এ রাম, সে রাম নয়  <br /> হিন্দোল ভট্টাচার্য

এ রাম, সে রাম নয়
হিন্দোল ভট্টাচার্য

আমাদের বাজারে এক রসিক ফলবিক্রেতা আছেন। তিনি যখনই ফলের দাম বাড়িয়ে দেন, তাঁর স্লোগান হয়ে ওঠে – এ আম সে আম নয়, এ আম আসল।
আর যখন ফল বিক্রি হয় একদম স্বাভাবিক দামে, তখন বলেন – জলের দরে ফলের দর। তো, আমার লোকটাকে বেশ ভালো লাগে। কারণ সোজাসাপ্টা
তিনি বলে দেন, এ আম সে আম নয়। কিন্তু ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত কেনই বা করছি? কেনই বা রামের প্রসঙ্গে আমের কথা এল? আমের মরশুমে
আমরা কি বলি – জয় শ্রী আম? বলি না, তো। মনের মধ্যে এ নিয়ে খটকা যখন চলছে, তখন নরেন্দ্রমন্দিরের উদ্বোধনে ভিড় করেছেন বিভিন্ন মানুষ। এই কয়েকদিন
আগের কথা। আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম মহারাষ্ট্রে। নাসিকের সেই গোদাবরী নদীর সঙ্গমে দেখেছিলাম ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন এসেছিলেন। একজনকে জিজ্ঞেস
করে জানতে পেরেছিলাম তিনি এসেছিলেন সুদূর উত্তরপ্রদেশ থেকে হেঁটে হেঁটে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিলেন – রাম কে লিয়ে। ঔর ক্যায়া। তো, নাসিক ঘুরতে ঘুরতে দেখেছিলাম লক্ষ্মণের শূর্পণখার নাসিকাচ্ছেদন এবং গণ্ডি কেটে সীতার রাবণের দ্বারা অপহৃত হওয়ার ঘটনা নিয়ে এখনো মিছিল করে মানুষ চর্চা করতে করতে ঢুকে পড়ছেন একটি গুহার ভিতর। কাল্পনিক রাবণের উপর কী যে বিদ্বেষ তাদের। আর অদৃশ্য জটায়ুর জন্য অশ্রুবর্ষণ। তাঁরা সবাই দরিদ্র। দেখলে তো আন্দাজ করা যায়। কিন্তু তাঁরা ভারতের সেই সব মানুষজনের একজন, যাঁদের মনে এখনো যুক্তি প্রবেশ করেনি। যাঁরা এ কথা বিশ্বাস করেন না, যে রাম এক ঐতিহাসিক চরিত্র নয়, বরং সাহিত্যের এক চরিত্র। আর সাহিত্যের এক চরিত্রের কোনও জন্মস্থান হওয়া সম্ভব নয়।
মনে আছে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার দিন। তখনও বিজেপির এমন একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল না। লক্ষ লক্ষ ধর্মীয় উন্মত্ত করসেবক গিয়ে বাবরি মসজিদের মতো ঐতিহাসিক এক ক্ষেত্রকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু আজ? ২২ তারিখ কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এমন এক দেশে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা হল, চালু হল, যে দেশের এখন প্রয়োজন চাকরি, অন্ন, ওষুধ, উপযুক্ত বাসস্থান। মানুষের এ নিয়ে কোনও ক্ষোভ নেই বা আশঙ্কা নেই যে, কীভাবে তাঁরা বাঁচবেন? রামমন্দির উপলক্ষ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা কাদের পকেটে যাচ্ছে? কিছু বহুজাতিক পুঁজপতির। তাঁরা হোটেল তৈরি করছেন, রাস্তা তৈরি করছেন। উত্তরপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে নানা প্রকল্পে সামিল। আগে ভাবা হত কৃষি আমাদের ভিত্তি। এখন কি তবে ভাবতে হবে ধর্ম আমাদের ভিত্তি?
এ দেশের শাসকদের নির্মিত রামমন্দিরে দেব আছেন কী নেই, তা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়, কারণ আমি একজন নাস্তিক। কিন্তু এ কথা তো অনুভব করাই যায়, যে দেশে দেড়শো কোটির কাছাকাছি মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিশুমৃত্যু, খিদে, কন্যাভ্রুণসন্তান হত্যা, চাকরিহীনতা, খেতে না পাওয়া – এগুলো জলজ্যান্ত সমস্যা, সে দেশে সব কিছুকে ঢাকার জন্য এক ধর্ম জিগির তোলা একপ্রকার হিন্দুরাষ্ট্রের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করারই সমতূল্য। তবে কি এ রাম সে রাম নয়? যে রাম মহাত্মা গান্ধীর রাম। কী বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী রামকে নিয়ে? একবার কি ফিরে পড়তে পারি আমরা? “My Rama, the Rama of our prayers is not the historical Rama, the son Dasharatha, the King of Ayodhya. He is the eternal, the unborn, the one without a second. Him alone I worship. His aid alone I see, and so should you. He belongs equally to all. I, therefore, see no reason why a Mussalman or anybody should object to taking His name. But he is in no way bound to recognize God as Ramanama. He may utter to himself Allah or Khuda so as not to mar the harmony of the sound.It can be said with justice that possession of a pure heart should do equally well without Ramanama. Only, I know no other way of attaining purity. And it is the way trodden by the sages of old all over the world. They were men of God, not supersitious men or charlatans.” (H, 9-6-1946, p171) কিন্তু না, গান্ধীর এই রাম তো বর্তমান ভারতবর্ষের আরাধ্য নয়। এমনকি কবীর সাঁইয়ের রামও এ দেশের আরাধ্য নয়। কবীর সাঁইয়ের রাম তো বাক্য ও মনের অতীত। তাকে পাওয়া যায় প্রেমে। তাকে অনুভব করা যায় ভক্তিতে। তার সঙ্গে দশরথের ছেলে রামের কোনও সম্পর্ক নেই। গান্ধীর রাম সংক্রান্ত ভাবনার সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মুশকিল হল, আমরা দেবতাজ্ঞানে রামকে যদি পূজাও করি, তাহলেও কি এই এত বড়ো প্রাসাদ তৈরি করে তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য এত লাফালাফি করতে হবে?
কেন?
কারণ রাম এক ইউটোপিয়া। কিন্তু আমরা একবার হয়তো দেখে নিতে পারি আগের সেই অযোধ্যা কেমন ছিল। সত্যিই কি তা রামরাজ্য ছিল? আর যদি রামরাজ্যই যদি তা হয়, তাহলে তা কেমন রামরাজ্য ছিল। আমরা এখানে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের একটি প্রবন্ধের সাহায্য নিতে পারি, যার নাম – রামায়ণের অযোধ্যা – ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ইউটোপিয়া।
এ লেখাটির কিছু অংশ মনে হয় তুলে দিলে ভালোই হয়।
তিনি বলছেন – রামরাজ্য এক ধরনের সব-পেয়েছির দেশ, ইউটোপিয়া। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা সমিতি ইউটোপিয়া-র স প্রতিশব্দ করেছিল ‘রামরাজ্য’। তবে এই প্রতিশব্দটি কেউ অ-ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে হয় না। সে যা-ই হোক, যুদ্ধকাণ্ড-য় রামরাজ্যর বর্ণনা বড়োই সংক্ষিপ্ত। সে-তুলনায় বালকাণ্ড-র গোড়ায় দশরথের আমলে অযোধ্যা নগরীর একটি ছিল বিস্তৃত বিবরণ আছে। সেটিকেই বরং প্রাচীন ভারতের একটি ইউটোপিয়া বলে ধরা যায়। নিচে তার পুরোটাই তুলে দিচ্ছি: বীর, বিদ্ববৃন্দের সংগ্রহকর্তা, মহাতেজস্বী, পুরবাসী ও জনপদ-বাসী জনগণের অতিশয় প্রিয়-পাত্র, ইক্ষাকুগণের মধ্যে অতিরথ, দশরথ নামে যজ্ঞশীল, ধর্মপরায়ণ, মহর্ষি সদৃশ, ত্রিলোক-বিশ্রুত রাজর্ষি ছিলেন। তিনি বলবান, নিঃসপত্ন, ভাবে রাজ্যশাসন মিত্রযুক্ত ও জিতেন্দ্রিয় ছিলেন। তিনি ধনধান্যসঞ্চয়ে দেবরাজ ও কুবের তুল্য ছিলেন। বৈবস্বত মনু যেরূপ জগৎ পালন করিতেন, তিনিও সেইরূপ জগতের পালক ছিলেন। সেই সত্যনিষ্ঠ রাজা দশরথ, ধৰ্ম্ম-অর্থ-কাম-রূপ ত্রিবর্গসাধনের নিমিত্তই সেই অযোধ্যাপুরী দেবরাজ ইন্দ্র যেমন অমরাবতী পুরী পালন করেন, সেইরূপ প্রতিপালন করিতেন। সেই শ্রেষ্ঠ নগরীতে সমুদায় লোকই বাসসুখে প্রীত ছিল। সকলেই ধার্মিক, বহুজ্ঞ, স্ব স্ব সম্পত্তিতে পরিতুষ্ট থাকিত। তাহারা লুব্ধ ছিল না এবং সত্যপরায়ণ ছিল, কোন কুটুম্বী গৃহস্থই অল্পসঞ্চয়ী ছিল না। যে গৃহস্থের গো, অশ্ব, ধনধান্য প্রভৃতি ঐশ্বর্য্য ছিল না, যাহার ঐহিক পারত্রিক কামনা সিদ্ধ হয় নাই, সেইরূপ গৃহস্থ ঐ নগরীতে ছিল না। কামপরায়ণ, স্বজনপীড়ক, নৃশংস, মূর্খ বা নাস্তিক মানব সেই পুরীতে কদাচ দেখা যাইত না। সকল নরনারীই ধর্মশীল ও জিতেন্দ্রিয় ছিল, এবং সকলেই মহর্ষিদিগের ন্যায় নির্মূলস্বভাব ছিল। সকলেই কুণ্ডল, কিরীট ও মাল্য ধারণ করিত, সকলেই মৃষ্ট ভোজ্য ভোজন করিত, পরিচ্ছন্ন থাকিত, এবং শরীরে চন্দনাদি বিলেপন করিত। অঙ্গদ, নিষ্ক ও করাভরণ সকলে ব্যবহার করিত। সকলেরই অন্তঃকরণ উচ্ছৃঙ্খলতা-বিহীন ছিল। সকলেই সাগ্নিক ও যজ্ঞদীক্ষিত ছিল, রাজ্যমধ্যে কেহ নীচ, সদাচারহীন বা বর্ণসঙ্কর ছিল না। ব্রাহ্মণগণ জিতেন্দ্রিয়, আত্মকর্মরত, দানাধ্যয়নপরায়ণ ও প্রতিগ্রহবিষয়ে সংযতচিত্ত ছিলেন অর্থাৎ অসৎপ্রতিগ্রহ করিতেন না। কেহই নাস্তিক,ছিলেন অর্থাৎ অসৎপ্রতিগ্রহ করিতেন না। কেহই নাস্তিক, মিথ্যাবাদী, সামান্য শিক্ষিত, অসূয়াপরায়ণ ও ব্রতাদি-কাৰ্য্যবিহীন টি ছিলেন না। সকলেই ষড়ঙ্গ বেদাধ্যয়ন করিতেন, কেহই দরিদ্র, ব্যথিত ছিল না। নর বা নারী কেহই রূপলাবণ্য-বিহীন বা কুশ্রী ছিল না, রাজভক্তির বিরুদ্ধে কাহারও মনের ভাব , লক্ষিত হয় নাই। ব্রাহ্মণাদি চারি বর্ণই দেবতা ও অতিথির অর্চ্চনা পরায়ণ ছিলেন, অধিক কি, সকলেই কৃতজ্ঞ, উদার ও বীরাগ্রগণ্য ছিলেন। সকলেই দীর্ঘজীবী এবং ধৰ্ম্ম ও সত্যাবলম্বী ছিলেন, কাহাকেও অকালমৃত্যুর হস্তে পতিত হইতে হয় নাই; পুত্র, পৌত্র ও কলত্র লইয়া সকলে সুখে কালযাপন করিত। ক্ষত্রিয়গণ ব্রাহ্মণের ও বৈশ্যগণ ক্ষত্রিয়ের অনুবৃত্তি করিত; এইরূপে শূদ্রেরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যসেবায় নিযুক্ত থাকিত। যেরূপ প্রজাপতি বৈবস্বত মনুর হস্তে পূর্ব্বে এই রাজধানী সংরক্ষিত হইয়াছিল, ইক্ষাকুনাথ দশরথও তাঁহার ন্যায় ইহার শাসন করিয়াছিলেন। সিংহ দ্বারা পর্ব্বতের গুহা যেরূপ পূর্ণ হয়, সেইরূপ এই রাজধানী অগ্নিতুল্য তেজস্বী, অসহিষ্ণু, সরলস্বভাব, ধনুর্বিদ্যাপারদর্শী বীরগণে পরিপূর্ণ ছিল। সেই পুরী, কাম্বোজ-বাহ্লীক-বনায়ু ও সিন্ধুদেশজাত উৎকৃষ্ট অশ্বে পরিপূর্ণ থাকিত; এইরূপ বিন্ধ্যপর্ব্বতজাত, হিমালয়োৎপন্ন, পর্ব্বত সদৃশ মদমত্ত মাতঙ্গে অযোধ্যা সুরক্ষিত থাকিত। ঐরাবত, মহাপদ্ম, অঞ্জন ও বামনবংশীসূত ভদ্রমন্দ, ভদ্রমৃগ ও মৃগভদ্র নামক সঙ্কর হস্তীতে ঐ পুরী সমাচ্ছন্ন থাকিত। সকল মাতঙ্গ মদোন্মত্ত এবং পর্ব্বত সদৃশ; কেহ এখানে যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইত না, এই নিমিত্ত ঐ নগরীর নাম অযোধ্যা হইয়াছিল। যদিও বিস্তারে উহা তিন যোজন মাত্র, কিন্তু দুই যোজনের মধ্যে কেহ যুদ্ধ করিতে সাহসী হইত না। তারাপতি যেরূপ তারকাদিগকে শাসন করেন, তাহার ন্যায় শত্রুবিমর্দ্দন ইন্দ্রতুল্য নৃপতি দশরথ সুদৃঢ় তোরণবিশিষ্ট অর্গলযুক্ত দিব্যগৃহশোভিত লোকাকীর্ণ মঙ্গলালয় অযোধ্যাপুরী শাসন করিতেন।
এ হলো রামায়ণ-এর একটি প্রচলিত পাঠ-এর অনুবাদ।’ তারপরে রামায়ণ-এর ‘চিকিৎসিত পাঠ’ অর্থাৎ প্রামাণিক বা বিচারমূলক সংস্করণ বেরিয়েছে। তাতে দেখা যায়: প্রচলিত রামায়ণ-এর ‘চিকিৎসিত পাঠ’ অর্থাৎ প্রামাণিক বা বিচারমূলক সংস্করণ বেরিয়েছে। তাতে দেখা যায়: প্রচলিত পাঠ-এর কিছু শ্লোক বা তার অংশবিশেষ পরবর্তী সংযোজন বলে বাদ গেছে।’ যে-পাঠই পড়া হোক, এই আদর্শ নগরীর বর্ণনায় বিশেষ তফাত হবে না।
অযোধ্যার বিশেষত্ব কী? সকলেই শুধু বড়োলোক নন, স্বভাবচরিত্রও ভালো। আর সেই সঙ্গে সকলেই ধর্মভীরু, সকলেই যজ্ঞ করেন, আর চার বর্ণর প্রথা অটুট রয়েছে। পিরামিডের মতো সাজানো এই সমাজ। তার একেবারে চূড়ায় রয়েছে ব্রাহ্মণ, তার সেবা করে ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়র সেবা করে বৈশ্য, আর ঐ তিন বর্ণর সেবা করে শূদ্র। কিন্তু তার জন্যে কারুর কোনো অপ্রীতির ভাব ছিল না, কেউ লোভী ছিলেন না, যে যাঁরা নিজের সম্পদে খুশি থাকতেন। অর্থাৎ, এই অ দশরথ-রাজ্য সব মানুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে নি: অধিকারভেদ ও বর্ণভেদ পুরোদস্তুর বহাল। যে-গৃহস্থদের গুণ ও সম্পদের বর্ণনা করা হয়েছে তাঁরা সবাই দ্বিজাতির বা প্রথম তিন বর্ণর লোক। শূদ্ররা কী করতেন, কী খেতেন, কী করে বাঁচতেন – সে-কথা রামায়ণ-এ নেই। অন্য একটি ব্যাপারও নজর করার মতো। অযোধ্যা- বর্ণনায় বলা হয়েছে- একবার নয়, দুবার – যে এই শহরে কেউ নাস্তিক ছিল না। ‘নাস্তিক’ বলতে কী বোঝায় সে-ব্যাপারে অবশ্য মতভেদ আছে। মধ্যযুগের টীকাকাররা এর নানারকম মানে করেছেন: পরলোকে অবিশ্বাসী, বেদ-এর অভ্রান্ততায় আস্থাহীন, নিরীশ্বরবাদী ইত্যাদি। হালের একটি ইংরিজি অনুবাদে নাস্তিক-এর জায়গায় লেখা হয়েছে: অ্যাগনস্টিক, অজ্ঞেয়বাদী’। তার মানে, ভগবান আছেন না নেই, ভগবানই জগতের সৃষ্টিকর্তা কি না, স্বর্গ নরক আছে না নেই – এইসব প্রশ্নর সামনে পড়লে যিনি বলেন: ‘আমি জানি না।’ হয়তো আরও এক পা এগিয়ে তিনি বলবেন: এসব প্রশ্নর উত্তর জানা যায় না। ভারতের ইতিহাসে ভগবানে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী দু ধরণের লোকেরই হদিশ মেলে। এমনকি সংশয়ী, পরকাল পরলোক আছে না নেই – এ বিষয়ে যিনি মনঃস্থির করে উঠতে পারেননি এমন লোকও নিশ্চয়ই ছিলেন।’ কিন্তু অজ্ঞেয়বাদ একেবারেই পশ্চিমী ব্যাপার। এই মতবাদ ইওরোপে দেখা দিয়েছে গত দু শতকে। কিন্তু ভারতে এমন পাশকাটানো মত কোনোদিন কি চালু ছিল? মনে হয় না। বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, আর সংশয়ী – এই তিনের বাইরে চতুর্থ কোনো মত আদৌ এদেশে ছিল কি না সেটি প্রমাণসাপেক্ষ। অযোধ্যার বর্ণনা পড়ে কেউ কেউ হয়তো মনে করবেন: এ তো ব্রাহ্মণ্য ইউটোপিয়া। তেমন ভাবা ঠিক হবে না। অযোধ্যার বর্ণনার শেষদিকে হাতি, ঘোড়া ও যোদ্ধাদের সম্পর্কে যে কথাগুলো আছে সেগুলোও খেয়াল করার মতো। শুধু ব্রাহ্মণদের বড়ো করে দেখানোই এখানে একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। বরং ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় মিলিয়ে দুটি বর্ণর স্বার্থগত – ঐক্য ও প্রাধান্যই ঐ বর্ণনা থেকে বেরিয়ে আসে। মনু ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রকারও একইভাবে এক ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ইউটোপিয়া-র ছবি হাজির করেছিলেন। শুধুই ‘ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বললে শাসকশ্রেণীর চেহারাটি আড়াল করা হয়। ক্ষত্রিয়দের এ পৃষ্ঠপোষণ ছাড়া ব্রাহ্মণদের অত ক্ষমতা কোনোদিন হতে পারত না। ইতিহাসের বিচারেও দেখা যায়: রাজশক্তিকে বাদ দিয়েই অন্য কোনো বর্ণর প্রাধান্য কোথাও বজায় থাকেনি।”
এখন প্রশ্ন হল, এসব কথা নিয়ে চর্চা তাঁরাই করেন, যাঁদের মনে সংশয় আছে। কিন্তু ভারতের বর্তমান শাসককুল তো এসব তো ভাবনাগত জায়গাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গড়ে তুলতে চান একত্ববাদী এক আধিপত্য। যেখানে রামমন্দিরের সামনে মাথা নুইয়ে থাকবে ভারতের জনগণ। এবং রামকে নাম বা রামমন্দিরকে নাম, ভারতের জনগণকে নির্দেশ দেবে রামের প্রতিনিধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের যে যে রূপ আমরা দেখছিলাম, তা এই রামমন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণমাত্রা পেল। এবার ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি হয়ে উঠবে আমাদের বাধ্যতামূলক সম্ভাষণ, আমাদের সংস্কৃতিতে বহুবৈচিত্রের ধারাকে অস্বীকার করে একটি বিশেষ ধারাকেই তুলে ধরা হবে। কোনও প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে প্রথমেই দমন করা হবে। তার নমুনা এখনো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। এমন দিন যে আসতে চলেছে তা সম্ভবত কয়েকজন ১৯৯১-৯২ থেকেই বলছিলেন। আজ তাঁদের অনেকেই হয়তো নেই। কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে আজ এক কালো দিন, কারণ রামমন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হিন্দুরাষ্ট্রের ভিত প্রতিষ্ঠা হল এবং হিন্দু রাষ্ট্রের ভিত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আসলে যা হল, তা হল সমগ্র ভারতবর্ষে হিন্দি বলয়ের ফ্যাসিবাদের প্রসার।
কবীরের রাম, তুলসীদাসের রাম, মহাত্মা গান্ধীর রাম এই মন্দিরে নেই। রয়েছেন বর্তমান ভারতবর্ষের শাসকদের রাম। ভারত নামক হিন্দুরাষ্ট্রের এই রাম যে আগামী দিনে শাসকদের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে হয়ে উঠবেন আরও বেশি বিধ্বংসী, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হিন্দু ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের এই তুঙ্গে ওঠার সময়ে, মনে হয় এক বিকল্প সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে আমাদের। আর যদি না পারি, তাহলে তা সম্পূর্ণ রূপে গ্রাস করে নেবে আমাদের অস্তিত্ব।
আগামী দিন ঠিক কেমন হবে ভেবে নিন। মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা শাসিত ইরান বা ইরাকের মতো এই দেশ হবে হিন্দু মৌলবাদীদের দ্বারা শাসিত ভারত। কেমন পোশাক পরব, কীভাবে বিজ্ঞানকে দেখব, কী লিখব, কী খাব, কী ফিল্ম করব, তাতে কী সংলাপ রাখব, সব এখন দেশ কর্তৃক নজরবন্দি। এই তো হল রামরাজত্ব, যেখানে মুক্তির শান্তি নেই রয়েছে শ্মশানের শান্তি।
মুশকিল হচ্ছে, বাঙালিদের মধ্যে অনেকেও ছুটছেন। এ দেশ কি তবে ক্রমশই পিছনের দিকে এগোচ্ছে? আসলে এগোচ্ছে কিছু পুঁজিবাদী কর্পোরেটদের পকেটে। রাম এখানে একটা প্রোডাক্ট, যাকে দেখিয়ে কর্পোরেট পুঁজি নিজেদের পকেট ভর্তি করবে। আর সেই পকেটের কিয়দংশ পাবে ভারতের বর্তমান শাসকরা। আমরা তাতেই খুশি থাকব। কারণ এ দেশ আজ সম্পূর্ণ রূপেই বিকিয়ে গেছে এই সব কর্পোরেট ব্যবসায়ী, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের হাতে। ধর্ম এখানে ব্যবসা। আর যে অগণিত মানুষ রামলালা বলে উল্লাস করে কাল্পনিক জন্মভূমির দিকে ছুটে যাচ্ছেন, তাঁদের মনের সেই ভক্তি হল শাসকদের ব্যবসার পুঁজি।
তা না হলে এ মন্দির দেখে মনে কি হয় না, এ মন্দিরে দেবতা হল শাসকরাই। নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এ মন্দির। আর এই মন্দির শাসকদের রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল দেশের গণতন্ত্রের এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কবর।
দেশ এই ২২ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে রামমন্দিরের নামে সম্পূর্ণ ভাবে ফ্যাসিবাদ দ্বারা বন্দি হল। এর বিরুদ্ধে মানুষকেই দাঁড়াতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সব শক্তি যদি এখনো একযোগে না দাঁড়ায়, তাহলে অচিরেই এ শক্তি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
আবার মহাত্মা গান্ধীর একটি লেখার অংশ তুলে দিয়ে এই সামান্য লেখাটি শেষ করছি– To repeat Ramanama and to follow the way of Ravana in actual practice is worse than useless. It is sheer hypocrisy. One may deceive oneself or the world, but one cannot deceive the Almighty. (H, 23-6-1946, p186)
সুতরাং, এ বড়ো সুখের সময় নয়, আনন্দের সময় নয় বন্ধু।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    সুদেষ্ণা মৈত্র 12 months

    একদম ঠিক। বর্তমানে রয়েছে শাসকদলের রাম। আর সংশয় রাখলেই প্রশ্নের জন্ম হয়। তাই আধিপত্যবাদ সংশয় পছন্দ করে না।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes