গৌরাঙ্গ শ্রীবাল-এর কবিতা
রাষ্ট্রযন্ত্র
বুড়ো এক রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ে খেলা করছে রাস্তায়
গণতন্ত্রের সিমেন্ট বালি ইট দিয়ে তৈরি যার মাথা
ভিতরে নতুন ভারতের মেঝে, ফার্নিচার এবং দেয়ালে
প্লাস্টার অফ প্যারিস, উঁচুনীচু পাহাড়ের ছবি।
বুড়োটা অনেক কথা বলে, যেন গল্পঠাকুমার
পিরিতের ভাতার, প্রতিটি
কথায় প্রশ্নের চিহ্নগুলি প্রযুক্তির খুঁটিনাটি
যন্ত্রাংশের মতো যুক্তি-বিযুক্তির মাঝখানে উলটো দিকে
ঝুলে আছে হুইল ছিপের কাঁটা।
গেঁথে আছে। গেঁথে আছে আর ব্যথা পাচ্ছি।
ব্যথিত মাছের উত্তেজনার আবেগে ছুটে বেড়াচ্ছি পুকুরে
উথাল-পাথাল করে কেঁপে উঠছে জল,
সুতোটা দাদুর হাতে যন্ত্রের জটিল প্যাঁচে ধরা।
অনেকক্ষণ খেলেছি। ক্লান্তি আসে। ক্লান্ত।
তবুও ভিতরে প্রাণ। বুড়ো খুশি। উল্লসিত। তার পোষা
কুকুর বেড়াল পায়রা ময়ূরের বুকে আত্মনির্ভর শ্বসনক্রিয়া
আনন্দে টেনে নেয় নির্মল হাওয়া, হাত থেকে খুঁটে খায়
ধান গম চাল আর ভূমিপূজার প্রসাদ।
দেশদ্রোহী
পরিচিত সুখ-দুঃখসীমার ভিতর
ঢুকে গেল এক অন্যরকমের ভাব, ভিনদেশি
রণতরী, মনে হল এ বুঝি বিদেশী শত্রু।
সমস্ত দুঃখের সেনাজাল দিয়ে ঘিরে ফেলে
নিবাসের মধ্যে নিয়ে এলাম, অনেক প্রশ্ন
জিজ্ঞাসার পর সে বোঝাল
সমস্ত দুঃখের জল,
সমস্ত সুখের ঘর তার আছে
তবু ভালোবাসার প্রকৃত দেশ
খুঁজতে খুঁজতে সে অন্যের
সীমানায় ঢুকে পড়ে।
আমার সেনার হাত থেকে তাকে
বাঁচানোর সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে দিলাম এই
সীমানা পেরিয়ে অন্য সীমানায়, আর
আমার সুখ-দুঃখেরা রেগে গেল,
মনে করল আমি দেশবিরোধী, নীরবে
সীমান্তে দাঁড়িয়ে দেখি––
সুদূরে হারিয়ে যাছে সুখের নিশান…।
বুড়ো ঈগল
ঈগল পাখিটা বুড়ো হয়ে গেছে,
উৎসবে-আনন্দে মেতে উঠল
গিরগিটি ইঁদুর সাপ, তার তুলনায় আরো
ছোটো ছোটো কিছু পাখি।
মহাসমারোহে যেন
পালিত হচ্ছে তার জন্মের শতবর্ষ
অথবা মৃত্যুর প্রাক-প্রার্থনা বা
যুক্ত হল বোধ হয় নতুন কিছু পালক।
আনন্দের মধ্যে ঝরে গেল তার
ডানার বার্ধক্য থেকে ওড়ার দৌর্বল্য,
দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা যেন ফিরে এল সহসা আবার,
চঞ্চু তুলে হাই ভাঙে ঈগল পাখিটা।
শান দিতে শুরু করল শিলাপাথরে থাবার নখ।
মৃত্যু-বদল
নিতান্ত কীটের থেকে এ জীবনের পূর্ণতা,
বেড়ে ওঠা, পোকারা আমাকে চেনে
বিছানায় সহবাস করে,
শরীরে নিশ্চিন্তে থাকে, জোঁক কেঁচো
মশা মাছি বিছে আরশোলা মৌমাছির সঙ্গে ঘর।
আমাকে তাদের সমগোত্রীয় মনে করে কেবল
ভাবায়, এক চড়ে মশার যেমন মৃত্যু তেমন
বাঁচার সমস্ত প্রস্তুতির মধ্যে প্রতি-রাতে
আমার মৃত্যু-বদল হয়।
কখনো কেন্নোর মতো অঙ্গুরীমাল জীবন,
কখনো শীতের লেপ-কাঁথামুড়ি দিয়ে
নিজের শরীরে শুঁয়োপোকার নরম গুটিবেঁধে থাকি,
রোদ এসে আমাকে সোহাগ করে যখন বেরোতে বলে
মুখ বের করে দেখি, বহু বিপর্যয় মোকাবিলা করে
ধড়ে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকা ছেঁড়া ডানার মুমূর্ষু মথ।
ঈশ্বরী
ঈশ্বরীর অনেক পোশাক
সে একের পর এক পোশাক খুলে খুলে যাচ্ছিল
যেন সরীসৃপ তার নষ্ট খোলসগুলিকে ঝেড়ে ফেলছে,
এভাবে একসময় দেখা গেল
ঈশ্বরীর শরীরে পোশাক বলতে কিছু নেই।
আবার এটুকু পেরোনোর পর
ঈশ্বরীর নগ্নতাও খুলে পড়তে লাগল
পাকাটির মতো কিছু কাঠির উপর রেশমের সুতো
ও দড়ি জড়ানো নম্র কাঠামো এগিয়ে চলল।
কিছুক্ষণ পরে তাও রইল না,
একটা গুবরে পোকা কাদামাটির ভিতর ঢুকে
এমনভাবে উঠতেপড়তে লাগল যেন
সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নড়তে থাকা হৃৎপিণ্ড।
এবার আকাশে জ্বলে উঠল আগুনের হলকা,
ঘরপোড়া গোরুমহিষের মতো কূপ কেটে কলসি কলসি
জলের বদলে রাম, কান্ট্রির বোতল নিয়ে ছুটে চলল ঈশ্বরীর বর,
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে লাগল ন্যাংটা রাজা
প্রজা, যারা ঈশ্বরীকে উপাসনা করে।