দেবারতি মিত্র <br />  ঈশিতা ভাদুড়ী

দেবারতি মিত্র
ঈশিতা ভাদুড়ী

“মেঘের মতো হাল্কা হতে চাই, বৃষ্টির মতো স্বচ্ছ। / ইন্টারনেটে গ্রীক ভাস্কর্যের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করতে করতে / পৌঁছে যাই সুন্দরের স্বর্গে” – ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি দেবারতি মিত্র কবিতা সিংহের পর আরেক বিস্ময়কর নাম। যখন শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের লেখনী প্রবল তেজের সঙ্গে চলেছে, সেই সময় দাঁড়িয়েও সেই প্রখর তেজে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত না হয়েও দেবারতি মিত্র যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে নিজস্ব স্থান করে নিতে পেরেছিলেন, বিশেষত সেই পুরুষশাষিত বাংলা কবিতায় যাবতীয় প্রভাব বর্জন করে, এ বড় কম কথা নয়।
তাঁর প্রথম কবিতার বই, ‘অন্ধস্কুলে ঘণ্টা বাজে’। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কবিতা জগতের নজর কেড়ে নেয় তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভাষা এবং কাব্যবিষয়। অন্যান্য বই ‘যুবকের স্নান’, ‘ভূতেরা ও খুকি’, ‘খোঁপা ভরে আছে তারার ধুলোয়’ প্রভৃতি। তিনি নারীবাদী তকমায় নিজেকে তুলে ধরতে চাননি কখনও, কিন্তু নারীমনের গভীর অনুভবকে তাঁর প্রতিটি লেখায় তুলে ধরেছেন। দেবারতি মিত্রর কবিতা প্রসঙ্গে যশোধরা রায়চৌধুরী লিখেছেন –“মেয়েদের কবিতায় নারীত্ব খুঁজে তাকে লেবেল পরানো অভিপ্রেত ছিল না দেবারতি মিত্রের। নিজেকে কখনও এই আইডেন্টিটি বা সত্তায় উচ্চকিতভাবে চিহ্নিত করতেও চাননি। নিজের কবি সত্তাকে নির্লিঙ্গ বলেই ভাবতে চেয়েছিলেন তিনি”।
তিনি আশ্চর্য সব কবিতা লিখেছেন – “প্রিয়তম পুরুষটি এক পা একটুখানি উঁচু করে / বিছানায় ভেসে আছে দেবদূত / ডৌলভরা মাংসল ব্রোঞ্জের ঊরু / অবিশ্স্বাস্য নিখুঁত সহজ গ্রিক ভাস্করতা / হঠাৎ সচল হয়ে ডাকে তরুনীকে। / দুহাতে জড়ানো নারী / তার উর্ধ শরীরের গভীর সৌকর্য ফেলে রেখে / গা-শিরশির লোভে / দু পায়ের ফাঁকে এসে মুখ গুঁজে দেয় — / গ্রীষ্মের ঠিক আগে মাইল মাইল ব্যাপী সরল বর্গীয় বনে ঝড় / একটানা আতশবাজির তীব্র রঙচঙে চক্কর / স্তনান্তরে ঢেউ লাগে, / অসম্ভব অনুরক্তা শিশুসুলভতা নিয়ে / অচেনা আশ্চর্য এক লালচে কিসমিস রঙা / ফুলের কোরক মুখে টপ করে পোরে / মাতৃদুধের মত স্বাদুরস টানে…” (পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী তারা দুজন)
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র ছিলেন দেবারতি মিত্র৷ তাঁর নিজস্ব ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিষয় ও শৈলি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র স্থান অর্জন করেছে। তাঁর কলমে বারবার উঠে এসেছ নারী মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি। কবি, সমালোচক এবং অনুবাদক সংযুক্তা দাশগুপ্ত দেবারতি মিত্রের কবিতা সম্বন্ধে লিখেছেন – ‘দেবারতি মিত্রের কবিতা বিরল সংবেদনশীলতা এবং উপলব্ধির এক কাব্যময় বৈশিষ্ট্যে ভাবনা, চিত্র এবং প্রতীকের এক সুনির্বাচিত সংমিশ্রণ। তার লেখায় সুস্পষ্ট লিঙ্গ এবং সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তবে সেগুলি একটি সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে উপস্থাপন।… তাঁর কবিতার যত্নশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জানা যায় যে তিনি তাঁর সময়ের জটিলতার প্রতি উদাসীন নন’।
নিজের কবিতার জন্ম প্রসঙ্গে দেবারতি মিত্র বলেছিলেন – “আমাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত সংসারের কাজকর্ম করতে হয়, ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসে যেতে হয়, সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হয়, সেগুলো আমার খারাপও লাগে না। কিন্তু কী করে জানি না, তারই মধ্যে চলে একটা স্পন্দন কবিতার আবছা বিচ্ছুরণ, আড়মোড়া ভাঙা, নানারকম ছেড়াখোঁড়া হাসি ও বেদনা। আবার অনেকসময় বাজার করতে গিয়ে, ডাক্তার দেখাতে গিয়েও পেয়ে যাই কবিতার বীজ। কখনও কখনও তা থেকে গাছ জন্মায়, আর কখনও তা বৃষ্টিজলে, অশ্রুতে ধুয়ে যায়, কোনও চিহ্নই থাকে না। তবু বেশ লাগে…”।
‘চর্যাপদ’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি মণীন্দ্র গুপ্ত সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘আমি তো ওঁকে স্বামী বলে মনে করি না, বাচ্চা বলে মনে করি। দু আড়াই বছরের বাচ্চা। অতএব ওঁর সঙ্গে থাকতে আমার তো অসুবিধে হয় না। ওই হয়তো ওষুধ খেলেন না। কোনও একটা নিয়ে রাগারাগি করছেন, বাচ্চাদের যেরকম মা বকে সেরকম বকি। কোনোরকম কম্পিটিশনের অনুভূতি হয় না। কারণ মার সঙ্গে তো বাচ্চাদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা ইগো ক্ল্যাশ হয় না’।
তিনি খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। তিনি স্বল্পবাক ছিলেন, নিভৃতচারী ছিলেন। ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – ‘ঈশ্বর আছেন, তাঁর কাছে সব সমস্যা বলি। তিনি সব সমাধান করে দেন। এটাই আসল কথা’।
‘মা থাকো’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন – “কলঘরের ভিজে মেঝে – বসে বসে চুল ছড়িয়ে কাঁদি – / তাও যদি ছিঁড়ে যায় আমার একটি মাত্র রক্তের বন্ধন! / মা, তুমি দাঁড়িপাল্লার যেদিকে রয়েছ, তার অন্য দিকে ব্রহ্মান্ড / সম্পূর্ণ ওজনশূন্য, ফাঁকা। / সমুদ্র-ঝিনুকে জন্ম, পড়ে আছি শুয়োরের পায়ের কাদায়। / জন্ম ও কর্মের হাত পাল্লা কষে – / নীল বাষ্পে সব রক্তকোষ ফেটে যায় / আমি যেন আকাশের বহুতলা উঠে গেছি / আলো যেন চির আকস্মিক। / রাক্ষস খোক্কস নেই এই দেশে, / রাক্ষসের ছেলে এসে বলবে না – দেখা আলজিভ। / পরী চাঁদ টি দিয়েছে, আহ্লাদ-কাজল দেবে মেঘ, / মা-গান শুনতে শুনতে তারাদের মধ্যিখানে তারা হয়ে কাঁপি। / মা থাকো মা থাকো মা থাকো / পরলোক কোন্‌ দিকে – সে জগতে / হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে একা অন্ধকারে হেঁটে / তোমাকে যদি না খুঁজে পাই!”
অনেকদিন আগে বারুইপুরে উত্তম দাশের ডাকে মহাদিগন্তর কবিতা-অনুষ্ঠানে বিজয়াদি শরৎদা, দেবারতি মিত্র আর মণীন্দ্র গুপ্তর সঙ্গে দেখা। বিজয়াদিদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হলেও দেবারতিদির সঙ্গে দেখা কদাচিত হয়েছে আমার। দেবারতিদি অনেক কথা বলছিলেন, দেবাঞ্জলির কথা কত। দেবারতিদি বলছিলেন, ‘দেবাঞ্জলি তোমার কথা খুব বলত, তুমি হিন্দুস্তান পার্কে থাকতে, আমরাও…’
তাঁর বোন দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায় আমাদের সঙ্গেই কবিতা লিখত। তার অকালপ্রয়াণ দেবারতিদিকে প্রচন্ডভাবেই নাড়া দিয়েছিল। অনেক কবিতা লিখেছেন দেবাঞ্জলিকে নিয়ে। “সাদার্ন অ্যাভিনিউর মাঝখানের ঘেরা গাছগুলো / এ কদিনে বেশ লম্বা হয়ে গেছে, / দেবাঞ্জলিকে এখানে পুঁতে দিলে অনেকখানি বাড়ত। / একঘেয়ে হয়ে যাবে সেই ভয়? / আরে না, না, এক একটি পাতার / এক এক রকমের মন। / গাছপালার স্বপ্ন কাকভোরে মায়ের গন্ধ, / ভরসন্ধেয় ট্রেনের কান্না, /রাতদুপুরে ছমছমে স্তব্ধতা। / বোবা বোনটা আমার, পাগল বোনটা আমার, / শুনলেই লোকে হাসে- / কত আর মেঘ দিয়ে রোদ ঢাকবে? / ও কথা বলবে কী করে / ও কি আর এ দেশে আছে! / গোছা গোছা ফুল ভর্তি মাধবীলতা পরনে / তেঁতুলপাতার টিপ কপালে চাঁদপানা বোন, / তোমার চেয়ে পাগল কোনোকালে হয়নি, / কোনোকালে ছিল না। / একটা গাছের কলম থেকে আরেকটা গাছ, / গাছ থেকে গাছের শিকড়বাকড় চারিয়ে / ঝুরি নামিয়ে আরেকটা গাছ, / শুকিয়ে গেলেও চট করে ধরা যায় না- / সঙ্গে সঙ্গে বিম্ববতীর আলোর কণা নখের মতো / গজিয়ে ওঠে। / গাছের শেষ নেই- / শীতকালে ওর জন্মদিন আর বসন্তকালে চলে যাবার দিন / ওরও শেষ নেই”। (দেবাঞ্জলির কথা) – চিত্রকল্পের আশ্চর্য নৈপুণ্যে তাঁর কবিতা বারবার ব্যক্তি-স্তর থেকে শিল্পের স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এই (২০২৪) বইমেলা উপলক্ষে সিগনেট থেকে আমার কবিতার বই ‘এই জীবন জারদৌসি’ প্রকাশিত হয়েছে, দেবারতিদিকে উৎসর্গিত। বড় দেরি করে ফেললাম, দেবারতিদিকে দেওয়া হল না। এই আফশোষ রয়ে যাবে জীবনভর।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80