আনন্দবাজার। না না পত্রিকা না, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মেলা। বছরে একবারই হয়। মহালয়ার দিন।
দোকান দোকান খেলা সেদিন সত্যিকারের বিকিকিনি।
ছেলেমেয়েদের সে কী ব্যস্ততা! একমাস কিম্বা তারও বেশিদিন ধরে তারা কতকিছু বানিয়ে ফেলেছে, সেদিন সব বিক্রিবাটার পালা! এদিন বাচ্চাদের ব্যবসায় হাতেখড়ি হবে এক আনন্দযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে, তাই তো সে আনন্দবাজার!
যেই রেডিওতে মহালয়া শেষ হবে, অমনি ছোটাছুটি শুরু! রেলিং টানো রে, চারদিক ঘিরে দোকান বানাও রে, আবার তারই মাঝখানে সময় বার করে রান্নাটান্নাও করো, কাজ কী কম! দইবড়া, সাহিটুকরা, লুচি-আলুরদম, নারকেল নাড়ু, চপ, মিষ্টি আরও কত কী! হলপ করে বলতে পারি খাবারের সেই স্বাদ, পৃথিবীর আর কোনও মেলাতে পাওয়া যাবে না! মনে,
আছে, একবার আমরা বন্ধুরা মেলায় দোকান দিয়েছিলাম, সম্ভবত ক্লাস এইট তখন, বেহিসাবি বিতরণের চোটে লুচির আলুরদমটি গেল ফুরিয়ে! সেই লুচি, শেষমেশ দইবড়ার ঝোল দিয়েই দিয়ে দেওয়া হল। লোকজন তা সোনামুখ করে খেয়েও নিল! এখনও ভাবলে মনেমনেই হেসে উঠি। হাসি দিয়ে মুহূর্ত বুনে, একটা মোটা রঙিন কাঁথা, বোধহয় আশ্রমিকদের সবার মনেই জড়ানো আছে।
সারা মেলা জুড়ে, ছড়িয়ে থাকত ছাত্রছাত্রীদের তৈরি করা মাটির, কাঠের, আরও কতরকম হাতেরকাজ। কমবয়েসি বাচ্চাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখলে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়! এই বিকিকিনির আবার নানান মজার গল্পও ছিল, হয়ত কুশন কাভারের কোণের পুতুলটা গেছে ছিঁড়ে, এদিকে খদ্দের তো দাঁড়িয়ে!
– কাকু, একটু দাঁড়ান হ্যাঁ, এখুনি সেলাই করে দিচ্ছি!
– সময় লাগবে না? আচ্ছা দাও, আমি ততক্ষণ একটু ঘুরে আসি নাহয়!
– না না কাকু যাবেন না (যদি আর না ফেরেন), এই এক্ষুনি হয়ে যাবে…
– আচ্ছা ,ঠিক আছে, দাঁড়াই তাহলে! নাড়ু হবে নাকি দুটো!
আসলে, সবকিছুই বড় সহজ ছিল তখন। রাজনীতি ছিল, অনুশাসন ছিল, কিন্তু সবই অনাড়ম্বর, সহজভাবে চলত। টের পেতাম, আদর্শ বড় কথা নয়, ভালবাসাটাই সব। অনেক মানুষ ছিলেন, যারা আশ্রমকে ভালবাসতেন। তাঁরা ঘিরে রেখেছিলেন আমাদের। তাঁদের সান্নিধ্যে থেকে, নিজেদের মতো, প্রকৃতি আর আশ্রমের সবটুকু নিয়েই আমরা বড় হয়েছি।
রাত্রিবেলা মেলাশেষে, টাকাপয়সা হিসেব করে, বাচ্চাদের আনন্দ দেখে কে! সেই ভোর থেকে মাতামাতি শুরু হয়েছে, অথচ চোখে ক্লান্তি নেই একফোঁটাও! আবার পরের দিন থেকে ইশকুলও বন্ধ। ডাউন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে সেদিন শুধু শারদোবকাশে ঘরমুখি বাচ্চাদের হইহই।
আজও মনে হয়, মহালয়ার দিন আনন্দবাজার না হলে, আমার শারদোৎসব যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায়।