দেবরাজ চ্যাটার্জীর কবিতাগুচ্ছ
যাব
যতো বলি, নাই রাতি, মলিন হয়েছে বাতি
তবে, এবার যে যেতে হবে —
চলে যাব।
রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখস্থ না হলেও যাব
শঙ্খ ঘোষ মারা গেলেও যাব
ফিক্স ডিপোজিটটা ম্যাচিওর করলেই যাব
ইন্সুরেন্সের শেষ প্রিমিয়ামটা দিয়ে চলে যাব
খাদানের পাশে, জলের ধার ঘেঁষে
এবার চুপচাপ পুড়ে যাব
শুকনো পাতাগুলো গোল হয়ে পুড়বে আমার সাথে
এর থেকে তো বেশি কিছু করার নেই এখানে
ই এম আই নেই, চাকরি চলে যাবার কোন ভয় নেই
জাঙিয়া পরার কোন দরকার নেই
দুঃখের কোন স্মৃতি নেই ক্রোশের পর ক্রোশ
সাত সমুদ্র তের মাইল পেরিয়ে তবে কমলা ভ্যারাইটি স্টোর্স
আর সেখানেও সাতটার বেশি ফিল্টার উইলস নেই
মরে যাব, এবার নির্ঘাত পুড়ে যাব
খাদানের পাশে, জলের ধার ঘেঁষে
সাইকেলে চড়ে চলে যাব বসন্তকালে
পোড়ানোর জন্য সঙ্গে একটা লোক নিয়ে যাব
জলের ওপর তারাদের ছায়া ফোটার শব্দ শুনব সন্ধেবেলায়
নক্ষত্ররা এসে মুখে আগুন দিয়ে যাবে
কয়েক হাজার গাছ আমার শ্মশানযাত্রী হবে
এই পুড়ে যাওয়া শরীর থেকে কয়েক মুঠো ছাই
এমনি এমনি উড়িয়ে দেব পুরুলিয়া জেলার গভীরে —
দুলাখ টাকা দিলেই এখানে দেড় বিঘে জমি হয়ে যাবে
কংগ্রেস মাহাতো তার থেকে কিছু কাটমানি খাবে
শুয়োরের মাংস দিয়ে একপেট মহুয়া খেয়ে
মরে ভুত হয়ে যাব একেবারে —
ঝাঁটিপাহাড়ি স্টেশন থেকে সাকুল্যে সাড়ে আটশো টাকা জিপভাড়া দিয়ে
এবার চলে যাব
খাদানের পাশে, জলের ধার ঘেঁষে
দুলাখ টাকা পেলেই, একটু হাত পা ছড়িয়ে
চুপচাপ পুড়ে যাব একেবারে।
লিবার্টি সিনেমা
একপেট আকাশের সাথে যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখে
সোডিয়াম ভেপারের নীচে
একমুঠো নক্ষত্র ঘুমিয়ে পড়ে।
অক্সিজেন
শীতলা মন্দিরের গা ঘেঁষে একটা ভিআরএস পেয়ে যাওয়া বটগাছের মাথায় অক্সিজেন ধরবে বলে এবার ফাঁদ পেতেছে বিকেল মুর্মু আপাতত কয়েক কিলোটন বেচতে পারলেই তার কপাল ঘুরে যাবে দুটো রেশনের ডিলারশিপ আর একটা ফরেন মালের লাইসেন্স পেয়ে গেলেই জুলপি রাখবে সে বিনোদ বাগচির মেজ শালার মত মেগা মনসা পুজো হবে এবার পার্টি অফিসের মুখের সামনেই ঘুঘু তো কম নেই হালিশহরে পকেটভর্তি নোটের বান্ডিলগুলো এসে খোঁচাখুঁচি করবে তার অণ্ডকোষে আর তিনতলার ওই টু বি এইচ কে উইথ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আড় চোখে মেপে নেবে এবার চম্পার কাকাকে চিকেন লিভার দিয়ে আহা কতদিন পরে আবার বুকভরে খাবি খাবে বিকেল মুর্মু তামাকের কলঙ্কে ভরা তার সবেধন কালো দুটো ফুসফুসের ভেতর কয়েক কোটি স্কোয়ার ফিট আকাশ ঢুকিয়ে নিয়ে সেও একদিন হয়ে যাবে কাওয়াসাকি বাজাজ বুড়োদার দোকানে সব ধারবাকি মিটিয়ে দিয়ে বাসন বাসন চিৎকারে ভরে যাবে বসন্ত
বঙ্গবালা স্মৃতিরক্ষা কমিটি
চিল আর শকুনের কাঁধে হাত রেখে
চুপচাপ বেড়ে যায়
কলকাতার মেজ সেজ
আর খুব উঁচু উঁচু বাড়িগুলো
তিনকাল কেটে গেল, দিনকাল ঘেঁটে গেল
কার্ল মার্ক্স চলে গেল ডালভাত সাঁটিয়ে —
জয়নগরের মোয়া, ফুরিয়ে গেলে আর পাবে না
রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে দেড় কেজি সানলাইট
আর এক বাটি অক্সিজেন হাতে
গভীর রাতে, ঘরে ফেরে নৈহাটি লোকাল —
উল্টোডাঙার মোড়ে অটোর জন্য হন্যে হয়ে তিতিবিরক্ত সিকিম বাম্পার
অবশেষে তার প্যান্টের চেন খুলে দিয়ে
কোটি কোটি জোনাকিদের উড়িয়ে দেয় শহরময় —
কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে দুটো পিস্তল
আর একটা কন্সটেবেল ভাড়া নিয়ে
হাওড়া ব্রিজ দখল করে
ফুল্কি হেমব্রম
দিশি আর জ্যোৎস্নার গন্ধে ভরা
খুকুপিসির লাগিয়ে যাওয়া
মনখারাপের এইসব বকুলগাছ পেরিয়ে —
এখনো রক্তের ভেতর
তোমার শরীর থেকে নেড়ি কুকুরের ঘ্রাণ
কেয়োকার্পিনের মত ঘুরঘুর করে —
বিপ্লবের চেয়েও বেশি লাল কুমড়োর সসে ভরা
ভালবাসার তেলচিটে এগরোল খেয়ে জেলুসিল চোষে বাংলা কবিতা
সাইকেল রিক্সায় দশ টাকা ভাড়া বেশি দিয়ে
দুমাসের ইএমআই বাকি ফেলে
ঘাটশিলা চলে যায় দিনবদল।
নব্বই তামাদি হল
জানলার ভাঙা কাঠ ছিল বাংলার খোলা মাঠ ছিল ছিল সাতপুরুষের উই ভিটের ঘুঘুচরা লবণপ্রতিম ইঁট ঘোড়াগাড়ি করে চলে যেত পাটকেবাড়ির জমিদার নাচঘর ছিল ডাকঘর ছিল সেই কোনকালে হাতে ঘি লেগেছিল বহুদূরের গয়লাবাগান থেকে আটাশখানা রাইসমিল এদেশে চালের অভাব ছিল কিছু ছিল আত্মহত্যাপ্রবণ উদাস কুচবরণ লম্বা ইউক্যালিপটাস ছায়াঘেরা ঘন সবুজ চোখ ছিল জল তাতে সাঁকো বাঁধবে বলে অনেকদিন বসেছিল কেউ ছিল দাঁতের ফাঁকে আটকে রাখা চুল বাঁধার বৈকালিক ফিতে বঙ্গনারীর অন্ধ জ্যামিতিক নৈপুণ্য ধোয়া জল খেয়ে এতদিন লড়ে গেল বাংলা কবিতা যদিও পাশে দাঁড়িয়ে বারকয়েক পেচ্ছাপ করার সুবাদে জানি তার বড় ফোঁদলওয়ালা সাদা পাজামার দড়িতে কিভাবে বেশ শক্ত করে গিঁট বাঁধতেন উৎপলকুমার বসু সুলভ শৌচালয় থেকে সোনাগাছি পর্যন্ত তাই প্রতিবারই প্যান্টের চেন টেনে তোলার সেই অমোঘ মুহূর্তে বারোটার কাঁটার মতই নির্ভুল ভাবে মনে পড়ে যেত ভাবছি ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো অথচ একসময়ে এই শহরের রাস্তায় ভালো পেচ্ছাপ করার জায়গা বলতে সব পাড়ায় বেশ কিছু ডিজাইনার পাঁচিল ছিল চোট খাওয়া একটা পৈতৃক সাইকেল ছিল রথের মেলায় ইলেকট্রিক নাগরদোলাই খুঁজেপেতে প্রেম করার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল সকাল থেকে পাঁপড়ের দোকানে আপনা হাত জগন্নাথ লেখা একটা টি শার্ট ঘুরঘুর করছিল সেবার ভারতবর্ষে খুব ভোট হয়েছিল বিশ্বকর্মায় ধর্মেন্দ্র চলে গিয়ে জিতেন্দ্র এল নবকুমার তখনো বেঁচে ছিল আরে বাবা এমন তো আর নয় যে বাপদাদার মেঘলা হাড়গোড় পুঁতে রাখা তিন বিঘে সাত ছটাক ধানজমি ছিল হরিহরপাড়ায় পোষা গরু ছিল হাফডজন ঠাকুমা এককালে সরু চালের পায়েস রাঁধতেন ক্রমে মদে চুমুক দেওয়া জলভাত হয়ে গেল চুমু খাওয়ার তখনো অনেক দেরি ছিল জীবনের নানান ওঠাপড়ায় পকেটে ছিল ছোট চার্মিনার আর গঙ্গার ঘাটে দাঁড়ালেই গৌরদার ঠেক থেকে ভেসে আসা একবুক বাংলার ঘ্রাণ ছিল স্বাধীনতার শেষ সিম্বল আমরা অন্ধকারতর নক্ষত্রদের তলায় বসে বছরের পর বছর ধরে গাছেদের শরীর দিয়ে নিজেদের শরীর জ্বালাতে চেয়েছিলাম ততদিনে এই শহর আপাদমস্তক বৈদ্যুতিক চুল্লি হয়ে গেছে আশমানের তারাগুলো সন্ধ্যার কুয়াশা ভেঙে খসে পড়ছে শ্মশানের মাথায় আমাদের শরীরের খোল থেকে তৈরি অলৌকিক নৌকাগুলো একে একে ভেসে গেল আকাশগঙ্গায় আসলে এই পৃথিবীর ইতিহাসটা যে ঠিক কতখানি গোল নাকি কমলালেবুর মত দুদিকে ঈষৎ চ্যাপ্টা চলে যাওয়ার আগে এসব বলে যাওয়ার মত কাউকে খুঁজে পাওয়ার একটা দরকার ছিল খুব
দেবরাজের কবিতায় এই যে লিটারাল বোম্বার্ডমেন্ট এবং তার বিস্তার – কলকাতা থেকে পুরুলিয়া, ঘাটশিলা কিংবা ঝাঁটিপাহাড়ি; জয়নগরের মোয়া থেকে সানলাইট কিংবা অক্সিজেন – সেইসঙ্গে যুগের অনিকেতবোধের সঙ্গে পরিহাসের কাউন্টারপয়েন্ট – তা বাংলা কবিতার ভুবনে বিরলই বলা চলে। কবিতার ভাষা, ভাবপ্রতিমার অন্তর্বয়ন একেবারেই এই কবির নিজস্ব – অনন্যতায় ঝিলমিল।
To be an existential and a dreamer is a tough job. Instead of subtleness he chooses chaos as a friend, a lover and above all as hope.
এ এক নতুন পাঠ অভিজ্ঞতা।🙏
অনেক ধন্যবাদ