ঝকঝকে, আধুনিক, আলাদা স্বাদের উপন্যাস
মিতা চট্টোপাধ্যায়
উপন্যাস – মুষলপর্ব প্রকাশক – আনন্দ পাবলিশার্স মূল্য – ৩৫০/- প্রকাশ – ২০২৩ বইমেলা
গত বছরের আনন্দলোক পুজোবার্ষিকীতে প্রিয় সাহিত্যিক অজিতেশ নাগের উপন্যাস ‘মুষলপর্ব’ প্রকাশিত হওয়ার পর দেরি না করেই পুজোর আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। এই বছর বইমেলায় সেই উপন্যাসটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। শুনলাম তাতে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন এবং সংশোধন ঘটেছে। কিনে ফেললাম এক কপি এবং আবারও ডুবে গেলাম চিনে ফেলা উপন্যাসের পাতায়, আবার নতুন করে।
কী চমৎকার একটি উপন্যাস লিখেছেন অজিতেশবাবু, তা বোধহয় সীমিত শব্দের মধ্যে বোঝানো যাবে না। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে প্রিয় নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত থিয়েটারগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আমরা সাধারণত থিয়েটার দেখতে গিয়ে কাহিনী ও অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয় ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হই, কিন্তু এর আড়ালেও প্রচুর মানুষ নিয়ত কাজ করে যান, যাদের সবাইকে মিলেই হয় গ্রুপ থিয়েটার। শুধু অভিনেতা নয়, যারা মঞ্চসজ্জা করেন, যারা আলোক প্রক্ষেপন করেন, প্রপস সরবরাহ করেন, সুর দেন, গান লেখেন, নির্দেশনা দেন, চিত্রনাট্য লেখেন, পোশাক পরিকল্পনা করেন ইত্যাদি আরও কত কত মানুষের অবদান থাকে একটা গ্রুপ থিয়েটারের পেছনে। এই উপন্যাসটি পড়ে জানা গেল। থিয়েটার নিয়ে এক প্রকার রিসার্চ ওয়ার্ক করে ফেলেছেন লেখক। এতদিন যা জানতাম, উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে দেখলাম সেই জানার পরিধির বাইরেও রয়ে গেছে অজস্র কাহিনী। আলো যে কতরকমের হয়, সেটাই তো জানতাম না। ‘মুষলপর্ব’ থেকে উঠিয়ে দিচ্ছি। প্রোফাইল স্পট, হার্ড এজেড বিম, সফট এজেড বিম ফ্লাড লাইট, লার্জ ওয়াশ, পার ক্যান, বার্ডি, স্মল ল্যান্টার্ন, ফ্রেস্নেল স্পটলাইট, ফলো স্পট, বার্ন ডোরস, কালার্ড ফিল্ম জেল আরও কত কী। আনন্দ পাবলিশার্স আয়োজিত একটি লাইভ অনুষ্ঠানে অজিতেশবাবু বলছিলেন, ‘Knowledge beyond reading’। অর্থাৎ উপন্যাসটি পড়লাম আর মুড়ে রেখে দিলাম, তা যেন না হয়। পড়ার পাশাপাশি চেনা জগতের অজস্র অচেনা খবর তিনি দিয়েছেন, যা চমকে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে। পড়া শেষ হয়ে গেলেও যা পড়ে থাকে, সেই প্রজ্ঞা পাঠকের কাজে আসতে পারে ভবিষ্যতে।
শুধু বর্তমান নয়, থিয়েটারের ইতিহাস নিয়েও কত চর্চা করেছেন ভদ্রলোক, পড়লে অবাক হতে হয়। ১৭৫৩ সালে দি প্লে-হাউস আর ১৭৭৫এর দি ক্যালকাটা থিয়েটারের যুগ থেকে শুরু করে স্ল্যাপস্টিক থিয়েটার, প্রসেনিয়াম ড্রামা থিয়েটার ছুঁয়ে ডায়মণ্ড জুবিলী থিয়েটার… আরও কত না জানা ইতিহাসের কণা কণা মণিমুক্তোর মত ছড়িয়ে আছে অজিতেশবাবুর উপন্যাসে, যারা আগাগোড়া না পড়বেন, তারা সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন না। পড়তে পড়তে নিবিষ্ট পাঠক কখন যেন বুঝে যান, ‘Morning Shows the day’ আপ্তবাক্যটা আসলে একটা চরম প্রহসন। তবে শুধু তথ্যের কচকচি নয়, তারই মধ্যে তির তির করতে বাড়তে থাকে হিংসা, রহস্য, খুনের প্রচেষ্টা, প্রেম, আত্মত্যাগ।
এবার কাহিনীর আভাসে আসি। সম্বুদ্ধ সেন এক নাটক-পাগল মানুষ। নতুন নতুন সৃষ্টির মন্ত্রে দীক্ষিত তিনি। নাটকের জন্য তিনি কোনওরকম আপোষে রাজি নন। তাঁর নাটক দল ‘দৈবিক’ সম্পর্কে নাট্যজগতে প্রচলিত আছে ‘“অভিনয় শিখতে হলে দৈবিক নাট্যগোষ্ঠীতে যাও।’ বেশ কয়েকটি সফল নাটক মঞ্চস্থ করার পর তিনি এবার ব্রেশটের লেখা একটি নাটক ভাবানুসরণ করে একটু অন্য ধরনের মার্ডার মিস্ট্রি প্রযোজনা করতে চাইছেন। মূল অভিনেতার সাথে মতপার্থক্য হওয়ায় তাকে বাদ দিয়ে আনকোরা নতুন একটি মুখকে অভিনেতার পাঠ করাবেন বলে মনস্থির করেন। কয়েকটি শো হওয়ার পর ‘দৈবিক’ গোষ্ঠীর ওপর নেমে আসে একের পর এক অপ্রত্যাশিত আঘাত। প্রথমেই সেকেন্ড লিড রোলের অভিনেত্রীর একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটে যায়। এরপরই অভিনয়ের সময় মূল অভিনেতার হাতে পেরেক ফুটে রক্তারক্তি কান্ড কিংবা সঠিক সময়ে আলো না জ্বলার মতো দুর্ঘটনা। এগুলো কি কাকতলীয় নাকি স্যাবোটাজ? পড়তে পড়তে বার বার মনে হচ্ছিল সম্বুদ্ধ সেন কি পারবেন তাঁর সৃষ্টির উত্তরণের পথে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ থেকে নিজেকে ও দৈবিক নাট্য গোষ্ঠীকে বাঁচাতে?
এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় স্ট্রং পয়েন্ট এর চমৎকার ডিটেইলিং এবং চরিত্র নির্মাণ। প্রত্যেকটি চরিত্রকে লেখক খুব সুন্দর এবং নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কোনও চরিত্রকে মনে হয়নি অপ্রয়োজনীয়। সম্পর্কের, ভালোবাসার নানা রং উদ্ভাসিত হয়েছে পাতায় পাতায়। আপাত ভালো মানুষের মুখোশপড়া চেহারাগুলোর কদর্য মুখ যেমন দেখা যায়, তেমনই একদমই অপরিচিত কেউ কেউ কখনও কখনও হয়ে ওঠে আপনজন। চেনা মুখ হয়ে যায় অচেনা, ভরসার হাতটাও সরিয়ে নেয় চরম সময়ে। গল্পে তিনটি নারী চরিত্র তাদের নিজের মতো করে সম্বুদ্ধ সেনের কাছে এসেছেন। সম্বুদ্ধ সেন হয়তো আশপাশের সবাইকে নাটকের কুশীলব ভাবতে অভ্যস্ত। তাই তিনি জীবন নাট্যে তাদের সহসা প্রবেশ ও প্রস্থানে বিচলিত হন না, কিন্তু নাটকের শেষ সিনটি লেখার বা নির্দেশনার ভার ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দেন না।
মহাভারতের মুষল পর্ব নায়ক ও মহানায়কদের অসহায়তা ও পতনের পর্ব; তবে অজিতেশ বাবু নিয়তির মতো নিষ্ঠুর নন। তাঁর নায়ক সম্বুদ্ধ সেন আহত হলেও অসহায় নন। তবে নায়কের বজ্রকঠিন চরিত্রের পায়ের তলায় থাকা প্রতিশোধস্পৃহা-রূপী দুর্বল অংশ তাঁকে দেবত্ব থেকে নামিয়ে আনে।
উপন্যাসের শেষে লেখকের লেখনী নিয়ে ভাবতে হয়। কী বলিষ্ঠ লেখনী। ঘটমান সময়কে উপন্যাসে ধরেছেন। নোংরা রাজনীতির কবলে পড়ে হল পাওয়া এক সমস্যা। ক’ মাস আগেই তো আমরা প্রত্যক্ষ করলাম অনীক দত্ত’র সিনেমা নিয়ে নোংরা রাজনীতি। উৎপল দত্ত, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত’র উল্লেখমাত্রে আমার তো সত্তর-আশির দশকের নাটকের কথা মনে পড়ে গেল। সে সব স্বর্ণময় যুগ। গ্রুপ থিয়েটারগুলোর অসাধারণ সব নাটক। উৎপল দত্তের কথা পড়তেই সামনে সব ভেসে এলো। ওরকম নাট্য ব্যক্তিত্ব আজ আর আছে কী না জানা নেই। হিন্দু থিয়েটার, প্রাইড অব বেঙ্গল থিয়েটার, ১৮৭৬-এ নবাব আবদুল গনির আমন্ত্রণে বম্বে থেকে একটি দলের ঢাকায় গিয়ে হিন্দি নাটক করা, শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকের পঞ্চম অঙ্ক এবং ভবভূতির উত্তররামচরিত-এর প্রথম অঙ্কের ইংরেজি অনুবাদ অভিনয়ের মাধ্যমে হিন্দু থিয়েটারের দরজা খোলা। কত কী জানা যাবে এই উপন্যাসে। একজন নাট্য নির্দেশককে কতো নিখুঁত হতে হয় তার প্রমাণ সম্বুদ্ধ সেন। উপন্যাসের শেষে কোথাও যেন মহাভারতের মহাপ্রস্থানপর্বের সাদৃশ্য ও পাওয়া যায়।
ডায়লগের কথা অবশ্য লিখব। খুব ঝকঝকে এবং আধুনিক ডায়লগ। খুব সাংঘাতিক স্পর্শকাতর একটা জায়গা খুঁজে পেলাম, যেখানে পরিচালক নাট্যকার সম্বুদ্ধ সেন পতিতার অভিব্যক্তি আবিষ্কার করতে এসে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলেন, “আমি জানি, ভালো মেয়েটাই তোমার নাম।” অপমানে যারা ক্রমাগত টাকার বিনিময়ে নিজেদেরকে বিক্রি করে; হঠাৎ করে কোনও মানুষের ভালো ব্যবহার তাদের কেও যে অবাক করে সেটা বলবার অপেক্ষায় রাখে না। আরও একটা ব্যাপার। পতিতা মানেই যে ভারি দুঃখে আছে, কষ্টে আছে, অজিতেশবাবুর উপন্যাস তা বলে না। তার সৃষ্ট চরিত্র ‘আরক্তা’ তার পেশায় সুখী। সে নতুন নতুন পুরুষকে, প্রায় প্রতি রাত্রে পেয়ে, জীবনটাকে দারুণ ভাবে উপভোগ করে। সে মনে করে আর পাঁচটা চাকরির মতো এটাও তার কাজ। কাজের বিনিময়ে সে টাকা উপার্জন করে। সেই টাকায় সে শুধু নিজেই খেয়ে-পরে, বাড়ি ভাড়া দিয়ে বেঁচে আছে তা-ই নয়, লাল-আলো এলাকার প্রাক্তন দেহব্যবসায়িনীদের দেখভালও সে করে। সে শুক্রবার করে সিনেমা দেখে, সে শপিং মলে কেনাকাটা করে, সে রাস্তায় চাইলে ভিক্ষুক অথবা হিজড়েদের হাতে তুলে দেয় টাকা। সে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে, সে নিয়মিত পুজো করে, তার গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ, সে বিকেলে গা ধুতে ধুতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, সে ক্রেতা খুঁজতে উগ্র সাজের আশ্রয় নেয় না, বরং আটপৌড়ে শাড়ি আর কপালে ছোট্ট টিপ পরতে ভালবাসে।
সে আসলে কে এটা বোঝাবার জন্য পুলিশ অফিসারকে সম্বুদ্ধ সেন বলেন, “চন্দ্রশেখর দা আমার নাটকের গুরু আর এই সময় তিনি পড়াশোনা করেন, ঘুমান না। তার ঘুমের সময় রাত দশটা থেকে তিনটে।” শেষের দিকের একটা বক্তব্য একেবারে লিখে রাখবার মত। “সত্যি কি কেউ হারিয়ে যায়? যে হারিয়ে যায়, সে তো কমপক্ষে জানে সে কোথায় যাচ্ছে। সে আছে, সে থাকে, এই বিশাল গোলাকার পৃথিবীর কোনও এক গোলার্ধে, কোনও এক স্থানে, হয়তো কোনও গ্রামে, হয়তো কোনও নির্জন অরণ্যের কাছাকাছি, হয়তো কোনও সমুদ্রের তীরের বেলাভূমি ঘেঁষে, হয়তো কোনও তুষারবৃত মনাস্টারিতে অথবা কোনও প্রচণ্ড কোলাহল-মিশ্রিত জনজীবনের মধ্যেই। আদতে মানুষ হারায় না। মরে গেলেও হারায় না। বড়জোর পঞ্চভূতে মিলিয়ে থাকে। তবু তো থাকে।”
শেষ পাতা অবধি একদম টানটান লেখার জাদুতে নিমগ্ন হয়ে থাকতে হয়। আনন্দ পাবলিশার্সকে অজস্র ধন্যবাদ এমন একটি আলাদা স্বাদের উপন্যাস বই আকারে পাঠককে উপহার দেওয়ার জন্য।