চিন্তার চিহ্নমালা পর্ব-১১
সন্মাত্রানন্দ
"ওই এক মহাশূন্যতা থেকেই এই ভুবন প্রতি মুহূর্তে জেগে উঠছে। জেগে উঠছে মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। জেগে উঠছে রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা, স্নায়ু। দেহমনের নামরূপ অনুভূত হয়। নামরূপ আরোপিত। এ দেহ-মন-অহমিকা সেই মহাশূন্যতা ছাড়া আর কিছু কী? ওই মহাশূন্যতাই এই ভুবন, দেহ-মন-আমি হয়ে রয়েছে। এই ভুবনের শূন্যতা-অতিরিক্ত কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই।" চিন্তার চিহ্নমালার একাদশ পর্বে লিখলেন সন্মাত্রানন্দ।
পূর্বপ্রকাশিতের পর
মঞ্জুশ্রীর তরবারি
এর আগে ‘লেখক কোথায়’ শিরোনামে যেকোনো লেখার লেখককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। দেখেছিলাম, সেই অনুসন্ধান কত দুরূহ; প্রথমে যা চোখের সামনে পড়ে আছে বলে মনে হয়েছিল, কয়েক পা এগোতেই দিগন্তরেখার মতো তা আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছিল। আমরা যতই তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, সেও ততই আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। শেষে বুদ্ধির শেষ সীমা পর্যন্ত এগিয়েও আমরা তাকে পাইনি। পেয়েছিলাম এক অতলস্পর্শী খাদের দেখা— যেখানে আর বুদ্ধি এগিয়ে যেতে পারে না, যদিও বুদ্ধি অঙ্গুলিনির্দেশে ওই খাদটাকে দেখিয়ে দিয়ে ফিরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
সেই অন্ধকার অতল খাদটাই সম্ভাব্য লেখক বা লেখকের অনস্তি। এভাবে বলছি, কেননা ‘অস্তি’ বা ‘অনস্তি’ নির্ণয়ের একমাত্র উপযোগী উপায় বুদ্ধি বা যুক্তি সেই খাদের তীর থেকে বোবা বাতিল হয়ে ফিরে গেছে। যে ছেলে সারা দিন বকবক করে, সে যদি কোথাও ভয়ের আকার দেখে বিষম খেয়ে বোকাভন্ডুল হয়ে বাড়ি ফিরে এসে চুপ করে বসে থাকে, তবে ভালো লাগে কার? সে অবস্থাটা বুদ্ধির অভিভাবকদের পক্ষে বড়ই অস্বস্তিকর!
অন্যদিকে ওই অপার খাদটা যে শুধু লেখকেরই স্বরূপ, তা তো নয়! লেখক, পাঠক, চিকিৎসক, শিক্ষক, রন্ধনী, অভিনেতা, জননেতা, ব্যবসায়ী, ধর্মযাজক—সবার ক্ষেত্রেই ওই প্রশ্ন তোলা যায় আর সেসব প্রশ্নের শেষে ওই এক অতল খাদটাই পড়ে থাকে। এথেন্সের রাজপথে সেই যে এক অদ্ভুতদর্শন বৃদ্ধ একদিন যাকেই পেতেন, তাকেই ধরে বেমক্কা প্রশ্ন করতেন, ‘তুমি কে? তুমি কী?’ হয়তো উত্তর এল, ‘আমি ক্রাইটো, হিসাবরক্ষক!’ তখন সেই বৃদ্ধ ফের প্রশ্ন করতেন, ‘আচ্ছা! হিসাবরক্ষক মানে কী? হিসাবরক্ষক কোথায়?’ তারপর তার উত্তরে আবার প্রশ্ন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে করতে বৃদ্ধ মানুষটি সেই পথিকটিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতেন যুক্তির একেবারে শেষ সীমা অবধি, দেখাতেন ওই এক অতলস্পর্শী অন্ধকার গহ্বর। বলতেন, ‘দ্যাখো, তুমি বলছ তুমি হিসাবরক্ষক, অথচ হিসাবরক্ষক মানে যে কী, তুমি তা জানো না। কেউ জানে না হে, কে কী! ওহে মানুষ, নিজেকে জানো!’ সক্রেটিসের যুক্তিক্রমের এই শেষ সৈদ্ধান্তিক কথাটা—‘মানুষ, তুমি নিজেকে জানো’ — তাঁর হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করার আগেই এথেন্সের অলিতে-গলিতে প্রবাদ বা ম্যাক্সিম-এ পরিণত হয়ে গেছিল বলে শোনা যায়।
কিন্তু সমস্যাটাকে কি ওখানেই আমরা ছেড়ে দেবো? ছেড়ে দেওয়ার মতো এ সমস্যা নয় যে! কারণ, এই জিজ্ঞাসা আমাদের অস্তিত্বঘটিত। এর সমাধান না-হলে আমাদের সত্তা চিরকাল অনিরূপিত থেকে যাবে। বুদ্ধিবাদীরা মনে করেন, ‘জানা’ মানেই মন দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে জানা। অর্থাৎ কোনো কিছু জানতে হলে সেই বিষয় বা বস্তুটিকে মন বা বুদ্ধি দিয়েই একমাত্র কব্জা করতে হবে, এছাড়া অন্য উপায় নেই। এমন যাঁরা ভাবেন, সেই বুদ্ধিবাদীরা ওই অতলস্পর্শী খাদটাকে যেহেতু বুদ্ধিগম্য বা মনোগম্য করা যায় না, তাই ওকে ‘অজ্ঞেয়’ বলতে চাইবেন। ‘অজ্ঞেয়’ মানে যা কোনোদিন জানা যাবে না। অন্ধকার খাদ এখানে রূপক, তার আড়ালে আমি কী বলতে চাইছি এবং কেন তা মনের অগোচর, সেসব কথা আমি আগের অধ্যায়ে দেখিয়েছি।
কিন্তু আমি দেহবাদীদের মতন করে, বুদ্ধিবাদীদের মতন করে ভাবব কেন? আমি কি একটা দম দেওয়া রক্তমাংসের পুতুল, যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণই আমার দাম? আমি কি একটা চিন্তা করার মেশিন, যতক্ষণ চার্জ আছে ততক্ষণই আমার মূল্য? নাকি আমি একটা আবেগের ফোয়ারা, জল শুকিয়ে গেলে যা কেবল জাদুঘরের সামগ্রী? এই রক্তমাংস, যুক্তিবুদ্ধি, আবেগ-সংবেগের বাইরে আমি কি নিতান্তই অনস্তি হয়ে যাই?
তা যে নয়, তার একটা প্রমাণ স্বপ্নহীন গভীর ঘুমের অবস্থা। সেখানে আমি আমার শরীরটাকে অনুভব করতে পারি না। আমার মন আমাকে কোনো দৃশ্য দেখায় না সেখানে। বুদ্ধির নিরূপণ তখন স্থগিত, আবেগ নিদ্রিত। এমনকি অহং-বোধটুকুও নেই। সমস্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ সেই অবস্থায় ‘আমি নেই’ একথা সত্য নয়, সেই অবস্থাতেও আমার অস্তিত্ব থাকে, তা না-হলে তারপর ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে কে?
অতএব, দেহ-মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার-আবেগের বাইরেই আমার প্রকৃত সত্তা। যেহেতু তা বুদ্ধির খোলসটাকেও খুলে রেখে দিব্যি থাকতে পারে (যেমন স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রায়), তাই বুদ্ধি তার বাইরের জিনিস। আর বুদ্ধি যখন সত্তার বাইরেই পড়ে রইল, তখন আমার আসল সত্তাকে সীমাকরণ করার ক্ষমতা বুদ্ধির নেই। যার সীমা নির্দেশ করতে পারা যায় না, তাকেই ‘অসীম’ বলে।
অন্যদিকে আগের অধ্যায়ে অন্ধকার খাদের রূপকের আশ্রয়ে যার কথা বলতে চেয়েছিলাম, তাও বুদ্ধির দ্বারা সীমাকৃত হয় না। অতএব, ওই বস্তুকেও ‘অসীম’ বলতে হচ্ছে।
তাহলে কি দুইখানা অসীম পাওয়া গেছে নাকি? ওরা যদি দুইখানাই হয়, তবে বলো, কোন কোন বৈশিষ্ট্যের দ্বারা ওদের দুজনকে আলাদা করছ? আলাদা না করতে পারলে ‘দুইখানা’ বলছ কী করে?
যেহেতু ওরা বুদ্ধির অগম্য, তাই ওদের আলাদা করার মতো বৈশিষ্ট্য পাওয়া অসম্ভব। কারণ বৈশিষ্ট্য নিরূপণ বুদ্ধিরই কাজ। বুদ্ধির অগম্য হওয়ায় ওদের আলাদা করার বৈশিষ্ট্য বা ডিস্টিংগুইশিং মার্ক পাওয়া যাবে না। আর তা পাওয়া না গেলে ওদেরকে আলাদাও করা যাবে না। যাদের আলাদা করা যায় না, তারা অভেদ।
সুতরাং বুদ্ধির দ্বারা জানা না গেলেও ওই নিরবয়ব অন্ধকার আসলে আমারই আসল সত্তা। এই অন্ধকার জ্ঞানের অভাব নয়। আসলে এই অন্ধকার আলোর আলো। আলো সবকিছুকে দেখিয়ে দেয়। আলোকে দেখিয়ে দেয় কে? আলোকেও যে প্রকাশিত করে, তাকে বলে ‘আলোর আলো’—জ্যোতিষাং তজ্জ্যোতিঃ। সকল লৌকিক জ্ঞানের অতীত বলে এই ‘আলোর আলো’-কে ‘লোকোত্তর প্রজ্ঞা’ বলা হয়।
সে না হয় হল। কিন্তু এই বিশ্লেষণের দ্বারা যা আমি পেলাম, তা লৌকিক চিন্তকের দৃষ্টিতে ‘অগম্য’ হয়েই বসে থাকুক অথবা লোকোত্তর অনুভূতিমানের উপলব্ধ সত্যই হোক, আমাদের সমস্যা তো মিটল না। কেন মিটল না?
মিটল না এই কারণে যে, যাকে পাওয়া গেল বা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল, সে কর্তাও নয়, ভোক্তাও নয়। আমাদের এই ধূলিধূসরিত পার্থিব বা লৌকিক জীবনের প্রতি উদাসীন সে এক পরম নৈর্ব্যক্তিকতা। আনন্দস্বরূপ সত্তা। সে কখনও জন্মায়নি, মরেওনি। সে কিছু দেখেনি, কিছু লেখেনি। সে লেখক নয়, পাঠক নয়, সন্ন্যাসী নয়, গৃহী নয়, করণিক নয়, ব্যবহারজীবী নয়, কৃষক নয়, কিচ্ছু নয়।
তাহলে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে যা পাওয়া গেল, তা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। সে লেখক নয়। প্রথমে যে প্রশ্ন তুলেছিলাম—‘লেখক কোথায়?’—তা অমীমাংসিতই থেকে গেল।
অমীমাংসার এই দোলাচলের ভিতর একাবোকা ঘুরে বেড়াই। যে আমাকে চিরকাল ভালোবেসে এল, সে পড়ে রইল মনের বাইরে অধরা। আর যাদের দেখলাম-শুনলাম, নাড়লাম-চাড়লাম, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে চাইলাম, তারা কারা, তাও চিনতে পারলাম না। নিজে আমি কে, তাই জানি না। লেখক কে, তাই যখন আমি খুঁজে পেলাম না, তখন লিখবটা কী? কেমন করেই বা লিখব? চিত্রকর কে, তাই জানলাম না, কী প্রকারে ছবি আঁকি? সংসারী কে, জানা হল না, সংসার করব কী প্রকারে? প্রেমিক কে, জানা হল না—প্রেম তবে কোন ভূমিতে আর দাঁড়াবে? ‘জ্ঞান নেই, জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই!’
জগতকে, নিজের এই আটপৌরে ‘আমি’-টাকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া দর্শনচিন্তার আসল কাজ নয়। দর্শনচিন্তার কাজ একে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা।
সংশয় ও অপ্রেমের এই ভুবনজোড়া অন্ধকারের ভিতর আমি হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে মগজে কতগুলো অসম্বদ্ধ চিন্তা, ছেঁড়া ছেঁড়া কতগুলো ছবি ঘুরে বেড়ায়। এমন অব্যবস্থিত চেতনায় আমি দেখেছি কখনও কখনও এমন কিছু কথা কিংবা এমন কিছু ছবি ভেসে ওঠে, এতক্ষণ যা ভাবা হচ্ছিল তার সঙ্গে সেসব ছবি বা কথাদের তেমন কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ সেই মুহূর্তেই খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ কিছুদিন পর ধীরে ধীরে বোঝা যায়, ওই ছবি বা কথাগুলোই আসলে সমস্যা-সমাধানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এমনই একটা ছবি অবচেতন থেকে ভেসে উঠল একদিন। কবে কোথায় সে ছবি দেখেছিলাম, আজ আর মনে নেই। হয়তো পুরোনো কোনো বইতে দেখে থাকব। ছবিটি একটি উপাস্য মূর্তির।
একজন ক্ষত্রিয় যুবাপুরুষ একটা নীল রঙের সিংহের উপর বসে আছেন। ডানহাতে একটা জ্বলন্ত তরবারি। বাঁহাতে একটা পদ্ম, পদ্মের কর্ণিকায় একটি শাস্ত্রগ্রন্থ। মুখের ভাব সদাপ্রফুল্ল, তেজোদ্দীপ্ত। তিনি যেন অভয়ের প্রতিমূর্তি।
বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝলাম, মূর্তিটি এক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ দেবতার। ইনি মঞ্জুশ্রী—মহাযান বৌদ্ধধর্মে অতি প্রাচীন কাল থেকেই এক বোধিসত্ত্বরূপে উপাসিত হতেন। ভারত থেকে ধীরে ধীরে চিন ও জাপানে এঁর উপাসনা ছড়িয়ে পড়েছিল। তিব্বতে অবলোকিতেশ্বর ও বজ্রপাণির সঙ্গে ইনিও পূজিত হচ্ছিলেন। শান্তরক্ষিত, কমলশীল, পদ্মসম্ভব, অতীশ দীপংকর এই মঞ্জুশ্রীকে পূজা করেছেন, স্তোত্র লিখেছেন। বজ্রযান বৌদ্ধমতেও ইনি প্রবেশ করেন। এই বাংলায় ইনিই একদিন প্রধান উপাস্য দেবতাবিশেষ ছিলেন। এখন যেমন কালী বা কৃষ্ণ বা শিব, হাজার বছর আগে তেমনই এখানে প্রধানত পূজা হত মঞ্জুশ্রীর।
কতদিন আগের কথা সেসব!
মঞ্জুশ্রীর মূর্তির নানারকম ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। যে নীল রঙের সিংহের উপর তিনি রাজকীয় চালে বসে আছেন, সেই সিংহটি আসলে আমাদের মনের প্রতীক। এর উপর মঞ্জুশ্রী বসে আছেন, অর্থাৎ তিনি এই অশান্ত চিত্তকে জয় করেছেন।
বাঁহাতের প্রস্ফুটিত পদ্মটি পরম-অনুভব বা বোধি ফুটে ওঠার প্রতীক। পদ্মের কেন্দ্রে বিরাজিত শাস্ত্রগ্রন্থটি প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র—মহাযান মতের সারনিষ্কর্ষ। আর ডানহাতের জ্বলন্ত তরবারিটি বিচারজাত প্রজ্ঞার প্রতীক। আরও নানারকম ব্যাখ্যা হয়। আমি সব জানি না।
আমার নজর গিয়ে পড়ল মঞ্জুশ্রীর ওই খরশান তরবারিটির উপর। মনে প্রশ্ন এল, তরবারির দুদিকে ধার কেন? ভারতীয় তরবারিতে তো একদিকে ধার থাকে। এঁর তরবারিতে দেখি দু’দিকেই ধার! কেন?
হতেই পারে, এসব মূর্তির অনেক বিবর্তন হয়েছে। হতেই পারে নয়, হয়েইছে। ইনি অনেক প্রাচীন; তার উপর কত দেশ যে ঘুরেছেন! আদিতে ভারতীয় মূর্তিতে একদিকে ধার দেওয়া তরবারিই হয়তো ছিল। তখন হয়তো তরবারিটি ছিল বঙ্কিম। পরে নানা দেশে ইনি যখন পুজো পেতে লাগলেন, তখন সেসব দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী তরবারিটি হয়ে উঠল রৈখিক বা ঋজু, ধার দেওয়া হল দুদিকেই। এসব গবেষণা তোলা থাক মূর্তিবিদ্যার পণ্ডিতদের জন্য। আমি তাতে অধিকারী নই, আগ্রহীও নই। মঞ্জুশ্রীর দু’দিকে ধার দেওয়া তরবারিটি নিয়ে আমার ভাবনাটুকুই আমি এখানে লিখি। তার সঙ্গে মূর্তিবিদদের বিশ্লেষণ মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে।
আমার মনে হল, মঞ্জুশ্রীর তরবারির একদিকের ধার যেন destructive dialectics। আর অন্যদিকের ধার যেন constructive dialectics-কে প্রকাশ করছে। Destructive dialectics মানে নেতিমুখ বিচার। যেখানে ‘না, না, না’-করে যা কিছু আছে সবকিছুকে কেটে ফেলে সেগুলো যে আদপেই নেই, তা দেখানো হয়। সমস্তকিছুকেই যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা হয়। সেই বিচারের সম্মুখে আমাদের যাবতীয় আসক্তি, প্রথাপ্রকীর্ণতা, স্থবির ধারণা, মিথ্যা অহমিকা ও দম্ভকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হয়। এইভাবে কাটতে কাটতে পড়ে থাকে মহাশূন্যতার ধারণা। কিন্তু সেও একটা ধারণাই। প্রকৃত মহাশূন্যতা নয়।
সেই অন্ধকার অতল গহ্বর!
কিন্তু মঞ্জুশ্রীর তরবারি এখানেই থামে না। এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেই বিন্দুতে, যার একদিকে পড়ে আছে ওই অন্ধকার ব্যাদিত-আনন মহাশূন্যতার গহ্বর আর অন্যদিকে আমাদের এই ভুবন; এই নীলকুন্তলা সমুদ্রমেখলা পৃথিবী শুয়ে আছে অন্যদিকে যেন কোনো স্বপ্নাতুর নারীর মতই। সেই ধাত্রী ধরিত্রীনারীর আলোড়িত নীবি, উত্তাল সুবিপুল জঘন, গম্ভীর নাভিদেশ, সুবিপুল স্তনকলস, তাঁর আলুয়ায়িত কেশকলাপে অজস্র নক্ষত্রের বজ্রমাণিক খচিত। তিনি আমাদের প্রিয়া, আমাদের জননী, আমাদের সকল কর্ম ও কবিত্বের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাত্রী সরস্বতী।
মঞ্জুশ্রী মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই সন্ধিবিন্দুতে। একদিকে শূন্যতা, অন্যদিকে ভুবন—দুটি বস্তু। এই যে ডুয়ালিটি বা দ্বৈততা একেই এবার তিনি কাটতে শুরু করেন। কিন্তু এতক্ষণ তরবারির যেদিক দিয়ে কাটছিলেন, সেদিক দিয়ে নয়; এবার এই দ্বৈততাকে মঞ্জুশ্রী কাটতে শুরু করেন তরবারির অপর ধার দিয়ে। অন্যদিকের সেই ধার হল constructive dialectics বা ইতিমুখ বিচার। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ’-করে এবার পূর্বে খণ্ডিত বস্তুগুলির প্রকৃতই সংস্থাপন করা হয়। দেখানো হয়, ভুবনের এই যাবতীয় বস্তু ও ব্যক্তিনিচয় ওই মহাশূন্যতারই একেকটি রূপ।
সব কেটে ফেলে শূন্যতায় পৌঁছে, এবার শূন্যতাকেই কেটে ফেলা হচ্ছে। সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাকে কেটে ফেলে, শেষে নিজেকেও কেটে ফেলার পর ছিন্নমুণ্ড ছিন্নমস্তার কণ্ঠ থেকে মহাকরুণার উচ্ছ্রিত স্রোত গিয়ে পড়ছে তৃষার্ত জীবের আননে।
মঞ্জুশ্রী দেখাচ্ছেন এবার, ওই অন্ধকার মহাশূন্যতার গহ্বরটাই যেন এই বিপুল ভুবন হয়ে রয়েছে। এই অনিল, অনল, আকাশ, এই পুণ্যগন্ধা পৃথিবী, এর আর্ত জীবকুল, এর বস্তুসমূহ, এর আরক্তভীষণ দিবাভাগ, এর নিবিড় নীল মায়াবী রাত্রিকাল—এসব বস্তুত তিনিই।
কীভাবে দেখাচ্ছেন? সেই বিচার ইতিমুখ বিচার। নেতি না হলে ইতি হয় না। বৈরাগ্য না এলে প্রেম অসম্ভব।
দেখাচ্ছেন এইভাবে। পাথরে পুতুল খোদাই করা রয়েছে। পুতুলের নামরূপ অনুভূত হয়। সেই নামরূপ আরোপিত মাত্র। ওই পুতুলটি পাথর ছাড়া আর কিছু কী? পাথর পুতুল হয়ে রয়েছে।
সমুদ্রে ঢেউ উঠছে। ঢেউয়ের নামরূপ অনুভূত হয়। নামরূপ আরোপিত। ঢেউ সমুদ্র ছাড়া আর কিছু কী? সমুদ্র ঢেউ হয়ে উঠছে, খানিক খেলা করছে, পরমুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।
ওই এক মহাশূন্যতা থেকেই এই ভুবন প্রতি মুহূর্তে জেগে উঠছে। জেগে উঠছে মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। জেগে উঠছে রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা, স্নায়ু। দেহমনের নামরূপ অনুভূত হয়। নামরূপ আরোপিত। এ দেহ-মন-অহমিকা সেই মহাশূন্যতা ছাড়া আর কিছু কী? ওই মহাশূন্যতাই এই ভুবন, দেহ-মন-আমি হয়ে রয়েছে। এই ভুবনের শূন্যতা-অতিরিক্ত কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই।
উপনিষদ তথা বেদান্ত দর্শনে এই একই কথা আছে। প্রথমে ‘এষ নেতি নেতি আত্মা’। অন্তিমে ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’। প্রথমে নেতিমুখ বিচার। পরে ইতিমুখ বিচার। প্রথমে খণ্ডন, পরে স্থাপন।
শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলেছেন, প্রথমে নেতি-নেতি করে, ‘এ নয়, সে নয়’ করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে গিয়ে উঠলে। তারপর ছাদে গিয়ে দেখলে, ছাদ যে-জিনিস দিয়ে গড়া, সেই একই চুন-সুড়কি দিয়ে সিঁড়ি, কার্নিস, মেঝে, মায় নিচের তলার ঘরগুলোও সমস্ত গড়া। সব সেই, সব সেই!
কিন্তু আগে প্রথমটি না হলে, পরেরটি হয় না। আগে খণ্ডন, পরে মণ্ডন।
এই সমস্ত প্রক্রিয়াটিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে চার লাইনে বলেছেনঃ
‘শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি,
বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি,
ভিক্ষা না নিবি, তখনই জানিবি—
ভরা আছে তোর ধন!’
তাই এই বিরাট ভুবনের দিকে তাকিয়ে আমি ঝড়ের রাতে শানিত বিদ্যুতের মতো মঞ্জুশ্রীর সেই স্পন্দ্যমান তরবারিটিকেই দ্রুতধাবিত হতে দেখছি। সেই তরবারি দুদিকেই কাটতে কাটতে যাচ্ছে। একবার এদিক থেকে ওদিকে। আবার ওদিক থেকে এদিকে।
সেই ‘না-লেখক’ই এই ভুবনপুঁথির আসল লেখক। প্রকৃত প্রণেতা।
অনবদ্য❤️
ধন্যবাদ
কোথাও যেন প্রচ্ছন্নভাবে dark energy আর dark matter এর খেলা চলেছে। অনুভব করতে পারছি। বোঝাতে পারছি না। ঐ মহাশূন্যই জমাট বেঁধে ‘আমি’ হয়ে ধরা পড়ে বোধহয়। আর মঞ্জুশ্রীর তরবারির ব্যাখ্যাটি অপূর্ব লাগলো।❤️
ওভারে দেখা যেতেই পারে। তবু যদি খোলা মনে দেখা যায়, পড়া যায়, ভালো হবে।
চিন্তার চিন্হমালা…. এমন এক অতুলনীয় সৃজন পৃথিবীর অভিমুখে ছুটে চলেছে …. যতোবারই পড়ি, আমরা মুগ্ধ হই । অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই সন্মাত্রানন্দ দা। অসাধারণ একটি চিহ্নায়ক রচনা ❤️
এসব লেখায় কাহিনি কথন নেই। শুধু নির্জলা চিন্তাটুকু পরিবেশনের তাগিদ আছে। উৎসাহ দানের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
সন্মাত্রনন্দর ‘চিন্তার চিহ্নমালা’কোনও cul-de-sac-এ আমাদের নিয়ে যায় না, বরং ভাবনার পথগুলি উন্মুক্ত করে দেয়।
ধন্যবাদ
আপনার এই ধারাবাহিকের প্রতি পর্বের বিশ্লেষন ব্যাখ্যা ভাবনাপথ ভালোলাগছে। ভাষাও চমত্কার
আপনার উপস্থিতি অনুভব করি।