গণতন্ত্রের সাথে কথা বলা <br /> জয়ন্ত ভট্টাচার্য

গণতন্ত্রের সাথে কথা বলা
জয়ন্ত ভট্টাচার্য

রেবেকা চপ (Rebeca S Chopp) তাঁর The Praxis of Suffering গ্রন্থে লিখছেন – “ইতিহাস কেঁপে কেঁপে ওঠে, অতিবৃহৎ সব ঘটনা দিয়ে বিদ্ধ হয় জনতার suffering (ক্লিষ্টতা), স্মৃতিকে তাড়া করে ফেরে ইতিহাসের বলির পশুদের চুপিসার পদক্ষেপ … বুভুক্ষু মানুষের আর্তনাদ, রাজনৈতিক বন্দীদের সুতীক্ষ্ণ চিৎকার এবং নিপীড়িতের নিঃশব্দ স্বর আমাদের প্রাত্যহিক যাপনে ধীর গতিতে, যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।”
যখন কেন্দ্র বা রাজ্যের শাসকের মুখে শুনি বিরোধী শূণ্য রাজনীতি হবে তখন সামান্য চিন্তাও যারা করেন, যাদের মনন এখনও ফসিল হয়ে যায়নি তাঁরা শিউড়ে ওঠেন। গণতন্ত্র মানে ঐতিহাসিকভাবে বহু স্বর, বিভিন্নমুখী মত, মতদ্বৈধতা, তীব্র রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-দর্শনগত বিতর্কের প্রাণবন্ত পরিবেশ। এ বিতর্ক জনসমাজে তথা নাগরিক সমাজে হয়ে থাকে। আধুনিকতার একটি জন্মচিহ্ন এই বিতর্কের পরিবেশ। এই বিতর্ক সজীব চেহারা নেবে সংসদে বা গণভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশনে। যদি এই প্রবাহটি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ভাবতে হবে গণতন্ত্র কি সান্তাক্লজের মতো পোষাকের আড়ালে নিজের রূপ বদলে নিচ্ছে? নাকি নতুন করে গণতন্ত্রের অভ্যুদয় প্রয়োজন – নয়া গণতন্ত্র? বামপন্থী আমেরিকান সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান তাঁর এ প্রিফেস টু পলিটিক্স গ্রন্থে (১৯১৩) বলেছিলেন – “Ours is a problem in which deception has become organized and strong; where truth is poisoned at its source; one in which the skill of the shrewdest brains is devoted to misleading a bewildered people.” (পৃঃ ১০৫) বর্তমান সময়ে এ কথাগুলো দৈববাণীর মতো শোনায়।

Engrafted (বা বাইরে থেকে রোপন করা) মডার্নিটির যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সবাই মানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষ্যণীয় যে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে যে ব্রিটিশ জাত প্রায় ৩৫০ বছর ধরে ধীরে ধীরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে ভারত সেসমস্ত ধাপ অতিক্রম করার জন্য পেয়েছে কয়েক দশক মাত্র। ফলে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ দেশগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথমে ব্যক্তির অভ্যুদয়, পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (secularism) যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা ভারতে হয়নি। যেভাবে শ্রমিক তথা মার্ক্সের ধারণানুযায়ী সর্বাহারা শ্রেণীর এবং পুঁজির সাথে শ্রমের টানাপোড়েন থেকেছে বিভিন্ন স্তরে, যেভাবে দেশগত ভিন্নতা থাকা সত্বেও বিভিন্ন সামাজিক ও শ্রেণী সম্পর্কের মানুষের একটি পাবলিক ডিসকোর্সের পরিসর তৈরি হয়েছে, যেভাবে চার্চ এবং রাষ্ট্র পৃথক হয়েছে, যেভাবে সমাজ জীবন থেকে অপসৃত হয়ে ধর্মানুগত্য ব্যক্তিগত রুচি এবং পরিসরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিকভাবে সেসব তো এখানে হয়নি। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ভারত নামের ভৌগোলিক ভুখন্ডে সামন্ত রাজা, উদীয়মান বৃহৎ শিল্পপতি শ্রেণী, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ওকালতি ও ডাক্তারির মতো বিভিন্ন স্বাধীন পেশার ব্যক্তিদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগ্রামের বিভিন্ন সফলতা ও ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করেছে ১৯৪৭ পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষ।
এধরনের বিভিন্ন সময়-চিহ্নের স্থায়ী ছাপ নিয়ে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হলো সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের ক্ষমতা চিহ্ন। এরকম এক ঐতিহাসিকতায় প্রধানত কৃষিসম্পর্কে আবদ্ধ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রে মডার্নিটি বা আধুনিকতা প্রকৃত অর্থে engrafted হয়ে যায়। ঐতিহাসিকভাবে কয়েকশ বছর ধরে সামাজিক পরিবর্তন ও গতিশীলতার (social and historical dynamics) নিয়মে জন্ম নেয় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার যে সম্পর্ক নতুন করে রচিত হয় ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষে তা প্রায়-সম্পূর্ণ ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংবিধানের ধারায় তৈরি হওয়া।
প্রধানত শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে সমাজ এবং কৌমের ধারণা খসে গেছে প্রায় ৩০০ বছর জুড়ে। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মাঝে সরাসরি সম্পর্ক – অধিকার এবং কর্তব্যের বাঁধনে, cash nexus-এর প্রবল উপস্থিতিতে। এখানে মধ্যস্থতাকারী কোন সামাজিক পরিসর নেই, যা আছে তা নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস। ডেমোক্রাসির স্বর্ণযুগে কিংবা সামাজিক পরিসরের সবল, জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর, কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে – indiscernible থেকে discernible হয়ে ওঠে, invisibility থেকে visibility-র স্তরে উঠে আসে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-৭০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ বা আমেরিকায় প্রায় সর্বব্যাপী তীব্র ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক কালের “অন্য এক পৃথিবী সম্ভব” এবং “Occupy Wall Street” বা গ্রেটা থুর্নবার্গের এককভাবে জন্ম দেওয়া পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এরকম একটা পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার কিংবা অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিকভাবে মান্যতা, গ্রাহ্যতা পায়। বহু ভাষ্যের নির্মাণ হতে থাকে।
কিন্তু সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটাই যদি ভিন্নধর্মী হয়? যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় প্রভুত্বকারী সামন্ত রাজা ও এর উপযোগী পরিব্যাপ্ত মানসিকতা, কৃষি শ্রম, শিল্পীয় শ্রম, শিক্ষিত জায়মান নাগরিক সমাজ, বৃহৎ পুঁজি এবং জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ পর্বে গড়ে ওঠা ছোট বা স্বাধীন পুঁজির মধ্যেকার অসংখ্য বাস্তব দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে? যদি গড়ে ওঠে জাতিস্বত্তার প্রশ্নকে সমাধানের আওতায় না এনে? Integer বা পূর্ণসংখ্যা না হয়ে, কোন ত্রৈরাশিক বা ভগ্নাংশ কিংবা অ-নাগরিক হয়ে কেউ থাকতে পারেনা। আধুনিকতার একটি এবং একমাত্র ভাষ্যেই এদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি সবসময়েই কেন্দ্রাভিমুখী। প্রান্ত এখানে প্রান্তিক, কখনো ব্রাত্যও বটে। অসংখ্য দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত রেখে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য চলমান চরিত্র (দলিলও বলা যেতে পারে) সতীনাথ ভাদুড়ীর সৃষ্টি ঢোঁড়াই। এরকম দলেই পড়বে আমার মতো সুশীল, সুবোধ, গোপাল-বালক গোছের মানুষজন।
ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাষ্য, যা আমাদের দেশে ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে অনুসৃত হচ্ছিল, তার উপাদানের মাঝে (matrix) নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের মতো নাগরিকদের ধরা হবে একেকটি integer বা পূর্ণ সংখ্যা হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশের কোন জায়গা নেই। উদো-বুধোর ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, এসব ভাবার কোন অবকাশই নেই। মণিপুরী বা কাশ্মিরী বলে আবার আলাদা কিছু হয় নাকি? এগুলো তো ভগ্নাংশ। পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়।
এরকম এক social psyche তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা, ক্রিকেট, বলিউডি সিনেমা এবং disciplinary time তথা শৃঙ্খলাবদ্ধ সময়। আবার পূর্ণ সংখ্যা পজিটিভ বা ইতিবাচক হতে পারে, যেমন স্থিতধী, প্রজ্ঞাবতী-প্রজ্ঞাবান সব নাগরিক। পূর্ণ সংখ্যা নেগেটিভও (নেতিবাচক) হতে পারে। ভাবুন দেখি নেগেটিভ পূর্ণ সংখ্যার কি ভারী একখানা দল।
শুরু করি যদি গোরখপুরের শিশু বিশেষজ্ঞ ডঃ কাফিল খানের কথা দিয়ে – সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ না থাকার ফলে কতগুলো বাচ্চা স্রেফ মরে গেলো, নিজের গাঁটের পয়সা দিয়ে গাড়ির তেল পুড়িয়ে বাইরে থেকে অক্সিজেন জোগাড় করে ডাক্তারবাবু বাঁচালেন অনেকগুলো প্রাণ, তারপরে ৮ মাস জেল খাটলেন যেন ওঁর জন্যই অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়নি এমনটা আর কি। আমাদের স্মৃতিতে আসছে কি একটু একটু এ ইতিহাস?
এখানেও তো আবার অন্য বিপদ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে numbing of collective consciousness – বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা, যাকে বলে historical and social amnesia – ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। এই বিস্মরণের জোরেই কিনা ডঃ খানের ভাই যে “অজ্ঞাত পরিচয়” দুষ্কৃতির হাতে মারা গেলো সে কথা বোধ করি আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। পূর্ণ সংখ্যা মানে পজিটিভ পূর্ণসংখ্যা – একখানা গোটা, আস্ত নাগরিক। কিন্তু নেগেটিভ পূর্ণসংখ্যারা কেমন অদ্ভুতভাবে পৃথিবী থেকে, মনুষ্য সমাজ থেকে একে একে খসে পড়তে থাকে – কখনো স্ট্যান স্বামী, কখনো গৌরি লঙ্কেশ নামে, কখনো কালবুর্গী, কখনো আখলাক, কখনো আসিফা, কখনো পানেসার নামে। এগুলো পরিচিত নাম। এর বাইরে রয়েছে অসংখ্য নামগোত্র হীন মানুষ। কি লম্বা মিছিল দেখুন। আমিও দেখি। কিন্তু তাতে হয়েছেটা কি? কি আর হবে! আমাদের যাপিত সময়ের জাগ্রত বিবেক শঙ্খ ঘোষ স্মরণ করিয়ে দেন –

“আর সব উন্নয়ন পরিত্রাণ ঘূর্ণমান অগণ্য বিপণি দেশ জুড়ে
যা দেয় তা নেবার যোগ্য নয়
আমাদের চেতনাই ক্রমে অস্পষ্ট করে সাহায্যের হাত …..
লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।”

কি বিচিত্র বিষয় ভেবে দেখি একবার! নাগরিক-অনাগরিক, ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দী-অহিন্দী, কেন্দ্রের ভারত-প্রান্তের ভারত, আলোর ভারত-আলো-আঁধারির ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লা ছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড ডে মিলের ভারত! উফ, মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এত্ত এত্ত ভারতকে মনে রাখতে হবে? সবাইকে প্রকাশ করতে হবে “তোমারই প্রকাশ হোক”-এর মতো পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? আমার পরিচালক রাষ্ট্র তো সে কথাই বলছে। আমাদের কি আর নেগেটিভ সংখ্যা হবার – এরকম দলভারী মিছিল দেখার পরেও – কোন “সদিচ্ছা” আছে বা থাকতে পারে। “আমরা তো অল্পে খুশি / কি হবে দুঃখ করে / আমাদের দিন চলে যায় / সাধারণ ভাত কাপড়ে!”
হয় তুমি রাষ্ট্র নির্ধারিত সংজ্ঞায় ভারতীয়, কিংবা সে সংজ্ঞার সাথে না মিললে তুমি অ-ভারতীয়। মানে তুমি আধুনিক, থুড়ি, বর্তমান রাষ্ট্রের নিয়ম-টিয়ম মানো তো? আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রথম যুগে মানে ইউরোপে যখন এলায়িত সামন্ত রাজ্য/রাষ্ট্রগুলো নতুন করে জুড়ে এবং বিন্যস্ত হয়ে ধীরে ধীরে আধুনিক শিল্পনির্ভর জাতীয় রাষ্ট্র হয়ে উঠছে সেসময় থেকেই তো অস্তিত্বের অন্যসব স্তর তলিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নাগরিক সত্তার মাঝে। একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ড নিয়ে, তার নিজস্ব আইনকানুন নিয়ে একটি রাষ্ট্র – বহুলাংশেই জনমতের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (যাকে এখন অ্যাকাডেমিক জগতের ভাষায় বলে “manufacturing consent”)।
আরো একধাপ এগিয়ে আবার আমার আপনার মতো কোন অর্বাচীন, অকালপক্ক, অর্ধশিক্ষিত দেখে এর মাঝে hegemony তথা মান্যতা নিয়ে টিঁকে থাকবার নানা রকমের কৃৎ-কৌশল রয়েছে। কৃৎ-কৌশল রয়েছে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্রের হয়ে ওঠার চারিত্র্যলক্ষণের মধ্যে আছে ক্রমশ ঘৃণাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া – শব্দে, চিত্রকল্পে, প্রাত্যহিক সংলাপে। হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী করে তুলতে হবে (spectacularized violence)। ধীরে ধীরে এগুলোকে সহনীয় করে তোলা। নিজের নিয়মেই এসবকিছু সহনীয় হয়েও যায়। যাকে পছন্দ করিনা তাকে ‘দানব’ বানিয়ে দাও (demonization)। সে হয়ে যাবে “অপর” – কখনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু, কখনো নিজের মাটি-জমি-জল-অরণ্য-পাহাড় নিয়ে বাঁচতে চাওয়া প্রান্তিক মানুষ।
ভিক্টর ফ্রাংকেল (Victor Frankl) বরাতজোরে হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে আসা একজন ডাক্তার ছিলেন। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন Man’s Search for Meaning। তাঁর জবানিতে আমরা জানতে পারি যে তিনি যখন প্রথম ক্যাম্পে ঢোকেন তখন আরেক বন্দী তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রতিদিন যেন গাল, মুখ পরিচ্ছন্ন থাকে। রোজ যেন দাঁড়ি কাটেন। কারণ? নাহলে তাঁকে মুসলিমদের মতো দেখাবে – Do you know what you mean by a ‘Moslem’? A man who looks miserable, down and out, sick and emaciated, and who cannot manage hard physical labor any longer … that is ‘Moslem’. Sooner or later, usually sooner, every ‘Moslem’ goes to the gas chamber. কিমাশ্চর্যম! এরকম miserable, emaciated, sick মানুষগুলোও আগে গ্যাস চেম্বারে ঢোকে! কারণ তাদের পরিচয়-চিহ্ন হল দাঁড়ি। এ যেন বর্তমান ভারতবর্ষে পোষাক দিয়ে চেনার মতো ব্যাপার। এবং উভয়ক্ষেত্রেই হতভাগ্য জীবটি ধর্মের দিক থেকে মুসলিম।

নতুন করে সিলেবাস তৈরি হবে। শিক্ষার জগত থেকে, শিক্ষার অন্তর্নিহিত কাঠামো থেকে সরিয়ে দিতে হবে প্রশ্ন করার সাহস, উৎসাহ এবং পরিসর। শিক্ষকেরা হয়ে যাক educational managers, ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার লক্ষ্যে কোন জ্ঞানভিক্ষু নয়। এরপরেও কি গণতন্ত্র বা সেক্যুলারিজম বা ফেডেরালিজম নিয়ে শিক্ষকেরা ছাত্রদের ক্লাসে পড়াতে পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। শুধু স্কুল থেকে বেরোলে দেখা যাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ইউএপিএ বা “দেশদ্রোহীর” তকমা।
একটি সংস্কৃতির জন্ম হবে যার ভিত্তি হবে কেবল তাৎক্ষণিকতা-নির্ভর, শুধুমাত্র বর্তমানকে চিনি বুঝি যাপন করি, অন্য কিছু নয়। অতীতের এবং ইতিহাসের পুনর্নিমাণ হবে। সমাজের অন্ধকার জগৎ (যাদেরকে চালু ভাষায় লুম্পেন বলা হয়) আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেবার, রাষ্ট্রিক ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে।

ভিন্ন প্রেক্ষিতে সমধর্মী এক পরিস্থিতি দেখেছিলেন ফ্রানজ ফ্যানঁ (Frantz Fanon) তাঁর The Wretched of the Earth পুস্তকে। তিনি দেখেছিলেন – “The very same people who had it constantly drummed into them that the only language they understood was that of force, now decide to express themselves with force.”
এরকম এক বিশেষ সময়ে নবারুণের সৃষ্টি “ফ্যাতাড়ু”রাও আর অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারেনা। এরা নিজেরাই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া আত্মীকরণ প্রক্রিয়ার (assimilation) অংশীদার হয়ে যায়। এরা হিংসা আর শক্তি প্রদর্শনের extra-judiciary, extra-state হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এরা “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে”-র সৌম্যকান্তি পাগল চরিত্রটির মতো দুর্বোধ্য “গ্যাৎচরেৎশালা” উচ্চারণ করেনা। এরা স্পষ্ট ভাষায় হিংসা-ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেয় “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যেতে থাকে। আমাদের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে আধুনিকতার এই গল্পগুলো ঠিক তৈরি হচ্ছেনা। অতিরাষ্ট্রের নিজের নির্মাণ করা আখ্যান তৈরি হয়ে চারিয়ে যায় জনসমাজে, জনজীবনের দৈনন্দিন প্রবাহের মাঝে। একটা সময়ে এসে মনে হয় যেন এটাই বাস্তব, এটাই সঠিক। আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে নিউরোনের উপরিতলে। দীর্ঘস্থায়ী গভীরে থাকা স্মৃতি অতলে চলে যায়।
রামচন্দ্র গুহ তাঁর সুবৃহৎ India after Gandhi পুস্তকে মির্জা গালিবের একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছেন। আমাদের জন্য বর্তমান মুহূর্তে বড়ো প্রাসঙ্গিক সে কবিতা –
Sir, you well perceive,
Fidelity and love
Have all departed from this sorry land.
….
Why does not the Last Trumpet sound?
Who holds the reins of the Final Catastrophe?
আমরা বিলক্ষণ জানি, রাজনৈতিক লুম্পেনিকরণ বহুদিন ধরেই চলছে। আমাদের বিবেক, মনন, চেতনা বিদ্ধ হলেও, রক্তাক্ত হলেও আমরা মেনে নিয়েছি বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের আচরণ করছে তাই নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীর প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তাকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেই বিচার যদি পার্টি বা দলের বিচার হয়? কিংবা যদি বিচারের আঙ্গিনায় প্রধান পুরুষ হয়ে দেখা দেয় রাষ্ট্রের প্রসারিত রাজশক্তির পৌরুষ – invisible এবং indiscernible বহুদূরের প্রান্তজন মানুষটির পরিবর্তে? তখন তো ঔপনিবেশিক কালের মতোই বিচারের বাণী নীরবে চোখের জল ফেলতেই পারে। অথচ আমরা কথা বলছি আধুনিকতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে। গণতন্ত্রের এমনই দ্বৈত সত্তা!
বর্তমানের যাপিত সময়ে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত স্তম্ভগুলোকে যদি স্মারকচিহ্নের স্তরে নামিয়ে আনা যায় তাহলে পার্টি এবং বকলমে রাষ্ট্র লালিত extra-judiciary এবং extra-democratic institutions-এর ধারণা জনমানসে নিঃসারে চারিয়ে যায়। লুম্পেনরাজ ঘোষিতভাবে সমাজের চলন, নীতি, নৈতিকতা, ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি পরিসর – সবকিছু নির্ধারণ করবে। আমরা তো জানিই “শীতলকুচি করে দেবো” বা “রগড়ে দেবো” বা “অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড” গড়ে তোলার মতো প্রবল প্রত্যয় এবং অমৃত তথা স্বস্তিবচন। আমরা ধীরে ধীরে সইয়ে নিচ্ছি নিজেদের? এরকম এক সুবোধ, সুশীল “ফ্যাতাড়ু” বাহিনী পেলে আর কারা অন্তর্ঘাত ঘটাবে? এদেরকেইতো নবনির্মিত রাষ্ট্রের প্রয়োজন কিংবা এভাবেই গড়ে নেবে। কিছু নির্মিত চিহ্ন বা শ্লোগানের প্রতি বশ্যতা ও আনুগত্য বোঝাবে পছন্দমতো-গড়ে-নেওয়া দেশ নামক ভূখণ্ডের নাগরিক বা না-নাগরিক। জার্মানিতে স্বস্তি চিহ্ন একসময়ে এই জাতীয় প্রতীকের কাজটি করেছিল। আবার বিপরীত উদাহরণ হিসেবে, লেনিনের রাশিয়ার কাস্তে-হাতুড়ি-তারার চিহ্ন বিশ্বজুড়ে মুক্তির বাতাস আনার প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়েছিল একসময়ে। বর্তমান ভারতে কোনটি প্রতীক হবে – চরকার ব্যঞ্জনা কিংবা সেন্ট্রাল ভিস্টা?
এখানেই রাষ্ট্র, পার্টি ও প্রচলিত আখ্যানের বাইরে গিয়ে জরুরী হয়ে পড়ে একটি তৃতীয় পরিসর গড়ে তোলা। জরুরী অবস্থার সময়ে ভারত জুড়ে পার্টি অস্তিত্বকে অতিক্রম করে সর্বব্যাপী তৃতীয় পরিসর জন্ম নিয়েছিল। এই তৃতীয় বা নাগরিক পরিসর নতুন চিন্তন, সৃষ্টিতরঙ্গ, নতুন কমরেডশিপকে বাস্তবের মাটিতে জীবন্ত চেহারা দিয়েছিল। এই তৃতীয় তথা নাগরিক পরিসরের সজীব উপস্থিতি জেলে অবরুদ্ধ কংসারী হালদারকে নির্বাচনী লড়াই জিতিয়েছে। ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৭৭-৭৮ বা ১৯৮৮-৮৯-এর পশ্চিমবঙ্গে বন্দীমুক্তি আন্দোলনকে সফল করেছে। নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে লাখো লোকের দৃপ্ত পদচারণা পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে। নাগরিক পরিসর না থাকা বা ক্রম-সংকুচিত হবার জন্য আজ দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানের চিত্র ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গের চিত্র এখনো খানিকটা ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে। এখানে “শ্রমজীবী ক্যান্টিন” বা “নো ভোট টু বিজেপি” বা অসংখ্য “কোভিড কমিউনিটি” ইত্যাদির বিভিন্ন স্তরে, অঞ্চলে তৈরি হওয়া এই তৃতীয় পরিসর বা নাগরিক সমাজের সজাগ সম্ভাবনা উন্মোচিত করছে।
এই পরিসরটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ইতিহাস আমাদের কাছে একে প্রাণবন্ত করে সক্রিয় রাখার ডাক পাঠাচ্ছে। আমরা কি শুনছি? চলুন নিজেদের মধ্যে নিবিড় সামাজিক সংলাপ শুরু হোক। শুরু হোক সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে এসে পরস্পরের কথা শোনা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে শিক্ষার্থী সাহিত্যিকদের বলেছিলেন – “When people talk listen completely. Don’t be thinking what you’re going to say. Most people never listen. Nor do they observe.” কথাগুলো এখনও বড়ো সত্যি! আমরা সবাই আরেকবার শিক্ষার্থী হয়ে যাই।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (13)
  • comment-avatar
    bidyut 3 years

    দারুন…

  • comment-avatar
    Sujoy+Chanda 3 years

    অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ

  • comment-avatar
    সুকুমার ভট্টাচার্য্য 3 years

    বিদগ্ধ আলোচনা। সব কথা শেষে এসে এক কথায় প্রকাশ করেছেন হেমিংওয়ের উক্তিটি যথোপযুক্ত উদ্ধৃত করে। ধন্যবাদ, ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।

  • comment-avatar
    Rabin Das 3 years

    “ইতিহাস কেঁপে কেঁপে ওঠে, অতিবৃহৎ সব ঘটনা দিয়ে বিদ্ধ হয় জনতার suffering (ক্লিষ্টতা), স্মৃতিকে তাড়া করে ফেরে ইতিহাসের বলির পশুদের চুপিসার পদক্ষেপ … বুভুক্ষু মানুষের আর্তনাদ, রাজনৈতিক বন্দীদের সুতীক্ষ্ণ চিৎকার এবং নিপীড়িতের নিঃশব্দ স্বর আমাদের প্রাত্যহিক যাপনে ধীর গতিতে, যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।”

  • comment-avatar
    Sudipta Basu 3 years

    অসম্ভব ভালো লিখেছেন। এক কথায় অনবদ্য।

  • comment-avatar
    Sudipta Basu 3 years

    ‘Democracy is a government of the people, by the people and for the people’এটা ভূলে গেছে‌ ক্ষমতালোভীরা।অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ,ধন্যবাদ স্যার

  • comment-avatar
    Soumya Chakraborty 3 years

    Excellent one sir 

  • comment-avatar
    TANMAY+DAS 3 years

    Khubi bhalo laglo. Khubi bhalo . Thank you so much sir

  • comment-avatar
    Dipankar+Sarkar 3 years

    গোটা ভারত তথা পশ্চিম বঙ্গে তৃতীয় পরিসর এ মুহূর্তে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

  • comment-avatar
    Soumya Chakraborty 3 years

    Khub sunder lekha sir. R sei sange Khub prasangik.

  • comment-avatar
    রথীন কুণ্ডু। 3 years

    খুব খুব ভালো লিখেছো। এক কথায় দারুন।

  • comment-avatar
    TANMAY+DAS 3 years

    Darun Darun. Khubi bhalo laglo . Onek kichi jana gelo

  • comment-avatar
    Soumya Chakraborty 3 years

    Khub sunder.

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes