অজিত সিং বনাম অজিত সিং
দ্বাত্রিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ৩২তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
৩২
ঘুম ঠিক করে ভাঙ্গার আগে একটা ফিনফিনে পাতলা আধো আধো ঘুম থাকে, যেমন ডিমের শক্ত খোলের নিচে পাতলা পর্দা, তার নিচে থাকে কুসুম। কুসুমের বুকে থাকে আস্ত একটা পাখি। এই আধো ঘুমটা খুব উপভোগ করে কুন্তল। পাতলা পর্দার আড়ালে যেমন লুকিয়ে থাকে পাখি, জীবনের সংঘাত শুরু হবার আগের শেষ শান্তির বিশ্রাম। এই পাতলা ঘুমের মধ্যে বাইরের পৃথিবীর সব শব্দ গন্ধ মৃদু হয়ে ঢুকে আসে। মৌটুসির টুঁই টুঁই ডাক, কাপ ডিসের ঠোকাঠুকি, ডালের সম্বর দেবার গন্ধ, খবরের কাগজের পাতা উলটনোর খসখস আওয়াজ, তারপর ওদিকের ঘর থেকে একটা গুনগুন শব্দ, বোনের কাছে কয়েকজন পড়তে আসে, ক্লাস টু থ্রির বাচ্চা সব। তাদের বলাই আছে বেশি গোলমাল না করতে, দাদার ঘুম ভেঙে যাবে। বোন ওদের গল্পও করেছে কুম্ভকর্ণের ঘুম অসময়ে ভাঙ্গানোয় কী অনর্থ ঘটেছিল। এখনকার বাচ্চা সব, কুন্তলদের মতো হাঁদা বোকা তো নয়, তবু তারা বিশ্বাস করেছে কথাটা। তার একটা কারণ, ওদের বাবা মা-রা ইতিমধ্যেই ওদের বলে দিয়েছে কুন্তল নামী চ্যানেলের ফটোগ্রাফার। দুষ্টুমি করলেই সেই ছবি তুলে চ্যানেলে দেখিয়ে দেবে। তাতেই ভয় খেয়ে গেছে বাচ্চাগুলো। তারা তাই কুন্তলের ঘুম ভাঙ্গিয়ে বিপদ ডেকে আনতে চায় না। আধো ঘুমের মধ্যে সেই কথা ভেবে ভারি মজা লাগল কুন্তলের। সে কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরল আর একটু। শীত শীত একটা অনুভূতি ঘিরে ধরল তাকে।
জীবনটা খুব সুন্দর শেষ পর্যন্ত। বিশেষ করে আজকের দিনটা তার বড্ড ভালো লাগল।আজ তার প্রথম স্বাধীনতার দিন। অন্যদিন এই সময় ঘুম ভাঙ্গলেও সে আরেকটু দেরিতে ওঠে, কিন্তু সে ঘুম নিরবিচ্ছিন্ন শান্তির হয় না, উদবেগ থাকে, তাড়া থাকে বেরোনোর। আজ তার কোন তাড়া নেই, আজ কোথাও বেরোনোর নেই তার। তার চাকরি গেছে। চাকরি চলে গেলে যে এত আনন্দ হয়, তা জানা ছিল না। আসলে এই প্রথম তার চাকরি গেল, নিজে ছাড়ার আগেই। আগেরগুলো সে নিজেই ছেড়েছে, তাই নিয়ে বাড়িতে কম অশান্তি হয়নি। এই বাজারে কেউ চাকরি ছাড়ে! এমনিতেই তো এই রাজ্যে বহুকাল সব কলকারখানার চিমনি চ হ্রস্ব ই এমনি এমনি হয়ে গেছে, আর ধোঁয়া বেরোয় না, আগে দিল্লি বম্বে থেকে এ রাজ্যে লোকে চাকরি করতে আসত, উদাহরণ তো হাতের কাছে মজুত, অমিতাভ বচ্চন, আর সেই রাজ্যে এখন কোন চাকরি নেই, সেখানে তুই হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললি, ব্লা ব্লা ব্লা। অন্যান্যবারের মতো বাড়িতে সেসব কোন অশান্তি নেই। তাকে কেউ বলছে না ‘তুই কেন চাকরি ছাড়লি এই বাজারে? কেউ করে এরকম কাজ?’ বরং সবাই বসের নামে, সাম্যদার নামে গালাগালি করছে যাচ্ছেতাই, মা তো বলেছে ‘বাঁচা গেল বাবা, দরকার নেই অমন ছেঁচড়া চাকরির, একগলা জলে দাঁড়িয়ে লোককে জিজ্ঞেস করা, আপনার ঘরে যখন জল ঢুকল কেমন লেগেছিল, ছিঃ আমার তো খালি ভয় হত কোনদিন না লোকে তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এখন কদিন ভালো করে ঘুমো, খা দা, বেড়া চেড়া। পৃথিবীটা দেখ, ট্রেকিং শুরু কর, ছবির একজিবিশন কর। আমাদের তো দোকানঘরটা পড়েই রয়েছে, ওখানেই কিছু করতে পারবি’
কোলবালিশটা কাছে টানতে টানতে কুন্তল ভাবল আর কী চাই তার, এমন মা আছে যখন। দিওয়ারের সেই শশী কাপুরের বিখ্যাত ডায়লগ মনে পড়ছিল। ‘মেরে পাস মা হ্যাঁয়’। নাহ, কয়েকদিন সে কিচ্ছুই করবে না। মার কথা শুনে ঘুরবে ফিরবে। আচ্ছা, সবাই মিলে একটা টুর করলে কেমন হয়, কতদিন তারা একসঙ্গে কোথাও যায় নি। মার খুব ইচ্ছে কানহা যাওয়ার, শুনেছে সেখানে নাকি বাঘ রাস্তায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। কানহা যদি অ্যারেঞ্জ করা নাও যায়, একবার ডুয়ার্সের দিকে চলে গেলে হয়। লাটপাঞ্চের বলে একটা জায়গা আছে, খুব ভালো পাখির ছবি তোলা যায়। নইলে চাপরামারি, গরুমারা, মূর্তি। একটা গাড়ি নিয়ে নেবে, আজই হোম স্টে বুক করে ফেলবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ওর ঘুম কেটে যাচ্ছিল। নরম রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। সবেদা পাতার লাল পাতাগুলো চকচক করছে। বাড়ির পাঁচিলের ওপারে একটা বকুল গাছ আছে। তার আড়ালে একটা বাঁশপাতি বাসা বেঁধেছে, শুয়ে শুয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কুন্তল। দেখছে মা বাঁশপাতি আর বাবা বাঁশপাতি দুজন বারবার মুখে করে পোকা নিয়ে বাচ্চাগুলোকে খাওয়াতে আসছে। আর বাচ্চা তিনটে হাঁ করে আছে। পাখিরাও জানে পেরেন্টিং বাবা মা দুজনের দায়িত্ব, কিন্তু মানুষ যাবতীয় দায় মায়ের ওপর চাপিয়ে দ্যায়। টাকা রোজগার করে বলে ছেলেদের সাত খুন মাফ হয়ে যায়। ক্কুন্তলের তো মনে হয় টাকা কামাইটা দুনিয়ার সবচেয়ে সোজা কাজ।
শুয়ে শুয়ে পাখির ছানার খাবার দৃশ্য দেখতে দেখতে ওর একবার মনে হল ক্যামেরাটা বার করে ছবি তোলে। তারপর কুঁড়েমি হল। শুধু তাই নয়, ওর এমনও মনে হল
সব মুহূর্ত ছবির জন্য নয়।কিছু মনের মধ্যেই রেখে দেবার জন্যে। আসল কথা, পাখি, গাছপালা নেচার-এসব তার দেখতে ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু সেটা একজন সাধারণ মানুষের মুগ্ধতা। ক্যামেরার চোখ দিয়ে সে এসব ছবি তোলার মধ্যে মজা পায় না। তার কাছে ফোটোগ্রাফিক ইন্টারেস্ট হচ্ছে মানুষ, রিয়েল মানুষ। যারা রোজকার জীবনসংগ্রামে লিপ্ত, বন্যা যার মেয়ের মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, যারা চাকরির জন্যে রাস্তায় ধর্নায় বসেছে, যে গ্রাম বহুমাস ভাত চোখে দেখেনি, টোটো থেকে নামিয়ে যে মেয়েকে… তাহলে কি স্যাডিস্ট কুন্তল? না, তা নয়, ও এসবের মধ্যে জ্যান্ত মানুষকে দেখতে পায়। গুচ্চি আর আরমানির ব্র্যান্ডের পেছনে যারা দৌড়য়, তারা কি তবে সত্যিকারের মানুষ না? হয়তো, কিন্তু তারা কোথায় যেন রিয়েলিটি থেকে বিচ্ছিন্ন।তারা নিজেরাই আয়নার সামনে দাঁড়ায় না বহুকাল। আর তাদের ছবি তোলার জন্যে অনেক লোক আছে। এদের কে আছে?
আরেকটু আড়গোড় পাড়গোড় খেল কুন্তল, কিন্তু আর ঘুমোতে পারল না। তার ঘুম কেটে গেছে।এখন উঠে কী করবে সে ভেবে একটু অস্থির হল সে। পর মুহূর্তেই মনকে শাসন করল। চাকরি শুধু বসেরই নয়, অভ্যেসের দাসত্বও তৈরি করে।তাই কয়েকদিন একটু খারাপ লাগবে তার, কিন্তু অচিরেই সে এটা কাটিয়ে উঠবে। আর চাকরি করবেই না সে। অন্তত এইরকম চ্যানেলের চাকরি। অন্য কিছু, অন্য কিছু কী করতে পারে সে… এই ভাবনা গুলোও বেশ এঞ্জয় করছিল সে। যেন সে একেবারে প্রথম থেকে শুরু করছে, সেইরকম উত্তেজনা নিজের মধ্যে ফিরে পাচ্ছিল। আহা!
তাদের পাড়ার দু তিনটে মেয়ে অনেকদিন ধরে বলছে ওদের পোর্টফোলিও বানিয়ে দিতে। ওরা টুকটাক মডেলিং করছে, কিন্তু ভালো পোর্টফোলিও ছাড়া বড় ব্রেক পাওয়া মুশকিল। তার জন্য ভালো ফোটোগ্রাফার দরকার। কুন্তল ভালো ছবি তুলে দিতে পারে ঠিকই। আর পছন্দের বিষয় যখন মানুষ। এরা তো মানুষই। কিন্তু এদের কেমন কাঠকাঠ লাগে কুন্তলের। সেজেগুজে নানান ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো আর হেঁটে যাওয়া- কেমন কষ্ট হয় দেখলে। কিন্তু বিশ্বায়ন মানলে এরা তো থাকবেই। এত এত পণ্য, সেসব বিক্রির মুখ চাই তো।
নাহ টাকার জন্য, স্রেফ টাকার জন্যে আর কিছুই করবে না সে। এবার থেকে যা করবে তাতে যেন তার হৃদয় থাকে। হৃদয়, মন দিয়ে সে করবে একটা কাজ, যেখান থেকে তাকে বার করা যাবে না।
কুন্তল শুয়ে শুয়ে আর একটু তার এই চাকরি না থাকাটা উপভোগ করল।খানিক পর মা ঘরে এসে ডাকল ‘উঠেছিস? চা দিই?’ কুন্তলের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না। উত্তর দিলেই যেন সকালটা ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। উত্তর না পেয়ে মা কাছে এসে কপালে হাত রাখল আর টিপিকাল বাংলা সিনেমার টিপিকাল মায়েদের মতো জিজ্ঞেস করল ‘জ্বর টর নেই তো?’
কুন্তল এই কথাটার জন্যেই, এই স্পর্শটুকুর জন্যেই যেন ঘাপটি মেরে পড়ে ছিল বিছানায়।
ও বলল ‘একটু বোসো না মা, কী এত কাজ তোমার সাত সকালে?’
অন্য সময় মা লম্বা এক ফিরিস্তি দ্যায় কাজের, না বসার অনেক কারণ দেখায়, একটা দিনরাতের কাজের লোক আছে তাদের, রিনাদি, এছাড়াও ঠিকে লোক, কিন্তু বাবার অসুখটার পর থেকে মার কাজ প্রচুর বেড়ে গেছে, ঘড়ি ধরে বাবার ওষুধ, খাবার, বাবার রান্না বেশির ভাগ মাই করে, আলাদা করে, তেল প্রায় না দেওয়া সেসব রান্না। রিনাদি তেল ছাড়া রাঁধতে পারে না একদম, রাঁধলেও এত বিস্বাদ, মুখে তোলা যায় না, কিন্তু মা কী অদ্ভুত রপ্ত করেছে সেইসব রান্না, খেলে মনে হয়, নিজেদের তেল মশলার খাবার ফেলে ওসবই খাই।মাছের ভাপা, চিকেন স্টু, পাঁচমিশালি তরকারি বা সুক্তো। শুখনো খোলায় নাড়া চিঁড়ে অল্প গোলমরিচ গুঁড়ো ছড়িয়ে।
এইসব করে মা কিন্তু ঠিক সময়ে স্কুলে বেরিয়ে যায়। কাছেই স্কুল। নিভাননী প্রাথমিক বিদ্যালয়।দূরে কোথাও যেতে হয় না, এটাই বাঁচোয়া। রিকশা করে মিনিট পনেরো। মা ক্যাসারোলে বাবার খাবার রেখে, ওষুধ একটা কাশ্মীরি কাঠের বাক্সে সাজিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মনে করিয়ে যায় রিনাদিকে ‘কাকুকে ওষুধ মনে করে খাওয়াস। বিকেলের চায়ের সঙ্গে বিস্কিট, শোবার ঘরেই রাখা আছে, মনে করে দিস’
কুন্তল অবাক হয়ে ভাবে এত সব মাথায় নিয়ে মা ইস্কুলে কাজ করে কীভাবে? শুধু তো নিজের পড়াটুকু নয়, সব দিক। মা তো এখন হেড মিস্ট্রেস। এই সময়টাতেই বাবার কার্ডিয়াক অ্যাটাক হল। দুদিক কীভাবে সামলেছে মা। ও তো কোথায় না কোথায় ঘোরে। এমন ছ্যাঁচড়া চাকরি, ছুটি বলে কিছু নেই। ছুটি চাইলে চাকরিই ছেড়ে দিতে হয়। কুন্তল ভাবছিল, মার এত চাপের ওপর সে আবার চাকরি ছেড়ে চাপ বাড়াল না তো? মা কখনো বলে না এসব। বরং চাকরি ছেড়ে দিয়েছে বলে খুব খুশি আর হালকা দেখাচ্ছে মাকে। বোনকে নিয়ে সবার আশা আছে অবশ্য অনেক। সে পড়াশোনায় খুব ব্রাইট। মেডিকেল পড়ার ইচ্ছে। কিন্তু মেডিকেল তো ইচ্ছে করলেই পড়া যায় না। কঠিন এক সর্বভারতীয় পরীক্ষা। সরকারি কলেজে কজন পায়? বেসরকারি তে সত্তর আশি লাখ টাকা মিনিমাম। মা বাবার খুব ইচ্ছে থাকলেও কি পারবে? সে এমন অপদার্থ ছেলে, যে কিছুই হেল্প করতে পারবে না। তার অ্যাকাউন্টে ষাট হাজার টাকা পড়ে আছে। নিজের একটা স্টুডিও খুলতে গেলেও মা বাবার কাছেই হাত পাততে হবে। আনুড়িয়া, দেশের বাড়িতে তাদের কিছু জমিজমা আছে, এছাড়া তার জানা নেই বাবা মার কিছু সেভিংস আছে কিনা। মার ভেজা ভেজা ঠান্ডা হাত কপালে নিয়ে হঠাৎ তার মাথায় একটা সংকল্প এল। সে কোনদিন তার কোন ভেঞ্চারের জন্য বাবা মার কাছে হাত পাতবে না। বোনের মেডিকেল পড়াটা অনেক বেশি দরকার। সে যখন সাহায্য করতে পারছে না, উল্টে সে নেবে কেন?
মা বলল ‘ঘুম যখন ভেঙ্গেই গেছে, উঠে পড়। চ আজ আমার সঙ্গে’
‘কোথায়?’
‘আমার স্কুলে। কয়েকটা ছবি তুলে দিবি।‘
‘ছবি? কেন?’
“টুপুর বলছিল ও স্কুলের একটা ওয়েব সাইট খুলে দেবে। ওর এক বন্ধু নাকি ডিজাইন করতে পারে। সেই সাইটে দেবার জন্যে কিছু ছবি লাগবে’
‘ওয়েবসাইট? হঠাৎ?’
‘টুপুর বলছিল, এতে করে পুরনো ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে, অনেকে হয়তো বিদেশে ভালো চাকরি করে, তারা স্কুলের জন্যে কিছু করতে চায়, কিন্তু যোগাযোগ নেই। তারা রিকানেক্ট করতে পারবে। এখনকার ছাত্র ছাত্রীদের সামনে একটা একজাম্পেল হবে’
‘বাহ টুপুর তো অনেক ভাবতে পারে মা। ওকে মেডিকেল পড়াতেই হবে কিন্তু’
মা এ কথার কোন উত্তর দিল না। বলল ‘তুই চট করে মুখ ধুয়ে নে, আমি চা নিয়ে আসি। টিফিন খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ব।’
-তুমি ভাত খেয়ে যাও না ইস্কুলে?
-আমি তো কতদিন ধরে রুটি খেয়েই যাই রে
চা খেতে খেতে মার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল কুন্তলের।মার যদিও একদম বসার সময় নেই, তবু কুন্তল যখন করুণ মুখে বলল ‘আজ আমার স্বাধীনতা দিবসটাকে একটু সেলিব্রেট করবে না?’ তখন মা না বসে পারল না। সত্যিই তো আজ একটা স্পেশাল দিন। বসে ধীরেসুস্থে চায়ের কাপে চুমুক মাও কত বছর আগের সকালে দিয়েছে, বলতে পারবে কি? বিছানায় আধশোয়া হয়ে মাকে দেখছিল কুন্তল। মাকে অসাধারণ দেখতে ছিল একসময়। মুখের ডৌলটা ঠিক যেন ভারতীয় নয়, শার্প চিক বোন, এত বয়সেও মেদ জমেনি একফঁটা। কিন্তু চুল পেকেছে, চোখের তলায় কালো ছোপ, বাবার শরীর, বোনের নিট পাওয়া এসব নিয়ে চিন্তা তো আছেই, তার থেকেও হয়তো বেশি চিন্তা কুন্তলকে নিয়ে। যদিও বাবা বা মা কেউই তাকে কিছু বলে নি কোনদিন, কিন্তু শুভাকাঙ্ক্ষীর তো অভাব নেই। তারা বাড়ি বয়ে এসে শুনিয়ে যায় মেয়ে পড়াশোনায় এত ভালো, আর ছেলেটার তো কিছুই হল না। ঝোপে ঝাড়ে, এক গলা জলে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। এটা একটা চাকরি? তারও আবার নিশ্চয়তা নেই। এটা শুনে বাবা একজনকে বলেছিল, আজকাল কোন চাকরিরই নিশ্চয়তা নেই আর। সরকারি চাকরিও আর চিরকাল টিকবে না। চেয়ারে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাইরে সাইড বিজনেস, আসি যাই মাইনে পাই-র দিন শেষ।একদিন আসবে যখন পারফর্ম না করতে পারলে, টার্গেট না রিচ করলে বরখাস্ত করে দেবে।
তবু লোকের বলা বন্ধ হয়নি। বাইরের লোককে পাত্তা না দিলেও বাবা, বিশেষ করে মার মনে একটা কষ্ট তো ছিলই। পড়াশোনায় তো ভালই ছিল কুন্তল। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নাই হোক, এম বি এ টা করতে পারত, কিংবা ওর লাইনেই ফোটোগ্রাফি বা ফিলমাটোগ্রাফি নিয়ে কোন কোর্স, দরকার পড়লে বিদেশে গিয়ে। সেসব কিছুই না করে কুন্তল চ্যানেলের চাকরিতে নিজেকে ক্ষয় করছে কেন যে!
মা জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে ছিল। কুন্তল মার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিল, এই শান্ত নরম সুখী মুখের নিচে কি একটা অসুখী মানুষ লুকিয়ে আছে? তাকে নিয়ে মা কি আদৌ সুখী নয়? নাকি আজ এই চাকরিটা ছাড়ল বলে মার মনে তাকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন বোনা শুরু হয়েছে?
কুন্তল অবশ্য এখনো অত ভাবছে না। তার মন বলছে কিছু একটা ভালো কাজ সে করবেই। কটা দিন চুপচাপ থাকা দরকার। শুয়ে শুয়ে ভাববে শুধু।
মা তাড়া দিল ‘নে টিফিন খেয়ে তৈরি হ, স্কুলে যাব তোকে নিয়ে’
ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা ফোন এল। অচেনা নম্বর।কুন্তলের যে চাকরি গেছে সেটা এতক্ষণে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। অন্য চ্যানেল থেকে ফোন করছে নির্ঘাত। শান্ত গলায় ফোন ধরে কুন্তল। একটা ছেলের গলা।‘আপনাকে কিছু ছবি তুলে দিতে হবে। বেশ কিছু দিনের ব্যাপার। ব্যাপারটা খুব কনফিডেনশিয়াল। কাউকে বললে আপনি বিপদে পড়ে যাবেন’
কুন্তল কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল।