দীপ শেখর চক্রবর্তীর গল্প ‘ কাগজ’

দীপ শেখর চক্রবর্তীর গল্প ‘ কাগজ’

“If you do not tell the truth about yourself you cannot tell it about other people”
Virginia woolf

রাত যত গভীর হয় ঠাকুমার চিৎকার ততটাই তীব্র হতে থাকে।বাড়ির কেউ এই চিৎকার শুনতে পায় না।শুধুমাত্র আমিই এই চিৎকারের শ্রোতা। ঠাকুমার মৃত্যুর দশ বছর পরেও আমাদের বাড়ি জুড়ে এই চিৎকার রয়ে গেছে।একজন স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভোগা মানুষের নিজের অস্তিত্ব খোঁজার তীব্র চিৎকার।
চিৎকার না বলে আর্তনাদ বলা ভালো একে।
ভোরের আলো ধীরে ধীরে আকাশকে উজ্জ্বল করে তোলে।ঠাকুমার আর্তনাদ অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যেতে থাকে। মনে হয় শতকের পর শতক আমি ঠিকমতো ঘুমোতে পারি না। না ঘুমিয়েও সারারাত অন্ধকারের মধ্যে বিছানায় কীভাবে যে আমি সেই স্বপ্নটা দেখি তার উত্তর নিজের কাছে বারবার খুঁজেও পাই নি।
একটি ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ইটের রাস্তা। কিছুটা এগিয়ে গেলে দিগন্ত বিস্তৃত একটা ফাঁকা মাঠ। মেঘলা দিন,আশেপাশে একটি মানুষও নেই। শুধু দূরে সেই মাঠের ভেতর দাউদাউ করে পুড়ছে একটা বাড়ি। এতদূর থেকেও তার আগুনের তাপ আমার শরীরে এসে লাগছে।
ঘুমের ভেতর নয়,জেগে জেগেই এই স্বপ্নটা আমি দেখি। দশ বছর আগে মৃত ঠাকুমার তীব্র আর্তনাদের মধ্যে জেগে নিজেকেই নিজে ব্যর্থ প্রশ্ন করে যাই-
কার বাড়ি? কার বাড়ি?


বিকেলের মাঠে ফুটবল খেলা দেখি দাঁড়িয়ে। মাঠগুলো ঘিরে দেওয়াতে এখন এগুলো ঠিক খাঁচায় আটকানো চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো লাগে। ভেতরে পয়সা দিয়ে ঢুকতে হয়। আমার মনে হয় রাষ্ট্র আমাদের থেকে মুক্তভাবে মাঠে ঢোকার অধিকার গোপনে কেড়ে নিয়েছে।
কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র এটি!
প্রতিবাদ কারা করে দীপ?
যারা এখনও খেলাটা বোঝে নি।
মাঝমাঠের ছেলেটার খেলা ভালো লাগছে। সুন্দর পায়ের কাজ। কিন্তু সেই একটাই দোষ। একা একা খেলা। কাউকে বলটা বাড়ায় না অথচ বা দিকের ছেলেটা ফাঁকায় দাঁড়িয়ে ছিল। বলটা বাড়ালেই নিশ্চিত গোল।
ছেলেটাকে চেনা লাগে। কিশোর। গুজরাটি বাসনওয়ালাদের ছেলে। বছর উনিশ আগে ওদের মতো আরও কয়েকটা পরিবার আমাদের পাড়ায় এসে একটা বস্তি গড়ে নিল। এই উনিশ বছরে কত উন্নতি হল গুজরাটের? কত গাড়ি কারখানা হল? কত রাস্তাঘাট হল? গুজরাট মডেল নাকি এখন দেশের মডেল? কিশোরদের পরিবার আর ফিরে যেতে পারেনি। এখন একটা পুরনো শাড়ি দিলে স্টিলের বাসন দিতে পারে না। চাই দু’টো শাড়ি।
কিশোরের দিদি আজ সাত বছর হল নিরুদ্দেশ।
যারা নিরুদ্দেশ হয়, তারা কোথায় যায়?
ফাঁকফোকর দিয়ে ঠিক মাঠে ঢোকার একটা পথ বের করে নিয়েছে পাড়ার ছেলেরা। প্রত্যেক সিস্টেমের এরকম একটা ফাঁক থাকে। সেটাকে বুদ্ধি দিয়ে যারা ব্যবহার করতে পারে খেলাটা তাদের জন্যেই। যারা একেবারে ভেঙে দেবে বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে তাদের দ্বারা কিস্যু হয় না।
রাস্তার আলোগুলো ধীরে ধীরে জ্বলে উঠলো।
ধীরে ধীরে মাঠগুলো হয়ে উঠবে নেশার আড্ডা। আগে ঠেক থেকেই পাওয়া যেত। পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে এখন গোটাটাই ‘ফ্লাইং’ হয়ে গেছে। আমাদের এই তৃতীয় পৃথিবীর দেশে এই তো চমৎকার জীবন।
বিকেলের ফুটবল খেলার মাঠ।
সন্ধের নেশার আড্ডা।
নীলার বাড়ির পথ দিয়ে যেতে যেতে একবার জানলায় উঁকি মারি। ওর বাবা মা বসে সন্ধের নিয়মিত ধারাবাহিক দেখছে। নীলা এখন বেশি বাপের বাড়ি আসে না? আজ থেকে বছর তেরো আগে এই নীলা একদিন রাস্তায় হঠাৎ চুমু খেয়ে নেওয়ার কথা বলেছিল।
ওর বাবা তখন সিপিএম করত।
নীলা তখন অন্য কারও সঙ্গে একটা প্রেম করতো। তবে চুমু খেতে চেয়েছিল আমাকে। রাস্তায়,আচমকা। বলেছিল,এটা নাকি খুব উত্তেজনায় পরিপূর্ণ একটা ঘটনা হবে। আমিও সেই উত্তেজনার স্বাদ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনোভাবেই সেই চুমুটা আমাদের খাওয়া হয়নি।
নীলাকে আমি নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম আমাদের চিলেকোঠার ঘরে। সেই মতো পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, শুধুমাত্র চুমুতেই আমাদের যৌন ইতিহাস থেমে যাবে না। ঠাকুমা তখন সমস্ত কিছু ভুলে গেছে। ঠাকুমাকে দেখার জন্য সকালে একজন, বিকেলে আরেকজন আয়া। ফলে,ফাঁকা বাড়ি এবং নীলাকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে যাওয়া দুটোই অসম্ভব ছিল।
নীলার বাবা মা নিশ্চয়ই সেরকম সিরিয়াল দেখাই বেশি পছন্দ করে যেখানে বাড়ির বউ কেবলমাত্র বরের যত্ন করে, বরের কথা মেনে চলে এবং তারই শয্যাসঙ্গিনী হয়।
দাম্পত্যের সমস্যা তারা মিটিয়ে নেবে বিছানাতে (ইত্যাদি)
যারা নিরুদ্দেশ হয়,তারা কোথায় যায়?


অন্তুদের বাড়ি খুব যেতে ইচ্ছে করছিল। অন্তু আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। আমাদের মধ্যে প্রথম প্রধান বিপ্লবী।ওই প্রথম আমাদের বিদেশী সিনেমা দেখিয়েছিল, বিদেশের গান শুনিয়েছিল, এমন সব বইপত্র আমাদের দেখিয়েছিল যা ঐ বয়সে পড়া নিষেধ। অন্তুই প্রথম বলেছিল একটা ফিল্ম বানানোর কথা।
কীসের ফিল্ম?
ভালোবাসার ফিল্ম।
ভালোবাসার ফিল্ম? মানে যাতে প্রেমিক থাকবে, প্রেমিকা থাকবে…
না দীপ।যাতে যুদ্ধ থাকবে না। অ্যান্টি ওয়ার ফিল্ম।
স্বাভাবিক ভাবেই এমন কোনও ফিল্মই আমরা বানাতে পারিনি যাতে যুদ্ধ নেই। প্রযোজক টাকা দেয়নি। অভিনেতা অভিনেত্রীদের উৎসাহিত করে তোলা যায়নি।যুদ্ধ ছাড়া একটি ফিল্ম করতে তারা আগ্রহী নয়। ফলে অন্তুর সেই ফিল্ম কোনোদিন আলোর মুখ দেখলো না।
অন্তু এই হতকুচ্ছিত দেশটাকে প্রবল ঘৃণা করে বিদেশে চলে গেল।
অন্তু কি ওখানে অ্যান্টি ওয়ার ফিল্ম বানায়?
না,আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কে চাকরি করে, মোটা মাইনে পায়, এ দেশে আসে না। শুনেছি ওর বউ খুব ফর্সা।
কতটা ফর্সা?
এতটাই যে আমাদের দেশের যে কোনও পাড়াগাঁয়ের মেয়েকে পাশে রাখা যাবে না। নোংরা লাগবে।
তাহলে কথাটা ঠিক সেখানেই ফিরে এল
যারা নিরুদ্দেশ হয় তারা ঠিক কোথায় যায়?
এখানে সিপিএমের জোর সবথেকে বেশি ছিল। গোটাটাই উদ্বাস্তু ভোট। মনে রাখতে হবে সাতষট্টির কথা।মনে রাখতে হবে সাতাত্তরের কথা।
মাঝে?
শোনো, এই কথা মনে রাখা খুব জরুরি। যারা নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে ঐ দেশ থেকে এই দেশে এসেছে তাদের জীবনে দুটো ভয় থাকা খুব স্বাভাবিক।
এক, খাদ্য ও সেই সংক্রান্ত নিরাপত্তা।ইতিহাস তাই বলছে।
দুই, বাসস্থান।
সুতরাং নীলাকে আমি আশ্চর্য এক মেয়ে হিসেবে দেখেছিলাম। ও কেবলমাত্র আমাকে একটা চুমুই খেতে চেয়েছিল। তাও আবার খোলা আকাশের নীচে। এমনকি আমার সঙ্গে তখন প্রেমও করতো না নীলা। অন্তুকেও আমি দোষ দিতে পারি না। ও এখানে থাকতে পারেনি। আবার কিশোরের যে দিদি নিরুদ্দেশ হল তাকেও তো দোষটা দেওয়া যায় না।
সন্ধের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়। বছর দশ আগেও এখানে কান পাতলে কিছু কিছু বাড়িতে হারমোনিয়াম শোনা যেত। শোনা যেত কর্কশ কয়েকটা গলা। পাড়ার কাকু কাকিমারা তাদের বারান্দায় বসে পথের লোক দেখত। পরিচিত হলে ডেকে কথা বলতো। এখন ঘরে ঘরে একই সিরিয়াল।
অন্তু বলতো এটাও নাকি রাষ্ট্রের একটা চক্রান্ত। সেই মুখের সামনে একটা পেন্ডুলাম ঝুলিয়ে সম্মোহন করার মতো।
আমরা সকলে একই কথা বলি।
আমরা সকলে একইরকম ভাবি।
আমরা সকলে একইরকম বাঁচি।
তাই এখন বাড়ির বারান্দাগুলো ফাঁকা। বাড়িতে বাড়িতে সিরিয়ালের সেই একই কথা।একই সুর।
চায়ের দোকানগুলোতেও সেই পরিচিত ভিড় নেই।


গল্পটা শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই।
কাজিপাড়ার চায়ের দোকানটা পেরিয়ে বামদিকে ঢুকে মসজিদটার সামনে দেখি লোকে লোকারণ্য। মাঝে একটা গোল জায়গাকে কেন্দ্র করে চারিদিকে প্রচুর লোক। পরিচিত মুখের সংখ্যা প্রচুর। প্রাক্তন সিপিএম বৃদ্ধদের একটা ঝাঁক দেখলাম। কিছু লিবেরাল বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সাহিত্যিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সবাই গোল করে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে।উত্তেজনায় ঘেমে লাল হয়ে উঠেছে তাদের মুখ।
লড়াইয়ে ছোট মোরগটি ঝাঁপিয়ে পড়লে তার নখের সঙ্গে বাঁধা পুরনো ব্লেডটি অন্তিম আঘাত করলো বিপক্ষকে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো সে। খেলা শেষ। মোরগের মালিক তাকে বুকে তুলে নিল প্রথমে তারপর শূন্যে তুলে তীব্র চিৎকার করলো। সমস্ত বাজারের মধ্যে একটা উত্তেজনার বিস্ফোরণ ঘটলো যেন।
তারপর ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেললো সকলে। পরাজিত মৃত মোরগটি পড়ে রইলো বাজারের মধ্যে মসজিদের সামনেটায়। সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, একটি পরাজিত মৃত মোরগ।তাকে নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সবাই।সকলের আগ্রহ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে ওর অস্তিত্ব।ও হেরে গেছে।
অন্তু ভেবেছিল একটা ভালোবাসার ফিল্ম বানাবে
-অ্যান্টি ওয়ার ফিল্ম
যাই হোক, আমার উদ্দেশ্য এখানে মোরগ লড়াই দেখতে আসা নয়।
মসজিদের সামনে থেকে যে রাস্তাটা চলে গেছে উত্তর-পূর্ব দিকে সেখানে একটা পানাপুকুর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে হয় কিন্তু তারপরেই খেয়াল হয় যে আমি সিগারেট খাই না। ফলে শুধুমাত্র গল্পের অপেক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সিগারেটের কথা লেখা এখানে অনুচিত হবে।
কিছুক্ষণ পর সে আসে যার জন্য আজ সন্ধেতে আমার অপেক্ষা ছিল। তার নাম এখানে উল্লেখ করা অনুচিত হবে কারণ কোনওপ্রকার ভুলের ফলই আমাদের পক্ষে মারাত্মক।
পরিস্থিতি কীরকম?
খুবই খারাপ।আজও বত্রিশ জনকে ধরে নিয়ে গেছে।
তাদের জন্য উপযুক্ত লুকোনোর জায়গা ব্যবস্থা করা যায় নি?
গেছিল।কিন্তু ওদের হাত বহুদূর।নিজেদের লোকেরাই বিশ্বাসঘাতকতা করছে আমাদের সঙ্গে।
সাবধানে থাকো।


সে চলে গেলে আবার কাজিপাড়ার বাজারের ভেতর চলে আসি। বাজারের পাশে একটা চওড়া খাল। শোনা যায়, একসময় এটি ছিল নদী। নৌকা চলত। মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন খালে পরিণত হয়েছে। সেখানেই বিরাট বিজ্ঞাপনটা দেখি-

বিরাট লটারি প্রতিযোগিতা
বিশেষ পুরস্কার
লটারি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে বয়সের কোনও বাঁধা নেই। ধর্ম, বর্ণ, জাত, রাজনৈতিক পরিচয় সমস্ত নির্বিশেষে এলাকার মানুষ এই লটারি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। টিকিটের মূল্যও বেশি নয়। তবে, পুরস্কার আকর্ষণীয়।
১। লটারিতে একজন সৌভাগ্যবানকে পাঠানো হবে শহরে।
২। তাকে দেওয়া হবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ।
৩। তাকে দেওয়া হবে উপযুক্ত এক জীবনসঙ্গী ( প্রয়োজনে একাধিক )।
৪। তাকে দেওয়া হবে আকর্ষণীয় পোশাক ( ইত্যাদি, ইত্যাদি )
৫। কোনও সান্ত্বনা পুরস্কার নেই।
তবে একটি শর্ত উল্লেখ রয়েছে। যিনি জয়ী হবেন তাকে একটি বিশেষ চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এতে করে তার পূর্ব জীবনের সমস্ত স্মৃতি বিশেষ রশ্মির প্রয়োগের দ্বারা মুছে ফেলা হবে। শহরে জীবনে গিয়ে তিনি কতটা ছোটোলোক ছিলেন সেই স্মৃতি মনে এলে অনেকসময় নানারকম মানসিক সমস্যা হয়। অনেকে আবার নিজেকে সামলাতে পারেন না।সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।
সবটা মানুষের সুবিধের জন্যই।

রাত্রিবেলা সাবধানে বাড়ি ফিরে আসি। সোজা পথে বাড়ি ফেরাটা এখন মুশকিল হয়ে গেছে। গোপন সূত্রে জেনেছি পাগল কুকুরদের জন্য বরাদ্দ খাঁচাগুলো অনেকটা ভরে উঠেছিল বলে দুই দিন ওরা অভিযান বন্ধ রেখেছিল। আজ থেকে আবার আগের মতোই শুরু করে দিয়েছে। দু’দিনে নাকি বারোশো পাগল কুকুর মেরে ফেলেছে ওরা।
যুদ্ধের ট্যাঙ্কগুলোতে চড়ে ওরা আমাদের ধরতে আসে। আমরা যারা কোনও কাগজ তৈরি করতে পারি নি। আমরা যারা কিশোরের দিদির মতো নিরুদ্দেশ হতে পারি নি, যারা নীলার মতো একটা সহজ জীবন বেছে নিতে পারি নি, যারা অন্তুর মতো বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে যেতে পারি নি, যারা মোরগ লড়াইয়ে নাম লেখাতে পারি নি এমনকি কিনে উঠতে পারি নি লটারির একখানি টিকিট।
ওরা আমাদের কাছে কাগজ দেখতে চায়।
না দেখাতে পারলে ধরে নিয়ে যায় আর আটকে রাখে পাগল কুকুরদের জন্য বরাদ্দ খাঁচার মধ্যে। তারপর একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাই আমরা।
এমন জাদুকর কই?
রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসে শুই। ঠাকুমার তীব্র আর্তনাদ শুরু হওয়ার এখনও ঘন্টা দুই দেরি আছে। এই দুটো ঘন্টা আমি লিখতে চাই। আমার লেখার বিষয় খুব সাধারণ।
যারা নিরুদ্দেশ হয়, তারা ঠিক কোথায় যায়?
অন্তুর মতো ভালোবাসার ফিল্ম বানানোর স্বপ্ন আমি দেখিনি। অ্যান্টি-ওয়ার ফিল্ম বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি অস্তিত্বের কথা লিখতে পারি। দেশ ভাগের পর আমরা যারা এ দেশে চলে এসেছিলাম।
যাদের কাগজ নেই।
কাগজ? কীসের কাগজ?
আনুগত্যের কাগজ।

রাতের বারান্দায় এসে দাঁড়াই।সিগারেট ধরাই না কারণ সিগারেট আমি খাই না।
বাঁচতে চাই আমি।
দূরে দেখি বড় বড় যুদ্ধের ট্যাঙ্ক আমাদের পাড়া কাঁপিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।তাদের চাকার ভারে কেঁপে উঠছে বসতবাড়িগুলো।রাস্তা শুনশান, ফাঁকা। ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে ক্রমাগত খুঁজে চলেছে তারা-
আরও একটি কাগজবিহীন মানুষ।
ঠাকুমার আর্তনাদ শুরু হল। সমস্ত বাড়িতে শুধুমাত্র আমিই এই আর্তনাদ শুনতে পাই। দশ বছর হল ঠাকুমা মারা গেছে। শুধু রয়ে গেছে এই তীব্র আর্তনাদ। স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভোগা একজন মানুষের অস্তিত্ব খোঁজার আর্তনাদ।
ট্যাঙ্কের চাকার ঘর্ঘর শব্দের সঙ্গে কীভাবে মিশে যায় এই আর্তনাদ। মিশে এক অদ্ভুত তৃতীয় পৃথিবী তৈরি করে। বুক ঢিপঢিপ করে আমার।মনে হয়, এইবার ঠিক আমার পালা।
তবে আজও আমার পালা আসেনি।
তাই জেগে জেগেও আশ্চর্য স্বপ্নটা আমি দেখতে পাই-
একটি ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ইটের রাস্তা। কিছুটা এগিয়ে গেলে দিগন্ত বিস্তৃত একটা ফাঁকা মাঠ। মেঘলা দিন,আশেপাশে একটি মানুষও নেই। শুধু দূরে সেই মাঠের ভেতর দাউদাউ করে পুড়ছে একটা বাড়ি।
এতদূর থেকেও তার আগুনের তাপ আমার শরীরে এসে লাগছে।
আমি জানতে পারি না বাড়িটি কার?
আমি শুধু জানি একদিন আমাকেও পাগল কুকুরদের খাঁচায় আটকে রাখবে ওরা। তারপর একদিন লিখে দেবে নিরুদ্দেশ।
সেদিন, নিরুদ্দেশ হয়েও আমি জানতে পারবো না-
যারা নিরুদ্দেশ হয়, তারা ঠিক কোথায়, কীভাবে চলে যাচ্ছে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (4)
  • comment-avatar
    Debabrata 4 years

    সময়কে সল্প পরিসরে কাটা কাটা শব্দে এবং বাক্যে বাঘের মতো কামড়ে ধরেছেন। আমার বুক কাটছিল।
    সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পের কথা মনে পড়ছিল….। Hats off

    • comment-avatar
      দীপ শেখর চক্রবর্তী 4 years

      অশেষ ধন্যবাদ জানাই

  • comment-avatar
    Shuvodeep nayak 4 years

    ভীষণ ভালো লেখা

    • comment-avatar
      দীপ শেখর চক্রবর্তী 4 years

      ♥️♥️♥️

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    404 Not Found

    Not Found

    The requested URL was not found on this server.


    Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80