তিনটে দোকান, আমাদের বড় হওয়ার কলকাতার
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
এ শহরের গল্প নতুন ভাষায় লিখি আমি। এটাই আমার পরিচয়। এ শহরের আনাচ-কানাচ, মানুষজন উঁকি মারে ইতিহাসের পাতা সরিয়ে আমার লেখায়। পরের ছেলেমেয়েরা তাই আমার লেখার নীচে প্রেম করে, পত্রিকা করে, স্বপ্ন দেখে, পাল্টাতে চায়। আমার লেখায় বসন্ত বর্ষা শরত ডাক পাঠায়; শীতের পার্ক স্ট্রিটে উথলে ওঠা আলো। আমার লেখা তারুণ্যের ম্যানিফেস্টো; একটা নতুন সময়ের ভাষ্য, আমার লেখা..আমি..এমনই ভাবে সমকাল..
ক্যাম্পারিঃ
এর আগে বলেছি অনেক গড়িয়া কালীঘাট ভবানীপুর সল্টলেক মানিকতলা যাদবপুর বেহালা…আজ সেভাবেই আমাদের বড় হওয়া ক্যাম্পারি ধরে..স্কুলছুটির পর কতবার এই গনগনে মার্চে হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেছি ফাউন্টেন পেপ্সির তাড়নায় ক্যাম্পারিতে..কলেজে প্রেমিকার সাথে কতবার ডোভার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাসবিহারী এভিনিউ পেরিয়ে এই দোকানের শরনাপন্ন হয়েছে আমাদের চলকে যাওয়া যৌবন-কফির কাপে চলকে উঠেছে সূর্যাস্ত..লেক মার্কেটে আশ্চর্য গোধুলি..রাদুবাবুর চা-দোকানে তখন কেরানিরা..কেয়াতলা আর জনক রোডের পুরোনো বাড়িগুলোর বারান্দা উপচে পড়ছে রক্তকরবী ফুলে..কে বলবে, এ শহরে শুকিয়ে যাচ্ছে জল! সিঙ্ঘি পার্ক পেরোতেই পশ একটা ভিড় সান্ধ্য জমায়েত জমায় বারিস্তায়..আমরা, যারা, সেদিকে যেতে পারি না তেমন, তারা চলে আসি যুগলসের রাস্তায়..এসব রাস্তাতেই বাবা-মারা প্রেম করতেন..এখানেই আমরাও বড় হলাম..ছোটবেলা আর বড়বেলার মাঝে আমাদের এই একটাই কমন স্টেশান ‘ক্যাম্পারি’..আমাদের নো-ম্যানস ল্যান্ড..
আমাদের এই ৩২-৩৩ বছর বয়সটা অদ্ভুত। আসন্ন নির্বাচনের মতই গোলমেলে। বিয়ে করা আর না-করা নিয়ে মানুষ খুবই চিন্তিত, যেমন চিন্তিত বিজেপি আসা- না আসা নিয়ে..তাই, আমরা ক জন যারা এ শহরের হাতেগোনা অন্য রকম কিছু মানুষ, বিকেল ঘনিয়ে এলে একটু একা হয়ে পড়ি..জীবনের ছক মেলাতে না পারা বেহিসেবি আমরা এলোমেলো হাঁটতে থাকি ভিড়েও একক হয়ে..গোলপার্কে কখনও দেখা করে রেস্তোরাঁয় রেস্তোরাঁয় মেলাতে থাকি জীবনের ক্লাস স্ট্রাগেল..মেলে না..কিচ্ছু মেলে না..ভেঙে যায় বারবার যা কিছু গড়ার..হাতে দেখি লেডি ম্যাকবেথের রক্ত লেগে..টাটকা সন্ধ্যায় হোর্ডিংগুলো জ্বলে ওঠে..গিলে খেতে চায় আমার সদিচ্ছা..লেকের দিক থেকে হাওয়া এলেও অসুস্থ লাগে আমার..ঘামতে ঘামতে নামতে নামতে কখনও ঢুকে পড়ি ফ্যাব-ইন্ডিয়া গলি কখনও ফুচকার টকজলের গন্ধ নিতে নিতে দেখি সাউথ পয়েন্টের ইউনিফর্ম..ফার্ন রোডের আশপাশ..কখনও একডালিয়া পেরিয়ে পাঠভবনের রাস্তায় দেখি মায়াবি বাড়িতে টিউব জ্বলে উঠছে ফটাফট..শাঁখের ধ্বনি ভেসে আসছে আজানের সাথেই পার্ক সার্কাসের দিক থেকে..ভাবি, ম্যাডক্স স্কোয়ারের দিকটা হাঁটব একটু..নাকি চলে যাব মিন্টো পার্ক..
দিনশেষে একাই আজকাল ঢুঁ মারি ক্যাম্পারি। একাই একটা ফাউন্টেন কোক অর্ডার করি। একাই কিনে নি দুটো চপ-কাটলেট। ভেতর থেকে অর্ডার করে স্লিপ নিয়ে জমা দি কাউন্টারে। তারপর উল্টোদিকের বন্ধ সেন্ট্রাল ব্যঙ্কের দিকে তাকাই…আমার ভেতরের ছোটবেলা দাদুর সাথে এখানেই আসত পেনশান তুলতে..মা গান শিখতেন বাণীচক্রে..মুরলিধরে পড়তেন..বাবা-মা প্রেম করতেন এসব রাস্তায়..বাবা-মা’দের বিশ্বাস ছিল..
আমাদের প্রজন্মে সেসব শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ..
অথচ, আমরাও ভালোবাসতে চেয়েছিলাম..
সেসব ভালোবাসার দিনরাত্রি একমাত্র জানে, ক্যাম্পারি..
ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েজঃ
আমাদের ছোটবেলার দোকান। ওয়ান্ডারল্যন্ড টয়েজ। ৯০ এ জন্মানো অনেক মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন ছিল গড়িয়াহাটের এ দোকান। অনেক বিস্ময় রাখা থাকতো তাক জুড়ে। কত ডিজনি ল্যান্ড, কত মিকি মাউজ, কত স্কুবি ডু। খুব সাধারণ ছিল আমাদের ছেলেবেলা। আমাদের মা-বাবাও। মাসে একবার পার্ক স্ট্রিটের পিপিং। তাতেই রাজা। একবার দাশগুপ্ত থেকে কেনা ডিউজ বল। আমাদের খুচরো অমরতা!
বিকেলের মাঠ ছিল। তাতে মার্চ মাসে এনুয়ালের পর হাওয়া দিত। কি যেন হত মনে তখন। দিব্যা ভারতী আমাদের ব্রণদাগে ফুটে উঠতেন। কুল খেয়ে ফেলতাম বরাবর পুজোর আগেই। আর, খুব কান্না পেত। একবার যদি স্কুলবাসে তাকে দেখা যায়! একবার যদি সে তাকায়..সান্ধ্য নাটকের রিহার্সালে..একবার..চোখের তারায়..সরস্বতী পুজোয়..লাল-হলুদ শাড়িতে..
অপলক তাকিয়ে থাকতাম। তার তারায়। চোখ পড়ত না। দন্ত যদিও পড়ে যেত। বড় হয়ে যাচ্ছিলাম। ডেন্টিস্ট অমল জেঠুর কাছে নিয়ে যেত বাবা। ভবানীপুরে। ওর চেম্বারে হালকা রবি ঠাকুরের গান চলত। অমল জেঠু হাসতে হাসতে যন্ত্র ঢোকাতেন মুখে। খুব লাগত। মেয়েটার চোখ মনে পড়ত। বিটনুন। কান্না পেত। গলা বুজে আসত। পোকা দন্ত পটাং হত অজান্তেই..
কাদতাম খুব। আইস্ক্রিম কিনে কম্পেনসেট করত বাবা। আমি তাতেও থামতাম না। বাধ্য হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েজ এ নিয়ে আসত। সেখানে আমার জন্য ওয়েট করত স্কুবি ডু, মিকি মাউজ আর ডিজনি ল্যান্ড..
কোয়ালিটিঃ
প্রথম ডেটে এসেছিলাম। কলেজে। এখানে। মেনুকার্ড দেখে ঢোক গিলেছিলাম। তারপর একটা ফ্রায়েড রাইস অর্ডার করেছিলাম দু”জনে। বেরিয়ে কেমন রাজা মনে হয়েছিল নিজেকে। বান্ধবী আড়চোখে হেসেছিল।
ছোটবেলায় দাত তুলতে নিয়ে যেত বাবা। ভবানীপুরে। অমল জ্যেঠুর চেম্বারে রবি ঠাকুরের গান চলত। হাসতে হাসতে যন্ত্রপাতি ঢোকাতেন তিনি মুখে। খুব লাগত। হেবি রাগ হত। বাবা কম্পেনসেট করতে নিয়ে আসত এখানে। স্যুপ খেতাম আমরা। তারপর আইসক্রিম।
এখন পুজোয় বন্ধুরা আসি মাঝেসাজে। ঢুকেই সেই ট্র্যাডিশানাল সোফা। সম্ভ্রান্ত ওয়েটারকুল। ধবধবে সাদা ইণ্টিরিয়ার। চকচকে গেলাসে জল। দিব্য সাহেব-সাহেব পরিবেশ। যেন বাইরের বদলকে বুড়ো আঙুল ইচ্ছেমতন।
বন্ধুরা বিয়ে করছে অনেকে। তারা অনেকেই বাবা-প্রেমিকা-পুজোয় এখানে এসেছে আগে। তাদের সন্তানরাও আসবে একইভাবে একদিন। কোয়ালিটির কোয়ালিটি একই থাকবে।
শীতের সন্ধ্যায় আজও নিওন নীল-লালে জ্বলে ওঠে কোয়ালিটি লেখাটা। আলো ঠিকরে পড়ে বালিগঞ্জ ফাড়িতে। বন্ধুদের বলি, কোয়ালিটির সামনে দাঁড়া আসছি। ওরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। আমরা কোয়ালিটি থেকে গড়িয়াহাটের দিকে হাটা শুরু করি। ক্রমশ। একদিন প্রতিদিন।
কী সুন্দর সহজ অনায়াস গদ্য, পড়ে তৃপ্তি হল।