুতো বউদিও নেপালী । তাই সে দু একটা নেপালী কথাও জানে। দুজনের সঙ্গে জমিয়ে কথা বলল । বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়লে সত্যিই বোঝা যায় বসুধৈব কুটূম্বকম।
কিন্তু চমকটা ছিল খাবারে। এত সামান্য টাকায় এত অসামান্য চাইনিজ স্বাদ ! কাজের সূত্রে রুদ্র কলকাতা , দিল্লিতেও বড় জায়গার খাবারের স্বাদও পেয়েছে। কিন্তু এ যে অতুলনীয়। সে মনে মনে ঠিক করল কাল আনন্দী এলেই কাল রাতে যদি পারে আসবে এখানে আবার। আনন্দী আসার এই আনন্দের মধ্যে মনখারাপ এটাই শুধু একটা রবিবার তারা পাবে নিজেরা সারাদিন। শনিবার, মানে কালও অফিস। সোমবারও অফিস।
প্রসেন সেই প্রসঙ্গ তুলেই বলছিল সে যদি মনে করে সোমবারটা ছুটি নিয়ে নিক। কিন্তু রুদ্র ইতস্তত করে ছুটির প্রসঙ্গে। আনন্দী বুমকে ওর মায়ের কাছে রেখে একা আসছে। ছেলেটাকে দেখার জন্য তাকে একবার কলকাতা তো যেতেই হবে এরমধ্যে। তখন ছুটিটা কাজে লাগবে। তখন একদিন বেশি মানে তো অনেক। এসব নিয়ে সে খুব যন্ত্রণায় ভোগে। স্ত্রী-পুত্রকে একটু দেখার জন্য এত নিষ্ঠুর ত্যাগ করতে হবে সে কোনোদিন ভাবেনি। আনন্দী সেই বুঝেই টিকিট কেটেছে। পুরনো স্কুলের কিছু টাকা পাওনা ছিল, সেটা পেতেই টিকিট কেটে নিয়েছে। রুদ্র দুঃখ পেয়ে বলেছিল—ইস, টাকাটা রাখলে থাকত ! পুজোতেও লাগবে । আনন্দী মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল—টাকা তো মানুষ এইজন্যই রাখে। তুমি পড়ে আছ দূরদেশে, আমি এখন পুজো নিয়ে ভাবতে পারছিনা।
তাও রুদ্রর বুকটা খচখচ করছিল। আনন্দী হয়ত ধরেই নিয়েছে তাদের সব কষ্টের অবসান হয়েছে। রুদ্রর এই চাকরিটাকেই ফাইনাল সেটলমেন্ট ভেবে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবটা তো তা না ! রুদ্র তো ভাবতেই পারেনা এইভাবে সারাজীবন কাটাবে । সে তো অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। আর এই চাকরিও যে কত অনিশ্চিত তা কে না জানে ! সে অনেক কথাই আনন্দীকে বলেছে কিন্তু ঐ সন্তোষের কেসটা, মিউজিক্যাল চেয়ারের ব্যাপারটা বলে উঠতে পারেনি আজও। সে আনন্দীকে ওইটুকু নিরাপত্তা দিতে চাইছে । একটা চেয়ারকে স্থির দেখার নিশ্চিন্তি। রুদ্রর কাজের চেয়ারটা যে স্থির সেইই নিরাপত্তাটুকু দিতে চাইছে রুদ্র তাকে।
চিলি পর্কটা খেয়ে মুখ ছেড়ে গেল যেন। বিশ্বাস লজের রোজ ট্যালটেলে ডাল আর অতি জঘন্য মাছের টুকরো খেয়ে তার নন ভেজে অরুচি চলে এসেছিল। প্রায় দিনই সে ডাল ভাত আলুভাজা খেয়ে অফিসে আসে। সে এমনিতেই রোগা। ইদানীং সে আরও একটু রোগা হয়েছে। শুধু মাঝেমাঝেই তার ছোটবেলার অপুষ্টিজনিত অসুবিধার কথা মনে পড়ে যায়। তখন সে ফুটপাথ থেকে কলা কিনে খেয়ে নেয়। কিংবা ঘন করে বানানো ছাতুর সরবত।
খাওয়ার সময় বালন খুব চুপচাপ ছিল। অফিসে সে চুপ থাকলেও তাদের তিনজনের মধ্যে বেশ কথা বলে। খাওয়া হলে তিনটে কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে বসা হলে বালন একটা অদ্ভুত কথা বলে। চেন্নাই থেকে সে একটা ভালো অফার পেয়েছে। সে হয়ত কৃষ্ণদাসন এজেন্সি ছেড়ে দেবে।
মুহূর্তে মনখারাপ হয়ে গেল রুদ্রর। প্রসেনও হাঁ হাঁ করে উঠল –হোয়াট আর ইউ সেয়িং গাই…দিজ ইজ নট ডান …
বালন নিজেও মনখারাপের মধ্যেই আছে। কিন্তু একদিন সে বাবার ওপর রাগ করে চেন্নাই ছেড়ে দিল্লি এসেছিল। এখন বাবা অসুস্থ। মা কান্নাকাটি করছে। সে তাই চেন্নাইতে দু এক জায়গায় রেজুমে পাঠিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি এত ভালো কোম্পানি থেকে ডাক আসবে সে ভাবেনি। তাকে চেন্নাই যাওয়ার এয়ার ফেয়ারটাও ওরা দেবে। কিন্তু বালনের একটা প্রোপোজাল আছে। চেন্নাইয়ের এই এজেন্সি ইন্টান্যাশনাল। ওরা নতুন ইন্ডিয়াতে উইং খুলেছে। নিশ্চয়ই ওদের সব পোস্টেই নতুন লোক নিচ্ছে। তাই গিয়ে যদি সে দেখে সেরকম চান্স আছে তখন রুদ্র আর প্রসেন কি যাবে ?
রুদ্র হইহই করে বলে—সে যাবে। বেশি টাকা পেলে সে অবশ্যই যাবে।
কিন্তু প্রসেনের অনেক পিছুটান। দিদি-জামাইবাবুকে ছেড়ে সে কীভাবে থাকবে ? বিশেষত তার শারীরিক অসুবিধার জন্য সে একেবারে একা থাকার সাহস পায়না। তার দৈনন্দিন অনেক জটিলতা থাকে। নিঋদিষ্ট সময়ে তাকে খেতে হয়, তাকে সময়ে সময়ে ফিজিওথেরাপি করতে হয়। তার শোয়ার জন্যও বিশেষ গদি চাই। একটু এদিক ওদিক হলে সে এতটাই অসুস্থ হয়ে যায় যে প্রায় দিন পনের বিছানায় থাকতে হয় তাকে এখনো। তাই তার পক্ষে দিদিকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব।
রুদ্র ইয়ার্কি করে—শুধু এইগুলোই ? আর কারোর জন্য পিছুটান নেইতো ?
প্রসেন হাহা করে হাসে , কিন্তু সেই হাসিতে স্পষ্ট হয় বেদনা। এই ছেলেটাকে কেন যেন খুব ভালোবেসে ফেলেছে রুদ্র। ছেলেটার মধ্যে খুব মায়ার টান আছে যেন। আজকাল শহুরে স্টাইলিশ কোন মেয়ে চাইবে এত ঝামেলা সহ্য করে একটা বিয়ে টিঁকিয়ে রাখতে ? বা আদৌ বিয়ে করতে ?
হঠাত তার মনে হয় আনন্দী কি তাকে নিয়ে সুখী ? তাকেও কি অনেক কিছু সহ্য করতে হচ্ছে ?
এগারো
ফ্লাইটের জন্য বোর্ডিং পাস নিয়ে বসে বসে আনন্দী ভাবছিল জীবন কি একটু বেশি দৌড়চ্ছে ? সে তাল রাখতে পারছেনা। সে একটু হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে বুঝি।
এখন ভোর প্রায় সাড়ে পাঁচ। তার ফ্লাইট সাড়ে ছটায়। প্রায় মাঝরাত থাকতে সে বুমকে ঘুমন্ত রেখে উঠে রেডি হয়ে বেরিয়ে এসেছে। বাবা আগেই পাড়ার ট্যাক্সিকে বলে রেখেছিল। সে একটা হাল্কা আকাশী রং্যের সালোয়ার পরে চুলটায় একটা গার্ডার দিয়েই জাস্ট চলে এসেছে। এখন বোর্ডিং এর জন্য কিছুটা সময় একা বসে সে নিজের মোবাইলটা খুলল। একগাদা মেসেজ । সব স্নেহাশীষের। অথচ গত সাতদিনে সাতটা মেসেজও আসেনি তার কাছে। সে দিল্লি যাচ্ছে বলে স্নেহাশীষ কি জেলাস ? সে কি সত্যিই তার প্রেমে পড়েছে ? মাত্র তিন বছর আগেও কেউ তাকে একথা বললে হয়ত সে কথাটা বিশ্বাস করত। লোকজন চিরকাল তাকে সুন্দরী আখ্যাই দিয়েছে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সে আর নিজেকে সুন্দর রাখতে পারেনি। বুম হওয়ার পর তো সে শুধুই মোটা হয়ে যাচ্ছে। তার তো এখন সারাদিন মাথায় চুল আঁচড়ানোর সময়টাও থাকছেনা। সে বুমকে দেখাশোনার পাশাপাশি দ্রুত কোনো চাকরি পেতে চাইছে। পিএইচডি আর কলেজ সার্ভিসে বসার সবরকম প্রস্তুতি সে নিচ্ছে। তাকে পেতেই হবে। নয়ত রুদ্রর ওপর খুব চাপ পরে যাবে। খুব অল্প টাকায় এডজাস্ট করে সে মোটেই থাকতে পারেনা। তাকে নিজের মত থাকতে গেলে টাকা রোজগার করতেই হবে। সে তাই অত্যন্ত চাপ নিয়ে রেখেছে নিজের ওপর। তার বন্ধুরা এখনো কেমন ম্যাচিং শাড়ি-ব্লাউজ ঠিক করতে ব্যস্ত থাকছে, আর সে বুমের জন্য জামাকাপড় গুছিয়ে বারবার মায়ের বাড়ি আসা-যাওয়ার মধ্যে দিয়ে হঠাত সালোয়ার পরতে গিয়ে দেখছে তার ওড়না অন্য বাড়িতে, সেটা বদলে শাড়ি পরতে গিয়ে দেখছে পুরনো ব্লাউজ একটাও হচ্ছেনা গায়ে। তখন তাড়াহুড়ো করে সাদা সালোয়ার , হলুজ কামিজ , লাল ওড়ানা ইত্যাদি যাহোক দিয়ে ম্যানেজ করছে।
তার কাঁধ অব্দি চিরকাল মাপমত কাটা চুল এখন সরু হয়ে কোমরের কাছে। প্রায় একবছর সে ফেসিয়াল ইত্যাদিও করেনি। তাই তাকে এখন দেখে কে যে সুন্দর ভাববে !
কিন্তু প্রেমে পড়ার জন্য কি সুন্দর হওয়া আবশ্যক ? স্নেহাশীষ একদিন খুব কথা বলে তো দিন দশেক একেবারে চুপচাপ থাকে। এর রহস্যটা ঠিক বোঝেনা আনন্দী । সে কি আনন্দীর তরফ থেকে তখন উচাটনতা আশা করে ? তার নীরবতার সময়ে ? আনন্দী কিছুটা বোঝে কিন্তু সাহস পায়না। চোদ্দ বছরের দূরত্ব তখন দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় হয়ত।
স্নেহাশিস সব কাজের কথাই লিখেছে। কী লিখছে, কী পেপার রেডি করছে ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো তাকে কেন বলছে কে জানে ! শুধু শেষে একটাই কথা, লাস্ট মেসেজে — সে চায় আনন্দী যেন এই কদিন বরের সঙ্গে খুব ভালো কাটায়। এই কদিন যেন অন্য কোনো কথা না ভাবে ইত্যাদি। এই লাস্ট মেসেজে একটা বেদনা আর সুপ্ত আকাঙ্খা জড়িয়ে থাকল শুধু।
এবার লাইন পড়ছে দেখে আনন্দী ওঠে। তার মনে হয় হঠাত , আচ্ছা রুদ্রর কাছে যাওয়ার সময় তার এত স্নেহাশীষের কথা মনে পড়ছে কেন ? এটা কি উচিত হচ্ছে ? কিন্তু সে নিজেকে তলিয়ে দেখে এরজন্য তার কোনোই অপরাধবোধ হচ্ছেনা। সে রুদ্রকে তার এই অন্য এক জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে মেলাচ্ছেইনা। এর কারণ কী ? সে কি রুদ্রকে কম ভালোবাসে ? নাকি রুদ্রকে সে বুমের মতই অপরিহার্য মনে করে ?
রুদ্র বলেছিল, সে এয়ারপোর্টে নাও আসতে পারে। কারণ সে জানেনা অফিস দেরি করে যাওয়ার ছাড়পত্র পাবে কিনা। সেক্ষেত্রে আনন্দী যেন বিশ্বাস লজের ঠিকানায় প্রিপেড ট্যকাসি ধরে চলে আসে। লজে বলাই আছে ,দুদিনের জন্য তাদের একটা অন্য ঘরও দেওয়া আছে। আনন্দী এসে রেস্ট নেবে।
প্রথমবার একা আসা আর প্রথমবার ফ্লাইটেও চেপে আনন্দী উত্তেজিত বোধ করছিল। তার নিজেকে খুব স্বাধীন আর সফল মনে হচ্ছিল। রুদ্র যে তার প্রিয় এই শহরে খুঁজে নিয়েছে নিজের জায়গা এ যেন তার নিজেরই পাওয়া এক স্বপ্ন। শুধু ফ্লাইট যখন মাঝ আকাশে, যখন ফোনের যোগাযোগও বন্ধ, তখন হঠাত মনে পড়ে গেল বুমের অভিমানী মুখটা। কোনো কিছুতে তার মনখারাপ হলেই মায়ের দিকে অভিমান করে তাকিয়ে কীভাবে যেন ঠোঁট ফোলায় ছেলেটা। সেই অপার্থিব মনোহরণকারী দৃশ্য আনন্দীকে হাসায় আবার কাঁদায়। এই তিনদিন সে পারবে তো থাকতে ? শুধু মায়ের ওপর তার ভরসা আছে অনেক। মা-ই পারে বুমকে ঠিকভাবে বুঝতে। প্রথম ভ্যাক্সিন নেওয়ার পর বুম যখন বিকেল অব্দি কাঁদছে , সে আকুল হয়ে গেছিল। মাকে বলছিল—ওর কি এত ব্যথা করছে ? এত কাঁদছে কেন ?
মা হেসে বুমকে কোলে আঁকড়ে বলেছিল—তোমার ছেলে তোমার মতই অভিমানী। শুধু ব্যথায় কাঁদছেনা, ওকে যে এরকম কষ্ট দেওয়া হল, তাও আবার মায়ের সামনে সেটাই ওকে কাঁদাচ্ছে ।
উত্তরটা শুনে আনন্দী চমকে উঠেছিল। ঠিক।বুমের কান্নায় যন্ত্রণা না তো, অভিমানই ছিল। সে মা হয়েও বুঝতে পারেনি।
বুম কি ভালো থাকবেনা তবে ? সে কান্না চেপে বাইরে তাকায়। মেঘ আর মেঘ। সে এই প্রথম এত উঁচুতে উড়ছে। রুদ্রও কোনোদিন প্লেনে চাপেনি। খানিকটা হঠকারিতা করেই সে টিকিট কেটেছিল। সে একবার রুদ্রকে না দেখলে কেমন ব্যালেন্স করতে পারছেনা বাকি সব কিছুর।
তাকে অবাক করে দিয়ে রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিল। এবং খুশির সঙ্গে জানালো সে ছুটি নিয়েই ফেলেছে আজ। রুদ্র এত রোগা হয়ে গেছে ? তারা দুজন দুজনকে দেখে অবাক হয়ে ঠিক বিপরীত কথাই বলল । সে চোখের জল চেপে বলল—তুমি এত রোগা হয়ে গেছ কেন ? খাচ্ছোনা ঠিকভাবে ? আর রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল— তুমি এত মোটা হয়ে গেলে কীভাবে ? ভুলভাল জাংক ফুড খাচ্ছ, না ?
তারা অনেকদিন পর সেই প্রথম দেখা হওয়ার মত ফুরফুর করে অটোতে চেপে এল হোটেলে। বিয়ের পর দুদিনের জন্য দীঘা যাওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনো হোটেল বাসের অভিজ্ঞতা নেই। তাই এই প্রথমবার মনে হচ্ছে তারা বেড়াতে এসেছে বুঝি। শুধু মাঝে প্রায় সাড়ে তিন মাস দেখা হয়নি বলে তারা দুজনেই একটু জড়তা নিয়ে আছে যেন। দুজনেই যেন দুজনের কাছে লজ্জা পাচ্ছে অল্প। আনন্দী ফ্রেশ হয়ে নিতে গেলে রুদ্র বাইরে গেল জলখাবার আনতে। এখানে যে কী ভালো আলুর পরোটা আর ঝাল তরকারি ফুটপাথে পাওয়া যায় , সে মাঝে মাঝেই খায় আর ভাবে আনন্দীকে খাওয়াতে হবে। আজ তাই নিয়ে এল।
আনন্দী একটা হাল্কা গোলাপী ঢোলা সালোয়ার পরে চুল খুলে খাটের ওপর বসে খেতে খেতে রুদ্রর সঙ্গে গল্প জুড়ল। রুদ্র হাসি হাসি মুখে দেখালো—দেখ, এই ঘরে টিভিও আছে।
আনন্দী প্রশ্ন করল—এই ঘরটা তো দুদিনের জন্য নিয়েছ, তুমি যেটায় রোজ থাকো সেটায় নেই ?
রুদ্র অল্প হেসে বলল—সেই ঘরে কিছুই নেই। তারপর বলছিল সেই ব্যানার্জী বাবুর কথা। ওপরের তিনতলায় ওনার সঙ্গেই রুম শেয়ার করত সে আর রোজ রাতে পর্ণ দেখে লোকটা। কীরকম অসভ্য লোক রে বাবা। আর শুধু ঘুরে ফিরে আমাকে বলে—তোমার বউয়ের কথা বল। তোমার ছবি দেখে খুব পছন্দ হয়েছে বুঝলে ! আবার কাকে একদিন বলছে ফোনে—তোমারটা যা বড় বড় না, একজন পেরে উঠবেনা !
আমি শুনে ফেলেছি দেখে হেসে বলে—আমার শালী, ইয়ার্কি করি ওর সঙ্গে।
আনন্দী আর রুদ্র দুজনেই হাসে। খাওয়া হলে নিচে বেরোনোর জন্য এসে আনন্দী রুদ্রকে বলে—তুমি যে ঘরটা নিয়েছ সেটা দেখাও।
রুদ্র কেমন এড়িয়ে যায়। –ছাড়ো, কী দেখবে। ঘুরে আসি চল। -কিন্তু আনন্দী তো রুদ্র ঠিক আছে কিনা সেটা দেখতেই এসেছে। না দেখলে চলবে কেন ? সে জেদ করে। রুদ্র খানিকটা বাধ্য হয়েই পকেট থেকে চাবি খুলে নিয়ে করিডরের শেষ প্রান্তে গিয়ে একটা ঘর খোলে ।
ঘর দেখে আনন্দী হতচকিত। এটা ঘর ? একটা বাথরুমের এক ভাগ। একটা পাতলা কাঁচের পার্টিশান দেওয়া। অন্যদিকে বাথরুমটা কমন। সেখানে এই মুহূর্তে কেউ গান গাইছে। পুরুষ কণ্ঠে। আর ঘর বলতে রুদ্র যেটা বলছে সেটা শুধু একটা খাট । একফালি সরু খাট। আর দরজার পিছন দিকে রুদ্রর জামাকাপড় ঝোলানো। একটা টেবিল রাখার জায়গাও নেই। রুদ্রর ব্যাগটাও খাটের এক পাশে।
সে কিচ্ছু বলেনা। বেরিয়ে আসে। রুদ্র ঘর চাবি দিয়ে তার পিছন পিছন আসতে আসতে বলে—সবেতেই এত কাঁদো কেন ? আমি কি এখানে চিরকাল থাকবো ?
সে বাইরে এসে চোখ মুছে বলে— তুমি রবিবার এইজন্যই রাত দশটা অব্দি বাইরে বাইরে ঘোরো ? আমার একবার এরকম কিছুই মনে হচ্ছিল। কিন্তু বাথরুমের একপাশে যে তোমার শোয়ার জায়গা হতে পারে টা ভাবিনি।
—একা থাকার জন্য আমার যে বাজেট তাতে এখন আর কিচ্ছু হবেনা । কদিন দাঁড়াও। আমি এরপর ফাইভ স্টার ছাড়া থাকবোই না।
আনন্দীর সত্যি সত্যি কান্না পেয়ে যায়। সে করোল বাগের ভিড় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখের জল মোছে। এভাবে গরু ছাগলের মত থেকে কীভাবে নিজের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখবে রুদ্র ? আর সে কীকরে ভেবে নিল রুদ্রর দিল্লি আসা মানেই তাদের সব সমস্যা মিটে গেছে ?
রুদ্র অবশ্য পাশে এসে হাহা করে হাসে আর বলে— আমি তখন থেকে ভাবছি তোমার বোধহয় আমার দিকে আর খেয়াল নেই, গল্পের মধ্যে কতবার স্নেহাশীষদাদা দাদা করলে। ভাবলাম প্রেমে পড়ে আছ লোকটার। ও বাবা, মেয়ে এদিকে ঠিক আছে। আমার জন্য কাঁদছে মানে বরের ব্যাপারে ষোল আনা। হা হা। আরে , আমি তো শুধু ওখানে ঘুমাই। বাকি সারাদিন অফিস নয়ত এই এতবড় দিল্লি শহরে। তুমি চিন্তা করছ কেন ? ক বছর একটু দাঁড়াও। তারপর দেখো কেমন ঘোড়া ছুটাই।
বারো
রায় রামানন্দ আর শ্রীচৈতন্যের আলোচনাসভা বসেছিল একবার দাক্ষিণাত্যে। প্রশ্ন ছিল সাধ্য কী ? অর্থাৎ লক্ষ্য কী ? সেই সাধ্যে পৌঁছনোর জন্য সাধনই বা কী ? নিজ লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ঠিক কী কী করতে হবে ? রায় রামানন্দের প্রশ্নের উত্তরে চৈতন্য একে একে পথ বলছিলেন। বলছিলেন পঞ্চরসের কথা। কিন্তু যাই বলছেন শ্রীচৈতন্য, তাতেই উত্তর দিচ্ছেন রায় রামানন্দ—এহ বাহ্য, আগে কহ আর। অর্থাৎ চৈতন্যের দেওয়া সব উত্তরই বহিরঙ্গের কথা। প্রকৃত উত্তর এর কোনোটাই নয়। এইভাবে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত চলছিল প্রশ্ন উত্তর পর্ব। আর শেষে এসে দেখা গেল যাহাই সাধ্য তাহাই সাধন। অর্থাৎ লক্ষ্য আর পথ, এ দুইই এক। দুইই মিলে গেছে এক পর্বে।
আনন্দী রুদ্রকে শোনাচ্ছিল এই গল্প। রুদ্র তখন বলল—তবে কি রবিঠাকুরের সেই গান—আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। পথ আর পথের শেষ আসলে এক ?
—সেটাই । দেখোনা, তুমি যে এই সব পথে হাঁটছ এইই তোমার অর্জন। এইই সাফল্য। আলাদা কিছু বোধহয় হয়না।
দুজনে করিমের বিরিয়ানি খেয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে এল লজে। হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র আনন্দীর এসব কথার উত্তরে বলছিল—তোমার কি মনে হয় সেই বিয়ের পর যে তুমি আর আমি মন্দিরের গেস্ট রুমে এসে উঠলাম তার থেকে আমি এগিয়েছি ?
—অবশ্যই। উফফ। সেবার যেদিন গেছে।
—-সেইসব দিনই তবে সাধন। আজও সাধন চলছে। এই অল্প তফাতটাই হয়ত সাধ্য। নিরন্তর সাধনার ফল হিসেবে লক্ষ্যের কাছাকাছি যাওয়া।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সেই দিনের গল্প করে। বেশিদিন নয়তো। তাদের বিয়ের পরপর। আনন্দী এপ্পলাই করেছিল জওহরলাল নেহেরু মেমোরিয়াল ফাণ্ডে পিএইচডির সূত্রে এশিয়ান কান্ট্রি ভিজিট করার একটা ফেলোশিপে। দুম করে চিঠি চলে এল তার। তখন প্রথম বেঁকে বসেছিল বাবা। যে স্কলারশিপ পেলেই বা কী লাভ ? অতদূরে তো তুমি একা যেতে পারবেনা। সে বোঝালো সে ঘরের কাছে যাবে বাংলাদেশে। তাতেও বাবা অরাজী। তখন রুদ্র বাবাকে বোঝালো। সে বোঝালো যে আপাতত দিল্লি যাওয়া হোক। তারপর স্কলারশিপ পেলে ভাবা যাবে। এটা পাওয়াটাও তো একটা এচিভমেন্ট। সে কৃতজ্ঞ হয়েছিল রুদ্রর কাছে। তার কেরিয়ারের জন্যও যে কেউ দায়িত্ব নিতে পারে এটা সে ভাবেনি।
বাবা তার কেরিয়ার নিয়ে কোনোদিন আলাদা করে ভাবেনি, সে অভিমান আনন্দীর থেকেই যাবে। সে চিরকাল ভালো স্টুডেন্ট , স্কুল লেভেল থেকে ভালো রেজাল্ট করে যাদবপুর থেকে এম এ করে পিএইচডি শুরু করেছিল। কিন্তু দুম করে একটা ভালো স্কুলে চাকরি আর বিবাহ তাকে কি কেরিয়ারে কিছুটা পিছিয়ে দিচ্ছে ? সেবার সেই ইন্টারভিউতে তারা এসেছিল এবং সে চান্স পেয়েছে। সেই চান্স দুবছর বৈধ। তার প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে। আদৌ কি সে আর যেতে পারবে বাংলাদেশ এই সরকারী প্রকল্পে ? সে জানেনা। রুদ্রর কাছে সে চেপে যায় অভিমান। রুদ্র নিজেই এখন দৌড়চ্ছে, তার তো দাঁড়ানোর অবকাশ নেই, সময়ও নেই ।
দিল্লির ভিড় রাস্তা হলেও ট্যাফিক অনেক সঠিক নির্দেশে চলে। রাত বলেও গাড়ি ঘোড়ার বিরাম নেই। আর দিল্লিতে কি নির্ভুল এই ঋতু। ছোটবেলায় এই সময় দেশের বাড়ি গেলে টের পেতাম ঠিক এরকম হাওয়া। এই রাত সাড়ে দশটাতেও কী সুন্দর হেমন্তের হাওয়া। রুদ্র মাঝে মাঝে তাকে নির্ভুল পড়তে পারে। সে পথা হাঁটতে হাঁটতেই তাইই হঠাত বলল—আমার ওপর একটু ভরসা রাখো। আমি তোমাকে বাংলাদেশ নিয়ে যাবো। সরকারী টাকায় হয়ত হোলোনা। কিন্তু আমার টাকাতেই যাবে।
এইসব সময়ে আনন্দী বালিকা বধূর মত আনন্দিত , সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। নিশ্চিন্ত হয়ে যায় বেশ কিছু সময়ের জন্য। দুজনে কলকল করে আগেরবারের দিল্লি ভ্রমণের কথা বলে।
তাদের দুজনের দিল্লি আসার মত টাকা ছিলনা। তার যাওয়া আসার খরচ দেবে জওহরলাল নেহেরু ফাণ্ড। কিন্তু সেটা দিল্লি এসে টিকিট দেখালেই। তাই অনেক হিসেব করেও দেখা গেল খুব সস্তায় তারা দিল্লিতে এসে থাকলে আর খেলেও তাদের দুজনের জন্য যে খরচ পড়ছে তত টাকা তাদের নেই। রুদ্রকে বিয়ে করার সময়ই পরিবারের কাছে অলিখিত চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল আনন্দী, তাই সে বাবা বা মায়ের থেকে চাইবেই না। তার মনে হচ্ছিল বাবার আশঙ্কা কাজ করে সবসময়ই, তারা দুজন সামলাতে পারবেনা এ সংসার ভার, আর তাদের ওপরই নির্ভর করবে এবার। আর মা তার জীবন নিয়ে, বিবাহ নিয়ে এইসব এক্সপেরিমেন্ট তো বোঝেইনা। মা চেয়েছিল সে বাবার দেখাশোনা পাত্রকে বিয়ে করে সুগৃহিণী সুলভ জীবন যাপন করুক। তাকে নিজেকেও কষ্ট করে চাকরি করতে হবেনা। মা নিজে চিরকাল যে জীবন যাপন করেছে তাকেই বিশ্বাস করে। আনন্দীর দিদি সুনন্দাও মায়ের জীবন বেছে নিয়ে সুখে সংসার করছে। কিন্তু সে বারবার এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে যেন পথে। তাই এসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের থেকে টাকা চাওয়ার ব্যাপারে খুবই বিরূপ আনন্দী। অনেক ভেবে এক কাছের বন্ধুর থেকে নিল দশ হাজার টাকা। হিসেবমত তার যাওয়া আসা থাকার খরচ সে পেয়ে গেলে অল্প কিছুই ধার থাকবে। আগামী দুমাসে তারা পারবে মিটিয়ে দিতে।
তারা দিল্লি এসে উঠেছিল হাতীবালা মন্দিরে। যখন রুদ্র তাকে জানিয়েছিল মন্দিরের গেস্ট রুম খুব ভালো, সে কেমন রোমাঞ্চিত ছিল।নতুন জীবনের স্বাদে। এসে তার বেজায় মনখারাপ হয়ে গেল। মহারাজ তাদের একটা চার বেডের রুম দিয়ে বললেন—বিকেলে আরও একজন দম্পতি আসবে।
এটুকু শুনেই আনন্দী কুঁকড়ে গেছিল। সে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সী এক যুবতী। তার নিজের চেহারা রূপ নিয়ে তার এত মাথাব্যথা নেই, কিন্তু সে দেখেছে তাকে দেখলেই অনেকে উৎসাহিত হয়ে পড়ে। অন্যের কামুক দৃষ্টি থেকে তাকে নিজেকে বাঁচাতে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়। সে একই ঘরে কোনো অচেনা পুরুষ থাকলে কীভাবে থাকবে ? তার তো সারারাত ঘুম হবেনা। তাদের ঘরের তালা খুলে দিলে দেখা গেল তাদের জন্য বাথরুমটাও কমন। নিজেদের চাদর দিয়ে দুটো বেড সাজিয়ে দিয়ে রুদ্র ফ্রেশ হয়ে যখন তাকে ডাকছে সে তখন কাঁদছে ঘরে বসে। আজন্ম আদরে ব্যসনে লালিত সে ভাবতেই পারছেনা কীভাবে থাকবে এভাবে । তাকে দেখে রুদ্র দমে যায়। তারপর বোঝায় তিনটে তো রাত। সারাদিন আমরা তো নিজেদের কাজে থাকবো। দেখো ঠিক কেটে যাবে সব ।
সে চোখ মুছে কমন বাথরুম ব্যবহারেই প্রস্তুত হয় । ইন্টারভিউ কাল। কিন্তু আজ তারা বেরোবে নানা কাজে। দিল্লিতে এসেই রুদ্র একটা খবরের কাগজ কিনেছিল। সে আর রুদ্র বাইরের একটা চায়ের দোকানে বসে টিক দিতে থাকে এড এজেন্সির জবে। রুদ্র সঙ্গে করে এনেছে তার কিছু তোলা ছবি আর কাজের ভারী ফাইল। তাদের দুজনেরই মনে হয়েছিল দিল্লি আসার এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এখনো মনে আছে আনন্দীর। সে পরেছিল একটা বাসন্তী রং এর শাড়ি। সেই শাড়ি পরে চায়ের দোকানে বসে সে যখন পেপারে দাগ দিচ্ছে তখন পাঞ্জাবি সেই এলাকার বহু লোক তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। স্বভাবত উদাসীন রুদ্রও তাকে বলে ফেলছে—ইস, বিয়ের পর তুমি আরও সুন্দর দেখতে হয়ে গেছো। কেন যে শাড়ি পরে আসতে গেলে !
সে বিরক্ত হচ্ছে। তার বিয়েতে পাওয়া একগাদা শাড়িই সম্বল। খুব ভালো সালোয়ার আর তেমন কিছু নেই দু একটা ছাড়া। তাই সে শাড়িই এনেছে। এখন সেসব নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় নেই তাদের। সে নিজেও এখন ঢুকে গেছে রুদ্রকে নিয়ে স্বপ্নে। তার নিজের কেরিয়ারের থেকেও বড় হয়ে গেছে সেটা। তারা তিনটে ভেকেন্সি দেখতে পেল যাতে রুদ্র এপ্পলাই করতে পারে। তিনজনকেই ফোন করা হল। দুজন আজ দেখা করতে পারবে। বাকিজন তিনদিন পর।
সেই এজেন্সি গুলোয় যাওয়া হল। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা অটোতে। কারণ অটোভাড়া বাঁচানো তাদের কাছে জরুরী ছিল। তারপর গলি তস্য গলিতে গিয়ে সন্ধান পাওয়া গেল দুটো অফিসের। গলির বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকল আনন্দী। দুবারই রুদ্র ম্লান মুখে এসে বলছে—স্যালারি দেবে ছয় বা সাত। একজন তার কাজ দেখে বলল—এত ভালো কাজের জন্য আমাদের অফিস নয়। আপনি আরও বড় জায়াগায় এপ্পলাই করুন।
তারা দ্রুত বাইরে একটা ধাবায় খেয়ে মন্দিরে ফিরল। সৌভাগ্যক্রমে দেখা গেল তাদের ঘরের ওই দম্পতি আসেনি। তারা দুরাত থাকল। কিন্তু অদ্ভুত এক সমস্যা হল, মহারাজ দ্বিতীয় দিনেই তাদের চলে যেতে বললেন।
দ্বিতীয় দিনে ছিল আনন্দীর ইন্টারভিউ। খুব ভয়ে ভয়ে গেলেও ইন্টারভিউ হল খুব ভালো। সে মায়ের থেকে চেয়ে একটা গম রঙের মেরুণ পাড়ের শাড়ি এনেছিল। সেইমত ম্যাচিং ব্লাউজ। রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলেছিল—তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজকে। মনে হচ্ছে যেন সরস্বতী আর লক্ষ্মী এক দেহে। আনন্দী ভয়ে ভয়ে বলেছিল— আর তোমার সুন্দর ! কী জিজ্ঞেস করবে ভেবে ভয়েই মরে যাচ্ছি। রুদ্র ওর ভয় উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল—না পারলে না পারবে। ক্ষতিটা কী ?
আনন্দী ব্যথিত হয়ে বলেছল—ক্ষতি কিছু নেই ? এইযে এতদূর থেকে আমরা এলাম এত কষ্ট করে !
রুদ্র তাতেও হাসতে হাসতে বলেছিল—কীসের কষ্ট ! নতুন জায়গায় এলে, কত অভিজ্ঞতা হল ! তোমার ভালো লাগছেনা !
ভালো তার লাগছিল। কিন্তু ঐ আশ্রমে থাকাটায় তার বেজায় মনখারাপ হয়ে গেছিল। পাশের একটা বড় ঘরে একদল ছেলে এসেছে কাল রাতে। তাদের আর ওদের বাথরুম একটাই। রুদ্র সকালে বাথরুমের করিডরে দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ সে ভেতরে ছিল। এইভাবে আরও একদিন !
ইন্টারভিউতে গিয়ে অবশ্য দারুণ মন ভালো লাগছিল। তার বয়সী এক সাউথ ইন্ডিয়ান স্কলারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আরও অনেকের সঙ্গেই। সে ভালোই উত্তর দিল। তবু এতজন প্রতিযোগী দেখে সে পাওয়ার আশা কিছুই করলনা। বিকেলে ফেরার পথে কাগজের ঠিকানা দেখে চিত্তরঞ্জন পার্কে এক এড এজেন্সিতে গেল। রুদ্র তাকে নিয়েই ঢুকল। বলল—কী বলে তো দেখি। বাইরে তুমি একা দাঁড়িয়ে থাকো আমার খুব বাজে লাগে।
ভেতরে তখন এক উড়িষ্যার ছেলে ডিজাইন করছিল। তার সঙ্গে রুদ্রর অনেক কথাও হল। সে রুদ্রকে জানালো, তাদের এজেন্সিতে কোনো ভ্যাকান্সি নেই, কিন্তু সে বেশ কটা বড় বড় এজেন্সির নাম করল যেখানে রুদ্র যোগাযোগ করতে পারে। রুদ্র নামগুলো নোট করে নিল।
তাদের ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা। এদিকে সাড়ে আটটায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে। গিয়ে দেখে তখনো মিনিট কুড়ি বাকি। রুদ্র তাকে বলে –গেটের কাছেই একটু দাঁড়াও। আমি কাছেই মার্কেট থেকে জেরক্স করে নিয়ে আসি। কাল তাহলে সকাল ১০টায় বেরিয়ে পড়ব।
সে দাঁড়ায়। সাদা শাড়ি তখন ঘামে ক্লান্ত। তার ব্যাগে তার যাবতীয় মার্কশীট আর সার্টিফিকেটস। আর হাতের ঝোলানো প্যাকেটে রুটি আর তড়কা, রাতের খাবার।
সাড়ে আটটায় গেট বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু রুদ্র তখনো আসেনা। তার চঞ্চল লাগে। প্রায় নটা। তখনো না। তার একা একা ক্লান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কান্না পেয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরেই সে টের পাচ্ছিল কেউ বা কারা কথা বলছে। সে রুদ্রর জন্য এতটাই মরীয়া হয়ে অন্যমনস্ক ছিল কিছুই খেয়াল করেনি। হঠাত সে দেখে দোতলার বারান্দায় প্রায় দশ বারোটা ছেলে দাঁড়িয়ে, যারা কাল রাতে এসেছে তাদের পাশের ঘরে। তাদের সবার চোখ তার দিকে। আর বিহারী হিন্দিতে নানারকম কথা বলছে তাকে উদ্দেশ্য করে আর হাহা করে হাসছে।
সে কী করবে বুঝতে পারছিলনা। টেনশনে সে সত্যিই কাঁদছিল। রুদ্রর কোনো বিপদ হয়নি তো ? সিকিউরিটির ছেলেটা তাকে ওপরে নিজেদের ঘরে যেতে বলছিল। কিন্তু ওই ছেলেগুলোর পাশের ঘরটাই তার। সে ওখানে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলনা। আর রুদ্র না এলে সে কিছুতেই যাবেনা স্থির করছিল। প্রায় পৌনে দশটায় রুদ্র আক্ষরিক অর্থে দৌড়ে দৌড়ে এল। তাকে দেখে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—উফ, তুমি কাঁদছ কেন ? এই মার্কেট বন্ধ ছিল। দূরেরটায় গেলাম। আসার সময় কোনো অটো পাইনা।
এদিকে গেট বন্ধ হয়ে গেছে, তাই সিকিউরিটি তাদের ঢুকতে দিতে নারাজ। আনন্দী মহারাজের ঘরের দিকে তাকায়। দেখেন তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন বারান্দায়। আর দোতলার ছেলেরাও তখন ঘরে ঢুকে গেছে আবার। মহারাজ ওপর থেকেই সিকিউরিটিকে গেট খুলে দিতে বলে। আনন্দী দোতলায় এসে রুদ্রকে জড়িয়ে হাপুস কাঁদে। আর কত লড়াই তাদের করতে হবে ? তারা কি খুব আগে বিয়ে করে ফেলল ? তার মাসুল দিতে হচ্ছে ? রুদ্র তাকে বোঝাচ্ছিল, দেখবে আমাদের জীবন কেমন দ্রুত বদলে যাবে। জাস্ট কটাদিন।
পরেরদিন ভোরেই মহারাজ রুদ্রকে ডেকে পাঠালেন। সে তখন ঘরেই একেবারে সালোয়ার কামিজ পরে প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছিল। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে ফিরবে সন্ধেতে। কাল দুপুরেই ট্রেন। বাব্বা , তারপর নিজের সংসার। তার কলকাতার একচিলতে রুম। কিন্তু অনন্ত প্রাইভেসি।
সকালেই মহারাজ জানালেন আজই তাদের চলে যেতে হবে। এখনই। অন্য গেস্ট আসবে। তাদের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ছে। দুজনেই বুঝল আনন্দীর মত সুন্দরী যুবতীকে রেখে মহারাজ অসুবিধে বাড়াতে চাইছেন না। ওই বারোজন ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমটা তাঁর নেই, তাইই এই ব্যবস্থা। রুদ্র যে কতটা ঠান্ডা মাথার ছেলে সেদিন আরেকবার টের পেল আনন্দী। রুদ্র বার কয়েক অনুরোধের পরও যখন ফল পেলোনা, আনন্দী যখন এই বিশ্বসংসারের ওপর অভিমানে ফেটে পড়ছে, রুদ্র তখন তার মোলায়েম হিন্দিতে মহারাজকে অনুরোধ করছিল—আমরা চলেই যাচ্ছি, তবে আমাদের এই লাগেজটা যদি রেখে দেন খুশি হব। কাল সকালে এসে নিয়ে যাবো।
মহারাজ রাজি হয়। দুজনে একটা করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলে আনন্দী অবাক হয়—থাকবে কোথায় আজ ?
—-দেখছি , চল ।
প্রথমেই পাশের মার্কেটের ফোন বুথ থেকে দু একটা ফোন করে রুদ্র। অবশেষে পাওয়া যায় এক ইস্কুলের বন্ধুকে। যে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে থাকে ময়ূর বিহারে। রুদ্র জানায় সন্ধের পর যাবে তারা। রাতটা থেকে কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়বে।
দুদিন পর সেইরাতে ওরা গরম আলুসেদ্ধ ভাত, ডিম সেদ্ধ খেয়ে নিশ্চিন্তে আলাদা একটা ঘরে ঘুমলো। নিজেদের জন্য কাউকে বিরক্ত করতে চিরকাল অনীহা আনন্দীর। রুদ্র বরং বলেছিল—মানুষই তো মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এত হেজিটেট করছ কেন ? ও তো আমার ক্লাসমেট। মাথাভাঙা রামকৃষ্ণ মিশনে একসঙ্গে হোস্টেলে থেকেছি। অনেকদিন যোগাযোগ নেই তাই। ভাগ্যিস ওর কথা আমার মনে পড়ল !
ওই নবদম্পতির আনাড়ি হাতের এক রাতের যত্নটুকুর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ হয়ে রইল আনন্দী।
তেরো
দিল্লী ঘুরে আনন্দীর কলকাতায় ফিরে যাবার তিনদিনের মধ্যে ঘটনাটা ঘটল। বেশ চলছিল অফিসের কাজ। তবে বালন গোপনে জানাচ্ছিল প্রসেন আর রুদ্র দুজনকেই, মার্কেটের অবস্থা ভালো না। একটা রিসেশান শুরু হল বলে। কথাটার গুরূত্ব বুঝেও বোঝেনি রুদ্র। তার একটা গোঁড়ামি কাজ করে সবসময়ই যে সে নিজের কাজ মন দিয়ে করলে তার আর কোনো ভয় নেই। সে স্যরের ওই বাক্যটা আঁকড়ে থাকে শুধু নিজেকে সোনা হয়ে উঠলেই জহুরী তার আদর করবে। কিন্তু জহুরী যে কে সে নিয়ে সে আর ভাবেনা। কিংবা টুনটুনি পাখির ঘরে যে সোনার মোহর কত অরক্ষিত সেটাও সে বোঝেনা।
যাইহোক, একদিন কাজের মধ্যে বিকেলে কৃষ্ণদাসন ডেকে পাঠালো রুদ্রকে। গিয়ে বসতে প্রথম কথাতেই বলল—রুদ্র, তুমি আমার এজেন্সির হায়েস্ট পেইডদের মধ্যে একজন। আমি তোমাকে এতটাকা দিতে পারবোনা। যদি তুমি এর কমে এডজাস্ট কর ঠিক আছে, নয়ত তুমি আগামী মাস থেকে অফ হয়ে যাও।
রুদ্র প্রথমে একটু হতচকিত হয়। তারপর তার হঠাত কেমন হাসি পেয়ে যায়। পেটের ভেতর থেকে হাসি পেতে থাকে। চাকরি চলে যাবার কথায় সে যদি হেসে ফেলে লোকে তাকে বদ্ধ পাগল ভাববে। তাই সে চেষ্টা করেই চুপ করে থাকে। তবে সবিনয়ে সে জানায়—কম টাকায় এডজাস্ট করার প্রশ্নই নেই, তার চেয়ে পরের মাস থেকে সে চলে যাবে।
কৃষ্ণদাসন একটু অবাক হয়ে যায়। ব্যাপারটা এত সহজে মিটবে সে বোধহয় ভাবেইনি। রুদ্র লঘু পায়ে নিজের কাজের কাছে ফিরে আসে। কিন্তু দশ মিনিট পরেই সে টের পায় এই খবরটা আনন্দীকে ভাগ করে না নিলে সে পারছেনা।
দুপুরে আনন্দীর আজ ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা। সে তাও ফোন করে আর আনন্দীকে পায়ও। হাসতে হাসতে বলে—কৃষ্ণদাসন যা জানালো সেকথা।
আনন্দী বাইরে আছে বলেই হয়ত, একটু সংযত হয়ে কথা বলছিল। তাও সে অবাক হয়ে বলল—তাতে তুমি এত খুশি কেন ?
রুদ্র হাসতে হাসতে বলল—পরের মাসের স্যালারি পেয়েই আগে কলকাতায় এসে দশদিন থাকবো। আর আমার কাছে একটা শেষ মানেই নতুন শুরু। আমি তো অন্য চাকরি খুঁজতে মন দিতেই পারছিলামনা। এবার দেখবে এর চেয়েও ভালো কিছু পাবো।
আনন্দী একটু অবাক হয়। তারপর বলে—ঠিক আছে, তুমি অফিসে কাজ কর। আমি বাড়ি গিয়ে ফোন করছি।
রুদ্র তাতেও ফোন রাখেনা। সে আগল ভাঙ্গা হয়ে বলতে থাকে—অন্তত দশ বারোদিন আমি কলকাতায় থাকবো। ছেলের কাছে। আমরা একবার জলপাইগুড়িও যাবো, হ্যাঁ ? কতদিন মাকে, দিদিকে দেখিনি বলতো । চাকরির জন্য তুমি চিন্তা কোরোনা। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। এখন তো আমার এক্সপেরিয়েন্সও হল। আমি যাট হাজারের স্যালারিতে জোগাড় করে নেবো।
ফোন রেখে দিয়ে রুদ্র যখন আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল তখন তার মনে হল জানা হলনা তো আনন্দী কি ন্যাশানাল লাইব্রেরি গেছে নাকি যাদবপুরে ? বাইরে আছে এটুকুই মনে হল।
স্নেহাশীষ ঘন হয়ে দেখছিল আনন্দীর মুখ। তার ফোন করার সময়কার প্রতিটা অভিব্যক্তি। সে একটু আড়াল চাইছিল। কারণ সে রুদ্রকে মিথ্যে কথা বলছিল। সে তখন লাইব্রেরিতে ছিলনা। গেছিল কিন্তু ফিরে এসেছে। কিন্তু রুদ্র যদি শোনে তার সঙ্গে একা বসে আছে এক অন্য ভদ্রলোক, রুদ্র সেটা মেনে নেবে ? তাই সে ওই মুহূর্তে রুদ্রকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল ফোনেই, স্নেহাশীষকেও । কিন্তু স্নেহ সেটা দিচ্ছিলনা। সে ফোন রেখে দিয়ে স্নেহাশীষের দিকে তাকিয়ে হাসে। তার এই ফ্ল্যাটে খুব আলো হাওয়া। কিন্তু সে বাইরের ঘরের পর্দাগুলো টেনে রেখেছে। বেডরুমেরও। আনন্দী কি অন্য কিছু প্রত্যাশা করছে তবে নিজেই ? একটা অন্যরকম ভালো লাগা ছড়িয়ে আছে তার শরীরে, মনে। রুদ্রর খবরটা তাকে কিছুটা বিচলিত করল। মাঝে মাঝে আজকাল তার ক্লান্ত লাগে, রুদ্রর জীবনে এত অনিশ্চয়তা কেন ? সে কেন অন্যদের মত একটা নিশ্চিন্ত জীবন উপভোগ করতে পারেনা ? একা মাতৃত্বের সব দায়িত্ব করতে করতেও সে ক্লান্ত। একমাত্র স্নেহাশীষ কাছে এলে সে যেন মনে করতে পারে তারও কিছু চাওয়া পাওয়া আছে।
সে নিজেকে কিছুটা লুকোতেই কিচেনে যায় কফি বানাতে। বুম আজ মায়ের বাড়ি আয়া মাসিও। সে লাইব্রেরি থেকে এসেছে নিজের ফ্ল্যাটে। সংগে স্নেহাশীষ। এখন মাত্র বিকেল তিনটে। বুমকে সন্ধেতে আনবে বলেই রেখেছে। কিন্তু স্নেহাশীষ নিজেই তার সঙ্গে কফি খেতে আসতে চাওয়াতে প্রথমে সে বেশ খুশি হয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল অন্তত ক ঘন্টার জন্য সেসব দায়িত্ব , চাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। রুদ্রর আসার খবরটাও তাকে এই মুহূর্তে স্পর্শ করতে পারলোনা। রুদ্র তাকে ভালোবাসে অথচ তাকে বুঝতে পারেনা কেন ? কেন সে বোঝেনা তার দেওয়া টাস্কে আনন্দী ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে ? কেন সে বুঝলোনা এই মুহূর্তে আনন্দী অন্য কাউকে ভালোবাসবার প্রস্তুতি নিচ্ছে ? সে মনে মনে রুদ্রকে দোষ দিল, স্বার্থপর বলল। তার কি নিজের কাছে নৈতিক দায় ছিল নিজেকে মুক্ত করবার ?
স্নেহাশীষ যখন তার শরীরে ধীরে ধীরে মুখ রাখছে আর মুখে বলছিল—তোকে সারাদিন আমি পকেটে করে নিয়ে ঘুরি। সারাদিন তুই আমার সঙ্গে থাকিস। তখন একটা বানভাসি ভালবাসায় সে ভেসে যাচ্ছিল। সে নিজেই জানতনা তার শরীর এতটা উন্মুখ হয়ে আছে। রুদ্রর সঙ্গে তো সাতদিন আগেই সে মিলিত হয়েছিল দিল্লি গিয়ে, কিন্তু সেই মিলনে লেগে ছিল সে চলে গেলেই রুদ্রকে যে ঘরে থাকতে হবে তার কষ্ট, ছেলেকে রাতে না পাবার যন্ত্রণা, রুদ্র কবে বাড়ি ফিরতে পারবে তার অনিশ্চয়টা ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন যে কোনোদিন রুদ্রর সঙ্গে সে মুক্ত হয়ে মিশতে পারেনা ! অথচ আজ সে ভেসে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই যে মানুষটা তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে তার কাছে সে ছোট্ট মেয়েটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে। তার কাছে সে পারবে নিজেকে উজাড় করে দিতে। এইযে আজকে লোকটা তারজন্য দু দুটো আইসক্রিম নিয়ে এল এ তো তারজন্য কেউ কোনোদিন করেনি ! সে তো অন্যেরা কে কী খেতে ভালোবাসে দেখতে দেখতে ক্লান্ত । এইযে মিলনের আগে লোকটা তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বোঝাচ্ছিল, কোথায় কোথায় এপ্পলাই করা উচিত তার চাকরির জন্য, কীভাবে সে প্রস্তুতি নেবে পরের মাসের ইন্টারভিউ এর জন্য এসব তাকে কেউ কোনোদিন দেয়নি। আনন্দী ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছিল। একটা সফল মিলনের পরে সে জানতে চাইছিল—আমাদের রিলেশানটা শুধু শরীরের হয়ে যাবেনা তো ! স্নেহাশীষ হাসতে হাসতে বলছিল— শুধু শরীর বলে আসলে কিছু হয়না। সবাইই মন খোঁজে। আর আমাকে দেখে এতদিনেও বুঝিসনি আমি মন দিয়ে কাউকে না স্পর্শ করতে পারলে শরীর দিয়েও পারিনা ? শুধু এইজন্যই আজ এগারো বছর হয়ে গেল আমার বউয়ের সঙ্গে আমি শুইনি।
সে মন থেকে নির্ভার হয়ে গেছিল। উঠে পোশাক বদলে মুখে চোখে জল দিয়ে আবার কফি বানাতে গেল। চীজ দিয়ে দুটো ওমলেট বানালো সুন্দর করে। তারপর নিয়ে এল। স্নেহ সিগারেট খেতে খেতে তাদের ফ্ল্যাটটা ঘুরে ফিরে দেখছিল। বেশি কিছু আসবাব নেই, কিন্তু সুন্দর করে সাজানো।
কফি খেতে খেতে আনন্দী দেখছিল স্নেহাশীষকে একদম অন্যরকম লাগছে। শান্ত, সুখী এক ভদ্রলোক। অন্যসময় একটা মেধার তীক্ষ্ণতা আর কিছুটা বিরক্তি লেগে থাকে ভ্রুতে, চোখে , তার কিছুই নেই এখন। তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন— এইযে আমি যতক্ষণ বিদায় না নেবো, তুই ছেলেটাকে আনতে পারবিনা এটা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। ওকে একটুও স্পর্শ করা হোলোনা।
আনন্দী হাসছে। তারপর কফি খেয়ে সে পোশাক বদলেও নিচ্ছে। ছেলেটাকে আনতে একেবারে ওঁর সঙ্গেই বেরিয়ে যাবে। তারপর ও টালিগঞ্জের দিকে চলে গেলে আনন্দী যাদবপুর যাবে।
রাতে ফিরে বুমের পাশে শুয়ে আছে এইসময় যখন রুদ্র ফোন করল তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিলনা। তার রুদ্রর ঐ শয্যা কল্পনা করতে ইচ্ছে করছিলনা। রুদ্রর হঠাত চাকরি চলে যাওয়ার চাপও নিতে ইচ্ছে করছিল না। আজকের দিনটা থাক। তার নিজের মত থাক। ফুলের মত সুঘ্রাণ লেগে থাক আজ তার গোটা দেহে। রুদ্র তো এই মাসের শেষে আসবেই তখন দেখা যাবে কী করা যায় ।
রুদ্র কিন্তু কথামত মাসের শেষে এলনা। সে নতুন জব পেয়ে গেল চেন্নাইতে, বালনের সেই এজেন্সিতে। রুদ্রকে ফ্লাইটে করে জয়েন করার টিকিট পাঠালো কোম্পানি। স্যালারি প্রায় দ্বিগুণ। রুদ্র জয়েন করার আগেই শর্ত করিয়ে নিল ঠিক একমাস পরেই তাকে দশদিনের জন্য ছুটি দিতে হবে। বস একজন ম্যাডাম। স্বাতী গণেশন। তিনি রাজি হলেন।
বালন আগেই গেছিল। নতুন মাস পরতেই রুদ্র দিল্লি থেকে সরাসরি রওনা দিল চেন্নাইতে। প্রসেন মনখারাপ করে ফেলল বিস্তর। রুদ্রকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দিদির হাতের রান্না খাওয়ালো। ময়ূর বিহারে আগে একবার এসেছিল রুদ্র। এবার এসে এত সুন্দর হাউজিং দেখে আর প্রসেনের দিদি-জামাইবাবু সবার মুখে সিলেটি উচ্চারণ শুনে, বাঙাল রান্না খেয়ে রুদ্রর জলপাইগুড়ির কথা, মায়ের কথা দিদির কথা মনে পড়ছিল খুব।
চেন্নাইয়ের জন্য ফ্লাইটে উঠে তার মনে হচ্ছিল, তার জীবন এত টাফ হয়ে যাচ্ছে কেন ? মা-স্ত্রী-সন্তান সবাইকে পেয়েও সে কাছে পায়না। এই স্বপ্নের পিছনে দৌড় কি সবার জীবনেই ঘটে ? সে কি কলকাতায় ফিরে তবে সেলস বা মার্কেটিং এর যেকোনো কাজ জুটিয়ে নেবে ? তারপর মাকে কাছে এনে রেখে একটা নিরাপদ সুখী জীবন যাপন করবে ?
এত মনখারাপের মধ্যেও ওসব ভাবনাতে তার অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে ওঠে। সে ওরকম একঘেয়ে জীবনকে মরে যাবার সঙ্গে তুলনা করে।
চোদ্দ
বুম মাত্র ছমাসেই খুব হাসতে শিখে গেছে। চোখ দিয়ে মুখ দিয়ে খুব সুন্দর কমিউনিকেশন ও। আনন্দীর এক একদিন কাজকর্ম মাথায় ওঠে পাজিটার জন্য। সকাল থেকে যে খেলার মুডে থাকে তাকে থামানো মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
আয়া মাসি যে এতদিন ছিল সে আর কাজ করবেনা, তাই বাড়ি গেছে। এসেছে একটা অল্পবয়সী মেয়ে। মেয়েটি বিবাহিতা হলেও বর নাকি নেয়না। সে কাজে খুব দড়, কিন্তু কথায় কথায় বাইরে যেতে চায়। বাজারে যেতে হলে খুব খুশি হয়।
আনন্দী এত সমস্যাতেও বুমকে নিয়ে মেতে থাকে। আর মনে মনে স্থির করেই নিয়েছে রুদ্র চেন্নাইতে সেটল করলে সেও চলে যাবে বুমকে নিয়ে। আর কলকাতায় একা থাকা সম্ভব না। তার ভালো চাকরি কবে হবে সে নিজেই বুঝতে পারছেনা। কলেজ সার্ভিসে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। কিন্তু ধরেই নিচ্ছে পাবেনা। তারচেয়ে সে বুম আর রুদ্র একসঙ্গে থাকবে। রুদ্রর স্যালারিটা তার কাছে একমাত্র আশাজনক। তার গবেষণা হয়ত হবেনা। তাতে কীই বা হবে । বুম বড় হলে আবার সে ভাববে। সন্ধেবেলায় বুমকে পাশে শুইয়ে টিভি দেখতে দেখতে সে দেখে সিরিয়ালের মেয়েরা কী সুন্দর নিখুঁত সাজ সাজে, বাড়ি গুছিয়ে রাখে এবং বেশিরভাগজনই স্বামী গরবে গরবিনী। সে নিজেকে বোঝায় তার ওরকম একটা জীবন চাই। সারাদিন এই যে একটা ঢোলা নাইটি পরে বাড়িতে আর বাইরে গেলেও চুল আঁচড়ে আর লিপ্সটিক টুকু বাদে কোনো সাজের সে সময় পায়না এই দশা থেকে সে বের হবে। কী লাভ হচ্ছে দৌড়ে দৌড়ে লাইব্রেরি, সেমিনার করে ? কবে চাকরি পাবে তার ঠিক নেই। আর স্কুলের চাকরির যা চাপ সেটা ম্যানেজ করে একা বুম কে সে সামলে উঠতে পারবেনা।
মায়ের বাড়িতেও যখন তখন গিয়ে থাকা যাচ্ছেনা। তার ঠাকুমা মৃত্যুশয্যায়। ছোটকাকুর কাছ থেকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন মায়ের ওই ছোট ফ্ল্যাটেই ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। এর মধ্যে সে , বুম , কাজের মেয়ে মিলে থাকা অসম্ভব। সে ভেবেছিল রুদ্রর মা বা দিদিরা কেউ এইসময় হয়ত আসবে বা তার পাশে থাকবে। কিন্তু তারা সেব্যাপারে কোনো ইচ্ছাই প্রকাশ করেন না। রুদ্র তার মা বা দিদি বলতে অজ্ঞান , কিন্তু তাঁরা কেউই আনন্দীকে খুব একটা পছন্দ করেন না। আনন্দী তার কারণ জানেনা, তার বন্ধু সুকন্যা বলছিল, ঘরের বউ হিসেবে সবাইই চায় অশিক্ষিত, কুরূপা অথচ গৃহকর্মনিপুণা মেয়ে। যাতে তাকে দিয়ে ঘরের কাজও করানো যাবে, আবার দুবেলা রূপ আর শিক্ষা তুলে গালমন্দও করা যাবে। তুই তো ওভার কোয়ালিফায়েড। —সুকন্যার কথাটা শুনে তখন মনে ধাক্কা লেগেছিল, কিন্তু ইদানীং সেটাই সত্যি মনে হয়।
সে এখন নিজেকে পরিস্থিতির হাতে ছেড়ে দিয়েছে। শুধু অপেক্ষা করে আছে রুদ্র খানিকটা যাতে গুছিয়ে নেয় সেইজন্য। বুম আজকাল দুপুরে ঘুমায়, আবার রাতে। জেগে যায় ভোরবেলা আবার রাত নটা অব্দি জেগে। তার জেগে থাকা মানেই একা একা পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা। আনন্দী মাঝে মাঝে সামলাতে পারেনা। আজকাল তার অল্পেতেই কাহিল লাগে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ফল কি ? খুব স্ট্রেস হয় তার সবেতেই। মনে হয় সে এমন এক দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে যে দড়িটাকে সে নিজেই দেখতে পাচ্ছেনা। দড়িটা কীরকম দশায় সেটাও সে জানেনা। সে চুপ করে অন্যমনস্ক হয়ে শুয়ে আছে। আগে এইসময় শুয়ে শুয়ে ভাবত কী করছে রুদ্র। এখন কি অফিসে ? নাকি ওখানে যে হোটেলে একমাসের জন্য রুম বুক করেছে ফিরে গেছে সেখানে ? রুদ্র বলেছে এই ঘরটা অনেক ভালো। বিরাট বড়, বাথরুমটাও বিরাট। রুদ্রর গলা শুনে মনে হচ্ছে চেন্নাইতে ভালো আছে দিল্লির চেয়ে। শুধু দিল্লির জীবনটার প্রতি রুদ্রর খুব টান।
আনন্দীর খুব একলা লাগছে। সে কি স্নেহাশীষকে একটা ফোন করবে ? তার খুব ইচ্ছে করলেও সে সেটা করেনা। খুব চাহিদার জিনিসের প্রতি চাহিদা যেন দেখানো যায়না, এও সেরকম। তার এই নীরবতা কে অবশ্য স্নেহাশীষ মাঝেমাঝেই ভুল বোঝে। ঔদাসীন্য ভাবে, নন ইনভলভমেন্ট ভাবে । সে কি ফোন করবে তবে ?
বুম তার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। সে হঠাত দেখে তার নিজের দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আজকাল তার এত দুঃখ লাগে কেন ? সে চোখ মুছে বুমের দিকে তাকিয়ে হাসে। তার মত কত মেয়েই তো একা থাকে, বর দূরে চাকরি করে। কিন্তু সে এত হাঁফিয়ে উঠছে কেন ? নাকি সে রুদ্রকে নিয়ে যেভাবে জীবন কাটাবে ভেবেছিল তা হচ্ছেনা তাইই সে ভেতরে ভেতরে ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছে ?
সে বুমকে বড়দের মত জিজ্ঞেস করে –কী ? কী হয়েছে ? কী দেখছ তুমি ?
বুম খুব সজাগ চোখে তার দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁত বার করে হেসে বলে— উসসস, হুসসস।
কিচ্ছু মানে বোঝেনা আনন্দী। কিন্তু সে কেমন করে বোঝে তার দুঃখ পাওয়া বন্ধ করতেই ছেলে তাকে হাসাতে চাইছে। সে হাসে। বুমকে জড়িয়ে আদর করে আর তখন তার রুদ্রকে খুব দুঃখী একটা মানুষ বলে মনে হল। বেচারি ছেলেটাকে জড়ানোর যে স্বর্গসুখ সেটাই পাচ্ছেনা।
বুম আবার নিজের মনে খেলতে শুরু করলে সে স্নেহাশীষকে একটা ফোন করে। যার সঙ্গে পনেরদিন আগে বিছানা ভাগ করে নেওয়া যায় তাকে মনখারাপের মুহূর্তে ফোন করাই তো যায় !
স্নেহাশীষ ফোন ধরে আর অত্যন্ত কেজো গলায় বলে—বল। সে কন্ঠটা শুনে একটু থতমত খায়। তারপর বলে দুম করে— আমার একদম ভালো লাগছেনা, খুব একা লাগছে ।
স্নেহাশীষ খুব শান্ত গলায় বলে— পড়াশোনা চলছে ঠিকভাবে ?
সে কী বলবে বুঝতে পারেনা। গতকাল বিকেলেও তো স্নেহাশীষ ফোন করেছিল। এখন মন হচ্ছে যেন একযুগ পরে কথা হচ্ছে বুঝি।
সে হুঁ বলে ফোন রেখে দেয়। বুঝতে পারে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মুহূর্তে সে ফোন করে ফেলেছে। তার পরিবার নেই বলে কি কারোর নেই ?
একটা ভয় তাকে শিহরিত করে। সে স্নেহাশীষকে নিজের পরিবারের অংশ করে নিজেকে বিপন্ন করে মিশে যাচ্ছে, কিন্তু স্নেহাশীষ কি তাকে জাস্ট উপরি একটা আনন্দ ভাবছে ? নিজের সবকিছু ঠিক রেখে বাইরের এইন্টারটেনমেন্টের মত ?
তার মন লজিক্যাল হলেও মানুষকে অবিশ্বাস করতে তার ভালো লাগেনা। তার কষ্ট হয়। সে রুদ্রকে ফোন করে এবার। রুদ্র তখন ডিনার করছে। পাশেই একটা হোটেলে ধোসা খাচ্ছে। এটাই এখন তার নিয়মিত ডিনার।
রুদ্রর গলাটা একটু চুপচাপ লাগল। চেন্নাইতে গেছে প্রায় দুমাস হতে চলল। বেশ স্পিরিটে আছে বলেই তো মনে হচ্ছে। সামনের মাসের তিন তারিখে আসার টিকিট কাটাও আছে। স্যালারি বেশি বলে রুদ্রকে তো একটু বেশি কনফিডেন্টও লাগছিল কদিন। রুদ্রর পাঠানো টাকা দিয়ে আনন্দী একটা বড় আলমারি বুক করেছে। পরের মাসে আরেকটা ছোট ডিভান কিনবে বলে ভেবে রেখেছে। সে আজকাল মনে মনে রুদ্রর সঙ্গে সংসার করে। তার সেই সংসারে বিছানার চাদর থেকে শুরু করে পর্দার কাপড় অব্দি ম্যাচিং। শুধু সেই আলোকিত সাজানো ফ্ল্যাটটা কোথায় সেটাই বুঝতে পারেনা আনন্দী, কলকাতা, দিল্লি না চেন্নাই ?
রুদ্রর কন্ঠটা শুনে খচখচ করছিল মনটা। সে আবার ফিরে ফোন করল। রুদ্র ঘরে এসে গেছে তখন। ও জিজ্ঞেস করাতে প্রায় কেঁদে বলল—একটা কাপলকে ধরেছে পুলিশ। তাদের একজন ট্রান্সজেন্ডার। তাকে কী মার মারছে পুলিশ। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। শুধু প্রেম করার জন্য এই অপরাধ নাকি ট্রান্স জেন্ডার বলেই ?…
বুমকে জড়িয়ে আনন্দীও কেঁদে ফেলে। সারা সন্ধে সে নিজের দুঃখে কাঁদছিল সেসব ভুলে এক অচেনা মানুষের জন্য ফোনের দুপ্রান্ত থেকে কাঁদে তারা দুই দম্পতি। কিংবা দুই বাবা-মা।
পনের
মিসেস স্বাতী গণেশণের কথা এবং ব্যবহার খুব মিষ্টি। এতটাই মিষ্টি যে প্রথমদিন তাক লেগে গেছিল রুদ্রর। কৃষ্ণদাসনের অফিসে সবসময়ই একটা চাপা টেনশন থাকত। যেন কী হয়ে যাবে এরকম ভাব। কেউ কারোর সঙ্গে মন খুলে কথা অব্দি বলেনা। ্তবু তারই মধ্যে ভাব হয়ে গেছিল প্রসেন আর বালনের সঙ্গে এইই অনেক। কিন্তু এখানে পরিবেশটা বেশ খোলামেলা। সবাই জোরে জোরে কথা বলছে, হাহা করে হাসছে। ইয়ং ডিজাইনাররা রঙীন পোশাক পরে ঘোরাফেরা করছে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে লাগছিল রুদ্রর, কেমন যেন ক্লাবের মত পরিবেশ। তারপর স্বাতী ম্যাডামই তাকে একটা আলাদা কিউবিকলের ব্যবস্থা করে দিলেন, কাঁচের ওপার থেকে শব্দ পৌঁছতনা একদম। তাতে খুব খুশি হয়েছিল রুদ্র। সে ম্যাডামের ওপর, কোম্পানির ওপর তো এমনিতেই খুশি ছিল তার প্রথম ফ্লাইটে ওঠাটা স্পনসর করার জন্য। তাই প্রাণ দিয়ে কাজ করছিল। রাতে অফিসে থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। সিকিউরিটি নিচেই থাকে। সে আর বালন মাঝে মাঝেই রাত জেগে উল্লেখযোগ্য দুটো প্রেজেন্টেশন নামিয়ে ফেলল। রুদ্র বুঝছিল একমাত্র কাজই তাকে বাকি সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে। সে তাই কাজে ব্যস্ত থাকত। মাঝে মাঝেই একা কিংবা বালনের সঙ্গে মেরিন ড্রাইভে গিয়ে বসে থাকে। হোটেলের ঘরে একা ফিরতে ইচ্ছে করেনা। তাদের অফিসটা রাধাকৃষ্ণ সলাই। সেখান থেকে এই সমুদ্র পাড় কিংবা চেন্নাই সিটি সেন্টার , সবই বেশ কাছে।
এখানে এসে বালনকে আরও ভালো করে চিনল রুদ্র। দিল্লিতে বাড়ি ছেড়ে , বাবা-মাকে ছেড়ে থাকার জন্যই হয়ত বালন একটু চুপচাপ থাকত। কিন্তু হোম টাউনে ফিরে বালন আগের চেয়ে অনেক কথা বলে, হাসিখুশি থাকে আর তারজন্য প্রায়ই মায়ের হাতের বানানো ইডলি, উত্তাপাম নিয়ে আসে। ছেলেটা যেন এক স্বপ্নের জগতে থাকে। এই ম্যাডাম স্বাতীর অলিভা নামের এজেন্সি নিয়ে বালনের অনেক স্বপ্ন। সে একদিন ইণ্ডিয়ার মধ্যে এক নং এজেন্সি বানাবে এটাকে। তাই সে সারাদিন মার্কেটিং আর সেলসের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করে চলেছে। এখানে দিল্লির থেকে কিছুটা হলেও এজেন্সি গুলো প্রেজেন্টেশনে পিছিয়ে আছে বলেই মনে হয় রুদ্রর। বালন সেটাই মেকাপ করতে চাইছে। ডিজিট্যাল প্রেজেন্টেশন নিয়ে প্রায়ই সে অফিসে জুনিয়রদের ক্লাস নিচ্ছে। সেই ক্লাসে ম্যাডামও হাসি হাসি মুখে জয়েন করছে। রুদ্র ভাবছিল এতকিছু বালন শিখল কখন ? বালন তো মাত্র তিনবছর কৃষ্ণদাসনে কাজ করেছে। সে বুঝতে পারে বালন এসব নিয়ে পড়াশোনা আর ভাবনাচিন্তা করে নিয়মিত।
একদিন সমুদ্রের ধারে বসে রুদ্র ওকে বোঝায়— কোম্পানির জন্য নিজেকে এতটা উজাড় করে দিওনা। একটু বুঝে শুনে দাও। নয়ত প্রচুর শক্রু বাড়বে তোমার। ম্যাডাম খুশি হচ্চে, কিন্তু ওই সুরেশ , কৌশিক এরা কিন্তু খুশি হচ্ছেনা।
বালনও অবশ্য সেটা বুঝতে পারছে। সেও বলে—আমি ভাবছি , কিন্তু আমি যখন বলতে শুরু করি কন্ট্রোল করতে পারিনা।
রুদ্র সেটা বোঝে, নিজেকে দিয়েই বোঝে। তারা দুজনেই কাজের মানুষ, স্বপ্নের মানুষ। দুজনেই বিরাট স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাঁচছে। তারা শুধু সেই স্বপ্নের আধার খুঁজছে একটা। কিন্তু অলিভা কি সেই আধার ? কদিন ধরে কেমন অন্যরকম লাগছে রুদ্রর। ঐ বাঙালি ছেলেটা কৌশিক জয়েন করেছে দিন পনেরো। এসেই ম্যাডামের ওপর বিরাট প্রভাব করে ফেলল। কীভাবে করল কে জানে। তারা যখন কাজে ব্যস্ত থাকে তখন কিছু জন আসলে এসব কাজেই ব্যস্ত থাকে। ছেলেটাও সেলসের। সে একেবারেই বালনের ওপর সন্তুষ্ট নয়। প্রথম থেকেই বালনকে কম্পিটিটর ভাবছে। আর সেই সুত্র তাকেও। কারণ এজেন্সিতে এটা সবারই জানা যে সে বালনের বন্ধু, বালনের রেফারেন্সেই এসেছে এখানে। সব এজেন্সির মত এখানেও আলাদা আলাদা চেইন। যদিও সে বা বালন দুজনেই এসব নিয়ে মাথাই ঘামায়না। কিন্তু অন্যদের বোঝাবে কে সেটা ?
আগের মাসে ঠিক ছাব্বিশ তারিখে স্যালারি হয়েছিল। ম্যাডাম স্বাতী জানিয়েছিলেন এই অফিসে মাসের শেষেই মাইনে হয়। সেই ভরসায় তিন তারিখে রুদ্রর কলকাতার টিকিট কাটা আছে ফ্লাইটে। কিন্তু আজ এক তারিখ। সে চেক পায়নি। কাল একাউন্টে খোঁজ নিয়ে জানল এখনো কিছু বলা হয়নি। রুদ্র খুব অস্থির বোধ করছিল। টাকা, একমাত্র টাকাই তার কাছে এই মুহূর্তে খুব দরকারী। সে ভেবে রেখেছিল আজ স্বাতী ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করবে। সকালে একবার করে আনন্দীকে ফোন করে, আজ করেনি। আগে অফিসে যাক। আনন্দী বেচারি সে পরশু আসবে ভেবে হাজার প্ল্যান করছে।
অফিসে ঢুকেই কেমন যেন শীত লাগতে থাকে রুদ্রর। চেন্নাইয়ের আবহাওয়ার জন্য সারাবছরই এখানে ঠান্ডা বাড়ানো এসি চলে। আজ কি ঠান্ডাটা একটু বেশি বাড়ানো আছে ? আর চারিপাশে কী ফুলের গন্ধ ! এখানে মেয়েরা সবাই প্রায় মাথায় ফুল দিয়ে আসে। সকালবেলা এসে সেই দৃশ্য দেখতে কিংবা ফুলের গন্ধ পেলে মন ভালোই হয়ে যায়। কিন্তু আজ কিছুই ভালো লাগছেনা রুদ্রর।
সে একবার গিয়ে দেখে আসে যে ম্যাডাম নেই। ওনার পাশের ঘরেই কৌশিক আর সুরেশ আরো দুটো ছেলে একটা ইংরেজি গান চালিয়ে বসে বেশ জোরে জোরে আড্ডা দিচ্ছে। সে এই আড্ডা আড্ডা পরিবেশ গুলোকে একেবারে বিশ্বাস করেনা। কাজের জায়গার পরিবেশ কেজো না হলে তার ভালো লাগেনা। আর সময়ে স্যালারি না পেয়ে তার মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে আছে। সে নিজের ঘরে এসে বসতেই দেখে বালন ঢুকছে। সে বালনকে ইশারায় ডাকে। বালন এলে প্রথমেই জানতে চায় স্যালারির ব্যাপারে কিছু জানে কিনা। বালন জানেনা। সেও চিন্তা করছে , মূলত রুদ্রর জন্যই। ম্যাডাম এলে দুজনেই যাবে।
কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম একটা লাল সিল্ক আর সাদা ফুলে সজ্জিত হয়ে এলেন। রুদ্র উঠে দাঁড়াতে গিয়েই দেখে ম্যাডামের সঙ্গেই তার ঘরে ঢুকছে কৌশিক। সে বিরক্ত হয়। বালন তখনো কম্পিউটারে বসে , মন দিয়ে তার আজকের প্রেজেন্টেশন দেখছে। কিন্তু আজ রুদ্র সবেতেই চঞ্চল হয়ে আছে। গত একমাস সে প্রাণ দিয়ে কাজ করেছে, এখন তার স্ত্রী-পুত্রের জন্য সে সময়ে স্যালারিটা চাইতে পারেনা ?
কৌশিকের বেরোনোর কোনো লক্ষণ নেই দেখে রুদ্র বালনকে তাড়া দেয়। বালন পেন ড্রাইভ নিয়ে ওঠে। দুজনে যখন ম্যাডামের চেম্বারে ঢোকে উনি যেন একটু বিরক্তই হন। বালন ম্যাডামকে পেন ড্রাইভ দিয়ে বলে, প্রেজেন্টেশনটা দেখে নিতে।
—কোন প্রেজেন্টেশন ? ম্যাডামের মুখ যেন আকাশ থেকে পড়ে।
বালনও প্রশ্ন শুনে অবাক। —-কোন মানে ? আজ আমাদের ভা ক্রিয়েটিভস এজেন্সিতে যাওয়ার কথা ছিল।
ম্যাডাম কৌশিকের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে। তারপর বলে — মি, বালন তোমাকে ওই একাউন্টটা আর দেখতে হবেনা। এটা মি, কৌশিক দেখবে আজ থেকে ।
বালন উত্তেজনায় উঠে পড়ে।—তার মানে ম্যাডাম ? আমি এত খাটলাম এই একাউন্টটা নিয়ে…
ম্যাডাম খুব শীতল হেসে বলে—কোম্পানি তোমাকে এই খাটনির জন্য এপ্রিসিয়েট করছে। কিন্তু এত ইনভলভড হওয়ারও দরকার নেই। এই একাউন্ট কৌশিক সাজাচ্ছে।
রুদ্র ওই মুহূর্তে ওখানে বসেই বুঝতে পারে , এইসব কাজ যদি এই পাকা বাঙালি ছেলেটা ভার নেয়, তবে আর কোনোদিনই তাদের স্যালারি পেতে হবেনা। তার বাঙালি বলে লজ্জা লাগতে থাকে আর তার সঙ্গে ভয়। সে এই এজেন্সি নিয়ে অনেকদূর ভেবে ফেলেছিল। রাধাকৃষ্ণ সলাইতে একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নেবে, বুম পড়বে এখানকার স্কুলে। সন্ধে হলেই তারা তিনজন সমুদ্রের ধারে বসবে। আর একটু টাকা হলে গাড়ি কিনে গাড়ি চালিয়ে ওদের নিয়ে যাবে মহাবলীপুরম। চেন্নাইয়ের জীবনে একটা শান্তি আছে, যেটা স্পর্শ করছিল রুদ্রকে।
বালন চুপ করে বসে গেলে সে সরাসরি প্রশ্নটা করে—হোয়াট এবাউট আওয়ার স্যালারি ম্যাম ?
ভদ্রমহিলার ব্যবহার দেখে সে একদিন মুগ্ধ হয়েছিল। আজ দেখল ভদ্রমহিলা একেবারে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলতে গেলেন—কোম্পানি খুব চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনই স্যালারি সম্ভব না। এখন তোমার ছুটি ক্যান্সেল করে তুমি কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখো। টাকা পাবে। কদিন পরে।
রুদ্র এবার মরীয়া হয়েই উঠল। ম্যাডামের চোখে চোখ রেখে সে তর্ক শুরু করল। এবং স্পষ্টতই জানালো ছুটি সে ক্যান্সেল করবেনা। আর আজকেই তার ফিফটি পার্সেন্ট অন্তত স্যালারি চাই। নাহলে সে সব কাজই বন্ধ রেখে দেবে।
ম্যাডাম বোধহয় রুদ্রকে নেহাত নিরীহ ভালো ছেলে ভেবেই নিয়েছিলেন। আজ কিছুটা পরিচয় পেলেন ওর ব্যক্তিত্বের। অনেক তর্কাতর্কির পর রুদ্রকে ফিফটি পার্সেন্ট স্যালারি দেওয়া হল। কথা হল বাকি টাকার চেক বালনের হাতে দেওয়া হবে। আর সেটা পাওয়ার পরই রুদ্র আবার জয়েন করবে।
কৌশিক ছেলেটা গনগণে মুখে দেখছিল সবটা। কিন্তু রুদ্রর আজকের রূপ দেখে কিছুই আর বলতে পারছিলনা।
ম্যাডামের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজ একাউন্টসে গিয়ে বসল রুদ্র। কথামত টাকার চেকটা না পাওয়া অব্দি উঠলনা। চেক হাতে নিজের কিউবিকলে এসে দেখে বালন বসে আছে চুপ করে। সে বালনকে ইশারা করে বলে—চল বেরোই। –একদম পাশেই ব্যাংক। রুদ্র আজই টাকাটা জমা করতে চাইছিল। তার কেমন ভয় হচ্ছিল টাকাটা যদি ক্যাশ না হয়। ভদ্রমহিলাকে তার আজকে ফ্রড মনে হচ্ছিল। উনি বালনের সঙ্গে যা করলেন সেরকম অসভ্যতা কর্পোরেট লেভেলেই সম্ভব। রুদ্র বালনকে নিয়ে ব্যাংকে গেল। চেক জমা দিয়ে ফেরার পথে পাশের একটা কাঁচের দরজা ঠেলা বড় দোকানে ঢুকল। টাকা খরচের ব্যাপারে রুদ্র চিরকালই সচেতন ছিল, আজকাল আরও বেশি। ফুটপাথের খাবারেই সে চেন্নাইতে প্রায় দুমাসের ওপর কাটিয়ে দিল। এই দোকানটার সামনে দিয়ে তারা দুবেলা যায়, ইচ্ছে হলেও ঢোকেনি। আজ গেল। বালন অবাক হচ্ছিল। সে হেসে বলল—কাল বাদে পরশু কলকাতা ফিরে যাচ্ছি, ঠিক জানিনা তো আবার আসব কিনা, কবে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। দুজনে আজ একসঙ্গে লাঞ্চ করি। আজ আর অফিসের জন্য তাড়া করবনা।
দুজনেই নিল পোঙ্গল, পেঁয়াজ উত্তাপাম, কেশর হালুয়া। খাবারের সুগন্ধে এই দোতলা রেস্টোরেন্টটা ম ম করছে। কিন্তু সেদিকে মন দেবার মত সময় নেই রুদ্রর। সে দেখল বালনের চোখে জল। ছেলেটা সত্যিকারের ভালো মনের এবং নরম মনের একটা ছেলে। সে খেতে খেতে বলল— বালন, এই এজেন্সি মনে হচ্ছে না তোমাকে বা আমাকে রাখতে পারবে, রাখলেও টাকা দিতে পারবে। আমি বাড়ি ফিরে দিল্লিতে আবার যোগাযোগ করছি। একটা এজেন্সির সঙ্গে এখানে আসার আগে কিছুটা কথা হয়েছিল। এখানে এত বেশি স্যালারি কমিট করল যে আর কিছু ভাবিনি। আমি যদি দিল্লি যাই তবে তুমিও চলে এসো সামনের মাসে। এখানে থাকতে পারবেনা। জানি তোমার হোম টাউন, তাও ভেবে দেখো।
বালন কিছুটা সময় চুপ করে বসে বলল— তুমি চলে যাচ্ছে, এতেই আমার মন ভেঙে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে কী ব্যবহার করল তাই নিয়ে আমি ভাবিনা। তুমি আমার একটা বড় জোর ছিলে। এখানে আমার তো দুমাস স্যালারি না পেলেও আমি ঠিকই থাকবো। তুমি তো জানতে আমার বাবার এখানে বড় বিজনেস, বাবা আমাকে প্রতি মাসে পেট্রোল ভর্তি গাড়ি দিয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে আমাকে এক পয়সাও দিতে হয়না। আমি শুধু নিজে কাজ করতে চাইছিলাম। কেমন ধ্যান হয়ে গেছিল একটা এজেন্সিকে নিজের যোগ্যতায় দাঁড় করাবো। গোটা দেশে ফেমাস করে তুলবো। কিন্তু বস নিজেই যদি বাধা দেয়, তবে কীভাবে সম্ভব ?
দুজনেই অবাক হচ্ছিল এই কৌশিক ছেলেটা মাত্র পনেরদিন এসে কীভাবে এত কন্ট্রোল নিচ্ছে ? এর সঙ্গে কি ম্যাডামের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল ? কিন্তু ম্যাডাম যতই সাজুক বয়স অন্তত পঁয়তাল্লিশ, আর কৌশিক পঁয়ত্রিশ হবে। কেজানে ! হতেও পারে। কিছু তো একটা গড়বড় আছেই। মাত্র দিন পনের আগেও যে উদ্যম নিয়ে এগোচ্ছিল এজেন্সি এখন সেসব নেই।
বিকেলে টাকাটা একাউন্টে ঢোকার মেসেজ আসতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্র। এবার শুধু বাড়ি আর বাড়ির চিন্তা। চাকরি যদি চলেও যায় যাক।
বালনের সঙ্গে বিকেলেই বেরিয়ে সিটি সেন্টারে ভালো কফি খেয়ে গিয়ে বসল সমুদ্রপাড়ে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল এক জাহাজের মস্তল। বালন সেদিকে তাকিয়ে স্বপ্নালু চোখে বলছিল— তুমি জেনে থেকো রুদ্র, তোমার স্যালারির বাকি টাকা আমি উদ্ধার করবই। আর আমার নিজের পুরো স্যালারি। ততদিন এই এজেন্সি আমি ছাড়বোনা। ওরা আমাকে খুব নরম সরম ভালো একটা ছেলে পেয়েছে। আমার বাবার খাতিরে চেন্নাই শহরের সবচেয়ে বড় উকিল, পুলিশ অফিসার সব্বাইকে আমি খুব ভালো চিনি। যেভাবে হোক এটা আমি করবই। তারপর যদি দিল্লি যেতে হয় যাবো।
ষোল
বুম তাকিয়ে আছে তার দিকে। অদ্ভুত অচেনা দৃষ্টিতে। রুদ্র স্মার্ট হবার চেষ্টা করছিল। সে আনন্দীর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলার চেষ্টা করছিল— দেখো, আমাকে কেমন অবাক হয়ে দেখছে। ঠিক চিনতে পেরেছে। আসলে চিনতে পারেনি। বুমের দৃষ্টিতে সেটা স্পষ্ট। আনন্দীকেও কেমন অচেনা লাগছে রুদ্রর। বেশ মোটা আর গম্ভীর। আনন্দীর সেই পাতলা কোমর, লম্বা গলা আর নেই। চাহনিতেও একটা অচেনা ব্যাগ। রুদ্র গেট দিয়ে ঢুকে দাঁড়িয়েই থাকে। দুজনকে দেখে। রুদ্রর কাঁধে ব্যাগ। সঙ্গে স্যুটকেশও। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্ল্যাটের বেল বাজাতেই আনন্দী এসে খুলেছে। আর হামাগুড়ি দিয়ে বুম এসে বসেছে সামনে ।
বুম তার দিকে অচেনা আর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে , আর রুদ্র তার দিকে খুব বিষন্ন আর ক্যাবলা চোখে তাকিয়ে আছে, এরকম একটা দৃশ্য কতক্ষণ হল কেজানে, তাদের মনে হল অনন্তক্ষণ। শেষে আনন্দীই বুমকে কোলে নিতে গেলে দেখা গেল বুম নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়িয়েছে এবং মুখে একটা কিছু বলতে বলতে আবার পড়ে গিয়ে বসে পড়ছে। তার চোখ মুখে একটা প্রত্যাখ্যান। রুদ্রকে সে চলে যেতে বলছে ? আনন্দী বুমকে কোলে নিয়ে বোঝায় —তোমার পাপা। রুদ্র। দ , দ । বলতে গিয়েই হেসে ফেলে বলছে—তোমার প্রসঙ্গে কাউকে ফোনে কিছু আমি বললেই একা একা বলবে দ , দ ।
এবার রুদ্র একটু কনফিডেন্স পাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ রেখে হাত ধুয়ে এসে বুমকে জোর করেই কোলে নিচ্ছে, আর বুম ঠোট ফোলাচ্ছে দেখে অবাক হয়ে আনন্দীর দিকে তাকিয়ে বলছে—এবাবা, এতো তোমার জেরক্স কপি গো। তোমার মত করছে একদম। আমাকে ভুলে গেছিস তুই ?
এবার বুম গলা ছেড়ে কান্না জুড়েছে। রুদ্র অসহায় হয়ে বুমকে বিছানায় নামিয়ে বলছে—ও আমাকে ভুলে গেল ?
আনন্দীকে তখন বলতেই হচ্ছে – দুদিন সময় দাও, সেই ওর দেড় মাসে তুমি গেলে। এখন সাড়ে সাতমাস ? ওর মনে থাকে ?
রুদ্র বাচ্ছা ছেলের মত বলছে— আমি ভেবেছিলাম আমাকে দেখেই ও দৌড়ে আসবে ।
—উফ, ওসব সিনেমায় হয়, তুমি স্নান কর। আগে খাও। ট্রেনে কিছু খেয়েছো ?
—-উফফ, এই দেড়মাস আমি শুধু দোসা দোসা দোসা। বাপরে বাপ। ভাত আছে ?
আনন্দী হাসে। –আছে তো। ভাত, মাছের ঝোল , পালং শাকের চচ্চড়ি। মাসিকে ভাত দিতে বলছি। তুমি স্নান কর।
রাত্তিরবেলা আরেক চোট কাঁদল বুম। রাতের বিছানা রুদ্রর জন্য অন্য ঘরেই করা হয়েছিল। কিন্তু সে আনন্দীর পাশে এসে মশারির ভেতরে শুয়ে পড়েছিল। এখনো চাকরি নিয়ে টেনশন কিছুই জানেনা আনন্দী। এখন সেসব বলতে ইচ্ছেও করছিলনা। সে আনন্দীর সঙ্গ চাইছিল, তার আশ্রয়ও চাইছিল। কিন্তু মাঝরাতে হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেলে বুম তার দিকে তাকিয়ে এতজোরে কাঁদতে শুরু করল যে রুদ্র বাধ্য হল উঠে অন্য ঘরে শুতে।
অন্য ঘরে গিয়ে তার খুব মনখারাপ লাগছিল। শুধু কেরিয়ারের জন্য সে কি সবার থেকে দূরে সরে গেল ? আনন্দীও তার কাছে আগের মত সহজে ধরা দিলনা। মাতৃসুলভ দূরত্ব রেখে দরকারী কথা বলল শুধু। বুম আনন্দীর কাছে যে নিশ্চিন্ততা টের পাচ্ছে, তার কাছে সেটা কবে পাবে ?
তার আনন্দীর ওপর রাগ, অভিমান , ঈর্ষা , মনখারাপ সব একসঙ্গে হতে শুরু করল। সেইভাবেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। পরেরদিন আনন্দীকে সব খুলে বলে বলল—চল, আমরা পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্টোরেনেটে খেতে যাই। সবসময় এত চিন্তা ভাল লাগেনা। আমার কাছে যত টাকা আছে তাতে অনায়াসে আড়াই মাস চলে যাবে। আর তারমধ্যে আমি চাকরি পাবোই। দিন দশেকের মধ্যেই পাবো। অত চিন্তা কোরোনা।
আনন্দীকে এসে থেকে খুব শুকনো লাগছে। ভারী হয়ে গেছে আগের থেকে, কিন্তু মুখে যেন কী চিন্তা। রুদ্র একা একাই দেখে বোঝার চেষ্টা করে। আনন্দী চিরকালই গম্ভীর ছিল। কিন্তু কাছের মানুষদের কাছে খুব প্রাণোচ্ছল। কিন্তু এবারে রুদ্রর কাছেও চুপ। রুদ্রর হতাশ লাগে, ও কি ওর সঙ্গে কোনো অন্যায় করেছে তবে ? তার স্বপ্নের পিছনে এই দৌড় কি তাকে তার স্ত্রী-পুত্রের থেকে আলাদা করে দিচ্ছে ?
খেতে যাবার জন্য প্রস্তুতির সময় আনন্দীকে একটু খুশি লাগল। তবে সে কিছুটা ভার হয়েই বলল—আজকাল আমাকে সব ড্রেসেই বাজে লাগে। তাই শাড়িই পরি , বল ?
—ওরকম হাল ছেড়ে দিওনা। তোমাকে রোগা হতে হবে ।
—-আমার আর ভালো লাগেনা অত ঝামেলা করতে। কী হবে দেখতে ভালো হয়ে !
—কী বুড়িদের মত কথা বলছ ! তুমি যথেষ্ট সুন্দর। একটু রোগা হতে হবে শুধু।
আনন্দী একটা নীল শাড়ি , কালো ব্লাউজ পরে । ট্যাক্সি ডেকে বুম বুম আর আয়া মাসিকে মায়ের বাড়ি নামিয়ে তারা পার্ক স্ট্রিট যায়। বুম সকালে রুদ্রকে দেখে মিটমিট করে দেখতেই থাকে। কোলে ওঠালে বাবার চোখে নাকে দুবার আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে কীসব বলতে চেষ্টাও করে। রুদ্রর যেন মনটা এতক্ষণে হাল্কা হয়। বুম আজ আয়া মাসির সঙ্গে আনন্দীর মায়ের কাছেই থাকবে। কারণ পার্ক স্ত্রীট থেকে ফিরতে দেরি হবে আনন্দী-রুদ্রর। ট্যাক্সি থেকে ছেলেকে নামানোর আগে রুদ্র তাই একটু চেপে আদর করে নেয়। তারপর পার্ক স্ট্রিট গিয়ে বুমবুমের বাবা-মা দুজনে বাচ্ছাদের মত হাত ধরে ঘোরে। তারপর খেতে ঢোকে একটা রেস্টরেন্টে। নিভু নিভু আলোয় দুজনের অনেকদিনের অভিমান যেন গলতে থাকে কিছুটা। রুদ্র আনন্দীকে জোর করে তার প্রিয় আইসক্রিম খাওয়ার জন্য। আনন্দী নিজের মোটা হয়ে যাওয়া নিয়ে খুব সংকোচে । তবু সে খায়। খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়েই তাদের কিছুটা ভাব হয়।
বাড়িতে ফিরে এক বিছানায় শুয়ে অবশ্যম্ভাবী ভাবে তাদের মিলনের প্রস্তুতি হয়। আনন্দী নিজেকে কিছুটা ছেড়ে দিয়েও গুটিয়ে নেয়। রুদ্র অবাক হয়ে যায়। কিন্তু জোর করার স্বভাব তার নেই, বরং কিছুটা অভিমানে সে সরে গিয়ে ঘুমনোর চেষ্টা করে।
মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে গেলে দেখে আনন্দী পাশে নেই। অবাক হয়ে উঠে দেখে বাইরের বারান্দায় বসে আছে আনন্দী। অন্ধকারে বসে সে কাঁদছে। রুদ্র অত্যন্ত আহত হয়। আনন্দীর প্রতি তার বাতসল্য ও তো কম নয় ! কী এমন হয়েছে যে আনন্দী কাঁদছে। সে তো সহযে এত ভেঙ্গে পড়ার মেয়ে নয়। সে ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়—কী হয়েছে , আমাকে বল।
আনন্দী কিচ্ছু না বলে কাঁদে। রুদ্র বুঝতে পারে সিরিয়াস কিছু। সে জোর করে আনন্দীকে ঘরে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে—আমাকে বল। আমি তো তোমার বন্ধুও।
আনন্দী আস্তে আস্তে বলে—পিরিয়ডের ডেট চলে গেছে, হচ্ছেনা।
—-তাতে কী হয়েছে ?
—–তুমি জানোনা তাতে কী হয় ? আনন্দী বিরক্ত গলায় বলে।
—-কিন্ত সেসব কীভাবে হবে ?
আনন্দী চুপ করে থাকে। রুদ্রর হঠাত মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারেনা।
আনন্দী চুপ করে থেকে ধীর গলায় বলে— আমি খুব ভুল করে ফেলছি রুদ্র। একজনের সঙ্গে… আনন্দী কাঁদতে থাকে।
রুদ্র অতি বড় বিপদেও স্থির থাকে। সে শান্ত ভাবে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। তার ভেতর থেকে একটা কান্না হূ হূ করে আসছিল। সে নানারকম বিপদ আর ভয়ের কথা ভেবেছে। এইদিকটা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি। আনন্দী যেন তার কাছে তার মা আর দিদির মতই বিশ্বাসী। সে তো মায়ের মত করে নির্ভর করে আছে এই মেয়েটার ওপর। আনন্দী অবিশ্বাসী হতে পারেইনা। কিন্তু সে এই ভুল করল কেন ? কার সঙ্গে ?
রুদ্র চুপ করে তাকিয়ে আছে আনন্দীর দিকে। আনন্দী কাঁদছে। এই দৃশ্য তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। সে ফিসফিস করে বলছে—কার সঙ্গে ? কে সে ?
আনন্দী তার দিকে তাকিয়ে বলছে –সেটা জেনে কী হবে ? সে আমার জীবনে আর কেউনা। কিন্তু তুমি কি আমাকে পুতুল ভাবো ? যেরকম আলমারিতে তুলে রেখে গেছ, ঠিক সেরকমই থাকবো। আমার কি একা লাগেনা ? কিছু হতে পারেনা কারোর সঙ্গে ?
রুদ্রর মনে হয় ঠিকই তো। আনন্দী কথাটা ভুল বলছেনা। সে শুধু বুঝতে পারেনা এরপর কী হবে। আনন্দীই বলতে থাকে— কিন্তু যদি কিছু হয়েই থাকে সেটা কীভাবে নষ্ট করতে হয় ? আমি তো কিছুই চিনিনা।
রুদ্র স্থির গলাতেই বলে—ঠিক আছে, আমি কাল সেটা অন্যভাবে জেনে নিচ্ছি। এখন ঘুমাও।
আনন্দী এবার ডুকরে কেঁদে বলে— টেনশনে গত সাতদিন আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমাকে কীভাবে বলব তাও ভাবছিলাম।
রুদ্র আনন্দীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর বলে— চল, এখন ঘুমানো যাক। অত চাপ নিওনা। আমি তো আছিই।
রুদ্রর পাশে শুয়ে আশ্চর্য বালিকার মত ঘুমিয়ে পড়ল আনন্দী। রুদ্র ওর পাশে শুয়ে ভাবছিল, এই ব্যাপারটা সে কোনোদিন মাথাতেও আনেনি। সে পাগলের মত নিজের কেরিয়ারের দিকে দৌড়েছে। আনন্দীর কারোর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব, মানসিক সংযোগ তবু বা ভেবেছে , কিন্তু কারোর সঙ্গে আনন্দীর শারীরিক সম্পর্ক হতে পারে এটা সে ভাবেইনি। সে আনন্দীকে এত পড়াশোনা, নিজের কাজে ফোকাস দেখে তাতেই তার ভুল হয়েছিল। মেয়েটার যে একটা বালিকা সত্ত্বাও আছে সেটা সে জেনেও মনে রাখেনি। আনন্দী কীভাবে অন্য একটা লোকের কাছে এতটা সহজ হল ? সে তো তার সঙ্গেই সহজ হতে অনেক সময় নিয়েছিল। কিন্তু লোকটা কে ? সেই স্নেহাশীষ বলে লোকটা ? তিনি তো একজন নামী অধ্যাপক । এরকম কান্ড হলে তার তো এটার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। ভোরের আলো চোখে লাগলে রুদ্রর খেয়াল হল সে জেগে আছে আর তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।
সকালে আনন্দীর ডাকে তার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখল, আনন্দীর ঝকঝকে হাসি আলো মাখা মুখ। সে সদ্য স্নান করেছে। হাসতে হাসতে বলছে— রুদ্র পিরিয়ডস শুরু হয়ে গেছে। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, জানো ?
সতের
দিন সাতেকের মধ্যেই টিকিট কাটল রুদ্র। ভারতের ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই । সে ভেবেছিল বাড়িতে অন্তত দিন পনের থাকবে। কিন্তু দিন সাত পরই তার চঞ্চল লাগছিল। তাছাড়া আনন্দীর সঙ্গে সে যতই সহজ হবার চেষ্টা করুক না কেন তার নিজেকে খুব বঞ্চিত, অপমানিত মনে হচ্ছিল। একা কিছুদিন থাকার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। তবু নিজের কষ্টের কারণে সে বাড়ির আনন্দ নষ্ট করতে চাইছিলনা। সেদিনের পরে আনন্দী হয়ে গেছে অত্যন্ত সহজ। আগের মত আনন্দিতা মূর্তিতে সে খুব ব্যস্ত। কখনো রুদ্রর জন্য নানারকম রান্না করছে, কখনো বুম আর তাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চাইছে। দুদিন কলকাতা ঘুরল তারা বুমকে নিয়ে। বুম এখন বাবাকে দেখলে মেনে নিচ্ছে। কিছু কিছু কথা বলারও চেষ্টা করছে। ছেলেকে নিয়ে দুজনেই কিছুটা মেতে থাকছে। আর থাকছে রুদ্রর স্বপ্ন। রুদ্র তার নিজের সব স্বপ্নকে গোছানোর চেষ্টা করছে। সেই নিয়ে দুজনের রাত জেগে গল্প হচ্ছে। কিন্তু দুজনেই কেউই শারীরিক ভাবে আর ঘনিষ্ঠ হচ্ছেনা পরস্পরের সঙ্গে। রুদ্রর মনে হচ্ছিল তারা যেন এই ফ্ল্যাটে চারজন বাস করছে। দুজন রুদ্র, দুজন আনন্দী। তাদের মধ্যে এক জোড়ার খুব ভাব, আর এক জোড়ার খুব দূরত্ব। আনন্দী নিজের ভার তাকে বলে শান্ত হয়ে গেছে, নিশ্চিন্তও। কিন্তু রুদ্র এক অজানা ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
সাতদিনের মাথায় চলে যাবার কথা বলতে আনন্দীর একটা মন কেঁদে উঠল, আর একটা মন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যেন। তারও কিছুদিন একা থাকার দরকার মনে হচ্ছিল। অথচ রুদ্র চলে গেলে যে কী শূন্যতা। সেই অভাব যে কেউ মেটাতে চায়না, পারেওনা সে জানে সেটা।
রুদ্র চলে গেলে সে একবার স্নেহাশীষের ফোন ধরবে, তারপর যা বলার বলবে তাকে। কিন্তু রুদ্র থাকাকালীন সে ফোন ধরবেনা। স্নেহাশীষ প্রায় বারোটা মিস কল করেছে তাকে। অথচ ঘনিষ্ঠ অবাস্থায় এটাই ছিল তার একটা কমপ্লেইন। স্নেহ বাড়িতে থাকাকালীন তার ফোন ধরেনা। যদিবা ধরে এমন একটা ভারী গলায় কথা বলে যে আনন্দী কিছুই বলে উঠতে পারেনা। স্নেহ তাকে তখন আশ্বাস দিত আর আনন্দী বলত , রুদ্র থাকলেও সে অনায়াসেই গল্প করতে পারে স্নেহাশীষের সঙ্গে। এতটা পরাধীন সে নয়। কিন্তু আজকে সে সেই কাজটাই করছে। সে বোঝেনি তার নিজের কথা নিজের কাছেই ফিরে আসবে। একটা ভয়ানক উচ্চতা সে দিয়েছিল স্নেহাশীষকে, তার সঙ্গে সম্পর্কটাকে। কিন্তু রুদ্র আসার আগেরদিন সে যখন প্রচণ্ড আতঙ্কে তার পিরিয়ড মিস করার কথা এবং রুদ্র আসলে সে কীভাবে সব সামলাবে বলতে চেয়েছিল তখন স্নেহাশীষ শীতল গলায় বলেছিল তাকে— সেটা তাকেই ভাবতে হবে, সে কীভাবে জানবে কীভাবে সে দাম্পত্য সামলাবে ! তাছাড়া পিরিয়ড মিস করার দায়িত্ব যে তারই তার কী গ্যারান্টি ? আনন্দীর তো আরও অনেক ছেলে বন্ধু আছে। তার ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা তো আজও তার সঙ্গে আড্ডা দিতে আসেই, তাদের মধ্যেই হয়ত কেউ…… সেদিনই আনন্দীর নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে গেছিল। এই লোকটা ভালবাসার ভাষা দিয়ে শুরু করে এখন বস্তাপচা সিরিয়ালের মত সংলাপ বলছে ! যুক্তি সাজিয়েই তবে এ তাকে ভালবাসতে এসেছিল !
নিজের ওপর সেদিন থেকে গ্লানিতে, ঘেন্নায় পাথর হয়ে গেছিল আনন্দী। ও এটা কী করল ? তাই এরপর মিসকল হলেও ফোন ধরেনি সে, আর কোনোদিন ধরবেনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। শুধু একবার সে কথা বলে নেবে। তাকে নিতে হবে।
রুদ্রর চলে যাওয়ার আয়োজনে সে তাই খুব বিভ্রান্ত হল। তার মনে হচ্ছিল সেও চলে যায় বুমকে নিয়ে। কিন্তু আর দিন পনের পর তার কলেজ সার্ভিসের ইন্টারভিউ। এবার না বসতে পারলে আবার কবে সুযোগ পাবে জানেনা।
রুদ্রও সেই কথাই বলল— আমি তোমাকে সারাজীবন বাচ্ছা সামলাচ্ছো বা কাপড় কাচছো বা রান্না করছ, এইভাবে দেখতেই পারবোনা। আমি নিজে যেমন সফল হতে চাই , তোমাকেও তাই দেখতে চাই। সংসার তো সবাই করে। শুধু ওটা নিয়ে কেউ থাকতে পারে ? তোমার বাংলাদেশ যাওয়ার স্কলারশিপটা হলনা, এবার অন্যভাবে যাতে যেতে পারো সেটা দেখো।
আনন্দী মন দিল পড়াশোনায় বাধ্যতই। রুদ্র আবার দিল্লি গেল। আনন্দী বুঝতে পারছিল তার ঠিক, তার ভুল নিয়ে সে বস্তুত একা। রুদ্র তাকে ভালবাসে কিন্তু রুদ্রর জীবনে সে বা তাদের পরিবার প্রথম প্রায়োরিটি হবেনা কোনোদিনই। সে থেকে যাবে দ্বিতীয় কুঠুরিতে। রুদ্র কর্মজীবনে আঘাত পেলে বা ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নেবে তার ঘরে এসে। আনন্দীর কদিন জীবনের ওপরই তুমুল অভিমান হচ্ছিল। সে বুমকে আঁকড়ে থেকে গেল আবার একা তার গহন শূন্যতা নিয়ে।
ভোরে উঠে সে পড়াশোনা করত আর বাকি সারাদিন বুমকে নিয়ে থাকত। তার সমস্যাও হল বহুবিধ। কাজের লোক দেশের বাড়ি গিয়ে ফিরলনা। বুমকে একেবারে একা নিয়ে থাকাকালীন বুমের সাংঘাতিক পেটের সমস্যা হল। দিন পনের নাকের জলে চোখের জলে করে, কখনো একা একা অসুস্থ ছেলে নিয়ে দৌড়ে ডাক্তারের কাছে গেল। কখনো বাবা তার ঠাকুমাকে নিয়ে অতি ব্যস্ততার মধ্যে সময় করে তাকে নিয়ে গেল। সে বুঝল তার সিঙ্গেল পেরেন্টিং এ রুদ্র প্রিয় বন্ধু ছাড়া কেউই না। কিন্তু আনন্দী এবার চেষ্টা করল নিজেকে হতাশা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে। সে এতসব বাধার মধ্যে দিয়ে প্রবলভাবে পড়াশোনা শুরু করল এবং একা গিয়ে ইন্টারভিউতে বসল।
স্নেহাশীষ আবারও ফোন করেছিল। সে কথা বলেছে। ভেবেছিল মনে যা আসছে বলবে। কিন্তু সেসব সে পারেনি। শুধু হুঁ হুঁ করে কাটিয়েছে ফোনটা। আর টের পেয়েছে নিজেকে উইথড্র করে নিলে কত শান্তি পাওয়া যায়, তীব্র অপমানের বোধও ফিকে হয়ে যায়। অহং থেকে “ আমি “ সরিয়ে নিলে তো আর কিছুই পড়ে থাকেনা।
সে নিজের পড়াশোনায় ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। সে আপাতত নিজের একটা চাকরি ছাড়া আর কিছুই চাইছেনা।
রুদ্রকেও আজকাল আর মনের সব কথা বলেনা। নতুন চাকরিতে রুদ্র সিনিয়র ডিজাইনার হিসেবে জয়েন করেছে। সঙ্গে পেয়েছে একটা টীম। সে নিজের কাজটা অনেক হাত খুলে করতে পারছে। সেই নিয়ে একটা সন্তুষ্টি রুদ্রর গলায় সবসময় থাকে। প্রতিটা ফোনের পরে আনন্দী শুধু একটা করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে যে তার যে আজীবন কল্পনা ছিল সংসার নিয়ে, সবাই মিলে মিশে হৈ হৈ করে থাকা নিয়ে তার কণাভাগও তো মিললনা। সে তো একটা পর্দা ঘেরা ঘরে শান্ত দুপুর ভাবত। ভাবত যে বাড়িটায় গিয়ে বসলে যেকনো মানুষের মন জুড়োয় তেমন একটা ঘর হবে তার। সন্ধেতে সবাই মিলে চা-মুড়ি নিয়ে গল্প করার কথা ভাবত। আনন্দ আর মজায় কেটে যাবে দিন। সেসব কিছুই নেই। তাই তার ফ্ল্যাট সে যতই সাজায় সেটাকে ট্রেনের ওয়েটিং রুম ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না তার।
কোনোদিন কি তার নিজের বাড়ি হবে ? নিজের ঘর ? দুজনে পাশাপাশি বসে থাকার ঘর ? বুমকে নিয়ে মেতে ওঠার, নিশ্চিন্তে থাকার একটা আশ্রয় ?
সে উত্তরগুলো পায়না। তাই পড়াশোনায় মন দিয়ে দেয় পুরো। নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে পারে তখন।
তৃতীয় পর্ব
এক
কী কী নিয়ে যাবে সঙ্গে রুদ্র ? এই পনের বছর তার দিল্লিতে থাকা, অর্জন সব ? চেন্নাই থেকে ফিরে দিল্লিতে রুদ্র চলে এসেছিল ভারতের ডাকে। নাহ, কোনো চাকরির আশ্বাস তার কাছে ছিলনা। তার ছিল শুধু অপেক্ষা। তখন রিসেশান চলছে। চাকরি পাবে কিনা জানেওনা। তবু তার মনে হচ্ছিল বাড়িতে বসে থাকলে আরও সে পিছিয়ে যাবে । তাকে রণক্ষেত্রে আসতে হবে।
সে উঠে এসেছিল ভারত গৌড় এর বাড়ি। ভেবেছিল দিন পনের বন্ধুর বাড়ি থেকে সে ম্যানেজ করে ফেলবে। ভোরবেলা স্নান সেরে সে বেরিয়ে যেত। রাস্তায় খেয়ে নিত ছাতুর সরবত। তারপর ব্যাগ কাঁধে এদিক ওদিক, নয়তবা কোনো রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে সে পরিকল্পনা করত তার ছোট্ট ডায়েরিতে। দিনগুলো ভয়াবহ ছিল। কনকনে শীত তখন দিল্লিতে। সে প্রায় মাঝরাতে ভারতদের বাড়ি ঢুকত। সে বুঝতে পারত তার এসে পড়ায় ভারতের মা খুব বিরক্ত। মারোয়ারি ভাষায় তিনি এ নিয়ে প্রায়ই কটু কথা বলতেন ভারত আর তার বাবাকে। রুদ্র বুঝেও না বোঝার ভান করে চলত। শুধু কোনো খাবারই সে যাতে খেতে না হয় সে ব্যাপারে সচেতন ছিল। সে বুঝত ভারতের মা তাতে আরও বিরক্ত হবেন। তবু দু একবার ভারতের অতি ততপরতায় তাকে তার মায়ের হাতের রুটি সব্জি খেতে হয়েছে। পেঁয়াজ রসুন ছাড়া রান্না যে এত সুস্বাদু হয় সে জানতনা। ভারত ছিল আদ্যন্ত ভালো একটা ছেলে। কিন্তু সে হল গিয়ে নেশারু। প্রতিদিন সে বিরাট নেশা করে ফিরত। ওর সঙ্গে কৃষ্ণদাসনের অফিসে কাজ করার সময় আলাপ। ও ছিল ক্লায়েন্ট । এক কোম্পানির মার্কেটিং এর দায়িত্বে। ভোলেভালা দেখতে ছেলেটা প্রথম দিন থেকেই রুদ্রকে ভালোবেসে ফেলেছিল। নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। কিন্তু ওর বাড়িতে থাকতে এসে বুঝেছিল রুদ্র ছেলেটা নেশা ছাড়া কিছু বোঝেনা। তার ডিভোর্সও হয়ে গেছে সেই কারণে। মা মুখরা হলেও ছেলে বলতে পাগল। হাতের চুড়ি বিক্রি করেও ছেলেকে নেশার টাকা যোগান। ভারত সেসবেই অভ্যস্ত।
দিন আঠারো তাদের বাড়ি টিঁকে যাওয়ার পর রুদ্র একদিন প্রমাদ গুনল। খুব ভোরে সে স্নান করে ব্যাগ নিয়ে বের হবে তখন দেখে প্রায় জনা সাতেক বডি বিল্ডারদের মত চেহারার কটি ছেলে এসে ভারতের খোঁজ করছে। ঘটনাচক্রে ভারত সেই রাতে ফেরেনি। নেশা করে এদিক ওদিক পড়ে থাকাও ছিল তার নিত্য ব্যাপার।
সেই লোকেরা ভারতের খোঁজ করতে এসে তাকে পেয়ে প্রচুর প্রশ্ন করল। রুদ্র সব সত্যি কথাই বলল। সে কদিন ভারতকে চেনে তাও বলল। তারপর ভারতের মা-বাবা বেরিয়ে এসে সেইসব ছেলেদের হাতে পায়ে ধরে কিছুদিন টাইম চাইল। ভারত নাকি কোন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে তিন লাখ টাকা বহুদিন ধরে শোধ করছেনা।
সেদিন ছাতু খেয়ে নেহেরু প্লেসের মার্কেটের সিঁড়িতে বসে মনে মনে কাঁদছিল রুদ্র। ঘরে তার স্ত্রী-পুত্র। তার জমা কিছু টাকা নেই। তার বাবা তার জন্মের আগে চলে গেছেন। জেঠুরা কার্যত তাদের বঞ্চিত করে বাড়ি থেকে সরিয়েই দিয়েছেন । সে সত ভাবে একটা কাজ খুঁজছে। চাকরি পেলে সে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে দিতে প্রস্তুত। তাহলে কোন পাপে তার এই শাস্তি ? এই শীতের ভোরে তার উপযুক্ত শীত পোশাকও নেই । সে শারীরিক ভাবেও নানা অসুস্থতা বহন করে। তাহলে কেন সে একটা কাজ পাবেনা ?
ওই ভদ্রলোক মাঝে মাঝে তার কথা মন দিয়ে শোনেন। বিকেলেই সে ফোন পেল । শিল্পার। যে মেয়েটা একদিন তার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল, অপমানও। সে আজকের মধ্যেই দেখা করতে বলল একটা ঠিকানা দিয়ে। বিকেল পাঁচটায় সে গিয়ে দেখল বিরাট একটা অফিস। নির্দিষ্ট লোকটার সঙ্গে দেখা হতেই লোক, বলা ভালো তার বয়সীই একটা ছেলে তার সিভি দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার চাকরি কনফার্ম করল। আগামীকালই জয়েনিং। একেবারে এপয়ন্টমেন্ট লেটার নিয়ে যেতে বলল । ছেলেটির নাম পবন । সে জানালো শিল্পা তার কথা বিস্তারিত জানিয়েছে। শিল্পা তাদেরই অন্য উইং এ ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং এ আছে।
ছেলেটিকে দেখে রুদ্র ভাবছিল তার বয়সী হলেও ছেলেটা সাফল্যে সম্পদে উজ্জ্বল। মুখের মধ্যে কী নিশ্চিন্ততা। কী ভরসা । সে আনন্দে ঘামছিল । এই শীতে, এই এসি রুমেও। কীভাবে আজ দিনটা শুরু হল, আর কীভাবে শেষ ।
বাইরে এসে সে প্রথম ফোনটা আনন্দীকে করল । আসলে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে , যিনি বারবার তাকে গলা জলে ঠেলে দিয়ে সুন্দরভাবে হাত ধরেন।
দিল্লির রাস্তাঘাট আজ কী উজ্জ্বল। চারিদিকে আনন্দ আর আনন্দ।
তার গলা শুনেই আনন্দী বলে— এত খুশি কেন ? কী হয়েছে ?
—-খুব বড় অফিস আনন্দী। আমি পেরেছি। এক লাখ মাইনে।
—-সত্যি ? আনন্দী খুব আনন্দিত গলায় বলে।
—–হ্যাঁ। আমি জানিনা এরপরে আর বিপদ হবে কিনা। কিন্তু আমার বসের মুখ দেখে খুব নিশ্চিন্ত লাগছিল।
—–আমারও আজকের ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে। খুব ভালো। মনে হচ্ছে পেয়ে যাবো
—-ইসস, আমি ভুলেই গেছিলাম । আজ তোমার ইন্টারভিউ ছিল ?
—-তুমি আগে নিজেকে সামলাও। দ্রুত বাড়ি দেখো। ওইভাবে অন্যের বাড়ি থাকতে হবেনা।
—-সে আর বলতে ! কালই জয়েনিং। কিন্তু এই অফিস দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের একেবারে কাছে।এই জায়গা একেবারে কলকাতার মত জানোতো। এখানেই দেখছি কিছু। তোমারও এসে থাকতে ভালো লাগবে। আজই ব্রোকারকে ফোন করছি। সেই অফিসের ঢোকার পর থেকে রুদ্র একধরণের নিশ্চয়তা পেয়েছিল। প্রায় দশ বছর চাকরি করেছিল । চিত্তরঞ্জন পার্কে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। আনন্দী আর বুম সেই ফ্ল্যাটে প্রতি বছর তিনবার করে এসে আনন্দে কাটিয়ে গেছে। রোজ অফিস থেকে ফিরে বুমের সঙ্গে আড্ডায় আড্ডায় তার ছোট্ট বাসা ভরে থেকেছে। কলকাতাতেও তাদের নিজেদের ফ্ল্যাট হয়েছে। আনন্দীও কলকাতার কাছাকাছি কলেজে চাকরি পেয়েছে। তারা কি তবে একটু থিতু জীবনের স্বাদ পেল ? তবে রুদ্রর জীবনে ছুটি নেই । সে দশবছর চাকরি করেছে আর লালন করতে শুরু করে তার নিজের এজেন্সি খোলার স্বপ্ন।
রুদ্র একেবারে তিনটে টিকিট কেটে রাখে। কলকাতায় ফেরার। কবে সঠিকভাবে আনলক হবে বোঝা যাচ্ছেনা। কিন্তু ফ্লাইট টিকিট দেওয়া শুরু করেছে। যদি প্রথম ফ্লাইট ক্যান্সেল হয় পরেরটা, সেটাও ক্যান্সেল হলে তৃতীয়টা।
সে দরকারী জিনিস গুলো আপাতত গুছিয়ে নিচ্ছে। জিনিসের দরকারী অদরকারী আছে, কিন্তু মানুষ গুলোর ? মুহূর্তগুলোর ? ঘটনাগুলোর ?
বারবার সে দেখেছে মানুষকে সে যা ভেবেছে মানুষ সেটা নয়, আলাদা। শিল্পার ক্ষেত্রেও তার ধারণা তাই হয়েছিল দৈনিক ভারতে চাকরি পাওয়ার সময়। সে তাই নিজেকে , নিজের জীবনকে কবেই ছেড়ে দিয়েছে সেই মানুষটার ওপর, যে তাকে ডোবায় আবার বাঁচায়।
ভারতের ক্ষেত্রে তাকে আবার অন্যরকম দাম দিতে হয়েছিল। সেও তার জীবনের একটা শিক্ষা। সে চিত্তরঞ্জন পার্কে এক চিলতে ছাদের একটা ঘর ভাড়া পেয়েছিল। নতুন চাকরি নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে গেছিল। আনন্দীও ততদিনে কলেজে চাকরি পেয়ে গেছে। গরমের ছুটিতে আনন্দীরা ওই ঘরেই এসে কাটিয়ে গেল একমাস। তারা কলকাতায় নিজেদের ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবনা চিন্তা করছিল। সেই একমাসের পরেও বড় বাড়ি নিলে আনন্দীরা কতবার এসেছে গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটিতে নিয়ম করে। কিন্তু সেই ছোট্ট ঘর আর একচিলতে ছাদে তাদের পিকনিক মুডে একমাস থাকাটা রুদ্রর জীবনে আনন্দের ঢেউ এনেছিল। ততদিনে বুম হয়ে পড়েছে বাবা ভক্ত। বাবাকে ছাড়া সে কিছুই চেনেনা যেন। বাবা অফিস থেকে আসার টাইম হলে ছাদে এসে দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখে নিচের গেট। রুদ্রর কাছে সব না পাওয়া মিলে যাচ্ছিল এইসব প্রাপ্তিতে। একবার ভারত এসে থাকতে শুরু করল তার সেই একচিলতে ঘরে। কোন ব্যাংকের টাকা মেটাতে গিয়ে তার বাবা ফতুর হয়ে গেছে। তাদের বাড়িটা মর্টগেজ রেখে বাবা-মা ফিরে গেছে রাজস্থান। সে দিল্লিতে এখন কোথায় থাকবে ?
রুদ্র বোঝে ভারতের বাড়ি সে দরকারে থেকেছে, তাই ভারতকে এখন বিপদের সময় রাখা তার নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু সে বুঝতে পারে নৈতিকতা করতে গিয়ে সে একটা বেজায় ভুল করে ফেলল। আশ্চর্যভাবে প্রথম দশ দিন ভরত একেবারে শান্তভাবে থেকে গেল। নিয়ম করে অফিস যায়, সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরে। এতদিন যা জানতনা রুদ্র, সেরকম একটা আশ্চর্য গল্পও সে শুনল ভরতের কাছে। ভরতের নাকি বছর সাতেক আগে বিয়ে হয়েছিল। তাদের মারোয়ারিদের মধ্যে বিয়ে খুব অল্প বয়সেই তো হয়। এখন তার বয়স আঠাশ। একুশে তার বিয়ে হয়েছিল খুব সুন্দরী কঙ্গনা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে। বাড়ি থেকে দেখেশুনে বিয়ে। এখন রুদ্র ভরতকে যেরকম রোদে পোড়া দেখছে তখন তো সেরকম সে ছিলনা। তাই মেয়ের বাড়ির লোক তাকে দ্রুত পছন্দ করে ফেলে। তাদের একটা সাড়ে তিন বছরের মেয়েও আছে। বৌ তাকে ছেড়ে চলে গেছে মেয়েকে নিয়ে। থাকে লাজপত নগরে। আফিস ফেরত সে মাঝে মাঝেই গিয়ে লাজপত নগরে যায়। বৌয়ের বাবার ফ্ল্যাটের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটাকে দেখবে বলে। কঙ্গনার জন্যও তার মনখারাপ করে। কিন্তু বৌ কিছুতেই তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখবেনা, মেয়েটাকেও আসতে দেবেনা।
রুদ্রর বুক হূ হূ করে ওঠে ভরতের জন্য। সে জানতে চায়—কেন ? অভিযোগ টা কী ?
ভরত দুঃখিত হয়ে বলে—ওই যে আমি নাকি নেশাড়ু। রেসপন্সবিলিটি নিইনা। লড়কি লোগ বহুত টীচার য্যসি, হরদম লেসন দেতি হ্যায়।
রুদ্র হাসে কিন্ত রুদ্রর খুব খারাপ লাগে। হাজার হোক নিের সন্তান। বুম যত দূরেই থাক, সে তো জানে কোন একদিন সে সকাল রাত বুমকে ঘিরেই থাকবে। এখনো থাকে, তবে মনে মনে। রুদ্র ভরতের জন্য দয়ালু হয়ে ওঠে মনে মনে। কিন্তু ভগবানের কী লীলা, মাত্র দিন পনেরর মধ্যেই রুদ্র ভরতের আসল রূপ দেখে ফেলল।
এই একচিলতে ঘরও অনেক কষ্ট করে পাওয়া। কিন্তু ভরতের জন্য বাড়িওলা বিরক্ত হয়ে গেল। সে রোজ রাতে , মানে মধ্যরাতে নেশা করে এসে গেট খোলার জন্য নিচের থেকে চিৎকার শুরু করল। রুদ্রর এই অফিসে প্রচণ্ড কাজের চাপ। সে নিজেই প্রায় রাত এগারোটায় ফেরে। ফিরেও টীমকে ফোনে এটা ওটা নির্দেশ দিতে হয়। নিজের রান্না নিজে করে, ভরতের জন্য গুছিয়ে রাখে। তারপর মাঝরাতে সবে গিয়ে শোয় আর ভারত তখন ডাকাডাকি করে। সে একাধিকবার বলেছে চাবিটার ডুপ্লিকেট করিয়ে নিতে। ভারত করায়নি। একদিন নিচে টহলদারি পুলিশ এসে তাকে বকাবকি করল। কারণ ভারত বলেছে সে রুদ্রর গেস্ট। রুদ্র কিছু বোঝাতেই পারলনা লোকটাকে। যে গেস্ট কিছু নয়, তার বন্ধু। থাকার জায়গা পাচ্ছেনা। তাই কদিন এসে থাকছে।
দোতলার বাড়িওলারা এতদিন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু সেদিনের পর রুদ্রকে ডেকে বলল—হয় সে যেন বাড়ি ছেড়ে দেয়, নয়ত ভারতকে যেন আসতে বারণ করে। তাদের বাড়িতে দুটি অল্পবয়সী মেয়ে আছে। এরকম নেশাড়ু রেখে দিতে পারবেনা তারা। তাছাড়া ঘর রুদ্রর নামে ভাড়া। রুদ্র জানিয়েছিল মাঝে মাঝে তার ফ্যামিলি আসবে শুধু, ব্যস। রুদ্রকে দেখে তাদের ভালো লেগেছিল, কিন্তু এই উতপাত তারা মানবে না।
রুদ্র পড়ল অথৈ জলে। একে এই দিল্লি শহরে একা বাড়ি ভাড়া নেওয়া একটা মহার্ঘ ব্যাপার। সে অনেক খুঁজে এটা পেয়েছিল যেটা একেবারে চিত্তরঞ্জন পার্কের এক নম্বর মার্কেটের সামনে অথচ ভাড়াটাও তার বাজেট অনুযায়ী। কিন্তু ভরত তাকে এভাবে বিপদে ফেলে দেওয়ায় সে বিরক্ত হয়ে গেল। বাড়িওলার কথা শোনার পর ভারত তার হাত ধরে প্রচুর কাঁদল। ততদিনে রুদ্র বুঝে গেছে ভারতের সবটাই নাটক। তাও সে বিশ্বাস করল ভারত যখন তাকে বলল, আজ রাতে সে দশটার মধ্যেই এসে যাবে। দাদা না ফেরা অব্দি সে নিচের পার্কে অপেক্ষা করবে।
কিন্তু রাতে দেখা গেল সে ফেরেনি। রুদ্র প্রমাদ গুনল। প্রায় রাত একটার সময় সে ছাদে এসে দেখল ভারত নিচের পার্কে বসে না শুয়ে আছে। একটু আগেও ছিলনা। এখন এসে শুয়ে পড়েছে। মানে আজও আকন্ঠ পান করে। রুদ্র যে কী করবে বুঝতে পারেনা। একবার ভাবে থাকগে, নিজে ঘুমাই। তারপর আবার বিছানায় গিয়ে বিবেক জেগে ওঠে। দিল্লিতে এখনো বেশ ঠান্ডা। সবে মার্চ মাস। ওইভাবে পড়ে থাকলে ছেলেটা যদি মরে যায় ! সে আবার নিচে এসে অতি কষ্টে ভারতকে তিনতলা অব্দি নিয়ে যায়। পরেরদিন অফিস যাওয়ার আগে সে মার্কেটে গিয়ে চাবির ডুপ্লিকেট করে একটা ভারতকে দিয়ে অফিস চলে যায়। সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পড়ে। ভারত নিজের থেকেই কাঁদুনি গায়, কাল নাকি সে নিজের বেটিকে দেখতে লাজপত নগরে গেছিল , বেটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখছিল অবাক হয়ে। সে তো চেনেনা নিজের পাপাকে। তখন কঙ্গনা তাকে দেখতে পেয়ে বেটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বারন্দার দিকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তাই আর সে পারেনি। মদ না খেলে কাল সে সুইসাইড করত।
রুদ্র অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হতে হতে শুনছিল।কিন্তু তার মনে হচ্ছিল সব বানানো। নিজের দোষ ঢাকার জন্য বেটিকে নিয়েও গল্প বানাচ্ছে। বাপরে, এর বউ পালিয়ে বেঁচেছে একেবারে।
সেদিন ফিরতে রুদ্রর বেশ রাত হল। প্রায় বারোটা। সে খুব ক্লান্ত বোধ করছিল। ফিরে এসে আবার দুজনের রান্না। ভাবছিল মুড়ি আছে কিনা বাড়িতে ।
নিজের ঘরের দরজার তালা খুলে অবাক। গোটা ঘর লন্ডভণ্ড। আলমারি থেকে তার সব জামা নামানো। সুটকেশ হাঁ করে খোলা। তার বিছানা বালিশও এলোমেলো। সে দ্রুত গিয়ে স্যুটকেশের ভেতরের খাপে হাত দিয়ে দেখল। নাহ নেই। প্রায় হাজার সাতেক টাকা সে আলাদা করে রেখেছিল। বাড়ি যাবার আগে কেনাকাটির জন্য। নেই।
ভরতও আর ফিরলনা। বাড়িওলা সুব্রতদা তাকে বারবার বলল পুলিশে জানাতে। কিন্তু সে আর ঝামেলা বাড়াতে চাইলনা। তবে তার মন বেজায় খারাপ হল। কত কষ্ট করে সে এত লড়াইয়ের পর টাকা জমাচ্ছে। ভরত বিদায় নিল কিনা সে নিশ্চিত না, কিন্তু সে তালা বদলে নিল আগে। ভারতের কোনো ট্রেস সে আর পেলনা। তার একাধিক নম্বর বন্ধ। তার কলিগরাও কেউ জানেনা। মাঝখান থেকে খবর পেল কোনো ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড অত্যধিক ব্যবহারের পর টাকা না মেটানোয় আবার লোক ঘুরছে ভরতের পিছনে। বন্ধুবান্ধবদের মারফতই শুনলো এসব।
দুই
দিল্লির মার্চ মাস খুব আকর্ষণীয়। রুদ্রর খুব ভোরে ঘুম ভাঙেনা। অনেক রাতে শোয়। কিন্তু সেদিন ভোর ভোর ফোন এলো আর ঘুম ভেঙে গেল। বালন ফোন করেছে চেন্নাই থেকে। কাল রাতে প্রসেনজিত মারা গেছে।
কে ? ক্কে ? –রুদ্র ধড়মড় করে ওঠে।
—-হ্যাঁ, আমাদের প্রসেন । হার্ট এট্যাক।
—কেন ? কেন বালন ? কী হয়েছিল ওর ?
বালন খুব সংযত চিরকালই। থেমে থেমে নির্লিপ্ত গলায় বলে, প্রসেনের স্পাইন নিয়ে তো প্রবলেম ছিলই। সেরকম কোনো কারণেই হার্ট এট্যাক ।
রুদ্রর কাছে একটা নির্জন স্টেশন, আর দুই বন্ধুর মনের কথা বলার সেই স্মৃতি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। প্রসেন তার কাছে একটা নরম অনুভূতির নাম। দিল্লীর কঠিনতম দিনগুলোয় সবচেয়ে শান্তির জায়গা। তার খুব আত্মগ্লানি হচ্ছিল। একই শহরে থেকে কতদিন সে প্রসেনের সঙ্গে দেখা করেনি। চেন্নাই থেকে ফিরে এসে দেখা হয়েছিল। তারও বছর দুয়েক হয়ে গেল।
বালন আরও জানালো— সে নিজে নতুন কোম্পানি খুলছে। ম্যাডাম স্বাতী তাকে তার ডিউজ আর রুদ্রর ডিউজও দিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু সে সামনের মাস থেকে নিজের অফিস নিচ্ছে ওই রাধাকৃষ্ণ সলাইতেই।
প্রসেনের এই আচম্বিত খবরটা পেয়ে মন এত দমে গেছিল, কিন্তু বালনের সিদ্ধান্তটা তার ভালো লাগল। অফিসে গিয়ে সে সুহাসকে বলল, –চল, আজ একটু আগে বের হই। তোর সঙ্গে একজায়গায় যাবো।
সুহাস তো আনন্দে আটখানা। মাত্র বছরখানেক হল ছেলেটা এসেছে আসাম থেকে। একা অবশ্য আসেনি। সঙ্গে এসেছে প্রেমিকা দরিয়া। মেয়েটা ওকে একা ছাড়তেই চায়নি। সুহাস নাকি এতটাই ভোলেভালা তার পক্ষে একা এই দিল্লি শহরে কিছুই সামলানো সম্ভব না। আসার পর বাড়ির চাপে তাড়াহুড়ো করে রেজিস্ট্রি করে এক বাসা ভাড়া নিয়ে আছে। দুজনেই আর্টিস্ট। চমতকার আঁকে। সুহাস তার টীমে জয়েন করেছিল ট্রেনি হিসেবে। আঁকার ভালো হাত দেখে রুদ্রই ওকে নিয়োগ করেছে।
ওদের সঙ্গে জুটে গেল উপল। কপিরাইটার, ওদের টীমেই। উপল বিবাহিত। বউ কলকাতায় থাকে। কিন্তু তাতে কিছুই এসে যায়না। বউ আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর ফোন করে ওর খোঁজ নেয়। ওকে ফোনে না পেলে রুদ্রকে, সুহাসকে বা অন্য যে কাউকে ফোন করে। অসম্ভব সন্দেহ বাতিক গ্রস্ত মেয়েটা অফিসের একটা লিলি নামের বাঙালি মেয়ের সঙ্গে জোরদার সন্দেহ করে।
রুদ্র সব শুনে অবাক হয়ে বলেছিল—তো আমাদের টীমে তো পাঁচজন মেয়ে। বাঙালিও দুজন। তা লিলি কী দোষ করল ?
উপল জানালো— কবে নাকি কার বার্থডে পার্টিতে উপল লিলির পাশে দাঁড়িয়েছিল,ফেসবুকে ছবি দেখেছে। আর লিলি মাথাটা একেবারে উপলের বুকের কাছে এনে রেখেছিল। তাছাড়া উপল নাকি একবার কবে বলেছে, তার কালো মেয়েদের ভালো লাগে। আর লিলি কালো।
—হায় ভগবান। রুদ্র হেসেই ফেলেছে। তারপর বলেছে—তুই তোর বউকে নিয়ে আয় দিল্লি। চোখের সামনে দেখলে অত সন্দেহ করবেনা আর।
উপল বউকে আনার ব্যাপারে বেশ সন্দিহান এখনো। কিন্তু ওদের নিয়ে গাড়ি বুক করে প্রসেনজিতের বাড়ি যেতে যেতে রুদ্রর মনে হল, এর চেয়ে সে আর আনন্দী বরং ভালো আছে। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত টাকাপয়সা নিয়ে। আনন্দী কলকাতার কাছে একটা কলেজে চাকরি পেয়ে গেছে। দুজনেই ব্যস্ত, বুম কিছুটা বড় হয়েছে। হ্যাঁ, সে জানে আনন্দী খুব একাকীত্বে ভোগে। সমস্ত কাজ সে একা হাতে সামলায়, কিন্তু দিনের শেষে তার কারোর সঙ্গে গল্প করার নেই। তবে ইদানীং একজনের নাম শুনছে। ইন্দ্রদা। একজন নামী শিল্পী ভদ্রলোক। আনন্দী ওঁর সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হল রুদ্র জানেনা।
কিন্তু ভদ্রলোক বেশ শান্ত, জ্ঞানী , কিছুটা নির্লিপ্তও। আনন্দীর সঙ্গে একটা স্নেহ –শ্রদ্ধা সূচক দূরত্ব আছে সে বুঝতে পারে। এখন দূরত্বটা কতদিন থাকবে তা কে জানে ! এবছরই সে আনন্দীর জন্মদিন সম্পূর্ণ ভুলে গেছিল। তার আগেই বাড়ি থেকে জলপাইগুড়ি হয়ে দিল্লি ফিরেছে। ফিরে কদিন মায়ের জন্য খুব মনখারাপ ছিল তার। আনন্দীর জন্মদিনে সে মাকে নিয়েই আবেগঘন একটা পোস্ট দিয়েছিল। বিকেলে মনে পড়ল সেদিন আনন্দীর জন্মদিন। খুব আত্মগ্লানি হয়েছিল। দ্রুত এপোলজি চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। কিন্তু সেদিন তার মনে হচ্ছিল সে আনন্দীকে হারিয়ে ফেলছে। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল আনন্দী তো আগেই তার বিশ্বাসভঙ্গ করেছে, তাহলে তার কীসের দায় !
প্রসেনজিতের বাড়ি গিয়ে পা যেন উঠছিলই না রুদ্রর। কী বলবে সে প্রসেনের মা বাবার মত আগলে রাখা দিদি জামাইবাবুকে ? দিদি স্থির হয়ে বসেছিলেন। রুদ্র মুখ নিচু করে দিদির পাশে গিয়ে বসল। আর অবাক হয়ে দেখল প্রসেনদের ডাইনিং এর হলের একপাশে একটা ছোট টুলের মধ্যে বসে আছে কৃষ্ণদাসনের অফিসের সেই বাঙালি মেয়েটা। কী যেন নাম ?
প্রসেনের প্রেমপ্রস্তাব তবে ওর কাছে শেষ অব্দি পৌঁছতে পেরেছিল ? জীবন কি তবে একটা গোল গল্প ? মৃত্যুর পরে যা গিয়ে শেষ হয় !
উপসংহার
মার্চ ২০২০
একটা গেরুয়া রং এর শাড়ি। ঘন সবুজ পাড়। আনন্দী পরে আছে। এই শাড়িটা খুব চেনা লাগছে রুদ্রর। আনন্দীর বেশিরভাগ এখনকার শাড়ি সে চেনেনা। নিজে রোজগার করার পর থেকে আনন্দী যা যা ইচ্ছে কেনে। অনেক দামী শাড়ি কেনে। সেগুলো রুদ্রর অপরিচিত। সে হঠাত সোশ্যাল সাইটে খেয়াল করে কোনো বিশেষ শাড়িতে আনন্দীকে বেশ ভালো লাগছে। আনন্দীর বন্ধু বান্ধব সহকর্মী, বুমের মায়েরা এসব মিলিয়ে আনন্দীর এখন পরিচিত সার্কেল বেশ বড়। কিন্তু আনন্দীর প্রথম দিকের সব শাড়িতে এক একটা চেনা গল্প ছিল। কে দিয়েছিল, কবে সে পরেছিল, রুদ্রর সঙ্গে বেরিয়েছিল, বেরিয়ে কী কী হয়েছিল। এই শাড়িটা রুদ্র চেনে। এটা কি তবে তার প্রথমদিকের শাড়ি ? তাদের জীবনে এখন প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ভাগ হয়ে গেছে কত।
ঝটকা ভেঙে যায়। প্লেন ল্যান্ড করেছে। উফফফ। অবশেষে কলকাতায়। মোবাইলের সুইচ অন করতেই ফোন। মনীষ মালহোত্রা। তাদের আপকামিং টেলিভিশন এডের পুরো দায়িত্বটা রুদ্রকে নিতে হবে। দিন পনেরর মধ্যে শ্যুটিং সেরে ফেলতে হবে।
রুদ্র একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে— কিন্তু আমিতো কলকাতায় এলাম আজ মনীষ।
—-কুছ পরোয়া নেহি। শ্যুটিং কলকাত্তামেই হো সকতা হয়।
লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে মিনিট পনের কথা বলে বাইরে এসে ট্যাক্সিতে বসে রুদ্র আনন্দীকে ফোন করে—এবার বিশ্বাস হল তো যে আমি আসছি।
—-তোমাকে কোয়ারিন্টাইনে পাঠাবে না তো !
আনন্দীর কাঁদোকাঁদো গলাটায় মজা পায় রুদ্র। তারপর বলে—বুম কী করছে ? জানো একটা শ্যুটিং আছে । এখান থেকেই করব।]
—আবার কাজ !
রুদ্র হাহা করে হাসে আর তার মনে পড়ে যায় গেরুয়া রং এর শাড়িটা তার দেওয়া একমাত্র শাড়ি , যেটা সে অতি কষ্টে কিনে দিয়েছিল আনন্দীকে বিয়ের পর।
তার মনে হচ্ছিল সে পাহাড় পেরোতে পেরেছে । অন্তত কিছুটা। বাড়িতে আসার জন্য। ঘরে ফেরার জন্য। সে চোখ বন্ধ করে সেই লোকটার কথা ভাবে যে তার জন্য একটা দীর্ঘ পথের শেষের বাড়ির ডিজাইন করে রেখেছে।
সমাপ্ত
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক