গোপন সে এক ঝাউপাতার কবি :
সরোজ দরবার
একজন কবি থাকেন। শব্দের বাইরের মুখ। বাচ্যার্থ। তিনি ঝকঝকে। ঈষৎ পরিচিতি সচেতন। লালন করে চলেন অপরিপাট্য। কথা বলেন, ছবি তোলেন। স্রোতের দু-আঁজলা জল তাঁকে যে ভেজাবে না, এমন বেরসিক তিনি নন। কবি বলেই তবু তিনি মাথায় করে রাখেন আর-একজন মানুষকে। পড়শি সে জনের বাস শব্দের ভিতরঘরে। সেখানে সাতমহলা। এক অর্থের মৃদু টোকায় অন্য অর্থের জানলা খুলে যায়। মানুষটি চাবিওয়ালা। ইঙ্গিত-ইশারার চাবিগুলো আলোগোছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন। এককভাবে তারা কেউ তৃণ, কেউ-বা মায়ের মৃত্যুদিন, অথবা অনতিদূরের প্রচ্ছদে মিশে থাকা ঝাউপাতা। চাবিওয়ালা জানেন, এঁরা মিলেমিশে এক চৈতন্যের জন্ম দিতে পারে। এদের ভিতর-ভিতর অপূর্ব এক প্রাণের খেলা।
তিনি যে ঝাউপাতার কবি, জয় গোস্বামীর সম্পর্কে এ-কথা সাহস করে বলে ফেলাই যায়। প্রেম তাঁর কবিতার প্রধানা আলো। সেই আলোয় তিনি গোপনে বাঁচিয়ে রাখেন একটা আস্ত আকাশ। কেমন সে আকাশ? যেমন আকাশ থাকে বিশু ও নন্দিনীর সম্পর্কের অবকাশে। যক্ষপুরীর ভিতর যেমন আকাশ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
এক অর্থে এ জীবনও তো নিয়মের শাসন। সেখানে অশাসনপ্রিয় এক মানুষ ক্রমে বিক্ষত হন, এই তার ভবিতব্য। তবু ওরই ভিতর কিছু আকাশ সঞ্চয় করে তুলে রাখেন তিনি। আমরা, বারমহলায় বসে যারা ওই ভিতরঘরের মানুষটিকে অনুধাবনের দীন প্রয়াসে মেতেছি, তারা এই আকাশের নাম দিতে পারি আত্মজীবনীর খণ্ডাংশ।
এই আত্মজীবনীর ভিতর কী-না-কী ঢুকে পড়তে পারে। মহাবিশ্বের কেন্দ্রে থাকা চেতনা থেকে টুকরো কোলাজে মোড়া রানাঘাট। আমাদের আপাত ঝোঁক শেষেরটির প্রতি। যেহেতু জয় গোস্বামী অনেকগুলো গদ্যে লিখেছেন তাঁর ব্যক্তিজীবন, আমরা জানি তাঁর পূর্বাশ্রম। জানি, সেই রমণীর কথা, একদিন যিনি হয়ে ওঠেন পক্ষীমাতা। পিতৃহারা সন্তানকে যিনি তাঁর আঁচলের ডানায় আড়াল করে রাখেন। সংসারের আঁচ, তাত লাগতে দেন না। ছেলেটির সকল রুগ্নতার কপালে থাকে তাঁর উপশম করস্পর্শ। এমনকি, সন্তানের ভিতর যে এক কবির বাস, তাকেও তো লালন করেন তিনিই। প্রকাশের খরচ দেন তার প্রথম কবিতা বইয়ের। এই মা যেদিন চলে যাবেন, সেদিন কী হবে? থাকার উল্টোপিঠে কেবলই শূন্যতা। ফলে, সেদিনই হয়তো সন্তানটি তার দ্বিতীয় জন্মের সাক্ষাৎ পাবে। এমনকি তার মাকে অর্জনও করতে পারে। মাকে তো সে এমনিই পেয়েছিল। যেমন সকলেই পায়। ঘাসে-মাটিতে ছিল অচ্ছেদ্য জীবন। সেই জোড় ভেঙে গেলে, থেকে-যাওয়াটুকু অর্জন করে চলে-যাওয়াটিকে।
স্মৃতি আর সত্তায় এখন ঘর করা। এভাবেই চলবে বাকিটা জীবন।
এই যুবকের কাছে যখন এল প্রেম, আবার চলেও গেল, তখন মায়ের কথা তার মনে পড়াই স্বাভাবিক। উপশমপ্রার্থী সে খুঁজে বেড়ায় হয়তো সেই একজনকে, যে মায়ের মতোই। কে সে? ‘ঘুমিয়েছো’? নাকি ‘ঝাউপাতা’? এতদিনে আমরা সাক্ষাৎকার সূত্রে জ্ঞাত, এই দু-জন হলেন দুই নারী। ‘ঘুমিয়েছো’ চলে গ্যাছে কবির জীবন থেকে। তার পাশে তাই একটি ‘কমা’ দেওয়া গেল। ‘ঝাউপাতা’ আছে এবং তার থাকার সম্ভাবনাটুকুর উদ্দেশে দেওয়া গেল একটি প্রশ্নচিহ্ন। অর্থাৎ, এই বিক্ষত পর্বের আত্মজীবনীর যে প্রস্তাব, তার নাম হয়ে উঠল ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা?’। সেখানে থাকল এদের দুজনই যুবকের জীবনকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তারই পঙ্ক্তিমালা। কিন্তু তার ভিতর আচমকা মাতৃতর্পণ কেন রাখা?
এই প্রশ্নে আমরা একটু দোলাচলে পড়ি। আগুপিছু তাকিয়ে দেখি, যে-পাতায় রাখা আছে ‘বাৎসরিক’, তার আগের পাতাতেই তো ‘একটি প্রেমের দৃশ্য’, গড়িয়ে পড়তে গিয়ে অশ্বটিকে তীব্র আঙুলে যেখানে আঁকড়ে ধরেছে বাঙালি মেয়েটি; আর, তার পরের পাতায় ‘তিল’, যেখানে সেই বালিকার তিলফুলে ভ্রমরের মরণ; এরই মাঝে এই যে দু-পঙ্ক্তির বিস্ময়, সে কি কেবলই তর্পণ?
ভাঙা-প্রেম, কিংবা হেমন্তের আলোর মতো মৃদু আভাসের প্রেমের দিনেও চলে আসে মায়ের মৃত্যুদিন। স্মৃতির ঘরে সেদিন উৎসব যেন। মুহূর্ত, অসংখ্য ফেলে-আসা মুহূর্তের ধাক্কাধাক্কি। কিন্তু তারা তো ধরাছোঁয়ার অতীত। যে চলে যায়, সে তো গেল। যে থেকে যায়, সে ওই থাকার উল্টোপিঠের শূন্যতাকে বুকে টেনে এনে হাবুডুবু খায়। তার নাকেমুখে ঢুকে যায় অতীত আর বর্তমানের জল। একটু বাতাসের জন্য সে মুখ তোলে আর কুটোটিকে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করে। অর্থাৎ, আগের কবিতার মতো এখানেও আছে তীব্র আঙুলে আঁকড়ে ধরা, আছে খানিকটা অপ্রকাশে, গোপনে। যুবকটি এখানে আঁকড়ে ধরছে সামনের দৃশ্যমান কুটোটিকে। এই কি সেই ঝাউপাতা, যে এখন থেকে গেছে জীবনে? আমরা বিশ্বাস করি, এই আঁকড়ে-ধরা তৃণসদৃশ সেই ঝাউপাতাটিকেই।
স্মৃতি – মাতৃবিয়োগ এবং প্রেম ভেঙে যাওয়ার ধারালো এই যে স্মৃতিতে যুবকটি বন্দি, সেখানে সে ওই ঝাউপাতার মধ্যেই এখন তার আকাশটিকে খুঁজে পায়। দ্যাখে, বিশু যেমন করে দেখত যে, এখনও তার ভিতর আলো আছে। যুবকটি মুক্তি প্রার্থনা করে। এবং বুঝতে পারে, তার মুক্তি আলোয় আলোয়, ঘাসে ঘাসে। আলোটি তার ভিতরঘরের। ঘাসে ঘাসে, তৃণে সে নাম লিখে দিতে তাই দ্বিধা করে না। কেমন করে সে নাম লেখা হয়? যেমন, কাঁসার গেলাসে লেখা থাকত কারও নাম। যেমন করে সে নামের জল পান করাও সম্ভব। সেভাবেই লেখা হয়ে যায় তৃণের গায়ে কারও নাম। হতে পারে সে নিজের নাম। হতে পারে তা ‘ঝাউপাতা’। মোটকথা, তৃণটির সঙ্গে যুবকের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ হয়। এবং আমরা বুঝতে পারি, তর্পণ থেকে এই এতক্ষণে আমরা পৌঁছেছি সমর্পণে। সেই সমর্পণ হয়ে-উঠেছে মায়ের মৃত্যুদিনে। সমর্পণ বলেই হয়তো এর পরে আর-কোনও যতিচিহ্ন নেই। আছে পাতা জোড়া অবাধ পরিসর। কেন-না এই মুহূর্তটুকু শাশ্বত; এর ভিতর ঢুকে পড়েছে অনন্ত, কিংবা অনন্তে মিশে গ্যাছে তা। ‘ঝাউপাতা’ এর পরে থাকবে কি থাকবে না, তা গৌণ; এমন কি পরের বাৎসরিকে কী হবে, তা-ও বিবেচ্য নয়। ঘটনা হল, এই যে মুহূর্তে নিজেকে সঁপে দেওয়া এই মুহূর্তটা ঋত; এক নতুন জন্মের শুভক্ষণ; এই হয়তো তবে দ্বিতীয় জন্মের অন্য পাঠ; এক জনমে ঘটে যাওয়া জনমান্তর; যুবকটিকে এখন আমাদের একঝলক মারশোলের মতো মনে হয়। মনে হয়, এই মিথ্যে জগতের ভণিতা সে অতিক্রমণে সক্ষম। শোকের দিনে এই সমর্পণ সে গোপন করেনি। বাৎসরিক প্রথা, রীতি, রেওয়াজের সঙ্গে লগ্ন করে দিয়েছে। কারণ এই সেই সত্য, যা বলে উঠতে পারলে, ব্যক্তি তার ব্যক্তির সীমানাকে পেরিয়ে যেতে পারে। শোক থেকে শ্লোকে উত্তীর্ণ হতে এই সত্যটুকুই কবিতার কাঙ্ক্ষিত অবলম্বন।
এখন এই যে পাঠপ্রয়াস, এবং ওই চাবি ছুঁয়ে-ছুঁয়ে সম্ভবনার কোনও এক ঝুলবারান্দায় থিতু হওয়ার চেষ্টা, এর ভুল হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। কিন্তু এই সমস্ত পরিক্রমণ জুড়ে আমরা সেই মানুষটিকে যেন খুব কাছ থেকে দেখতে পাই, যিনি বলেন, যে কবিতা লেখে ‘… স্বীকার করতেই হবে, সে তো মাথা তোলবার জন্য লেখে। সে তো বেঁচে ওঠবার জন্য লেখে। ভালবাসবার জন্য লেখে।’ আমরা এই সম্ভাবনার পাঠে মানুষটির সেই মাথা তোলাটুকু, বেঁচে ওঠার আকুতি, ভালোবাসবার জন্য লেখার আর্তি ছুঁয়ে ফেলতে পারি। এখানেই কবিতার আকাশ ভরে ওঠে আলোয় আলোয়। ফলে, সম্ভাবনা সত্যি কি মিথ্যে, ঠিক কি ভুল, সে প্রশ্ন ছেড়ে বরং আমরা কবির বিশ্বাসটিকে আঁকড়ে ধরতে পারি, যা আমাদের ভরসা দিয়ে বলে- ‘কবিতায় সমস্ত সম্ভব।’
এই সম্ভাব্যের ভিতরেই বেঁচে ওঠেন কবি। ঝাউপাতার কবি জয় গোস্বামী। তাঁর যে-কবিতাটি নিয়ে এই পাঠ প্রস্তাবনা, আসুন, আরও কোনও সম্ভাব্যের আভাস পেতে, তা পুনর্বার পড়ে ফেলি –
নাম লিখেছি একটি তৃণে
আমার মায়ের মৃত্যুদিনে
দারূণ। কী সুন্দর করে লিখেছেন প্রবন্ধটি। হিংসা হয় আমার। আমার হিংসা হয়।