কস্তুরী সেন-এর কবিতাগুচ্ছ
আলো
এই যে সকাল হল রোদ্দুর এসে পড়ল
ভোরবেলার ফ্রেমে
এই যে দূরের তারে উঠে যাচ্ছে মুহূর্মুহু ফিরে এসে
বসে পড়ছে পাখি
এই যে এ অন্যের পাপ আছে ধরে ফেলা ঘর
লাল ঠাণ্ডা মেঝেতেও এসে পড়ল আলো
আবার দরজায় শব্দ, সাইকেলের ঘন্টি আর
ছড়ছড় জল পড়ল দিনের প্রথম
এই জল, রোদ আর তারে বসা উড়ে যাওয়া ওরা
সকলেই জানে
আজ এখানে শুরু হচ্ছে
কোনওদিন আর কথা হবে না ভাঙন
তা বলে কি জলে যাবে এতদিন? এত এত কথা?
ওই তার, রোদ্দুর আর পাখিটির মনে
এবার সমস্ত বাকি কথা, লিখে রাখা শুরু হল জেনে চঞ্চলতা!…এত আলো,
এত আয়োজন
ভাগ
ছেড়ে আসা সাঙ্কেতিক
ছেড়ে থাকা তারও পরে বস্তুত মলিন
তেমন মলিন, যেন মেসবাড়ি, হলুদ চিঠিতে বলা ‘চাকরি নাই,
ঘুরে ঘুরে টিউশনি পড়াই’
তেমন মলিন যেন কলোনিতে প্রথম যে টিউকল
তাকে ভেঙে বছরষাটেক পর গড়ে উঠছে সাদা ফ্ল্যাটবাড়ি
বারান্দায় শিশু জবা, ও জানে না জিলাস্কুল
পেটাঘণ্টা, প্রভাতফেরির আগে হুহু সাইকেল
সদরঘাটের রোদ এখানে ওখানে লেগে, শিয়ালদহ, ফুটপাথ, ফ্রকের সেলাই
ছেড়ে যাওয়া সাঙ্কেতিক, পদে পদে পাটক্ষেত
বুকে হেঁটে অনন্ত পালানো
ছেড়ে থাকা তারও পরে বস্তুত মলিন
তেমন মলিন যেন জন্মভূমি, একাত্তর,
গুলি আর আগুনের মাঘমাস,
ভোররাত্রে শেষ ঢাকা মেল
বাকি
প্রথমে অল্পই আঁচ, ধিকিধিকি হাওয়া
প্রথমে ‘আবার কতদিন পরে দেখা হল!’
প্রথম ‘মাধবী’বিতানে হল দেরি
পুলকে ততও হয়নি,
নাট্যকলা, ধুলো ধুলো নন্দন চত্বর…
সকলই তো কতদিন,
কতদিন পর –
কেউ কিছু টের পায়নি।
প্রথমের কতদিন গেলে, বাজ পড়ে,
দুমড়ে যায় শরীরের রেখা
‘প্রথম লেখাটি পড়ছি’…অবিশ্বাস,
অল্পদূরে জ্বলেপুড়ে আছে সন্দেহ।
হে পাঠক, সে আমার আরেকটিমাত্র বাকি লেখা…
ঘ্রাণ
সহসা বিচ্ছেদ হল যে লোকের
লোকমুখে আক্ষেপোক্তি জেনে আসি তার
ফিরে আয়, তোকে ছাড়া পারছি না
এই কথা আগে বুঝি ততটা বলেনি?
ওরা কতদিন আগে থেকে সরে বসা শিখে গেল,
কটুতর্ক, দোষারোপ সেরে তবু কতদিন
এ অন্যের কাছে ওরা অল্পও ফেরেনি?
ফিরে ফিরে এসকলই ভেবে, শিহরন জাগে খুব
যেমন হেমন্তরাত্রে একা একা শিউরোয় পুকুরের জল
তুমি তো অন্নের গন্ধ, সে রাতেই
শেষ ট্রেন ছেড়ে নেমে বাড়ি ফিরলে কেউ,
গৃহস্থের হেঁসেলে যে ভাত বসে!
ফিরে আসাটুকু সেই ঘ্রাণের সম্বল
আরও
আজ্ঞাবহ থেকে যাওয়া, চিরদিন এইমতো
আজ্ঞাবহ থাকা,
যদি দুকলম রং এসে
দেহটি রাঙিয়ে দেয়, দেবী আভা!
আর আভায় মুখবন্ধ পাড়া…
দেহ মানে প্রাঙ্গণ,
হেলাফেলা, অন্ধকারে
কলমটি তার
উপরে শিরীষশাখা ভরে থাকা তারা
তাঁর কবিতার চিত্রকল্প আমাকে মুগ্ধ করে। ফেলে আসা পূর্বপুরুষের অতীত, নিঃশেষিতায়ু মফস্বলি শৈশব-কৈশোর, প্রণয়ের ভিতর এক শাশ্বত বিরহের অনুসন্ধান, সুস্থির হয়ে থেকেও রোমাঞ্চিত এক প্রভাতকাল, এমনই সব বিষয় বারবার স্থান পায় তাঁর কবিতায়। এই কবিতাগুলিতেও সেই কাব্যলক্ষণ পরিস্ফুট; যেসব ছবি আমরা দেখেও দেখি না, লেখার সময় যাদের কথা ভুলে যাই, কস্তুরী তাদের বহন করেন নিঃশ্বাসের মতো। যাঁদের কবিতা আমার খররৌদ্রাক্ত গদ্যভুবনকে মায়ামেদুরতা দিয়ে ভেতরের দিকে টেনে রেখেছে, কস্তুরী সেন তাঁদের অন্যতম। শুভেচ্ছা ও নমস্কার জানাই।
বেশ অন্যরকম ভালো লাগে এই কবির লেখা। কবির স্বকীয়তা মুগ্ধ করে। “যেমন হেমন্তরাত্রে একা একা শিউরোয় পুকুরের জল” ❤️❤️
সময়, তার দীর্ঘ দুডানা মেলে উড়ছে এই সব কবিতায়। ভারি চমৎকার কস্তুরীর কবিতার ভাবপ্রতিমা।
ভালো লাগলো ঘ্রাণ ও আরও