গান্ধী [মূলগ্রন্থ : ভিখু পারেখ কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘গান্ধী: অ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাক্শন্’]
অনুবাদ- গৌতম বসু
বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষের বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে জোর করে 'ওয়ান নেশন'-এর একত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে কিছু রাজনৈতিক শক্তি। আমরা কিছুই করতে পারি না, শুধুমাত্র একটা বিপরীতমুখী সংস্কৃতির যুদ্ধ করে যাওয়া ছাড়া। মহাত্মা গান্ধীর ভাবনা এবং জীবন নিয়ে তাই এই ধারাবাহিকের সূচনা। ভিখু পারেখের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ 'গান্ধী, এ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন' যার অনুপ্রেরণা। সেই গ্রন্থ থেকেই অনুসৃজন করলেন কবি গৌতম বসু। আজ এই ধারাবাহিকের চতুর্থ পর্ব প্রকাশিত হল।
আগে প্রকাশিত পর্বগুলি কেউ পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে—> (১), (২), (৩)
[পূর্বপ্রকাশিতের পর]
চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মানবপ্রকৃতি
মানবপ্রকৃতি-বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বের সঙ্গে তাঁর ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মচিন্তার একটি নিবিড় সম্বন্ধ রয়েছে। মানবপ্রকৃতির তত্ত্বটি জটিল, কোথাও-কোথাও দ্ব্যর্থক, অন্য কোথাও অসঙ্গতিলক্ষণাক্রান্ত। অতিসরলীকরণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর ভাষ্যকে আমরা যদি সংক্ষিপ্ত করি, লক্ষ করব যে, তিনটি মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সেখানে উল্লিখিত। প্রথমত, মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির এক অচ্ছেদ্য অংশ। দ্বিতীয়ত, মানুষ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল, তাদের উত্থান ও পতন একই সঙ্গে ঘটে। তৃতীয়ত, গঠনের দিক থেকে মানুষ চতুর্মাত্রিক; শরীর, মানস, আত্মা ও স্বভাব । এদের পারস্পরিক ক্রিয়া মানুষের আচার-আচরণ নির্ধারণ করে এবং এই চারটি মাত্রাই তার নীতিজ্ঞানের ভিত্তি। আমরা একে-একে এই নিয়ে আলোচনা করব।
বিশ্বপ্রকৃতিকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ
প্রতীচ্যের দর্শনশাস্ত্রে সর্বত্রই পশুপাখি ও মানুষ স্পষ্টরূপে বিভাজিত, জগতের উচ্চতম স্থানটি মানুষের জন্য সুরক্ষিত। এর বিপরীতে, গান্ধী ভারতীয় ভাবনাবিশ্বকেই অনুসরণ করেছেন, তাঁর মনে হয়েছে বিশ্বপ্রকৃতিকেন্দ্রিক(কস্মোসেন্ট্রিক)অবস্থানই মানুষের পক্ষে যথোপযুক্ত। সুসমন্বয় এবং সম্পূর্ণতায় ঋদ্ধ বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি অংশ পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা এবং একে অপরের সঙ্গে সেবাবিনিময়ের এক যাজ্ঞিক সম্বন্ধে সংযুক্ত (এখানে ‘যজ্ঞ’ শব্দটির অর্থ, পরস্পরের মধ্যে নির্ভরশীলতার সূত্র ধ’রে পরস্পরের হিতার্থে অনুষ্ঠিত আহুতি)। এই সম্পর্কগুচ্ছে বিভিন্ন স্তর বিদ্যমান, জড়বস্তু থেকে মনুষ্যদেহ পর্যন্ত এর বিস্তার, প্রত্যেকেই নিজস্ব নিয়মাবলীর অধীন, প্রত্যেকেই বাকিদের সঙ্গে যুগপৎ দুরূহ ও অচ্ছেদ্য সম্পর্কের বন্ধনে যুক্ত। মনুষ্যপ্রজাতি বিশ্বপ্রকৃতির এক অবিচ্ছিন্ন অংশ, এবং সমগ্রের সঙ্গে নিবিড়তম বন্ধনে সংযুক্ত। জড়পৃথিবী রয়েছে সর্বনিম্ন ধাপে এবং মানুষ শীর্ষবিন্দুতে, বিশ্বপ্রকৃতির এইরকম পিরামিডের আকার গান্ধীর পছন্দ ছিল না, একটি অন্য রূপক তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল; তিনি মনে করতেন, বিশ্বপ্রকৃতির গড়ন অনেকটা এককেন্দ্রীয় বৃত্তের (কন্সেন্ট্রিক সারক্ল্) এক বৃহৎ পরিবারের মতো, যেখানে একের পর এক বৃত্তের ব্যাসার্ধ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে, ফলত বৃত্তগুলির আকারও ক্রমবর্ধমান, মানুষ, বিশ্বচেতনা, জড়বিশ্ব সকলেই, এমন কি, সর্বব্যাপ্ত অসীম ব্রহ্মাণ্ডও যার অন্তর্গত। মহাজাগতিক চেতনা যেহেতু ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে অবস্থিত নয়, ব্রহ্মাণ্ডের সবখানে বিরাজমান, সেহেতু তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক’ বিশ্ব, প্রকৃত অর্থে প্রাকৃতিক নয়, জড়ও নয়, বরং দিব্য ও আধ্যাত্মিক।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি কণাই যখন পবিত্রতার চিহ্নযুক্ত তখন আমাদের আচরণ সার্বজনীন (কস্মিক/য়ুনিভ়ার্সাল) শ্রদ্ধাযুক্ত ও মৈত্রীপূর্ণ হওয়া সমীচীন। ঈশ্বর মানুষের হাতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তুলে দিয়েছেন যাতে মানুষ তাকে সম্পত্তির মতো আপন খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করতে পারে ─ গান্ধী মনে করতেন এই মনোভাব ধারণ করা কেবল যুক্তিহীন নয়, পাপকর্মও। গান্ধীর মতানুসারে ওই অভিমতটি দু’টি কারণে যুক্তিবর্জিত; এক, ঈশ্বর কোনও ব্যক্তি নন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে বিযুক্তও নন; এবং দুই, যা ঐশ্বরিক তা কখনও সম্পত্তির পরিধির অন্তর্গত হতে পারে না। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্তকিছুর উপর প্রতিটি জীবদেহের সমান ও যৌথ উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত, সেই কারণে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রেখে মানুষের চলা উচিত। মানুষ যেহেতু যুক্তিধর্মে সমৃদ্ধ, সেহেতু, অন্যদের পক্ষ অবলম্বন ক’রে, মালিক হয়ে নয়, অভিভাবক-তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করা তাঁর কর্তব্য; অন্যদের অধিকার-বিষয়ে তাঁর শ্রদ্ধাবনত থাকা উচিত, জীবনের বৈচিত্র্যকে লালনপালন করা উচিত। প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করা যেহেতু জীবনধারণের একমাত্র উপায়, এবং প্রকৃতি যেহেতু নিজেকে নিত্য পুনর্জীবিত ক’রে চলেছে, সেহেতু পরিমিত স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু প্রকৃতির থেকে গ্রহণ করার পূর্ণ অধিকার মানুষের আছে। এর অধিক গ্রহণ করবার অধিকার মানুষের নেই, কারণ তা চৌর্যবৃত্তির সমান; ঠিক যেমন, প্রতিবেশকে বিষাক্ত ক’রে তোলবার, তাকে কলুষিত করবার, উর্বর জমিকে অনুর্বর জমিতে রূপান্তরিত করবার, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করবার, প্রকৃতির পুনরুজ্জীবনক্ষমতাকে খর্বিত করবার কোনও অধিকার মানুষের নেই।
সর্বপ্রকার জীবদেহ-ই পবিত্র; সেই ভাবনাসূত্র ধ’রে অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে মানুষ উন্নতর কি না, এ-প্রশ্নে গান্ধী সংশয়াচ্ছন্ন ছিলেন। মানুষের যুক্তিধর্ম ও নৈতিকতার কারণে অন্যান্য প্রাণীদের প্রতিতুনায় তাঁর পক্ষপাত ছিল মানুষের দিকেই। কিন্ত, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, ‘সার্বিক’ নয়, কারণ যে-জীবদেহ মানুষ নয়, সেও পবিত্র, সেও এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বৈধ সদস্য। অতএব, প্রয়োজন অত্যাবশ্যক না হলে মানুষের পক্ষে আমিষাহার পরিহার ক’রেই চলা বিধেয়, আপতকালীন পরিস্থিতিতে বাধ্যত আমিষ আহার গ্রহণ করতে হলে, অনুতাপের সঙ্গে তা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিষধর সাপ অথবা ফসলের ক্ষতি করে যে পশুরা, তাদেরও হত্যা না-ক’রে নিরাপদ দূরত্বে তাদের রেখে আসতে হবে, অথবা লোকালয় থেকে তাদের বিতাড়ণ করতে হবে। কেবল দুটি ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রে আমিষাহারের অনুমতি আছে ─ এক, প্রাকৃতিক আবহাওয়ার কারণে যেখানে নিরামিষ খাদ্যবস্তুর উৎস দুর্লভ এবং, দুই, স্থানীয় পরিস্থিতির কারণে যেখানে নিরামিষ ভোজন অনুকূল নয়। উৎসব ও বিনোদনের প্রয়োজনে, প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ; বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যও তিনি প্রাণীহত্যার বিরোধী ছিলেন। শরীরের প্রয়োজন হয় খাদ্যের, ওদিকে খাদ্যে রয়েছে প্রাণ; খাদ্য সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কৃষিকাজের প্রয়োজন এবং সেই সূত্রে এসে পড়ে কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার ও তৎসঙ্ক্রান্ত বিপুল পরিমাণে প্রাণনিধনের প্রসঙ্গ। গান্ধী শরীরের নাম রেখেছিলেন, ‘কসাইখানা’; মানুষের শরীর প্রতিপালন করার জন্য, বাধ্যত যে বিপুল পরিমাণের হিংসার আশ্রয় তাকে বাধ্যত নিতে হয়, তা তাঁর কাছে গভীর মনস্তাপের কারণ ছিল। মানুষের জীবনের সঙ্গে হিংসা এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, তাকে সম্পূর্ণ পরিহার করা অসম্ভব। এ-অবস্থায়, সঠিক নৈতিক আচরণের মাত্র দুটি পন্থা খোলা রয়েছে ব’লে গান্ধী মনে করতেন ; এক, কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা চাহিদা হ্রাস, এবং, দুই, জীবজগতের যত্ন নিয়ে প্রকৃতির পুনরুজ্জীবনে সদর্থক ভূমিকা পালন।
মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা
নিজেদের প্রয়োজনবোধদ্বারা চালিত মানুষ, পারস্পরিক নির্ভরশীলতার আকর্ষণে সুসংহত এক বলয় গ’ড়ে তোলে; মানুষ সম্পর্কে গান্ধীভাবনার এটি আরও একটি ‘প্রাথমিক’ সত্য। ব্যক্তির অস্তিত্ব তাঁর পিতামাতার উপর নির্ভরশীল, তাঁদের অপরিমিত আত্মত্যাগ না থাকলে শিশুটি বাঁচত না, সুস্থ ও সবল পূর্ণবয়স্ক মানুষও হয়ে উঠতে পারত না। এক স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজে, শিশুর মধ্যকার যে সম্ভাবনাগুলি তাঁর পিতামাতা বাস্তবায়িত করেন, তার নেপথ্যে অগণিত নামহীন নারীপুরুষের সক্রিয় সহযোগিতা থাকে। তারও পরে, বহু সাধুসন্ত, বিদ্বান ও বৈজ্ঞানিকের যৌথ প্রচেষ্টায় গ’ড়ে তোলা এক সভ্যতায়, একজন যুক্তিপূর্ণ, চিন্তাশীল, নীতিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির পূর্ণ পরিচয় নিয়ে ব্যক্তি তাঁর সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে মনুষ্যত্ব আছে, তা সম্পূর্ণভাবে অন্যদের দানলব্ধ, তিনি এমন এক পৃথিবীর দ্বারা উপকৃত হয়েছেন যেখানে তাঁর ন্যূনতম অবদান নেই। গান্ধীর দৃষ্টিতে মানুষ ‘জন্মমুহূর্ত থেকে ঋণী’ এবং নিজের অজ্ঞাতে সে-ঋণের ভার এমন ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে যে, একসময়ে তা হয়ে উঠেছে অপরিশোধ্য। সারা জীবনের প্রচেষ্টাতেও একজন ব্যক্তি তাঁর পিতামাতার কাছে যে ঋণের বোঝা জমে রয়েছে তা প্রত্যার্পণ করতে পারবেন না, অন্য ঋণ ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত। তদুপরি, সেই সব ঋণদাতাদের ধরনই এমন যে, ঋণদাতাকে শনাক্ত করা যায় না। অধিক সংখ্যায় তাঁরা কেউ প্রয়াত, কারুর পরিচয় অজ্ঞাত, যাঁদের পরিচয় জানা যায়, সংখ্যায় তাঁরা বিপুল, এবং তাঁদের অবদান বিবিধ রকমের, কার কাছে কত ঋণ আছে তা নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য। বিমূর্ত ও স্থূল প্রকৃতির আলোচনায়, ঋণপরিশোধ প্রসঙ্গটি শেষ পর্যন্ত, অযাচিত উপহার প্রদানের বাইরে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে নি।
সমাজের কাছে ব্যক্তির ঋণ অপরিশোধ্য, অন্যান্য উপকার প্রত্যার্পণ করাও সবদিক থেকে অসম্ভব; এই প্রশ্ন দু’টির নিষ্পত্তি হবার পর, মানুষের সামনে দু’টি পথ খোলা থাকে। এক, ব্যক্তির অস্তিত্বে সমাজের অবদানের স্বীকৃতিজ্ঞাপন; এবং, দুই, পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এই প্রক্রিয়ার অধীনে কাজ ক’রে সামগ্রিক জনকল্যাণের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া। মানুষের উচিত নিজের জীবনকে একটা যজ্ঞানুষ্ঠানের মতো ক’রে দেখা, অর্থাৎ সে যেন সার্বজনীন হোমাগ্নিতে আহুতি। এইভাবে মানুষের পৃথিবী এবং ঊর্ধ্বলোক, উভয়ই স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত থাকবে, হবে আরও সমৃদ্ধ। গান্ধী বলতেন, ‘যজ্ঞ যেহেতু আমাদের জন্মমুহূর্তের সঙ্গে জড়িত, সারা জীবন যেহেতু আমরা ঋণগ্রহীতা, সেহেতু বিশ্বপ্রকৃতির সেবা করতে আমরা দায়বদ্ধ।’ এই সেবাধর্ম কেবল মানুষের কর্তব্য নয়, তার অধিকারও বটে, কারণ কাজ করবার সুযোগ না-দেওয়া, তাঁর পক্ষে আত্মসম্মানহানিকর। গান্ধীর মতানুসারে, অধিকার ও কর্তব্য অভিন্ন, একজনের অধিকার অপরজনের কর্তব্য, কেবল প্রথাগত কারণে নয়, বস্তুত, গভীরতর অর্থেও; একটাই ক্রিয়াকে এখানে বিপরীত দিক থেকে দেখা হচ্ছে। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ব্যক্তির কর্তব্য, সেইজন্য অধিকার ও কর্তব্য অভিন্ন। আবার, নিজের কর্তব্য পালন ব্যক্তির অধিকার, এদিক থেকেও তারা অভিন্ন। এই দুরূহ প্রসঙ্গটিতে আমরা ফিরে আসব।
মানুষ যেহেতু বাধ্যত পরস্পরের উপর নির্ভরশীল, সেহেতু ব্যক্তির প্রতিটি ক্রিয়ার লক্ষ্য সে নিজে, আবার, একইসঙ্গে লক্ষ্য অন্য ব্যক্তিও। যে-কোনও ক্রিয়া কেবল ব্যক্তির নিজের চরিত্র ও জীবনধারণকে ফুটিয়ে তোলে তা নয়, পরের উপরেও অভিঘাত সৃষ্টি করে, কেবল নিজের সঙ্গে নয়, অন্যদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। ব্যক্তি যখন নিজের উন্নতিসাধন করেন তখন তিনি অন্যদেরও জাগিয়ে তোলেন, তাঁদের মধ্যে যে সম্ভাবনা সুপ্তাবস্থায় রয়েছে সেটি বাস্তবায়িত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্ট হয়, তাঁরাও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত বোধ করেন। আবার, এর বিপরীতে, ব্যক্তির পতন হলে, অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। গান্ধী বিশ্বাস করতেন, নিজের মর্যাদাহানি না ক’রে অথবা নিজে পশু না হলে, অন্যের মর্যাদাহানি অথবা অন্যের প্রতি পাশবিক আচরণ করা, কোনওটাই সম্ভব নয়; অন্যের মন অথবা নীতিবোধ আঘাত করবার অনেক আগেই মানুষ নিজের মনকে অথবা নিজের নীতিবোধকে আঘাত ক’রে থাকে। তিন ভাবে এটি হওয়া সম্ভব। প্রথমত, কোনও ব্যক্তি যখন অপর ব্যক্তিকে অবমাননা করেন তখন তিনি ধ’রে নেন যে এটি করা সম্ভব, এবং প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাপণীয় ন্যূনতম মর্যাদার মানদণ্ডটি তাঁকে নামিয়ে আনতে হয়। যেহেতু মানদণ্ডটি সকলের পক্ষে প্রযোজ্য, সেহেতু এর দ্বারা অনিবার্যভাবে সকলেরই অবমাননা হয়। দ্বিতীয়ত, অন্যের মর্যাদাহানি ঘটালে তাঁর আত্মসম্মান, আত্মাভিমান এবং তাঁর মঙ্গলসাধন প্রবর্তন করবার সম্ভাবনা, সবই চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলত, একদিকে যেমন আগামীদিনে সমাজ তাঁর ইতিবাচক যোগদান থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনই, অন্যদিকে, নিজেদের ও অন্যের মর্যাদাহানির ক্ষতিপূরণের জন্য মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক ও আর্থিক, তিনটি ক্ষেত্রেই যৌথ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, নৈতিক মূল্যবোধ এবং আত্মসমালোচনামূলক বিশ্লেষণী মনোভাবসম্বলিত ব্যক্তিদের পক্ষে, অন্যদের লাঞ্ছনা করবার আগে নিজেদের উদার মানবিকতার স্তর নামিয়ে আনতে হবে, অন্যদের দুঃখকষ্টের ব্যাপারে হতে হবে নিঃস্পৃহ, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একটা বিকৃত যুক্তিগুচ্ছ প্রস্তুত করতে হবে এবং, একইসঙ্গে বিনষ্ট করতে হবে নিজেদের নৈতিক সংবেদনশীলতার সূক্ষ্মতা। গান্ধীর ভাষ্য অনুসারে, ‘নিজেকে অন্ধকূপে নামানোর পাপকর্মে লিপ্ত না হয়ে, কোনও মানুষ অন্যকে সেই কূপে নামাতে পারে না।’ মানবসমাজ অবিভাজ্য, সেইজন্য প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের প্রতি ও অন্যদের প্রতি দায়িত্ব আছে; এই যৌথ ভূমিকা যথাযথ পালন করবার জন্য ব্যক্তিকে নিজের জীবনধারণ সম্বন্ধেও সচেতন থাকতে হবে।
সামাজিক নির্যাতন ও শোষণ-বিষয়ে গান্ধীর অভিমতের মূলে রয়েছে মানবসমাজের অবিভাজ্যতা সংক্রান্ত তাঁর প্রত্যয়। সব প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়, ভারতবর্ষে এবং অন্য রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী, এবং প্রত্যেক সমাজে ধনকুবের ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা, এই ধারণা নিয়ে চলেন যে, তাঁদের নানা নিপীড়নমূলক আচরণ কোনও ভাবেই তাঁদের নিজেদের ক্ষতিবৃদ্ধির কারণ হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে, সে-লাঞ্ছনা ও অবমাননা নিপীড়তকে যতটা নীচে টেনে নামায়, ততটাই টেনে নামায় নিপীড়নকারীকেও, নিপীড়নকারীর ক্ষতির পরিমাণ কখনও–কখনও নিপীড়তের চেয়েও বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় প্রথমে তাঁদের নিজেদের বিশ্লেষণী আত্মবিচারের শক্তি, নিরপেক্ষ আত্মসমীক্ষার ক্ষমতা, প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত না ক’রে, নিজেরাই নৈতিক দম্ভ, ব্যাধিগ্রস্ত আতঙ্ক এবং অবাস্তব ধ্যানধারণার শিকার না হয়ে, কখনওই কৃষ্ণনাঙ্গদের তঁদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত অথবা তাঁদের আত্মসম্মানবোধ হরণ করতে পারতেন না। কৃষ্ণনাঙ্গদের উপর পাশবিক আচরণ করতে গিয়ে তাঁরা নিজেদের উপরেও পাশবিক আচরণ ক’রে বসতেন; চরম ঔদ্ধত্যের কারণে তাঁরা এটুকুও বুঝতে পারতেন না যে, কত দুঃখময় ও অগভীর হয়ে পড়েছে তাঁদের নিজেদের জীবন। তাঁদের জীবনযাত্রা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হলেও, তা না করতে পেরেছিল তাঁদের উন্নত মানুষ, না সুখী। একই পরিণতি হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকদেরও। তাঁরাও তাঁদের প্রজাদের প্রথমে ‘মেয়েলি’ ও ‘শিশুসুলভ’, অকিঞ্চিৎকর, না মনে করলে, নিজেদের প্রবল বিক্রমশালী ও আবেগবর্জিত পুরুষসিংহ মনে করতে পারতেন না; বাস্তবকে বিকৃত করতে না পারলে, তাঁদের নিজেদের ভিতরের সুপ্ত সম্ভাবনা বিনষ্ট করতে না পারলে, পুরুষসিংহের স্বরচিত আকৃতির মুখোমুখি হওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হত। প্রজাদের ভুল ভাবে চিত্রিত করতে গিয়ে তাঁরা নিজেরাও ভুল চিত্রণের শিকার হয়ে, স্বনির্মিত ফাঁদে পা দিতেন। তদুপরি, স্বদেশে ফিরে গিয়েও তাঁরা সরকারের ওই আদবকায়দা, বদভ্যাস ও রীতিনীতি নিয়ে ফিরতেন, এবং নিজেদের সমাজকে দূষিত করতেন। ঔপনিবেশিকতা শাসকদের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধি সুনিশ্চিত করেছিল এ-কথা সত্য, কিন্তু এই স্বার্থসিদ্ধির জন্য, বৃহত্তর ও বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের মূল্য চোকাতে হয়েছে। মানুষের কল্যাণ যেহেতু অবিভাজ্য, সেহেতু যে–কোনও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় কোনও পক্ষই জয়ী হতে পারেন না, উভয়ই পরাজিত, এবং, সেইজন্য উভয় পক্ষের স্বার্থেই অব্যবস্থার পরিসমাপ্তি কাম্য।
চতুর্মাত্রিকতা
পাশ্চাত্য চিন্তায়, মানুষকে কোথাও দ্বিমাত্রিক প্রাণী, অর্থাৎ শরীর ও মনের সমাহার রূপে তত্ত্বায়িত করা হয়েছে, আবার অন্য কোথাও, আরও একটি উপাদান, আত্মা (সোল) সংযুক্ত করে, ত্রিমাত্রিক প্রাণী রূপেও তাকে কল্পনা করা হয়েছে। ভারতবর্ষের একাধিক ঐতিহ্যে, তত্ত্ব কিছুটা ভিন্ন। এই ভাবনাসূত্রগুলির কিছু-কিছু অনুসরণ ক’রে, গান্ধী, মানুষকে এক চতুর্মাত্রিক প্রাণী রূপে দেখেছেন (তথ্যসূত্র নির্দেশ: ‘দ্য মরাল অ্যান্ড পলিটিকাল রাইটিংস অফ্ মহাত্মা গান্ধী’ / সম্পাদনা: রাঘবন আয়ার)। মানুষ শরীরের অধিকারী, যা, অস্তিত্বসঙ্ক্রান্ত বিদ্যার (অন্টোলজি)দৃষ্টিকোণ থেকে, দু’টি তাৎপর্য বহন করছে। শরীর আত্ম-আবদ্ধ(সেল্ফ-এন্ক্লোজ়ড), স্বতন্ত্র, অন্য শরীর থেকে স্পষ্ট পৃথকীকৃত, এবং কেবল নিজের পার্থক্যকে প্রতিষ্ঠিত ক’রেই, নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে রক্ষা ক’রে চলে। এই কারণে, এটি মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতার ভ্রান্ত ধারণার উৎসও বটে; এর থেকে তাঁর অন্তরে একটা ভ্রান্ত বোধ জন্মায় যে তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্যদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপন কেবল বিশেষ কোনও পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত, এবং সেই অর্থে বাহ্যিক। অন্যদিকে, শরীর ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্র, সেইজন্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে জড়িত সমস্ত রকমের কামনাবাসনার উৎসমুখও বটে। ইন্দ্রিয় নৈসর্গিক ভাবে অবাধ্য ‘পাগলা ঘোড়া’র মতো, সংযম-বর্জিত। মানুষের কামনাবাসনাও একই রকমের, তাকে অনন্ত পর্যন্ত টেনে প্রসারিত করা সম্ভব, অন্তহীন পিপাসা তার নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্য।
শরীর ছাড়াও, মানুষের মন(মানস) আছে। এ-প্রসঙ্গে গান্ধীর ধারণাগুলি অতিদুরূহ এবং কোথাও-কোথাও দ্ব্যর্থক। মানসের মধ্যে চেতনাও অন্তর্গত, যার আরম্ভ ব্যক্তির জন্মমুহূর্তে ও সমাপ্তি মৃত্যুলগ্নে। মানসের আরও একটি উপাদান, বুদ্ধি, যার প্রকাশ ঘটতে পারে নানা ভাবে ও নানা স্তরে, এবং যা, প্রভেদ শনাক্ত করার ক্ষমতা, বিশ্লেষণী শক্তি, অন্তর্দৃষ্টি ও স্বজ্ঞা (ইন্টুইশন্)প্রভৃতি, অন্য অনেক বৃত্তি জাগ্রত করতে পারে। মানস-এর অন্য অনেক ক্ষেত্র আছে, যেমন ভাবাবেগ(প্যাশন্), ভাবনা, স্মৃতিশক্তি এবং মেজাজ(মূড)।মানস, গান্ধীর বিবেচনায় জ্ঞানার্জন ও কর্মসিদ্ধির একটি উপায়, তিনি উপাদানটিকে বুঝতে চাইতেন, তাকে নিয়ন্ত্রণে এনে কীভাবে জীবনের পথে চলা যাবে, সেই প্রসঙ্গে ভাবতেন। মানস শরীরের থেকে পৃথক হয়েও তার সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে যুক্ত। জগৎসংসার থেকে আহরিত অভিজ্ঞতার আলোয় মানুষের মনে অহং-এর(ঈগো)উদয় হয়, যা মানুষের আত্মপরিচয়, প্রতিনিধিত্ব ও বিশিষ্টতার উৎস। মানুষের অহং যেহেতু নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় ও সাময়িক প্রবহমানতা রক্ষা করতে সদাসর্বদা সচেষ্ট, সেহেতু নৈসর্গিকভাবে মনও সর্বদা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে, কখনও তা চঞ্চলতায় আক্রান্ত, কখনও নিরাপত্তাহীনতায়। মন, স্মৃতির ‘ভিড়ে’ দিশাহারা, অতীতের জন্য আবেগে ‘ভারাক্রান্ত’, ভবিষ্যতের ভাবনায় আবিষ্ট; মন, তার স্বাভাবিক নমনীয়তা ও নীরবতা আস্বাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
মানুষের তৃতীয় মাত্রা আত্মা । সাধারণত, ইংরেজি অনুবাদে আত্মা হয়ে দাঁড়ায় ‘সোল’, এবং যদিও স্বয়ং গান্ধী ‘সোল’ শব্দটিই কখনও-কখনও ব্যবহার করেছেন, তবু, ‘স্পিরিট’ শব্দটি আত্মা-র যথার্থ তর্জমা ব’লে মনে হয়। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেকটি জীবদেহে মহাজাগতিক চেতনা বিরাজমান। জীবদেহে মহাজাগতিক চেতনার প্রকাশ ঘটলে তা আত্মা নামে পরিচিত হয়; আত্মা পবিত্র। গান্ধীর ভাবনানুসারে, কেবল মানুষ নয়, সব জীবদেহে আত্মা বিরাজমান, এবং সব জীবদেহেই আত্মা অভিন্ন; তাঁর প্রকৃতি ‘স্ফুলিঙ্গের’ মতো নয়, মহাজাগতিক চেতনার অংশও নয়, যেমন খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বে কখনও- কখনও বলা হয়। আত্মা , এক ও অভিন্ন, সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে সামগ্রিক ভাবেই তা মহাজাগতিক চেতনা রূপে উপস্থিত। গান্ধী বলতেন, ‘আমাদের একটাই আত্মা আছে’ এবং ‘শেষত, আমরা সকলে এক ও অভিন্ন’। আত্মা-র একটি উপযুক্ত প্রতীক হিসাবে যেহেতু তিনি হৃদয়কে ধার্য করেছিলেন, সেহেতু, প্রায়শ শব্দ-দুটিকে তিনি একে অপরের বিকল্প রূপে ব্যবহার করতেন।
মহাজাগতিক চেতনার প্রকাশ হওয়ার কারণে, আত্মা-য় সে-চেতনার নানা লক্ষণ দেখা যায়। মহাজাগতিক চেতনার মতোই আত্মা বস্তুপিণ্ড নয়, সামগ্রী নয়, প্রাণী নয়, বরং তা এক ‘শক্তিপুঞ্জ’, এক ‘কর্মশীল নীতি’,এক ‘পরমজ্ঞানী তেজরাশি’। আত্মা অজর ও অক্ষয়, একইসঙ্গে কর্মশীল ও প্রত্যক্ষদর্শী, সমস্ত অস্তিত্বের ভিত্তিভূমি। আত্মা-র নিয়তি, অথবা অন্যভাবে প্রকাশ করতে গেলে,আত্মা-র পরিণতি হল, নিজের ও মহাজাগতিক চেতনার সংযোগের সূত্র সন্ধানের পর তাতে লীন হয়ে যাওয়া; বিশেষের মায়াবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ ক’রে নির্বিশেষ হয়ে-ওঠাকে, শাস্ত্রমতে গান্ধী যাকে মোক্ষ নামে চিহ্নিত করেছিলেন।
এতদূর পর্যন্ত, ধ্রুপদী ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে, বিশেষত অদ্বৈতবাদী ধারার সঙ্গে, গান্ধীর ভাবনা মিলে যায়। এরপর, ধারণাটি তিনি নিজের প্রয়োজনে ঈষৎ ঘুরিয়ে নেন, প্রস্তাব করেন, মহাজাগতিক চেতনা যেহেতু সব জীবদেহে, বিশেষত সব মানুষে প্রবাহিত, সেহেতু, সেই মহাজাগতিক চেতনার সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগস্থাপন ক’রে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতে গেলে সার্বজনীন প্রেম ও জনসেবার ব্রতপালনের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। মোক্ষ–র সনাতন ধারণার সঙ্গে একদিকে মানবতাবাদীর বার্তা, অন্যদিকে পার্থিব জগতের লক্ষ্যকে মিশ্রিত ক’রে, আধ্যাত্মিকতাকে নীতিধর্ম-দ্বারা পুনর্সংজ্ঞায়িত ক’রে, ভারতীয় ঐতিহ্যকে গান্ধী এমনভাবে সমাজকল্যাণমুখী ক’রে তোলেন যে একইসঙ্গে তাঁর কপালে জোটে দেশবাসীর প্রশংসা ও নিন্দা।
আত্মা মহাজাগতিক চেতনার ক্ষুদ্রাংশ নয়, স্ফুলিঙ্গ মাত্র নয়, বরং সমগ্র ─ এই বিশ্বাস , অন্য অনেক ধ্রুপদী লেখককে যেমন এক সময়ে আগ্রহী ক’রে তোলে, তেমনই গান্ধীকেও, আধ্যাত্মিক শক্তির একটি ব্যতিক্রমী ধারণা গ’ড়ে তুলতে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর বিবেচনায় আত্মা প্রাণ নয়, কোনো সামগ্রী নয়, বরং একরকম বল, শক্তিপুঞ্জের উৎস বিশেষ। শরীর যেমন শারীরিক বলের উৎস, ঠিক তেমনই আত্মা আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। আত্মা ও মহাজাগতিক চেতনা যেহেতু অভিন্ন, সেহেতু মহাজাগতিক চেতনার অসীম শক্তিপুঞ্জে আত্মা-র প্রবেশাধিকার সব রকম বাধামুক্ত, যার এক ভগ্নাংশ ব্যবহার করতে পারলে অভাবনীয় সুফল ফলতে পারে। অন্য অনেক ভারতীয় চিন্তকের মতোই গান্ধী যুক্তি পেশ করেন, ব্যক্তি যদি নিজের বিশিষ্টতার মায়া-আবরণ বর্জন করতে পারেন, ত্যাগ করতে পারেন আমিত্ব, এবং হয়ে উঠতে পারেন মহাজাগতিক চেতনার স্ফটিকসম স্বচ্ছ মাধ্যম, তা হলে নিজের মধ্যে তিনি অপরিমিত আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চারিত করতে সক্ষম হবেন এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা তিনি তাঁর নিজের জনগোষ্ঠীর উপর সুগভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। যীশু খ্রিস্ট, হজরত মহম্মদ এবং গৌতম বুদ্ধ তাঁদের নিজেদের অনুগামীদের উপর যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তার পিছনে ছিল শক্তিসঞ্চয়ের এই গোপন সূত্রটি, এমনই ছিল গান্ধীর অভিমত। গান্ধীও আজীবন এই পদ্ধতি অবলম্বন ক’রে নিজের মধ্যে সেই আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চারিত করবার প্রয়াসে নিযুক্ত ছিলেন, যে কারণে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে নৈতিক শুদ্ধতা অর্জনের অন্বেষণ এত গভীর ভাবে সম্পৃক্ত।
শেষত, প্রত্যেক মানুষের অন্তরে বিভিন্ন প্রবণতা, মেজাজ প্রভৃতি দ্বারা নির্মিত এক স্বতন্ত্র মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক গঠন আছে, যাকে স্বভাব নামে চিহ্নিত করা যায়। গান্ধীর কাছে, এটি এক বাস্তব অবস্থা যে, জন্মলগ্ন থেকেই ব্যক্তির আচরণে বিভিন্ন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক ঝোঁক, বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা, বিভিন্ন বস্তুর প্রতি আকর্ষণ ও বিকর্ষণ লক্ষ করা যায়, এবং ব্যক্তি, অন্তরের এই প্রবণতাগুলি স্বীকার ক’রেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠেন। অস্তিত্বসঙ্ক্রান্ত বিদ্যার (অন্টোলজিকাল)দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিশিষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত এই কারণে যে, এটি ব্যক্তিপরিচয়ের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং দ্বিতীয়ত, সব ব্যক্তিই সামগ্রিক মানবপ্রকৃতিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ ক’রে নিয়েছেন। সেই সমগ্রতা বহু ব্যক্তিসত্তাকে একসাথে ধ’রে রাখার সঙ্গে-সঙ্গে অস্তিত্বসঙ্ক্রান্ত বিদ্যার প্রেক্ষিতে ব্যক্তির বিশিষ্টতার পরিচয়ও তুলে ধরে।
ব্যক্তিমানুষের এই অদ্বিতীয় প্রকৃতি সম্যক বোঝার প্রয়োজন আছে। ঈশ্বর, এর উৎস হতে পারেন না, কারণ সব মানুষকেই তিনি সমান ভালবাসেন এবং সেইজন্য বিভিন্ন সম্পদ, ভিন্ন-ভিন্ন পরিমাণে, তিনি বিভিন্ন জনকে তুলে দেবেন, তার কোনো যুক্তির ভিত্তি নেই। পিতামাতাও এর উৎস হতে পারেন না, কারণ অনেক সময়ে তাঁদের স্বভাব–এর সঙ্গে সন্তানদের স্বভাব–এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রায় প্রতিটি প্রধান ধারাকে অনুসরণ ক’রে গান্ধী এমন একটি প্রস্তাব (হাইপথেসিস্) রাখেন যে, ব্যক্তির স্বভাব তাঁর পূর্বজন্মের ফল। রক্তমাংসের শরীর ছাড়াও মানুষের একটা সূক্ষ্মশরীর আছে, সূক্ষ্ম অপার্থিব একটি ‘দেহ’ বা ব্যক্তিত্ব আছে। মৃত্যুর পরেও এই সূক্ষ্মশরীর ব্যক্তির সঙ্গে রয়ে যায়, বেশ কয়েকটি জন্মচক্র জুড়ে তার উপস্থিতি, এবং এটিই ব্যক্তির অদ্বিতীয় পরিচয়ের, তাঁর স্বভাব–এর ভিত্তিভূমি। জন্মান্তর বলতে ভুলবশত আমরা যাকে আত্মা-র মহাভিপ্রয়াণ (ট্রান্সমাইগ্রেশন্) বুঝি, প্রকৃতপক্ষে তা সূক্ষ্মশরীরের মহাভিপ্রয়াণ। কোনও ব্যক্তি পূর্বজন্মে যেমন জীবনযাপন করেছিলেন তার কিছু ‘রেশ’ অথবা ‘ছাপ’ রয়ে যায়, সেগুলি দিয়েই তাঁর বর্তমান জীবনের সূক্ষ্মশরীর গঠিত এবং ব্যক্তির এই অপার্থিব ‘দেহ’ তাঁর অতীতকালের কর্মের সুফল এবং কুফল একযোগে ধারণ করছে। এই কারণে, বর্তমান জীবনে অতীতের কুকর্মের প্রতিকার করা সম্ভব। এই মর্মে নিজের কুকর্মের প্রতিকার করবার ইঙ্গিত দিলেও, সূক্ষ্মশরীর আত্মসংশোধনের লক্ষ্যে, ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বাধ্য করে না।
গান্ধী এমনও মনে করেন, ব্যক্তির স্বভাব–এর মতোই কর্মফলতত্ত্ব-এও জন্মান্তরবাদ উহ্য রয়েছে। আমরা পূর্বেই দেখেছি, মহাজাগতিক চেতনা নিয়মানুবর্তী, এবং তা শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে কাজ করে, প্রাকৃতিক বিশ্বেই কেবল নয়, নীতিধর্মের জগতও কিছু-কিছু অপরিবর্তনীয় নিয়মাবলীর অধীন। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামধর্ম অনুসারে ব্যক্তির মৃত্যুর পর ঈশ্বর তাঁর বিচার করেন, এবং সে-ব্যক্তি কীভাবে তাঁর জীবন ধারণ ক’রে গেছেন তার ভিত্তিতে তাঁকে স্বর্গে অথবা নরকে পাঠানো হয়। অন্য একাধিক ভারতীয় চিন্তকের মতোই, এই বিশ্বাস গান্ধীর অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছিল। এই বিশ্বাস এক বিশেষ পূর্বানুমানের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, ঈশ্বর এক ব্যক্তিবিশেষ, যা পূর্বে উল্লিখিত কারণবশত, গ্রহণযোগ্য নয়। তদুপরি, এটিও উহ্য রয়েছে যে, ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করবার কোনও সুযোগ পাচ্ছেন না, কারণ বিচারটাই ব্যক্তির মৃত্যুর পরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গান্ধীর দৃষ্টিতে ঈশ্বর, অথবা আরও স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে, মহাজাগতিক চেতনা, কোনও ব্যক্তিসত্তা নন, এক আইনি শৃঙ্খলা, এবং এই নিয়মাবলীর কার্যপ্রণালী অনুসারে, প্রতি ব্যক্তির প্রতিটি ক্রিয়ার অনিবার্যভাবে ফল ফলবে। ব্যক্তিকে যেহেতু তাঁর প্রতিটি ক্রিয়ার ফলের দায়িত্বগ্রহণ করতে হয়, এবং যেহেতু সব ক্রিয়ার সম্মিলিত ফসলের ভার বিপুল, সেহেতু একটি জীবনের দৈর্ঘ্য যথেষ্ট নয়, বেশ কয়েকটি জন্মচক্র পেরিয়ে যাবার পরই বারবার জন্মগ্রহণের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
অতএব, গান্ধীর দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে এক চতুর্মাত্রিক প্রাণী, তার অধিকারে রয়েছে একটি শরীর, একটি মন (মানস), অপার্থিব উপাদান দ্বারা গঠিত একটি স্বভাব, এবং (স্পিরিট) আত্মা । শরীর লাভ হয় জন্মমুহূর্তে, এবং মৃত্যুকালে তা বিনষ্ট হয়। ব্যক্তির মন কিছু-কিছু প্রবণতা সংগ্রহ করে স্বভাব থেকে, আর বাকিটা জড়ো হয় জীবনের পথে চলতে-চলতে; শরীর ও মন সমবয়সী। স্বভাব, অথবা ব্যক্তির সূক্ষ্ম, অপার্থিব ব্যক্তিত্ব, রূপান্তরের ভিতর দিয়ে গেলেও, কয়েকটি জন্ম জুড়ে সক্রিয় থাকে এবং এখানেই ব্যক্তির বিভিন্ন কালখণ্ডব্যাপী আত্মপরিচয় অধিষ্ঠান করে। চতুর্থত, আত্মা , যাকে ইংরেজিতে ‘স্পিরিট’ অথবা ‘সোল’ নামে চিহ্নিত করা যায়, অন্যদের থেকে এই জন্য ভিন্ন যে, তা অজর, অক্ষয় এবং সব জীবদেহে অভিন্ন। শরীর ও আত্মা পরস্পরের সব চেয়ে দূরে অবস্থিত, এবং মন যেমন এদিকে টান অনুভব করে, ঠিক তেমনই ওদিকেও। মন শরীরের নির্দেশ মানবে, না আত্মা-র, সেটা নির্ধারণ করে ব্যক্তিরস্বভাব। ব্যক্তির শরীরে তাঁর বিশেষতা অধিষ্ঠিত। শরীর ব্যক্তিকে নিজের মধ্যে বন্দী ক’রে রাখে, ব্যক্তি যে অন্য সকলের চেয়ে পৃথক, এই বোধের উপর আরও জোর দিয়ে, শরীর ব্যক্তির স্বার্থপরতাকে ইন্ধন যোগায়। এর ঠিক বিপরীতে, আত্মা প্রতিনিধিত্ব করে সার্বজনীনতার, আমিত্বের প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে এসে, অন্য সমস্ত প্রাণীর সঙ্গে একাত্ম বোধ করবার জন্য ব্যক্তিকে উৎসাহ দিয়ে চলে। শরীর-ভিত্তিক বিশেষতার মায়াবন্ধন ত্যাগ করা খুবই কষ্টসাধ্য, এর জন্য কঠোর আত্মসংযমের, ইন্দ্রিয়দমনের, অবিরাম আত্মানুসন্ধানের,ধ্যানের,আধ্যাত্মিকঅনুশীলনের এবং দৈবানুগ্রহের(ডিভ়াইন গ্রেস)প্রয়োজন হয়। শেষোক্ত দৈবানুগ্রহের জন্য একাধিক ভারতীয় ঐতিহ্য কোনও বিশিষ্ট স্থান নেই, কিন্তু গান্ধী একে গুরুত্ব দেন। তাঁর উপর বৈষ্ণবধর্ম-এর গভীর প্রভাব ছিল, তার সঙ্গে তিনি সনাতন খ্রিস্টধর্মের ‘গ্রেস’ মিশ্রিত ক’রে দৈবানুগ্রহের ধারণা সৃষ্টি করেন।
সব মানুষেরই আধ্যাত্মিক গন্তব্য মোক্ষ ; লক্ষ্য অভিন্ন হলেও; প্রত্যেকেই তাঁদের অন্তরস্থ স্বতন্ত্র মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক গঠন অনুসারে নিজস্ব পথ কেটে সেই অভিন্ন গন্তব্যে উপনীত হন। আরম্ভের সময় প্রথমেই নিজেদের অবস্থা তাঁদের স্বীকার ক’রে নিতে হবে, নিজস্ব গতিপ্রকৃতি শনাক্ত করতে হবে, তারপর অনুকূল গতিতে অনুসারে, নিজেদের পক্ষে অনুকূল পথ ধ’রে, সাধারণ গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হতে হবে। যে আধ্যাত্মিক অনুশীলন, ব্রত ও নিয়ম পালন, ধর্মাচরণ, অথবা জীবনধারণ প্রণালী একজনের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ইতিবাচক ফল দেয়, তা অন্যের পক্ষে ক্ষতিসাধক হতে পারে।
এই কারণে, সব ধর্মমতের মধ্যে একটিই শ্রেষ্ঠ, অথবা মুক্তিলাভের মাত্র একটিই পথ উন্মুক্ত, এই ধারণা অসঙ্গতিপূর্ণ। সব মানুষকে এক ভাবে জীবনযাপন করবার নীতি নির্ধারণ করলে অস্তিত্বসঙ্ক্রান্ত শাস্ত্রের অন্তর্নিহিত সত্যকে লঙ্ঘন করা হয়; ব্যক্তি প্রকৃত পক্ষে যা নন, তাঁর প্রতি সেই আচরণ করা হয়। নিজস্ব স্বভাব আবিষ্কার করা, এবং উন্নতির কো্ন্ আধ্যাত্মিক পথ নিজের পক্ষে শ্রেয় তা নির্ধারণ করা, উভয়ই, প্রত্যেক মানুষের পক্ষে জরুরী কর্তব্য। এঁর অর্থ এই নয় যে, অন্যরা ব্যক্তিকে তাঁর অন্বেষণে সহায়তা করবেন না, বা করতে পারবেন না। ব্যক্তির স্বভাব তাঁর আচরণে ও তাঁর জীবনপ্রণালীতে প্রতিফলিত, এবং সেই সূত্র অনুসরণ ক’রে আরও বলা যায়, ব্যক্তির বন্ধুবর্গ, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা, এবং মুখ্যত, আধ্যাত্মিকতায় আলোকপ্রাপ্ত তাঁর গুরু, তাঁর অন্তরের স্পন্দন অনুভব করতে পারবেন, অন্তরস্থ প্রবণতা ও মেজাজ শনাক্ত ক’রে উপযুক্ত উপদেশ দিতে পারবেন। যদিও, ব্যক্তি সে-উপদেশ চেয়ে নেবেন কি না, প্রাপ্ত উপদেশ দ্বারা চালিত হবেন কি না, সবই ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের অন্তর্গত। তিনি যদি সে-উপদেশ প্রত্যাখ্যান করেন, এবং পরে তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়, সেই অধিকারও একান্ত ভাবে তাঁরই, কেবল এই কারণে নয় যে, তাঁর জীবনটা তাঁর নিজস্ব, এবং নিজের নৈতিক স্বার্থ-বিষয়ে তিনিই সবচেয়ে ভাল বোঝেন (যেমন উদারপন্থীরা সাধারণত তর্ক ক’রে থাকেন), বস্তুত,এই জন্যও যে, অস্তিত্বসঙ্ক্রান্ত শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্যক্তি অদ্বিতীয়। তাঁর বিশেষ অবস্থানের প্রতি তখনই শ্রদ্ধাশীল হওয়া সম্ভব, যখন দেখা যাবে তাঁর মতামত ও জীবনপ্রণালী সরাসরি তাঁর বিশ্ববীক্ষা থেকে উঠে এসেছে এবং সেই মতামত তাঁকে, এবং তাঁর বোধে যা সত্য, তাকেই প্রতিফলিত করছে। এই কারণে সৎপরামর্শদান ও বলপ্রয়োগের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ লক্ষণীয়। সৎপরামর্শদান বলপ্রয়োগের মতো আদৌ নয়, একজনের সৎপরামর্শদান অন্যের সম্পূর্ণতাবোধকে সমাদর এবং আরও শক্তিশালী করে, ব্যক্তি কর্তৃক নতুন দৃষ্টিতে জগত দেখা যাতে ব্যক্তির রূপান্তরিত অস্তিত্বে দৃঢ়রূপে প্রোথিত হয়ে তারপর সেখান থেকে পল্লবিত হয়, তা সুনিশ্চিত করে। যে–কোনও রকম বলপ্রয়োগে গান্ধী ঘোর অকল্যাণ দেখতেন, এবং মনে করতেন বলপ্রয়োগ কেবল তখনই সহনীয় যখন কোনও প্রবল সামাজিক সঙ্কট রোধ করবার আর কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। আর তখন, সেই বলপ্রয়োগ যে ব্যক্তির ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যপ্রতিষ্ঠাকে সরাসরি আঘাত করেছে, এবং, অনভিপ্রেত হলেও, তার যে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা যেন সুমিষ্ট বাক্য দিয়ে আড়াল করা না হয়।
অন্য অনেক ভারতীয় দার্শনিকের মতোই, গান্ধী, স্বাধীনতা-অর্জনকে কে সত্যের নিচে স্থান দিতেন। অস্তিত্বসঙ্ক্রান্ত শাস্ত্রের সূত্র অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তি যেহেতু অদ্বিতীয়, সেহেতু আত্ম- আবিষ্কারের জন্য, নিজের গতি অনুসারে নিজের অন্তর্জীবনের উন্নতিসাধনের জন্য, স্বাধীনতা প্রয়োজন। স্বাধীনতা এক ভিত্তিভূমি এবং নিজের প্রতি সৎ থাকবার এক আবশ্যিক পূর্বশর্ত। ব্যক্তিকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার অর্থ নিজের প্রতি অসৎ হতে তাঁকে বাধ্য করা, অন্যের মতে যা সত্য সেই পথে তাঁকে চলতে বাধ্য করা, এবং তাঁর অন্তরে মিথ্যার বীজ রোপণ করা। গান্ধীর কাছে মুক্তির অন্বেষণের প্রসঙ্গটি সরল; মুক্তির অন্বেষণ ও সত্যোন্বেষণ এক ও অভিন্ন। সত্যকে সম্মান জ্ঞাপন করার নিহিতার্থ মানুষকেও সম্মান করা, কারণ নির্দিষ্ট কালখণ্ডে চিহ্নিত মানুষকে তাঁর অস্তিত্বের যুক্তিধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা আবশ্যক। সত্যকে সমাদর করতে গেলে অন্য ব্যক্তিকে তাঁর বিশিষ্টতাসহ তাঁকে ভালবাসতে হবে, আমরা তাঁকে যেমন ভাবে দেখতে চাই সেই কল্পিত রূপকে ভালবাসলে চলবে না। ‘মুক্তিলাভের জন্য কাউকে বাধ্য করা’ অথবা কোনও ব্যক্তিকে বিমূর্ত ও নৈর্ব্যক্তিক আদর্শের যূপকাষ্ঠে বলিদান, সত্যের প্রতি নিষ্ঠার সুচিহ্ন নয়।
নীতিধর্মের তত্ত্ব
গান্ধীর মানবপ্রকৃতির তত্ত্বকে (‘থিওরি অফ্ হিউমান নেচার’) তাঁর নীতিধর্মের (‘মরাল থিওরি’)ভিত্তিভূমি রূপে ধরা হয়। আমরা দেখেছি, তাঁর নৈতিকতার বোধ সমস্ত জীবদেহের সেবা এবং তাদের সকলের সঙ্গে একাত্ম বোধ করার মধ্যে নিহিত রয়েছে। নেতিবাচক দিক থেকে এর অর্থ, কোনও প্রাণীর শারীরিক যাতনার কারণ না-হওয়া, এবং ইতিবাচক দিক থেকে অর্থ, প্রথমত ‘প্রত্যেক চোখ থেকে প্রতিটি অশ্রুবিন্দু মুছে দেওয়া’ ও প্রত্যেকের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্ভাবনাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়তাদান। গান্ধীর বিবেচনায়, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মচেতনা, এক ও অভিন্ন। আধ্যাত্মিকতার অর্থ যেহেতু মহাজাগতিক চেতনার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করা এবং সর্বজীবে প্রেমের প্রতিষ্ঠা, সেহেতু এটি অবশ্যই নীতিধর্মসম্মত একটি নৈতিক অবস্থানও বটে। আবার, বিপরীত দিক থেকে দেখতে গেলে, মহাজাগতিক চেতনা প্রোথিত রয়েছে আধ্যাত্মিকতায়, এবং তা মহাজাগতিক চেতনায় পূর্বস্বীকৃত। গান্ধীর যুক্তিপরম্পরা সহজবোধ্য নয়। তিনি হয়তো ভেবেছেন, সর্বজীবে অটল ও নিঃস্বার্থ সেবা যেহেতু নৈতিকতার এক আবশ্যিক শর্ত, সেহেতু ব্যক্তির অন্তরে আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি না থাকলে, এতটা উদ্যোগ, এতটা তীব্র আবেগ, এতটা শক্তিক্ষয়ের কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি একবার বলেছিলেন, নীতিজ্ঞানঋদ্ধ ব্যক্তি একজন পেশাদার যোদ্ধার মতো, এবং তাঁর বিপরীতে, একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এক সর্বত্যাগী দেশপ্রেমিক। উভয়ই সুকর্মে নিযুক্ত, কিন্তু তাঁদের উদ্যমের স্বাদ, তাঁদের উপর অন্য মানুষের নির্ভরশীলতা, তাঁদের অঙ্গীকার এবং তাঁদের শক্তিবিচ্ছুরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের।
যদিও সর্বজীবের প্রতি নিষ্কাম সংস্রব নৈতিকতার একটি শর্ত, মানুষের নৈতিক ধারণক্ষমতা সীমিত, অন্য সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান স্বল্প, এবং পুঞ্জিভূত শক্তিও তাঁর অপর্যাপ্ত নয়। এমত অবস্থায়, তিনি যাঁদের পরিচিত, তাঁর উপর যাঁদের প্রত্যাশা রয়েছে, তাঁদের উপরেই মনঃসংযোগ করাই তাঁর পক্ষে সমীচীন; সতর্ক থাকতে হবে, অন্যদের ক্ষতি ক’রে নিজেদের স্বার্থরক্ষা যেন অগ্রাধিকার না পায়। যথার্থ নৈতিক জীবন যাপন করতে হলে স্থানীয় প্রতিবেশ ও নিকটস্থ প্রেক্ষিতকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিতে হবে, কিন্তু একই সঙ্গে, এটাও উল্লেখনীয় যে, সার্বজনীন দায়িত্বকে সেই স্থানীয় প্রেক্ষিতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরখ ক’রে নেওয়া দরকার। গান্ধী মনে করতেন, একদিকে, বিমূর্ত বিশ্ববাদ, যেখানে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ কাছের মানুষের প্রতি ব্যক্তির অঙ্গীকার উপেক্ষিত, এবং, অন্যদিকে, বৃহত্তর দায়সমূহ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য ক’রে যেখানে নিকটবর্তী প্রেক্ষিতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শিত, উভয় প্রান্তকে প্রতিরোধ করবার জন্য নিয়মিত আত্মসমীক্ষাই একমাত্র উপায়।
চারপাশের মানুষকে সেবা করার দায়বোধকে, গান্ধী ব্যক্তির স্বতন্ত্র ও পৃথক কোনও কার্যক্রম হিসাবে দেখতেন না, ব্যক্তির সর্বমুহূর্তের ভাবনা রূপে দেখতেন। একজন স্বামী হওয়া, পুত্র হওয়া, একজন বন্ধু, একজন প্রতিবেশী হওয়া, একজন সহকর্মী, একজন নাগরিক, একজন মালিক অথবা চাকুরিজীবী হওয়া, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন ভূমিকা নির্বাহ করা নয়, অথবা স্বতন্ত্র নিয়মবিধি ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিতও নয়, বরং তা ব্যক্তির মানবিকতার প্রকাশ ঘটানো এবং স্বদেশবাসীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের ভিন্ন-ভিন্ন পথ। যেমন, একজন প্রতিবেশী হিসাবে ব্যক্তির উচিত, কেবল পরকে উৎপীড়ন করা থেকে নিজেকে কেবল বিরত রাখা নয়, এগিয়ে এসে পরকে সাহায্যদান, তাঁদের হিতার্থে সক্রিয় ভূমিকা পালন, ঘনিষ্ঠ পরিবেশের উন্নতিসাধনে প্রয়াস, এবং একটি জীবন্ত, উন্নতিশীল লোকসমাজ গ’ড়ে তোলার কর্মকাণ্ডে সক্রিয় যোগদান। ব্যক্তির উপার্জনের ক্ষেত্রেও এমনই মানবিকতা ও জনসেবার মনোভাবের প্রকাশ ঘটা উচিত, যা এক যজ্ঞ–র মতো ক’রে দেখা উচিত, যেখানে ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন নিজের গোষ্ঠীর কল্যাণার্থে, অর্থাগম যার আবশ্যিক ফল হলেও, মূল উদ্দেশ্য নয়। গান্ধী মনে করতেন, ব্যক্তির প্রতিটি ক্রিয়ায় ‘মানবিকতার সৌরভ’ যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, প্রত্যেক মানুষ যদি নিজের ক্ষুদ্র সাধ্যের সীমাবদ্ধতার ভিতরে বসবাস ক’রেও মানবিক সম্পর্কগুলির উন্নতিকল্পে যোগদান করেন, একটি উন্নততর পৃথিবী গ’ড়ে তোলা সম্ভব। কোনও স্বামীহারা নারীকে সান্ত্বনা দান, প্রতিবেশীর সন্তানকে শিক্ষাদান, রোগপীড়িত আত্মীয়ের সেবা, কোনও বিকলাঙ্গ বন্ধুর জন্য বাজারে গিয়ে তার জন্য কেনাকাটা ক’রে দেওয়া ─ এ-সমস্তই ‘নীরব, অনাড়ম্বর সমাজসেবা’র দৃষ্টান্ত। মানুষের দুঃখকষ্টের পাহাড় থেকে ‘একটি মাটির ঢেলা’ সরানো ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা গুরুত্বপূর্ণ সমাজকল্যাণমূলক কোনো মনোলোভা প্রদর্শন অথবা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম; কখনও-কখনও মানবপ্রীতির এই অনাড়ম্বর দৃষ্টান্তগুলির সুফল আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
যখন তুমি সংশয়াচ্ছন্ন, অথবা যখন অহং-এর মাত্রাবৃদ্ধি হয়েছে, এই পরীক্ষাটি ক’রো। সবচেয়ে দুঃস্থ, সবচেয়ে দুর্বল যে মানুষটিকে দেখেছ, তার মুখখানা স্মরণ ক’রো, আর নিজেকে প্রশ্ন ক’রো, যে পদক্ষেপগ্রহণের কথা তুমি ভাবছ সেটা কি তার কোনো কাজে আসবে? এর দ্বারা সে কী কোনওভাবে উপকৃত হবে? নিজের জীবন ও নিয়তির উপর নিয়ন্ত্রণ সে ফিরে পাবে কী ?
নিহিতার্থ
এই পরিচ্ছেদ সমাপ্ত করবার আগে, গান্ধীর মানবপ্রকৃতির তত্ত্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আমরা ফিরে দেখতে পারি। প্রথমত, মানুষ নৈসর্গিক ভাবে পুণ্যবান না পাপিষ্ঠ, সনাতন পাশ্চাত্য ভাবনার প্রতর্কটি, এ-তত্ত্বে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। মানুষের অন্তরে আত্মা বিদ্যমান, ধর্মপরায়ণতা তাঁর প্রকৃতিগত, সেইজন্য গভীরে, তাঁর অভিমুখ মঙ্গলের দিকেই স্থিত। যদিও, এর অর্থ এই নয় যে, মঙ্গলই সর্বদা মানুষের প্রিয় এবং সর্বদা মঙ্গলের পথই তিনি অনুসরণ করেছেন ,কারণ, প্রায়শ তাঁর মধ্যে প্রকৃত আত্মোপলব্ধির অভাব লক্ষ করা যায়, শরীরভিত্তিক মায়ায় তিনি আচ্ছন্ন, তিনি বিশিষ্টতার ভ্রান্ত ধারণার অধীন। এমনও হওয়া সম্ভব, তাঁর স্বভাব তাঁকে পাপকর্মে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, মঙ্গলকে সম্যক অনুধাবন করা এবং তাকে অনুসরণ করবার ক্ষমতা মানুষের গভীরে প্রোথিত; সে-ক্ষমতা যদি কোনওভাবে তাঁর মধ্যে জাগ্রত করা যায়, মানুষ সে-পথই অনুসরণ করবে।
দ্বিতীয়ত,অধিকাংশ তত্ত্বে সমপ্রকৃতি(হোমোজেনেয়টি) প্রতিষ্ঠিত করবার তাড়নায় মানুষকে এক ধাঁচে ফেলে দেওয়ার একটা ধারা জনপ্রিয়; গান্ধীর তত্ত্ব এই ভ্রান্তি এড়িয়ে যেতে পেরেছে। ওই সমস্ত তত্ত্ব অনুসারে, মানুষের এক বিশেষ প্রকৃতি লক্ষনীয় যা তাঁর জীবনধারণ প্রণালীকে নির্ধারণ করে। সকলের মধ্যেই মূল প্রকৃতি যেহেতু অভিন্ন ব’লে ধ’রে নেওয়া হয়, সেহেতু, মাত্র একরকম আদর্শ জীবনপ্রণালীই স্বীকৃত, যাঁরাই এর বাইরে পড়বেন তাঁদেরই উপর এই জীবনপ্রণালী আরোপ করবার অধিকার জন্মায়। গান্ধীর তত্ত্ব এই বিপদ থেকে মুক্ত। তাঁর তত্ত্বানুসারে, যদিও সব মানুষের অন্তরে আত্মা এক, এবং তাঁদের গন্তব্যও অভিন্ন, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের মতো ক’রে অদ্বিতীয়, তাঁদের অন্তর্বর্তী লক্ষ্য আলাদা, সেখানে উপনীত হওয়ার পথও ভিন্ন। মানুষের পরিচয় এবং মানুষের বৈচিত্র্য, গান্ধীর ভাবনায় উভয়ের উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে, অস্তিত্বসঙ্ক্রান্ত বিদ্যার সূত্রানুসারে স্বায়ত্তশাসন ও বৈচিত্র্যের জন্য পর্যাপ্ত পরিসরের ব্যবস্থা আছে। আমরা আরও লক্ষ করি, ব্যক্তির স্বভাবের বিশিষ্টতাকে তিনি জন্মান্তরবাদের সন্দেহজনক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। আমাদের দিক থেকে এটি প্রত্যাখ্যান না করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই, যদিও একইসঙ্গে স্বীকার করতে হয়, মানবপ্রকৃতির গঠনে মানুষের স্বাভাবিক বৈচিত্র্যকে উপযুক্ত গুরুত্বপ্রদানে গান্ধীর প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়।
তৃতীয়ত, কর্তব্য ও অধিকার-বিষয়ে ইয়ুরোপীয় ভাবনা, এবং কর্তব্য ও অধিকারের কৃত্রিম পরস্পরবিরোধিতা প্রসঙ্গে গান্ধী গভীর অস্বস্তি বোধ করতেন। এইরকম একটা অভিমত প্রচলিত আছে; যে-কোনও অধিকার যেমন কখনও কর্তব্য হতে পারে না, ঠিক তেমনই কোনও কর্তব্য কখনও অধিকার হতে পারে না, আরও বলা হয়, অধিকার স্বাধীনতার এক ক্রিয়া, এবং তার বিপরীতে, কর্তব্য, স্বাধীনতাকে খর্বিত করে। আমরা দেখেছি, গান্ধী প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর বিবেচনায়, একটিকে অন্য থেকে পৃথক করা যায় না, তারা একই মুদ্রার দুই পিঠ, একে অপরকে তারা চালনা করছে। একটি দৃষ্টান্ত, আত্ম-উন্নতি ও স্বায়ত্তশাসন ব্যক্তির অধিকার, কারণ প্রত্যেক ব্যক্তি অদ্বিতীয়, নিজের মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক গঠন অনুসারে নিজেকে চালনা করায় তাঁর কোনও বাধা থাকা অনুচিত। বিপরীত দিক থেকে দেখলে, এটি ব্যক্তির কর্তব্যও, কারণ এটিই সমাজের কাছে অর্ঘ্য তুলে ধরবার একমাত্র উপায়, তাঁর বেঁচে-থাকার মধ্যে সমাজের প্রতি তাঁর ঋণ জমে উঠেছে, তাঁর স্বীকৃতি। আরও একটি উদাহরণ:নিজের সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ সুনিশ্চিত করা ব্যক্তির অধিকারের মধ্যে পড়ে কারণ, সন্তানকে তাঁরাই এই পৃথিবীতে এনেছেন, সন্তানের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য তাঁরা চাইবেনই। অন্যদিকে, এটি কর্তব্যও বটে, কারণ শিশুকে সঠিক ভাবে প্রতিপালন না করলে সে অবহেলিত রয়ে যাবে, আত্মবিশ্বাসী, নৈতিক ভাবে সচেতন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না, এবং অবশেষে সমাজের দৃষ্টিতে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কর্তব্য ও অধিকারের অবিভাজ্যতা প্রকাশ করবার লক্ষ্য নিয়ে গান্ধী বহু অর্থবাহী সংস্কৃত শব্দ ধর্ম বেছে নিয়েছিলেন, যা প্রকৃতি, কর্তব্য এবং অধিকার, তিনটিই বোঝায়। মানুষের প্রতিটি ক্রিয়া যেহেতু একাধারে কর্তব্য এবং আধিকারের মধ্যে পড়ে, এবং প্রতিটি ক্রিয়া যেহেতু একইসঙ্গে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মাত্রাযুক্ত, সেহেতু অধিকারকে সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত এবং সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানসহ ব্যবহার করা সমীচীন। অন্যদিকে, কর্তব্যকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত এবং সেইভাবে পালন করা প্রয়োজন যাতে ব্যক্তির অদ্বিতীয় প্রকৃতি ও বিশিষ্টতার দাবি অক্ষুণ্ণ থাকে(তথ্যসূত্র নির্দেশ : ‘দ্য মরাল অ্যান্ড পলিটিকাল রাইটিংস অফ্ মহাত্মা গান্ধী’ / সম্পাদনা রাঘবন আয়ার)।
চিত্রলিপি– ১) মহাত্মা গান্ধীর ভাতুষ্পুত্র নারায়ণদাসের পুত্র, কানু গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৬)। শৈশব থেকেই মহাত্মার পিছু-পিছু ঘুরতেন ব’লে ‘বাপুর হনুমান’ নামেও তাঁকে ডাকা হত। পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী। আলোকচিত্রশিল্পীদের জগতে তিনি যে কতটা সমাদৃত, সরল প্রকৃতির এই মানুষটির সে-বিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না।
২) ১৯১৭-এ আহমেদবাদের উপকণ্ঠে, সাবরমতীর নদীতীরে মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আশ্রম।
৩) ১৯৩৬ সালে মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নতুন আশ্রম, সেবাগ্রাম।
৪) কস্তুরবা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৪)
৫) মহাত্মা গান্ধীর সার্ধজন্মশতবর্ষের সময়ের সাবরমতী আশ্রম
৬) কানু গান্ধীর তোলা একটি ছবি
৭) কানু গান্ধীর তোলা অগণিত ছবির একটি।
৮ ) সরলাদেবী চৌধুরানী (১৮৭২-১৯৪৫)। ঐতিহাসিক জেরাল্ডিন ফর্বেস জানিয়েছেন যে, কেবল ১৯২০ সালেই মহাত্মা গান্ধী সরলা দেবী চৌধুরানীকে অন্তত ২০০টি চিঠি লিখেছিলেন।
৯ ) মীরা বহন (১৮৯২-১৯৮২)। জন্মসূত্রে অভিজাত ব্রিটিশ পরিবারের কন্যা, ম্যাডেলিন স্লেড।
১০ ) সাবরমতী আশ্রমের একটি পুরানো আলোকচিত্র।
(ক্রমশ)
অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ অনুবাদ প্রবন্ধ সত্যিই পড়লাম ও জানলাম অনেককিছু !
ধন্যবাদ ।