ক্রোড়পত্র: নিশীথ ভড়
সকালের বাগানে বেড়াতে আসা এক কবি :
পার্থজিৎ চন্দ

অগ্রহায়ণের দুপুরে শরীর পেতে শুয়ে আছে রোদ। একটি ঘুঘুর ডাক রোদের জাফরি পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে ঘরে, এক নির্জন…আবেশমাখা ঘরে। ঘরটির সব থেকে বড় অহংকার ও অলঙ্কার তার আসবাবহীন সহজের উন্মুক্ততা। এই অভিজাত বিস্তার তাকে ঘিরে রেখেছে। উঠোনের এক কোণে দীর্ঘ হচ্ছে বিকেল-আমলকির ছায়া।

এই ঘরে নক্ষত্ররহস্য ও নক্ষত্রসন্ত্রাসের নীচে থাকেন একজন মানুষ। মায়াবেদনার জানালা দিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন দূরে। নক্ষত্রবর্শার ফলা চেপে বসে তাঁর ত্বক ফুঁড়ে। সে আলোর বর্শা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে এবং সাজিয়ে দেয় চিরচলমানতার শিল্পে। শোভন-নির্জনতার গো’মুখ থেকে যে নদীর জন্ম হয়েছে, জন্ম হয়েছে যে অন্তঃস্রোতের তা-ই প্রবাহিত হয়ে যায় এক চরাচর। আকাশগঙ্গার নীচে সেও এক ‘আকাশগঙ্গা’। এক পথিক বসে থাকেন নদীর পাশে…এ নদীর একমাত্র দর্শক তিনিই। এ নদী একমাত্র তাঁর। তিনি ঋষি নন, তিনি আপাদমস্তক রক্তমাংসের একজন মানুষ।

নিশীথ ভড়ের কবিতার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় তাঁর বিশ্ববিক্ষা…ভাষা আমাদের কাছে ‘সম্পূর্ণ নতুন’ নয়। প্রথম-পাঠে ছারখার করে দেবার অস্ত্র নিশীথের সম্পদ ছিল না কোনও দিন। কিছুটা অভিমানে যেন দূরে শুয়ে আছেন এক বিষণ্ণ সম্রাট। তাঁকে ঘিরে ধরছে সবুজমাটির স্তর…অসম্ভব সবুজ স্তরগুলি। স্তরায়ণের রহস্যে রহস্যে ক্রমাগত বন্দি হয়ে পড়ছে এক মুগ্ধ পতঙ্গ। আমদানিকৃত দ্বন্দ্বে সত্তার সংকট ঘনিয়ে তোলার ইউরোপিয় ও আমেরিকান পদ্ধতি ‘চোলাই’রূপে এ-বঙ্গে আছড়ে পড়েছে সুনামির মতো অভিঘাত নিয়ে। এ বিষয়টি যে বাঙালির দর্শন ও ভাষার ক্ষেত্রে যে কী অপূরণীয় ক্ষতি করে গেল সে নিয়ে এক দীর্ঘ সন্দর্ভ রচিত হবে কোনও একদিন। গুটিকয়েক প্রশ্নের আগোছালো উপস্থাপনা ও ডিসকোর্স-নির্মাণ এক বিষয় নয়। গদ্যের জগতে বিস্তর হাস্যকর নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। কবিতার ক্ষেত্রে দর্শন-সৌন্দর্য-রস ইত্যাদির প্রশ্নে অনেকেই এই নমুনাটি রেখে যান। এবং বে-আব্রু হয়ে যায় তাদের ছিন্নমূল দশা। একটি ভাষার আত্মা ও প্রাণ থেকে বহুদূর সরে গিয়ে সে এক ব্যর্থতার নামান্তর। এই শৈবালদামের দেশে নিশীথ গুটিকয়েক ব্যতিক্রমের মধ্যেই পড়েন। ভাষামুদ্রা, অস্তিবাদী দর্শনের দিকে তাঁর একটি হিজলগাছের মতো হেলে থাকা…আশিরনখ তৃষ্ণা ও তার ব্যর্থ উপসম – এ সবের থেকে উঠে আসা এক মিথস্ক্রিয়া অতি-সন্তর্পণে পাঠকের স্নায়ু-চৌকাঠ পেরিয়ে প্রবেশ করে। সমষ্টির দিকে ছুটে যাওয়া, সমষ্টিকে ঘিরে ফেলা দর্শনের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর ব্যক্তি-দর্শন আলোফুলের দ্যুতি নিয়ে ফুটে থাকা রডোডেনড্রন। জীবন-সংলগ্ন, ক্রম-প্রসারিত অনুধ্যানের বিস্তার ঘটে এভাবেই নিশীথের কবিতায়। প্রতিদিন একটু একটু ঘটে যায় এ প্রক্রিয়াটি। নিরাসক্তি ও নিস্পৃহতার অতিচেনা জপৎ থেকে আধুনিকতার এ বিশেষ রূপ বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত। সান্দ্র…জলভরা মেঘের মতো টলটলে এক পৃথিবীর রাজা নিশীথ। অভিজ্ঞতাপুঞ্জকে হাতের তালুতে নিয়ে কবিতায় প্রবেশ করলেন তিনি এবং তারপর অভিজ্ঞতার ভারকে একপাশে সরিয়ে রেখে শুষে নিলেন তার আলোটুকু। একটিও দৃশ্যমান উলম্ফন-উপমা বা প্রকৌশল ব্যবহার না-করেও কীভাবে ট্যেম্পোরাল্যিটিকে অতিক্রম করে যেতে হয় তার সব থেকে উল্লেখ্য উদাহরণের মধ্যে নিশীথ প্রথমদিকেই উল্লেখিত হবেন। অথবা, এমনও হতে পারে – এসবই তাঁর স্বাভাবিকতার প্রকাশ।

শুধু তাই নয়, ইচ্ছাকৃত কোনও ‘কর্কশ’ নির্মাণ নিশীথ করেননি। রহস্যময় চলিতভাষার ঈষৎ প্রমিতরূপ কীভাবে অমোঘ হয়ে উঠতে পারে তাও দেখিয়ে দিয়েছিলেন নিশীথ।

নিশীথের একটি চারলাইনের কবিতার সামনে বসে থাকলে অভিমান বেদনা ও হাহাকারের বিশ্বভ্রমণ হয়। কবিতাটির সঙ্গে যে ঠিক কবে আমার পরিচয় ঘটেছিল সেটা মনে পড়ে না। এটিই নিশীথের বড় এক সিগনেচার-টিউন। শান্তভাবে বেজে চলে এবং ধীরে ধীরে জলস্তম্ভের মতো গ্রাস করে নেয়। কবিতাটি মাত্র চার-লাইনের,

‘ভালবাসা যেতে পারে শান্ত দু মাইল শাদা পথ

পথ শব্দটির কোনো বিকল্প ছিল না তাই বিপত্তি ঘটেছে

আজো সংসারের মধ্যে: সারাপথ খুব চুপচাপ

কে যে শুয়েছিল, তাকে ভালবাসা উপেক্ষা করেছে’ (পথ)

-ভালবাসার শক্তি শুধু দু-চারমাইল শান্ত শাদা পথ হেঁটে যাবার। সারাজীবন প্রাত্যহিকতার আড়ালে সে ফুঁপিয়ে মরে। পথ শব্দটির মধ্যে যে সুদূরের ইশারা রয়েছে ভালবাসার সব থেকে বড় সম্পদ সেই সুদূরের ইশারাই। কিন্তু কবিতাটির সার্থক উলম্ফন ঘটে শেষ লাইনটিতে এসে। ভালবাসা একজন মানুষকে উপেক্ষা করে চলে গেছে। এরপর আর কোনও শব্দ নেই, শুধু এক হাহাকার ঘুরে ঘুরে মরে চরাচরে।

ঠিক একই ভাবে নিশীথের ‘মাসীমা’ কবিতাটির সামনে এসেও বসেছিলাম একদিন। বাংলা-ভাষায় রণক্লান্ত নারী-পুরুষ নিয়ে ঢের লেখা হয়ে গেছে, লেখা হয়ে গেছে মধ্যযৌবন পেরিয়ে আসা মহিলার ধিকধিক করে বেঁচে থাকার কথাও। নিশীথের আধা-আটপৌরে আধা-প্রমিত চলনে ফুটে ওঠে আরেক মাসিমার কথা। সংসার সীমান্তে দাঁড়িয়ে সাজানো সংসারের মধ্যে ঘুম আর জেগে ওঠার মাঝখানে পুড়তে থাকেন এক মহিলা। প্রিয় পুরুষ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, সন্তান দূরে সরে যাচ্ছে।ঋতুবন্ধ হয়ে যাওয়া এক মহিলার জীবন থেকে উবে গেছে রহস্যের সব নীল শিখা। এবং সেই সময়েই সেই ‘মাসীমা’ একদিন আবিষ্কার করলেন আরেক রহস্যের খনি,

‘মুখে তাঁর রহস্যের নীল আভা, কেরোসিন কুপি নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে

মাথায় জ্বালান মদ, আগুনের আলিঙ্গন, আহা নাচ সমস্ত শরীরে

এমনটি সেজেছিল রক্ত যেন সেই দিন, ফুলশয্যা প্রথম বিস্ময়

বহুদিন বাদে প্রৌঢ়া মাসীমার আলিঙ্গন, আহা সুখ, আলো মৃত্যু নাচ

এমন পুড়িয়ে দেয় হৃদয়ে কম্পন ওঠে, চুলে-স্তনে-যোনি ও গ্রীবায়

এমন পূজার স্তব, আর কেউ করেছিল কোনোদিন শরীর আঘ্রাণে।’

-জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ ও আত্মহত্যা এক বিপণ্ন বিষ্ময়ের খেলা। পুরুষের সেই বিপণ্ন বিষ্ময়ের পাশে এতদিন নারীর তেমন কোনও বিপণ্ন বিষ্ময়ের ছবি আঁকা ছিল না। নিশীথের ‘মাসীমা’ বাংলা কবিতাকে যেন সেটি ফিরিয়ে দিল। এই কবিতাটিতে প্রৌড়ার ‘আত্মহত্যাকামী’ সত্তার থেকে কবি আপাতভাবে বিপণ্ন বিষ্ময়কে কিছুটা তফাতে রেখেছিলেন। নারী-যৌনতা ও প্রথম রক্তপাতের মধ্যে সংযোগ দেখিয়ে নিশীথ চলে গেছিলেন মৃত্যুর দিকে। আগুনের লেলিহান শিখার সঙ্গে ক্রমশ মিশে যাচ্ছিল রক্তপাতের লালরঙ। সে আগুনকে এক সময়ে মনে হচ্ছে পূজার স্তব। শিরদাঁড়া দিয়ে স্রোত নেমে যায় এখানে দাঁড়িয়ে।

কিন্তু এ কবিতাটির চূড়ান্ত আকর্ষণ, অন্তত আমার কাছে অন্য জায়গায়। যতবার কবিতাটি পড়ি ব্যক্তি-‘মাসীমা’ ধীরে ধীরে অবসৃত হয়ে ফুটে উঠতে থাকে জীবন-রহস্য ও শিল্প। সব রহস্যের শেষে কি জেগে থাকে এমনই এক শূন্যতা? জীবন কি আসলে এক শিল্প ও ‘মাসীমা’ কি সেই শিল্পের মুগ্ধ শিল্পী? সারাদিন আশ্রয় হয়ে থাকার পর দিনশেষে, অন্তিমে শিল্প কি আসলে আশ্রয়ের পরিবর্তে এক আশ্রয়হীনতাই উপহার দিয়ে যায়?

সমুদ্র ও ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে একদিন সব সান্তিয়াগোর হাতেই উঠে আসে মাছের কঙ্কাল…দূর বাতিস্তম্ভের মতো একদিন রহস্যময় ও অনিবার্য ইশারা থাকে শিল্পের। কিন্তু এক আগুনপরিখায় শেষতক ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার থেকে বেশি সত্য হয়তো আর কিছুই নেই, মাসিমারও ছিল না।

নিশীথ সংকেতদেবতার বিষণ্ণ সন্তান। অথবা বিষণ্ন শব্দটি, যা তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে সেই কবে থেকে, অতিক্রম করে বলা উচিত – নিশীথ সংকেতদেবতার নিবিড় প্রকাশ। ‘বাগানে একটি সকাল’ কবিতাটি পড়ছিলাম,

‘আমার চোখ থেকে সরে গেল কুয়াশা, এই বাগান জেগে উঠল হঠাৎ।’

‘দেখা’ ও ‘দর্শনের’ মধ্যে যে দূরত্ব সেটিকে অতিক্রম করে গেলেন নিশীথ। কুয়াশার সরে যাওয়া এক গভীর উন্মোচন। যেন এবার সব কিছু স্বচ্ছ হয়ে আসবে তাঁর কাছে। সত্যিই তা হচ্ছে, কারণ

‘আকাশে মুখ তুলে প্রশ্বাসের প্রবল টানে গাছগুলোর ডালপালায়

নামিয়ে আনল সোনালি স্রোত

ঘাসগুলো শিউরে শিউরে উঠে পাখিদের পায়ে পায়ে

মাখিয়ে দিল গতজন্মের শিশির’

-এই উন্মোচিত দর্শন কিছুটা অ্যন্টিসিপেটেড। কিন্তু নিশীথ আমাদের নিয়ে পৌঁছে যাবেন অন্য এক উচ্চতায়, তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল কিছুটা আগে। এবার পাঠককে নখরে গেঁথে উড়তে শুরু করলেন কবি,

‘আমি বসে থাকতে থাকতে টের পেলাম কী নিবিড় জান্তব নড়াচড়া এদের’

-ঘন ঘন বজ্রপাত লাভা-উদগীরণ প্রাইমরডিয়াল স্যুপ থেকে বৃক্ষজন্ম পর্যন্ত কেঁপে উঠতে বাধ্য শুধু মাত্র ‘জান্তব’ শব্দটির পায়ের কাছে বসে। কবিতাটি শেষ হয়েছিল এভাবে,

‘মনে হলো, আমি আজন্মকাল এখানে বসে আছি

মনে হলো এখান থেকে চলে যাওয়ার প্রশ্নই অবান্তর’

-জন্ম-জন্মান্তরের দিকে বৃষ্টি নামে। এক বৃষ্টিজন্ম নিয়ে বিষনীল এক যুবক এসেছিলেন বাংলা কবিতা লিখতে। কবিতা লিখে তিনি ফিরে গেছেন। এবার বাংলা কবিতা ঠিক করবে এই কবিতাকে সে কীভাবে ধারণ করবে।

বাংলা কবিতার অন্দরে যাকে ‘স্বেচ্ছ নির্বাসন’ নামে চালিয়ে দেওয়া হয়, সন্দেহ হয় সেটি আসলে ‘অভিজাত আত্মগোপন ছিল না তো!

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Shyamashri Ray Karmakar 4 years

    খুব সুন্দর আলোচনা পড়লাম। স্বেচ্ছা নির্বাসন না অভিজাত আত্মগোপন,এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাখলেন পাঠককে

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    404 Not Found

    Not Found

    The requested URL was not found on this server.


    Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80